তার ঋণ আমি কীভাবে শোধ করব?

saifullamahmud_dulal
Published : 5 Jan 2013, 04:12 PM
Updated : 5 Jan 2013, 04:12 PM

সত্তর দশকের শেষ দিকে আমরা একঝাঁক উচ্ছ্বল তরুণ ঢাকায় এসেছি 'কবি' হওয়ার জন্য। কবিতা নিয়ে চষে বেড়াই টিএসসি, শাহবাগ, নবাবপুর, রামকৃষ্ণ মিশন রোড, ডিআইটি এভিনিউ, নয়া ও পুরানা পল্টন। কখনও আড্ডায়, কখনও পত্রিকাপাড়ায় আমাদের সময়গুলো ছড়িয়ে থাকে। মাঝে মাঝে সাহিত্য আসরে যোগ দেওয়ার জন্য দল বেঁধে ছুটে যাই টাঙ্গাইল, সিলেট, কুমিল্লা, চিটাগাং…কিংবা কবিতা সম্মেলনের জন্য ছুটে যাই কৃষ্ণনগর, হলদিয়া, ২৪ পরগনা, কলকাতায়। যেন পুরো সাহিত্যটা আমাদের হাতের মুঠোয়।

তখন প্রায়ই পত্রিকাপাড়ায় অভারলেপ হয় একজন অস্থির মানুষের সঙ্গে। মধ্যবয়সী, কিন্তু চলনে-বলনে আমাদের চেয়েও চঞ্চল। নায়কদের মতো স্মার্ট, ক্লিনসেভ, চোখে চশমা, চোখেমুখে অস্থিরতা। সেই মানুষটি ইতোমধ্যে কীভাবে যেন আমার নাম জেনেছেন, জানি না। দৈনিক বাংলায় শামসুর রাহমানের অফিসে আড্ডায় খুব বিনয়ের সঙ্গে তিনি ঢুকলেন। রাহমান ভাইয়ের টেবিলে বাড়িয়ে দিলেন- দু'টি পত্রিকা। মাঝখানে আমি বিদায় নিয়ে নিচে নেমে এলাম। তিনিও দ্রুত বেরিয়ে এসে দোতলা থেকে আমার নাম ধরে ডাকছেন- দুলাল, দাঁড়াও।

তারপর আমাকে দাঁড় করিয়ে বিচিত্রার দেড়তলার একাউন্টস থেকে ঢুঁ মেরে রিকশা নিলেন। বললেন, উঠো। বলা নেই, কওয়া নেই- 'উঠো'। অনেকটা জোর করেই রিকশায় তুলে নিলেন। বললেন, আমি আন্ওয়ার, আন্ওয়ার আহমদ। রূপম-কিছুধ্বনি বের করি। তুমি লেখা দেবে। এই সব বলতে বলতে নিয়ে গেলেন দিলকুশার অগ্রণী ব্যাংকের হেড অফিসে। সরাসরি ঢুকে পড়েন এমডি লুৎফর রহমান সরকারের রুমে। আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারা দু'জনেই বগুড়ার মানুষ। আঞ্চলিকতার কারণেই হয়তো আন্ওয়ার ভাই তাকে মামা ডাকেন। সেই সূত্রে লুৎফর রহমান সরকার এখনও আমার মামা।

