গার্মেন্ট শ্রমিকদের বেতনের দাবি ও মোশরেফা মিশুর রিমান্ড নিয়ে প্রশ্ন

ফরিদা আখতার
Published : 17 Oct 2008, 05:03 AM
Updated : 21 Dec 2010, 04:45 PM

ঢাকা শহরে কিছুদিন আগে (১০ ডিসেম্বর, ২০১০) ভারতের একজন নাম করা সিনেমার অভিনেতা এসে বেশ নাচগান করে গেছেন। তাঁর নাম শাহরুখ খান। সঙ্গে ছিলেন রানী মুখার্জী ও অন্যান্য নাচের শিল্পী। যাঁরা আয়োজন করেছেন তাঁরা যেমন তাঁদের এই আসার জন্যে খেটেছেন তেমনি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকেও তাঁদের পেছনে নিরাপত্তার জন্য ব্যয় করতে হয়েছে। শুধু শাহরুখ খানের নিরাপত্তার জন্যে ছিল দেড় শতাধিক র‌্যাব ও পুলিশ। তবে এমনই নাচ গান যে পরিবারের সকলে মিলে দেখা বেশ কঠিন ছিল। আমি কৌতুহলবশত দেখতে চেয়েও বেশিক্ষণ দেখতে পারি নি, রিমোট কণ্ট্রোলে আমার হাত অন্য চ্যানেলে নিতে বাধ্য করেছে। শুনেছি বিশ ত্রিশ হাজার ধনী মানুষ এই অনুষ্ঠান দেখার জন্যে দুপুর থেকে ভীড় করে ছিলেন। ধনী মানুষ বলছি এই কারণে যে এঁরা ২৫ হাজার টাকা খরচ করেছেন একটি টিকেটের জন্যে। ধনী না হলে কি এই খরচ করা যায়? শুনেছি কয়েক কোটি টাকা তাঁরা নিয়ে গেছেন এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। এই বিষয়ে এর বেশি কিছু বলার জন্য আমি লিখতে বসি নি। শুধু এর পরবর্তী কয়েকটি ঘটনা আমার মনকে প্রশ্নবিদ্ধ্ করেছে আমরা কোন ধরণের রাষ্ট্রে বাস করছি?

সেদিন ছিল বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। সারাদিন অনেক কর্মসূচী হয়েছে, মানবাধিকার নিয়ে কথাবার্তাও হয়েছে অনেক। আমি নিজেও অংশগ্রহণ করেছি, দু'একটি অনুষ্ঠানে। তারপর? তেরই ডিসেম্বর ঘটলো চট্টগ্রাম রপ্তানী প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলে (সিইপিজেড) কোরীয় মালিকানাধীন ইয়াং ওয়ান করপোরেশনের কয়েকটি কারখানায় শ্রমিক বিক্ষোভের কারণে বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় টঙ্গী, রূপগঞ্জ আশুলিয়া উত্তপ্ত হয়ে উঠতে থাকে। শ্রমিকদের দাবি কিছুই নতুন নয়, বেতন বৈষম্য, ঘোষিত কাঠামো অনুযায়ী বেতন না দেয়া, সাপ্তাহিক ছুটি কার্যকর করা ইত্যাদি। শ্রমিকরা অভিযোগ করেছেন, নতুন বেতন কাঠামো অনুসরণ না করে অপারেটরদের গড় বেতন সাড়ে তিন হাজার টাকা, নতুন হেলপারদের বেতন আড়াই হাজার টাকা ও পুরনো হেল্পারদের বেতন তিন হাজার টাকা নির্ধারণ করেছে এবং ওভারটাইমের মজুরি আগের চেয়ে প্রায় অর্ধেকে কমিয়ে দেয়া হয়েছে। তাহলে শ্রমিকদের এতোদিনের আন্দোলন, এতো দর কষাকষি, এত নির্যাতন সয়ে কী লাভ হোল? বিদেশী বায়াররা কি এগুলো দেখে না? তারা শ্রমিক পুরুষ না মহিলা, এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন, শ্রমিকের বয়স কত তা নিয়ে চেচামেচি করে, কিন্তু ন্যায্য মজুরি দিল কি না, কারখানায় শ্রমিক মারা গেল কেন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে তাদের মাথাব্যাথা নেই। এবং তাই আমাদের মালিকপক্ষ শ্রমিকদের ওপর দিনে দিনে কঠোর হয়ে উঠছে। বেতন বাড়াতে গেলে মালিকদের গড়িমসি, কারখানা লাভজনক কিনা তা নিয়ে হিসাব নিকাশ। অথচ তাদের পরিবারগুলো প্রতিদিন শপিংয়ে শ্রমিকের একমাসের বেতন একদিনেই খরচ করেন, এমন কথা প্রধানমন্ত্রী নিজেও বলেছেন ।

