কানকুনের জলবায়ু সম্মেলন, বাংলাদেশের মমতাজ বেগম এবং আমার কিছু কথা

রুশানারা আলী
Published : 28 Sept 2008, 07:16 AM
Updated : 20 Dec 2010, 06:49 PM

একটি ন্যায্য জলবায়ু তহবিল গঠনের বিষয়ে আশাবাদ তৈরি হয়েছে কানকুনের সদ্যসমাপ্ত জলবায়ু সম্মেলনের মাধ্যমে। এ তহবিল থেকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বা হুমকির মুখে পড়া দরিদ্র দেশগুলোকে সহায়তা করা হবে। যদিও এ তহবিলের অর্থ সংগ্রহ এবং রাষ্ট্রসমূহের কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে এখনও বিস্তর অগ্রগতি প্রয়োজন।

যুক্তরাজ্যের অনেকের জন্য ২০১০ সালটি ছিল অন্য স্বাভাবিক দশটা বছরের মতোই। কিন্তু সাম্প্রতিক অনেকগুলো ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থতার প্রতিটি বছর সমস্যাটি বিশ্ববাসীর জন্য আরও ভয়াবহ করে তুলবে। পাকিস্তানের নজিরবিহীন বন্যা ও আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলের খাদ্যাভাব সুস্পষ্টভাবে সংকেত দিয়েছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হুমকির মুখে থাকা মানুষদের জন্য সামনের দিনগুলো ক্রমেই কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠবে। গত মাসে জন্মভূমিতে সফরে গিয়ে আমি নিজে দেখেছি, বাংলাদেশের জেলে সম্প্রদায়ের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে।

বাংলাদেশে আমি অক্সফাম আয়োজিত একটি 'জলবায়ু আদালত'-এ যোগ দিয়েছি। সেখানে জলবায়ু বিজ্ঞানী, আইনজীবী এবং বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের সরকারি ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। এ আদালতে আমি মমতাজের মতো ভুক্তভোগী নারীদের দুঃখের কথা শুনেছি। ১৯৯৯ সালে হঠাৎ ঝড়ে পড়ে জেলে স্বামীর নৌকা ডোবার খবর পাওয়ার দিনটির কথা এখনও স্পষ্ট মনে আছে তাঁর– 'স্বামী যাওয়ার দিন আকাশের অবস্থা ভালো ছিল না। আমি তাকে যেতে নিষেধ করেছিলাম। কিন্তু সে আমার কথা শোনেনি।'–এভাবেই নিজের কষ্টের কথা বলেছেন মমতাজ।

তাঁর স্বামী আর ফেরেননি। ২০০৭ সালে সিডরের সময় তাঁর মায়েরও মৃত্যু হলে এখন মানুষের বাড়িতে কাজ করে কোনোমতে চার সন্তান নিয়ে জীবনধারন করছেন মমতাজ। আদালতে আমরা সন্তানহারা পিতা-মাতা, উত্তাল সমুদ্রে লাখ টাকা মুল্যের ট্রলার হারিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়া ব্যক্তিদের শোকের কথা শুনেছি, শুনেছি ট্রলারডুবির পর সাগরে ভেসে অন্য দেশের সীমানায় চলে যাওয়ার অপরাধে ভারতে জেল খাটা একজনের কথাও।

এটা ঠিক যে, মাছ ধরার পেশাটি কখনও ঝুঁকিমুক্ত ছিল না। কিন্তু জলবায়ু বিজ্ঞানীদের তথ্যপ্রমাণ প্রত্যয়ন করে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে এবং এর ফলে হঠাৎ সমুদ্র উত্তাল হচ্ছে, ঝড় কিংবা জলোচ্ছ্বাস হচ্ছে। এসব তথ্যপ্রমাণের কারণেই আদালত বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলে সম্প্রদায়ের দুর্ভোগের বিষয়টি 'জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি পরিণতি' হিসেবে অভিহিত করেছেন। আদালত বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত নাগরিকদের পুনর্বাসন ও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাদের খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করার উদ্যোগ নিতে হবে বাংলাদেশ সরকারকে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, আদালত বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং ভুক্তভোগীদের দুর্ভোগের পেছনে ধনী ও শিল্পোন্নত দেশগুলোর দায় আছে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বক্তব্য। কারণ এটি আমাদের বুঝতে সাহায্য করে, কানকুনের মতো আন্তর্জাতিক জলবায়ু আলোচনাগুলোতে জলবায়ু তহবিলের বিষয়টি কেন এত জরুরি।

সহজ ভাষায়, জলবায়ু তহবিল হল জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সহায়তা করার জন্য উন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সম্পদের স্থানান্তর। আমার মতে, এ তহবিল কেবল জলবায়ু পরিবর্তন রোধের লক্ষ্যে উন্নয়নশীল অর্থনীতিগুলোতে কার্বন কমাতে সাহায্য করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। বরং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের জেলে সম্প্রদায়ের মতো ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর অভিযোজনের জন্যও সাহায্য করবে এটি। যাতে তারা নিজদের সুরক্ষা ও নতুন করে জীবিকা উপার্জনের জন্য বিনিয়োগ করতে পারে। জলবায়ু তহবিলের অর্থ কোনখান থেকে আসবে এবং এ অর্থ কীভাবে পরিচালিত হবে– একটি বৈশ্বিক জলবায়ু চুক্তির পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য এ বিষয়গুলোতে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা জরুরি।

সরকার যুক্তরাজ্যের মোট জাতীয় আয়ের ০.৭ শতাংশ আন্তর্জাতিক সাহায্য হিসেবে ব্যয় করার প্রতিশ্রুতি বহাল রাখার ঘোষণা দেওয়ায় দেশটির আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়ক ছায়ামন্ত্রী হিসেবে আমি খুশি। এ প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতেও আমি সচেষ্ট থাকব। তবে বাংলাদেশ থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমি বলব, জলবায়ু তহবিল ও সাহায্য অবশ্যই দুটি ভিন্ন বিষয়। দুটোকে পৃথক হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে। জলবায়ু তহবিল উন্নয়নশীল দেশের প্রতি আমাদের উপহার বা দান নয়। বরং এটা ওইসব দরিদ্র মানুষের অধিকার, যারা নিজেরা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দোষী না হয়েও এর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

এ কারণেই এটা নিশ্চিত করা জরুরি যে, যুক্তরাজ্য জলবায়ু তহবিলে যে অর্থ দিবে তা 'আন্তর্জাতিক সাহায্য' খাতের বাইরে থেকে দিবে অর্থাৎ আগেই প্রতিশ্রুত ০.৭ শতাংশের বাইরে থেকে এ অর্থ দিতে হবে। গত লেবার সরকারের সময় আমরা নিশ্চিত করেছি, সাহায্য খাতে মোট বরাদ্দের ১০ ভাগের বেশি যেন জলবায়ু পরিবর্তন খাতে ব্যবহৃত না হয়। বর্তমান সরকারের আমলেও এ নীতি অব্যাহত রাখতে হবে। আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি ও সরকারের সদিচ্ছা থাকলে অভ্যন্তরীন ব্যয় সংকোচনের এ সময়েও করদাতাদের উপর অতিরিক্ত চাপ না দিয়েই বিষয়টি নিশ্চিত করা সম্ভব। কানকুন সম্মেলন শুরুর আগেই পার্লামেন্টে আন্তর্জাতিক সাহায্য বিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর কাছে আমি প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছি।

মমতাজের কাহিনি শুনে খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থতার আরও একটি বছর অতিবাহিত হওয়ায় ভবিষ্যতে যেসব নারী বিধবা হবেন, তাদের কাহিনি শোনার বিষয়টি আরও বেশি কষ্টকর হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার দায়িত্ব নিজদের কাঁধে তুলে নেওয়া উচিত যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশগুলোর। যে কোনো মূল্যে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঠেকাতে হবে এবং এজন্য নিঃসরণ কমানো জরুরি। কিন্তু এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইতোমধ্যেই ঝুঁকির মুখে পড়া মানুষের প্রতি আমাদের দায়িত্ব পালন।

এ কারণেই জলবায়ু খাতে নতুন ও বাড়তি অর্থ দেওয়ার বিষয়টি সর্বাগ্রে বিবেচনা করতে হবে।