আমি যাব ইত্তেফাকে। তিনি নাছোড় বান্দা। আমাকে কিছুতে ছাড়বেন না। আমার পকেটে টাকা নেই। আমি বাসে যাব। কিন্তু তিনিও আমার সঙ্গে যাবেন। যাওয়ার পথে দুই কপি করে রূপম আর কিছুধ্বনি দিয়ে বললেন- তুমি তো পূর্বাণীতে বই রিভিউ করো। এই দু'টো নিয়ে লিখে দিও। আন্ওয়ার ভাই নিচে বসে রইলেন। আমি ইত্তেফাক-পূর্বাণী ঘুরে এলাম। এবারও মুক্তি নেই। আমাকে ছাড়াবেন না। নিয়ে যাবেন তার মতিঝিলের কলোনির বাসায়। বেবী ভাবির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবেন! মহা-মুশকিল। এ কার পাল্লায় পড়লাম! কাঁঠালের আঠার মতো লেগে আছেন। শেষ পর্যন্ত যেতেই হল। কিন্তু বাসায় যাওয়ার পর বাঘের বাচ্চা বিড়াল হয়ে গেল। মনে হল- বেবী ভাবি কিছুটা বিরক্ত। খুব একটা সারা দিলেন না। তখন থেকেই তাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি শুরু হয়েছে।
বল্লেন- 'চলো, বাইরে চা খাব'। তারপর থেকে তিনি সবসময় চা খাওয়াতেন। শুধু আমাকেই নয়, অনেকেই এভাবে প্রতিদিন চা-পুরি-সিঙ্গারা খাওয়াতেন। আন্ওয়ার ভাই চায়ের কাপে পানি ঢেলে নিয়ে চুমুক দিতেন। অদ্ভুত তাঁর চা খাওয়া। সেই সঙ্গে সিগারেট টানা। গরম ধুঁয়া টানা আর গরম পানি পান এক সাথে। মতিঝিলে দেখা হলেই জোর করে রেস্টুরেন্টে ঢুকিয়ে চা-সিঙ্গারা খাওয়াবেন। কিন্তু তিনি পয়সা না দিয়ে, কি যেন একটা কাগজে সই করে বেরিয়ে আসতেন। পরে একদিন জানালেন, মতিঝিল তার এরিয়া! এরিয়া মানে তিনি এই এলাকার কাস্টম অফিসার হিসেবে দায়িত্বে নিয়োজিত। তাই রেস্টুরেন্টের লোকেরা তাকে বিশেষ খাতির করতেন।

আজ কেন যেন আন্ওয়ার আহমদকে মনে পড়ছে। সে এক অদ্ভুত পাগলাটে, খেপাটে আর রগচটা প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। যেমন ছিল তার হ্রদয় উজাড় করা উদার ভালবাসায় পূর্ণ, আবার তেমনি ছিল তার রুঢ়-রুক্ষ আচরণ; বদ মেজাজি। মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠে দৃশ্য এত বিপরীত যে ব্যাখ্যা করা কঠিন।
আনওয়ার আহমদ যতটা লেখক ছিলেন, তার চেয়ে অনেক বড় সম্পাদক ছিলেন। তিনি ছিলেন নিষ্ঠাবান সম্পাদকদের প্রতীক। লেখার জন্য লেখকদের সঙ্গে রীতিমতো মান-অভিমান পর্ব ছাড়িয়ে রাগ করতেন, ঝগড়া করতেন, কথা বলা বন্ধ করে দিতেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জবরদস্তি করে লেখা আদায় করেই ছাড়তেন। সম্পাদক হিসেবে তার আবেগ আর অনুভূতি অতুলনীয়। লেখার তাগিদ দিয়ে রাগ-অভিমান ভর্তি কাট-কাট কথায় কাটা-কাটা অক্ষরে ছোট্ট-ছোট্ট শর্টকাট চিরকুট লিখতেন। যেমনঃ
'দুলাল,
রূপম দিয়ে গেলাম।
কিছুধ্বনি প্রেসে।
এখনো তোমার কবিতা পাইনি।
নাসিমাও লেখা দেয়নি।
কাল আসবো তোমাদের লেখার জন্য।
আনওয়ার'।

এভাবেই তিনি লেখার জন্য লেখকের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলতেন, যার তুলনা তিনিই নিজেই। এ এক বিরল দৃষ্টান্ত। তিনি অনেককেই লেখক বানিয়েছেন, প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন যারা আজ প্রথমসারির লেখক। তিনি অনেক প্রতিষ্ঠিত লেখকের প্রথম বই প্রকাশ করেছেন নিজের পকেটের পয়সা দিয়ে। যেমন মঞ্জু সরকারের 'অবিনাশী আয়োজন', নাসরীন জাহানের 'স্থবির যৌবন' ইত্যাদি। এই বইগুলো রিভিউ কিংবা প্রচারের জন্য তিনি রীতিমতো পাগল হয়ে উঠতেন।
তাঁর কোনও অফিস ছিল না। ভ্রাম্যমাণ আন্ওয়ার আহমদ নিজেই একটি চলমান অফিস। ব্যাগের ভেতর নিজের লেখা, অন্যের লেখা, পত্রিকা, প্রুফ, বিজ্ঞাপনের ফর্ম, বিজ্ঞাপনের বিল, সিল-প্যাড প্রভৃতি যা যা প্রয়োজন, সব থাকত। লেখদের সম্মানী চেষ্টা করতেন, সে জন্য ভাউচারও রাখতেন। আর ছোট ছোট কাগজে টুকরো টুকরো চিঠি, চিরকুট ত থাকতই।