বাংলাদেশের গার্মেন্ট শ্রমিকদের বেতন এশিয়ার অন্য সকল দেশের চেয়ে কম। জাতিসংঘের শ্রম সংস্থা (ILO) এর Global Wage Report 2010/2011 বিশ্বের ১১৫টি দেশের ন্যূন্যতম মজুরির সমীক্ষায় দেখা গেছে বাংলাদেশের গার্মেন্ট শ্রমিকের মাসিক বেতন মাত্র ৫৮ ডলার, যা একেবারে ছোট একটি দেশ ভুটান ও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ আফগানিস্তানের চেয়েও কম। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এতো কম মজুরী আর কোথাও নেই; পাকিস্তানে ২২৯ ডলার, নেপালে ১৫১ ডলার, ভারতে ১২১ ডলার, ভুটান ১০৮, আফগানিস্তানে ৮৯ ডলার (New Age December 17, 2010) । এই সমীক্ষার খবর কি বিজিএমইএ রাখেন না?

চৌদ্দই ডিসেম্বর, ঢাকার কাছে সাভারের আশুলিয়ায় হা-মীম গ্রুপের একটি কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে কমপক্ষে ২৬ জন শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছে। যত শ্রমিক সেখানে ছিল, এবং যত জন নিখোঁজ রয়েছে লাশ পাওয়ার সংখ্যা তত নয়, অর্থাৎ মৃত্যুর সংখ্যা আরও অনেক বেশি। আজকাল নতুন এক নিয়ম হয়েছে যে পানিতে ডুবলে কিংবা গার্মেন্টে আগুন লাগলে কর্তৃপক্ষের সিদ্ধ্বান্ত অনুযায়ী লাশ পাওয়া যায়। তাঁরা যদি বলে দেন লাশ আর নাই, তো নাই। স্বজনদের মৃত্যুর শোক সহ্য করতে হবে কিন্তু লাশ দাফন করা, একটি নির্দিষ্ট স্থানে কবর দেয়ার অধিকারটুকুও থাকবে না। এ কেমন কথা? গার্মেণ্ট কারখানায় আগুন লাগলে লাশ নিয়ে এমন ঘটনা ঘটছে, আমরা সকলেই তা নীরবে মেনে নিচ্ছি। লাশের খবর না হয় নাই পাওয়া গেল, কিন্তু যারা আহত হয়েছে তাদের খবরও কেউ রাখছে না। তাদের শারীরিক অবস্থা কেমন আছে, তাদের চাকুরী আছে কি না, তাদের চিকিৎসা খরচ কারখানা কর্তৃপক্ষ দিচ্ছে কিনা, আমরা তার কোন খবর জানতে পারছি না। হা-মীম কারখানায় আগুনের ঘটনায় শ্রমিকদের বাঁচার চেষ্টার প্রতিবেদন পড়ে চোখে পানি ধরে রাখা কষ্টকর। ভবনের ১০ এবং ১১ তলায় আশ্রয় নেয়া শ্রমিকরা রশি বেয়ে লাফিয়ে পড়ার চেষ্টা করেন অনেকে। আগুনের ভয়াবহতা বাড়তে শুরু করলে অনেক শ্রমিক জানালা দিয়ে মাথা বের করে তাঁদের বাঁচানোর জন্যে উদ্ধারকর্মী এবং নীচে অপেক্ষমান জনতার কাছে আকুতি জানাতে থাকেন। দৈনিক পত্রিকার প্রতিবেদকদের এমন ভাষা তাদের কলমের কালিতে নয় অশ্রু দিয়ে লেখা হয়েছে।