আন্ওয়ার আহমদের এসব অসহ্য পাগলামির জন্য সংসারটা টিকল না। বেবী ভাবি এসব জ্বালা-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি নিলেন। একা হয়ে গেলেন তিনি। যাযাবর আন্ওয়ার আহমদ সংসার পাতলেন সাহিত্যের সঙ্গে! ডেরা গাঁথলেন ইস্কাটনে দিলু রোডের উল্টো দিকে ইসমাইল লেন, আবার কখনও সোবহানবাগের মসজিদের উল্টো দিকে কিংবা লালমাটিয়া পানির ট্যাংকের গলিতে!

তার অনেক ভালো-মন্দ, মানবিক-অমানবিক স্মৃতি মনে পড়ছে। একবার রেগে গিয়ে আরামবাগের এক কম্পোজিটারকে চড় দিয়েছিলেন। সেই কম্পোজিটার কিছুধ্বনির ফাইনাল কপির প্রিন্টে যাওয়ার আগে প্লেট তৈরি হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে আন্ওয়ারের 'আ' উঠিয়ে 'জা' বসিয়ে দিয়ে চাকরি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। পরে সেই কম্পোজিটারকে আজিমপুর ছাপড়া মসজিদের গলির এক প্রেসে পেয়ে গেলেন। তত দিনে তার রাগ মাটি হয়ে গেছে। একেবারে কোমল কাদা মাটি। ছেলেটিকে ডেকে একটা দশ টাকার নোট দিয়ে বলললেন- যা, আর জীবনেও এমন কাজ করবি না। কানে ধর।

আমি তখন ঢাকায় আসিনি। তখন কবিতাবিষয়ক কাগজ 'কিছুধ্বনি' আর গল্পগদ্যের কাগজ 'রূপম' বের শুরু করেন। লেখার জন্য লেখকদের কাছে প্রতিনিয়ত ধরনা দেন। কিন্তু কবি হাসান হাফিজুর রহমানের কাছ থেকে কিছুতেই কবিতা আদায় করতে পারছিলেন না। দায়িত্ব নিলেন দাউদ হায়দার। এবার দাউদ ঘুরাতে শুরু করলেন। অবশেষে একদিন ধরা দিলেন দাউদ ভাই। বৃষ্টিতে ভেজা ভাঁজ করা একটা কাগজ, যাতে লেখাগুলো ভিজে ছড়িয়ে গেছে। তা আন্ওয়ার ভাইকে দিয়ে বললেন- নিন, হাসান ভাইয়ের কবিতা। কিন্তু আন্ওয়ার সেই লেখা পাঠোদ্ধার করতে না পেরে বললেন- 'এটা আবার ভালো করে লিখে দেও'। দাউদ তাই করলেন। পরে কবিতাটি ছাপার পর প্রেস থেকে সদ্যপ্রসূত গরম গরম কিছুধ্বনি নিয়ে ডিআইটি এভিনিউস্থ 'সমকাল' অফিসে হাজির হলেন। হাসান হাফিজুর রহমানকে প্রথম কপিটি দিয়ে কবিতাটির জন্য ধন্যবাদ জানালেন। হাসান ভাই তো অবাক, রেগেমেগে আগুন! কারণ তিনি তো কবিতা দেননি? হাসান ভাইয়ের তাড়া খেয়ে তাড়িয়ে বেড়াতে লাগলেন দাউদ হায়দারকে।

আমি বার্লিনে গিয়ে এই ঘটনটা দাউদ ভাইকে বললে, তিনি হাসতে হাসতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। বলেন- তারুণ্যের বিটলামি!
আন্ওয়ার ভাই যে বিপদে প্রকৃত বন্ধু ছিলেন, তা আমি সারাজীবন মনে রাখব। আমি তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত পাক্ষিক প্রতিরোধে কাজ করি। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় একপর্যায়ে পত্রিকার সম্পাদক ব্যক্তিগত আক্রোশে আমাকে নানান ষড়যন্ত্রে জড়ানোর অপচেষ্টায় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জেলারেল (অব.) মাহমুদুল হাসানকে দিয়ে গ্রেফতার করা চূড়ান্ত করেন। টিপটিপ বৃষ্টি ঝরা বিকেলে আমি মতিঝিলে আন্ওয়ার ভাইয়ের সঙ্গে। তখন স্কাউটে কর্মরত শেখ শামসুল হক নামের ব্যক্তিটি আনওয়ার ভাইকে ডেকে নিয়ে সতর্ক করে দিয়ে বললেন, 'দুলাল আজ রাতে গ্রেফতার হয়ে যাবে। আপনি তার সঙ্গ ছাড়–ন'। আন্ওয়ার ভাই অনেকক্ষণ তার সঙ্গে কথা বললেন আর একটু দূরে আমি একটি দোকানের সাটারের নিচে দাঁড়িয়ে হালকা বৃষ্টিতে ভিজে রেগে যাচ্ছি। পরে তিনি গম্ভীর মুখে একটা চায়ের দোকানে ঢুকে চুপচাপ বসে থাকলেন। ভাবছেন, আমাকে কীভাবে এই দুঃসংবাদটা জানাবেন আর আমার জন্য কি করা করা যায়!

আমি বললাম, কি হয়েছে? অবশেষে বললেন এবং সাহস দিলেন। ভয় পেয়েও না। আমি তোমার পাশে আছি, থাকব। প্রথমে কবি রবীন্দ্র গোপের সঙ্গে কথা বললেন। রবীন্দ্র গোপ বললেন, প্রয়োজনে আমরা রাজপথে নামব।

তারপর আন্ওয়ার ভাই একের পর এক তার অপারেশন চালাতে লাগলেন। একটা গেস্ট হাউসের রিসিপশন থেকে ফোন দিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রাক্তন যুগ্মসচিব, বিমান ও পর্যটনের এমডি মঞ্জুর-উল-করিম অর্থাৎ কবি ইমরান নূরকে। তিনি এরশাদের উৎসবের লোক বলে ইগনোর করলেন। পরে ফোন দিলেন পুলিশের ডিআইজি আবুল খায়ের মুসলেউদ্দিনকে। তিনি বললেন, বিষয়টি পুলিশের হাতে থাকলে আমি পারব। আর যদি আর্মির হাতে থাকে, তা হলে কিছু করা সম্ভব না।

বৃষ্টিতে ভিজে আমাকে নিয়ে গেলেন মোবারক হোসেন খানের মতিঝিলের কলোনির বাসায়। তিনিও যেহেতু ওই পত্রিকার সম্পাদকের খুব ঘনিষ্ঠজন; তাই আমাকে আরও বকাঝকা করে আনওয়ার ভাইয়ের সঙ্গে খারাপ আচরণ করলেন। উপকারের বদলে উল্টো দোষারোপ করলেন। পারলে খান নিজেই আমাকে পুলিশে ধরিয়ে দেয়!

গ্রেফতার এড়ানোর জন্য সেদিন আনওয়ার ভাই কিছুতেই আমাকে আমার বাসায় ফিরতে দিলেন না! নিয়ে গেলেন তার সোবহানবাগের বাসায়। সেই দুঃসময়ে সারারাত আমাকে অভয় আর সান্ত্বনা দিলেন, 'তুমি জেলে গেলে আমি তোমার ফ্যামেলিকে দেখব। কোনও চিন্তা করো না। এখন ঘুমাও'।
আন্ওয়ার ভাইয়ের এই ঋণ আমি কীভাবে শোধ করব?