অবাক হয়ে দেখলাম, হা-মীম গ্রুপের পক্ষ থেকে নিহতদের প্রত্যেকের জন্য ১ লাখ টাকা ও আহতদের জন্য ২৫ হাজার টাকা দেবে। একই সাথে বিজিএমইএ নিহতদের জন্য দেবে ১ লাখ টাকা এবং লাশ পৌঁছানোর জন্য ১০ হাজার টাকা দেবে। এই সিদ্ধান্ত খুবই দ্রুতভাবে ঘোষণা করা হয়েছে, যা এর আগে দেখা যায় নি। হতে পারে যে তাঁরা জানেন এই দাবী উঠবে তাই দ্রুত ঘোষণা দিয়েছেন। বিজিএমইএ বিবৃতি দিয়ে নিহতদের রুহের মাগফেরাতও কামনা করেছেন। এসব খুব ভাল কাজ হওয়া সত্ত্বেও আমরা আশ্বস্ত হতে পারছি না। এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হয় কিনা দেখতে হবে। শ্রমিকদের খুবই সাধারণ বেতন বৃদ্ধির দাবী মেনে নিতে যারা এতো গড়িমসি করছেন, তাঁরাই আবার শ্রমিকের মৃত্যুর পর এতো সহানুভূতিশীল দেখেও একটু বিভ্রান্ত হই। শ্রমিকরা বেতন বৃদ্ধির দাবি ন্যায্যভাবেই করেছিলেন, তাদের আন্দোলনে জনগনের সমর্থনও আছে। জনগণ জানে দেশের অর্থনীতিতে এই শ্রমিকরা তাদের শ্রম দিয়ে কত বড় অবদান রাখছে। রপ্তানী খাতের তিন-চতুর্থাংশ আয় আসে গার্মেন্ট রপ্তানী থেকে। বৈদেশিক মুদ্রা ঠিক যেমন করে রাখছে আমাদের প্রবাসী শ্রমিকরা নিজে খেয়ে না খেয়ে রেমিটেন্সের টাকা পাঠিয়ে। এরা সবাই গরিব, কিন্তু এঁরা নিজেদের অবস্থা যতটা উন্নতি করছেন তার চেয়েও বেশি করছেন দেশের উন্নতি। তবুও কাজ করতে এসে নিজের প্রাণটা নিয়ে ফিরবে কিনা তার কোন নিশ্চয়তা নাই। এই পরিবারে এক জনের মৃত্যু কিংবা আহত হওয়ার অর্থ একটি পরিবারে অন্তত পাঁচজনের জীবন বিপন্ন হওয়া। কিন্তু তবুও তাঁদের সামান্য বেতন বৃদ্ধির আন্দোলনে এতো দমন নিপীড়ন কেন? নাশকতা বা বিদেশী ষড়যন্ত্র থাকবার কথা বলে বারেবারে শ্রমিকদের দাবি মানা হয় না।

এদিকে গার্মেন্ট শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সভাপতি মোশরেফা মিশুকে গত ১৪ ডিসেম্বর তারিখে গার্মেন্ট শ্রমিক অসন্তোষ ও ভাংচুরের ঘটনায় ইন্ধন দেয়ার অভিযোগে গভীর রাতে হাতিরপুলের বাসা থেকে গ্রেফতার করেছে। শুধু তাই নয় গ্রেফতারের পর ৩টি মামলায় ৩০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়, যদিও আদালত প্রথমবারে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন ২ দিনের। রিমান্ডে নেয়ার মতো অভিযোগ মিশুর বিরুদ্ধ্বে রয়েছে কিনা জানি না, তবে আজকাল যে কোন ধরণের রাজনৈতিক গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নেয়া অনেক উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে বিচারের আগেই এবং অভিযোগের সত্যতা প্রমানের আগেই শাস্তি দেয়া হচ্ছে। মানবাধিকার দিবসে রিমান্ড সম্পর্কে এই প্রশ্ন উঠেছে। মিশুর পারিবারিক সুত্রে জানা যাচ্ছে তার শারীরিক অবস্থা ভাল নয়, এজমা ও কোমর ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছেন। রিমান্ডের সময় থাকা খাওয়ার সমস্যা এবং শীতের সময় যথেষ্ট গরম কাপড় না থাকা কী কষ্টদায়ক হতে পারে তা ভুক্তভুগী মাত্রই জানে। প্রথম দুই দিনের রিমান্ডের পর আর একদফা রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। এবার তার শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি ঘটেছে, ফলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। পুলিশ ভ্যানে তোলার সময় মিশু অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মেয়েদের ওয়ার্ডে রাখা হলেও মিশুকে ঘিরে রেখেছে মহিলা ও পুরুষ পুলিশ। ফলে অসুস্থ মিশুর নিজের এবং ওয়ার্ডের অন্যান্য মহিলা রোগীদের ভীষন অসুবিধা হচ্ছে।

মোশরেফা মিশু সাহসী মানুষ, তাই দীর্ঘ দিন ধরে গার্মেণ্ট আন্দোলনের সাথে যুক্ত রয়েছেন। গ্রেফতারের ভয় তাঁর ছিল বলে মনে হয় না। কিন্তু এখন তাঁর গ্রেফতার ও রিমান্ড নিয়ে যা ঘটছে তা মোটেও কাম্য নয়। মানবাধিকার ও আইন উভয়েরই লঙ্ঘন ঘটছে এখানে। সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে তার মুক্তির দাবী করা হয়েছে।

মিশুর এই গ্রেফতার গার্মেন্ট শ্রমিক আন্দোলনের সাথে যারা যুক্ত তাদের প্রতি হুঁসিয়ারী উচ্চারণ করা হচ্ছে । মোশরেফা মিশু ছাত্র আন্দোলন থেকে এসেছেন, কিন্তু অধিকাংশ গার্মেণ্ট শ্রমিক নেত্রী নিজেরাই শ্রমিক ছিলেন। তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধ্বে হুলিয়া রয়েছে। মিশুর জন্য অন্তত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও তাঁর বন্ধুরা প্রতিবাদে নেমেছেন, কিন্তু এই শ্রমিকদের গ্রেফতার করলে তাদের পক্ষে কে নামবে? মিশুর পক্ষে যারা কাজ করছেন আজ তাঁরা একই সাথে এই প্রশ্নও তুলছেন।

আমাদের কথা হচ্ছে যদি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পোশাক শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হয় তাহলে সরকার, মালিক পক্ষ এবং শ্রমিক সকলেরই সহযোগিতা লাগবে কোন সন্দেহ নাই, কিন্তু গার্মেন্ট শ্রমিক আন্দোলন দমন করার জন্য দমন, পীড়ন ও নির্যাতনের পথ বেছে নিলে এই শিল্প নিয়ে দেশে-বিদেশে প্রশ্ন উঠবে এবং তা বাজার হারাবার কারণ হয়ে উঠতে পারে।

আশা করি সরকার মালিকদের পক্ষাবলম্বন না করে শ্রমিকদের পক্ষে একটা সুষ্ঠু সমাধানের পথ বেছে নেবেন। এবং গার্মেন্ট শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন ও মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা যেন না ঘটে তার ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবেন।