দুলছে লণ্ঠন

মীর ওয়ালীউজ্জামান
Published : 20 Nov 2008, 03:32 AM
Updated : 20 Nov 2008, 03:32 AM

১.


এখন বুড়িগঙ্গা।

বইপত্তর খোঁজাখুঁজির পত্তন আমার সেই পঞ্চাশের দশকে — ১৯৫৭-৫৮ সালে সম্ভবত। পগোজ স্কুলের ছাত্র আমি বন্ধু শঙ্করপ্রসাদ সরকারের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে শাঁখারি বাজার সংলগ্ন স্কুল থেকে টিফিনের ছুটিতে বেরিয়ে ঝটিতি পৌঁছে যেতাম ডানহাতে জগন্নাথ কলেজ, কলেজিয়েট স্কুল রেখে রাস্তা পেরিয়ে বাঁয়ে গির্জা আর বাইবেল সোসাইটি ঘেঁষা ফুটপাতে। পথচারীর ভিড় তেমন অসহনীয় না হওয়ায় তখন ফেরিঅলারা ফুটপাতের আধাআধি দখল নিতে পারত স্বচ্ছন্দে। 'যা নেবে তাই ছ' আনা' থেকে শুরু করে গামছা-লুঙি, গেঞ্জি, মেয়েদের চুলের রিবন-সেফটিপিন-কালো ক্লিপ, কাবুলি খাঁ সাহেবদের শিলাজিত-হালুয়ায়ে খাস্খাস্ ইত্যাদি রকমারি পশরার পাশাপাশি সহাবস্থান ছিল বইপত্র পত্রিকার — পুরনো ও নতুন, সস্তা এবং মূল্যবান মোটাসোটা বাঁধানো ভল্যুমের।

……..
বাহাদুরশাহ পার্ক, সে আমলে ছিল ভিক্টোরিয়া পার্ক।
…….
সেখানে বইপোকা শঙ্করকে সঙ্গ দিতে গিয়ে আমিও সসঙ্কোচে দু'টো চটি বই, পত্রিকা নেড়েচেড়ে দেখতাম। শঙ্কর নিবিষ্ট মনে উবু হয়ে বসে রহস্য কাহিনি বাছাই করত। কখনো বা স্বপনকুমারের চার আনা, আট আনা, বারো আনা সিরিজের একটি বা দু'টি চটি কাহিনী কিনে পকেটে ভরত কোন কৌশলে। টিফিন পিরিয়ড শেষ হয়ে যেত লহমায়। ত্রস্তে আমরা কোনো কোনোদিন দৌড়ে ক্লাসে ফিরতাম। ওসব 'গল্পের বই' লুকিয়ে রাখতে হত। টিফিনের পর আরো তিনটে পিরিয়ড — ফিফ্‌থ, সিক্সথ, সেভেন্‌থ — তারপর ৪টে ১০ মিনিটে ছুটির ঘণ্টা বাজত। ফুসফুসে যেন এক দমকে অনেকটা বাতাস ঢুকে আসত, মনটা উড়ু উড়ু — কী হয়, কী হয়। স্কুলের গেইটে শঙ্কু আর আমি একটু দাঁড়াতাম। শঙ্করের ছোটভাই দীপঙ্কর, আমার ভাই রবুর অপেক্ষায়।


পগোজ হাইস্কুল। উপমহাদেশের প্রাচীনতম স্কুলের একটি।

ওরা ভিড় ঠেলে বেরোতে পারত না — মায়েদেরও নিষেধ ছিল। ছুটির পর বইখাতা গুছিয়ে স্যুটকেইসে ভরে, সাবধানে চাইনিজ লক্ ক্লিক করে বন্ধ করে, — চাবি হারানোর আগ পর্যন্ত চাবি ঘুরিয়ে তালা লক্ করা হত — ধীরেসুস্থে বড়ভাই বা দাদার সঙ্গে বাড়ি ফিরব — এরকম কড়ার ওদের উচ্চারণ করতে হত মাঝে-মাঝেই।

স্কুলের সদরে দাঁড়িয়ে আছি, শঙ্কর উত্তেজনা চেপে আছে কষ্ট করে, কত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে কোমরে গোঁজা ডিটেকটিভ দীপক চ্যাটার্জি আর তার অ্যাসিস্ট্যান্ট রতনকুমারের হাড়ে ভেল্‌কি খেলানো বুদ্ধির প্রয়োগ আর নতুন নতুন রহস্য উদ্ধারের কাহিনী পড়তে পাবে, তারই অপেক্ষায়। একসময় দীপু-রবু হেলতে-দুলতে এসে যেত। চল দাদা, চলেন বড়ভাই — ডাক শুনে আমরা দুইবন্ধু নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে, চারজনের রিকশাভাড়া একসঙ্গে করে, পকেটভর্তি চিনেবাদাম আর হাতে-হাতে হয়তো আমড়া অথবা পেয়ারা সম্বল করে, দু'জন দু'জন ফাইল করে, খেতে খেতে, গল্প করতে করতে বাড়িমুখো হতাম। সামনে দীপু-রবু, ওদের দেখেশুনে নেবার দায়ে শঙ্কু আর আমি ঠিক পেছন-পেছন হেঁটে যেতাম। শঙ্কু তার আমড়া-পেয়ারা যেটাই হোক কচ্‌কচিয়ে চিবিয়ে পেটে চালান করে, শার্ট একটু তুলে একটি চটিবই হয়তো বের করে আনত। দু'জনে ঝুঁকে পড়ে টাইটেল পড়তাম — রাঁচিরহস্যের সন্ধানে, নীল আলোর সংকেত — এরকম সব নাম ছিল স্বপনকুমারের রহস্যকাহিনি সিরিজের বইয়ের।


আহসান মঞ্জিল, বুড়িগঙ্গা থেকে আগেও এমনই দেখা যেত।

আচ্ছা, শঙ্কু, আমি জিজ্ঞেস করতাম, তুই যে পড়ার বইয়ের নিচে স্বপনকুমার লুকিয়ে ফিট্ করে, ফাঁকে ফাঁকে পড়ে নিস, তোর মা কিছু টের পান না? নারে, শঙ্কু বলত, তবে দিদিটা একবারে দারোগা, ওর চোখকে ফাঁকি দেয়া মুশকিল। যেদিন মায়ের আলসারের ব্যথা বেশি হয়, সেদিন দিদি আমাদের ঘরে বাবার ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বই পড়ার ছল করে, আমার ওপর নজর রাখে। ওরকম হলে আমিও সাদাসিধে ভালোমানুষের মত জোর গলায় কেবল ইংরেজি গ্র্যামার পড়ি। দিদি যখন নিশ্চিত হয়ে বইমুখে ঘুমিয়ে পড়ে, তখন আমি চুপিসাড়ে হানাবাড়ি-তে হানা দিই। ওই যে কথায় বলে না, হোয়্যার দেয়ার'জ আ উইল, দেয়া'জ আ ওয়েই — কথাটা খুব ঠিক। হুম্, আমি বলি, কিন্তু আমার মা একেবারে শ্যেনচক্ষু — সেদিন আমি হারিকেন জ্বেলে বেশ জমিয়ে মায়ের জন্য নতুন সংঘ লাইব্রেরি থেকে আনা রেঙ্গুনে মোহন-কে কেবল জাহাজ থেকে নামিয়েছি — এমনি সময় মা ছোঁ মেরে বইটা তো নয়, আমার প্রাণটাই যেন তুলে নিয়ে, তালপাতার পাখার ডাঁটি বেশ কয়েকবার ঠাস্‌ঠাস্ করে আমার পিঠে চালিয়ে দিলেন, হাত বুলিয়ে টের পেলাম লম্বা-লম্বা দাগ ফুলে ফুলে উঠেছে। আমার মায়ের খুব মেজাজ জানিস, তোরা গেলে তো খুব মিষ্টি মিষ্টি কথা বলেন, মিষ্টি খেতে দেন, তাই বুঝিস্ না।

তাহলে তুই আর গল্পের বই নিয়ে কী করবি ? আমি নাহয় একা-একাই পড়ব এখন থেকে, বলে শঙ্কর আড়চোখে আমার দিকে তাকায় আর একটুও না হেসে পকেট থেকে বাদাম বের করে খোসা ছাড়াতে ব্যস্ত হয়। না, না, তোকে তো পুরোটা বলিনি, আমি ত্রস্তে বলি, ছুটির দিনে আমরা যত খুশি গল্পের বই পড়তে পারি। তবে মা-বাবা অর্থাৎ বড়দের বইয়ে হাত দেয়া বারণ। ঠিক আছে, এই নতুন তিনটের একটা তোমাকে দিচ্ছি, আগামি শুককুরবারে পাঠ্য। কেমন? অল রাইট, এটা শেষ করে আমি তোর আগের দু'টোশুদ্ধু তিনটে ফেরত দিয়ে যাব। আর তোর পড়া হলে এই নতুন দু'টো দিবি, কেমন? ততক্ষণে রথখোলার মোড় ঘুরে আমরা ডানে মদনমোহন বসাক রোডে পা দিয়েছি। বাঁদিকে শঙ্করদের বাড়ি এসে গেল। ওরা দু'ভাই হাত নেড়ে বাড়িতে ঢুকে গেলে আমরাও এগিয়ে বাঁয়ে বনগ্রাম রোডে পড়ে বাড়িমুখো হই।

পাঠ্যবইয়ের বাইরের বইয়ের জগতের শুলুকসন্ধান আমার ওই শঙ্করের হাতধরা হয়েই শুরু। ফুটপাতের বইয়ের রাজ্যে অভিষেক বলতে পারি। তারপর থেকে খোঁজা আর সংগ্রহের সীমানা, পরিসর যেমন বাড়তে লাগল, তেমনি শঙ্করের উৎসাহে মাটির ব্যাঙ্কে জমানো পয়সা, ঈদের সালামি, পরীক্ষায় ভাল করার সুবাদে পুরস্কার ইত্যাদি সুযোগের ব্যবহার ও কৃপণের যৎসামান্য ধন বই সংগ্রহে বিনিয়োগে কার্পণ্য করিনি কখনো। নিচের ক্লাসে পড়ার সময়ে আমার আরেক বন্ধু শতদল — শতদল বিহারী দত্ত আমার বই সংগ্রহ ও পঠনপাঠনের রুচি তৈরিতে সহায়ক হয়েছিল। ওরা তাঁতিবাজার রোডে এক দোতলা বাড়ির ওপর তলায় থাকত। শতদলের বাবা-মা ওর সঙ্গে নাকি ইংরেজিতে কথাবার্তা চালাতেন, যাতে ছেলে ইংরেজিতে বেশ সড়গড় হয়ে ওঠে অনায়াসে। মাসিমা অর্থাৎ শতুর মা নাকি প্রায়ই ওকে বলতেন, শতু, তোমাদের ওই ফার্স্টবয় ছেলেটিকে একদিন স্কুল ফেরত আমাদের বাড়িতে জলখাবার খেতে ডাকো না?

শতদল ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে ইংরেজি গল্পের বই পড়ত, ইংরেজি গান গাইত গুনগুন স্বরে। আমি বেশিরভাগ দিনেই শঙ্করের সঙ্গে বসতাম ফার্স্টবয়-সেকেন্ডবয় আমরা অটোম্যাটিক্যালি সেকশ্যনের ফার্স্ট এবং সেকেন্ড মনিটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করতাম এবং পাশাপাশি বসতাম। শতদল, যতদূর মনে পড়ে, গ্র্যাজুয়েট্‌স হাইস্কুল থেকে এসে আমাদের স্কুলে ক্লাস ফোরে ভর্তি হয়। পট্‌পট্ করে ইংরেজি বলা, চশমা পরা রোগা, শ্যামলা ছেলেটিকে আমি আর শঙ্কর ডেকে নিয়ে বন্ধুত্ব করেছিলাম। শতু অবশ্য বলত, ক্লাসে মেলামেশা করার মত ছেলে নাকি তেমন নেই, আমরা দু'জন ছাড়া। আমাদের হয়তো খুশি রাখতেই ওর ওকথা বলা। তবে, বলতে বাধা নেই, আমি ওতে মনে-মনে একটুখানি আত্মপ্রসাদ লাভ করতাম বৈকি। শঙ্কর কিছু মন্তব্য করত না। ও কিছুটা চুপচাপ, ভাবালু স্বভাবের ছিল। আমি ঠাট্টা করে বলতাম, কীরে শঙ্কু, তুই শেষে শ্রীরামকৃষ্ণ বা শ্রীচৈতন্য হয়ে যাবি নাতো? শঙ্কর হাসত না, আমার মুখের পানে তাকিয়ে দেখত, তারপর হয়তো জানালা দিয়ে আবার আকাশে ওর চোখজোড়ার সঙ্গে মন উধাও হত।


আহসান মঞ্জিলের পশ্চাৎভাগ। এদিক দিয়েই আমরা ভেতরে ঢুকতাম।

শতু এক বিকেলে শঙ্কর আর আমাকে জানাল, পরদিন বিকেলে ওদের বাড়িতে আমাদের জলখাবারের নিমন্ত্রণ। সকালে বাড়িতে যেন বলে আসি, ফিরতে দেরি হবে। যথারীতি স্কুলফেরত আমাদের পাঁচ পাণ্ডবের বাহিনী মার্চ করে তাঁতিবাজারে ওদের বাড়িতে হাজির হয়েছিলাম পরদিন। মাসিমা পাটভাঙা সাদা-নীল তাঁতের শাড়ি পরে বাইরের ঘরে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। শতু আমাদের পরিচয় করিয়ে দিল। রবু, দীপু একটু সঙ্কুচিত হয়ে বসেছিল। মাসিমা আমাদের বললেন, তোমরা খাবার ঘরে চলো। হাতমুখ ধুয়ে আগে জলখাবার খাও, তারপর গল্প হবে। খাবার টেবিলে প্লেটভর্তি স্যান্ডুইচ, সিঙাড়া, সন্দেশ, ডালমুটের সমাহার। আমরা সবই কিছু-কিছু খেলাম। হাতধুয়ে বসবার ঘরে এসে দেখি, সেন্টারটেবিলে ওভালটিন মেশানো দুধের গ্লাস। মাসিমা সবার হাতে গ্লাস তুলে দিলেন যতœ করে, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তো শুনি সব টার্মিনাল আর অ্যানুয়াল পরীক্ষায় অনেক নম্বর পেয়ে কেবল ফার্স্ট হও, তা ক্লাসের বইয়ের বাইরে আর কিছু পড়?

মাসিমা, আমাকে বাইরের বই পড়তে শিখিয়েছে এই শঙ্কর। বলে আমি ওভালটিনে লম্বা চুমুক দিই। শঙ্কর লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে। ইংরেজি বই পড়বে? মাসিমার প্রশ্ন শুনে আমি আর শঙ্কর পরস্পরের দিকে তাকাই। আমাদের বাড়িতে ইংরেজি বই পড়েন আমার আব্বা, মা-খালা-মামা সবাই বাংলা বই পড়েন, ইংরেজি বই পড়ব আরো ওপরের ক্লাসে উঠে, বলে আমি অতিথিদের পক্ষে জবাবদিহি করে থামি। মাসিমা উঠে দাঁড়ালেন। আঁচল থেকে চাবির গোছা খুলে, বেছে একটি চাবি আলাদা করে শতদলের হাতে দিলেন। বল্লেন, তোমার বইয়ের আলমারি খুলে বন্ধুদের দেখাও, ওদের রুচিমত বই পড়ার জন্য দাও, আমি রবু আর দীপুর সঙ্গে গল্প করি ততক্ষণ, কেমন?

…….
চক মসজিদ
……..
শতদল গম্ভীরভাবে প্রায়ান্ধকার খাবার ঘর বেরিয়ে পরের ঘরটিতে ঢুকে সুইচ টিপে আলো জ্বালাল। তিনদিকের দেয়াল জুড়ে মেহগনি পালিশ করা কাঠের আলমারিতে শুধু বই আর বই। শতু কোণের দিকের ছোট্ট আলমারির কড়ায় ঝোলানো তালায় চাবি ঘোরাল, কাঁচ বসানো পাল্লাদুটো টেনে খুলল, এক ঝলক গন্ধ এসে আমাদের নাকে আছড়াল। ন্যাপথালিনের। বাড়িতে মায়ের কাপড়ের আলমারির কোণে রাখা সাদা মার্বেলগুলোর গন্ধ এরকম। চুজ ইওর বুক্‌স, প্লিজ। শতদলের কাঠ্ কাঠ্ কথা শুনে আমি হেসে বল্লাম, শূওর আই উইল। মাসিমার হুকুম তো পেয়েই গেছি। তুমি বেছে দাও না? অনুরোধ জানালাম। শতদল এতক্ষণে তার পায়ের তলায় পরিচিত মাটি পেল যেন। টান্‌টান্ হয়ে এগিয়ে গিয়ে শক্ত মলাটের দু'টো ছোট ছোট বই বের করে আমার আর শঙ্করের হাতে তুলে দিল। আমার বইটির মলাট হলদেটে, টাইটেল 'ল্যাম্বস টেইল্স ফ্রম শেক্সপিয়ার'। শঙ্করের হাতে সবুজ মলাট, নাম 'ঈসপ্‌স ফেইব্লজ'। আলমারি তালাবন্ধ হল, বাতি নেবানো হল। আমরা নিঃশব্দে ফিরলাম বসার ঘরে।

মাসিমা যথারীতি আমাদের ইংরেজ মহাকবি এবং ঈসপের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বল্লেন, ক্লাসের পড়া করে, বাংলা গল্পের বই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে এগুলো পড়বে, একজনের পড়া হলে অন্যকে দেবে। দুজনেরই দুটো বই পড়া শেষ হলে আবার একদিন এস। পড়া বই নিয়ে আলাপ করব, আবার নতুন বই নিয়ে পড়বে, কেমন ? আজ সন্ধে হয়ে এল, এস এখন। সবাইকে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে মাসিমা আমাদের সদর দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। রাস্তায় পড়ে দীপু বলে বসল, দাদা, আমাদের মায়ের গায়ে মাসিমার মত অমন সুন্দর গন্ধ হয় না কেন রে? শঙ্কর গম্ভীরভাবে কেবল বলল, আমাদের মা কি বি.এ. পাশ নাকি? বলে দ্রুত হাঁটতে শুরু করল।

শঙ্করের কথা সত্যি। আমাদের স্কুলফেরত মায়েরা অবসরে শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ আর শশধর দত্ত পড়তেন। পাড়ায় পাড়ায় তখন 'তরুণ সংঘ', 'নতুন সংঘ', 'সুধীজন পাঠাগার' ইত্যাদি ক্লাব ও সংঘের রমরমা ছিল। একটাকা কি দু'টাকা দিয়ে ফর্ম কিনে পূরণ করে বাড়ির মেয়েরা পাঠাগারের সদস্য হতে পারতেন। যাঁরা লাইব্রেরির বই সময়ের আগে পড়ে শেষ করতেন, তাঁরা বই আবার নিজেদের মধ্যে আদান-প্রদান করতেন। একালে এরকমটা আর ঘটতে দেখি না। ওই বই নেয়াদেয়ার মাধ্যমে এক পরিবারের সঙ্গে আরেকের সম্পর্ক গড়ে উঠত প্রীতির, ক্ষেত্রবিশেষে ঘনিষ্ঠতর সহযোগিতার যে কথা হচ্ছিল, শঙ্করের মনের কোণে কি সেদিন একটু হলেও ক্ষোভ জমেছিল? কী জানি। স্পর্শকাতর বিষয়ে অনধিকার চর্চা আমাদের পরিবারে বারণ ছিল। সায়েবদের কোম্পানির চাকুরে আমার বাবা অন্যের প্রিভেসিতে নাক গলানো সামাজিক অপরাধ বিবেচনা করতেন। আমাদের তিনি মৃদুস্বরে বারবার এ বিষয়ে বলে সচেতন করে তুলতে সচেষ্ট থাকতেন। আমার মা অবশ্য বাবার ওসব অ্যাটিকেট-ম্যানার্সের খুব তোয়াক্কা করতেন না।

পগোজ স্কুলে ওপরের ক্লাসের ছাত্র ছিলেন তখন রফিকুননবী, তাঁর ছোটভাই শফিকুননবী, আমার সহপাঠী সুব্রত দেবের বড় দাদা দেবব্রত, ইন্দ্রব্রত ইত্যাদি। পাঁচভাই ঘাট লেইনে আমাদের বাস ছিল করিম কটেজের পাশে মসজিদের বিপরীতে ৪৪ নম্বর বাড়িতে। বাড়ির লাগোয়া খেলার মাঠ, তারপরের একতলা বাড়িতে থাকতেন রফিকুননবী ওরফে ওফা ভাইদের পরিবার। ওফা ভাই ছবি আঁকতেন। যদ্দূর মনে পড়ে, তাঁর বাবা পুলিশ অফিসার ছিলেন, উনিও বোধকরি ছবি আঁকতেন, গান শুনতেন। মোটের ওপর বোদ্ধা, রসিক মানুষ ছিলেন। শফিকুননবী ওরফে পান্নাভাই ছড়া লিখতেন। নামী ছড়াকার হবার সব গুণই ছিল ওর মধ্যে। ওদের বাড়ির বইয়ের আলমারিতেও আমার অবাধ ঘাঁটাঘাঁটি করার অধিকার ছিল, মনে আছে। আমাদের বাড়িতে দু'তিনটে বাংলা-ইংরেজি দৈনিক কাগজ রাখা হত। মাসিক পত্র, সাময়িকীর মধ্যে মাহেনও, সওগাত, মোহাম্মদী, পাকিস্তানী খবর, বেগমের সঙ্গে শুকতারা, শিশু সাথীও আসত মামা, খালা ও বড়দের সৌজন্যে।

কাজেই পড়ার সুযোগ ছিল বেশ। তবে অবাধে, নির্বিচারে পড়ার যে উদগ্র বাসনা আমার আজও বর্তমান — সেটাকে তেমন প্রশ্রয় দেবার বা পাবার সুযোগ কম ছিল। আর, যেনতেন একরকমের রুচি তৈরি হয়ে যাওয়াতে লভ্য সময়ের সদ্ব্যবহার করার একটা তাগিদও ভেতর থেকে সাবধান করে দিত। তাই, একেবারে আজেবাজে বটতলার ম্যাটার গোগ্রাসে গেলা তেমন হয়ে ওঠেনি। আর মাথায় একটু একটু উঁচু হওয়ার পাশাপাশি তখন চেতনা, দায়িত্ববোধ, বিবেক, ন্যায়-অন্যায়, ভালমন্দের বিচারবোধ পক্ক হবার একটা তাগিদও আমরা ভেতর থেকে অনুভব করতাম, সমবয়সীদের আসরে সেসব নিয়ে আলাপও হত। আসলে, এখনকার মাবাবা, গুরুজন, শিক্ষক স্থানীয়রা প্রায় সর্বক্ষণ ব্যস্ততার আড়াল তুলে শিশু-বালকদের সঙ্গে হার্দ্যকি আলাপচারিতা প্রায় করেনই না। আমার মনে পড়ে, আমি এবং আমার বয়সী আত্মীয়, সহপাঠীদের প্রায় সকলেরই তখনকার দিনে প্রয়োজনীয় অভিভাবকত্বের যত্ন বা মেন্টরিং পাবার সুযোগ ছিল। আমরা যে সেই খবরদারিতে কখনো-কখনো বিরক্তি অথবা দ্রোহ ব্যক্ত করতে চাইতাম না, তাও ঠিক নয়। তবে ওই ভাবা পর্যন্তই, কখনো তেমন অনভিপ্রেত বিস্ফোরণ ঘটতে দেখা যেত না। বোধকরি তাতেই আমরা একবারে উন্মূল হয়ে যেতে পারিনি ওই প্রজন্মের অনেকেই।

হচ্ছিল পড়া আর শোনার কথা। মা-খালা-নানি-মামিদের কথিত ছড়া-রূপকথা-জাতকের গল্পরামায়ণমহাভারতবিষাদসিন্ধুমহাশ্মশান-এর উপজীব্য বিষয়ে জানার সুযোগ হয়েছিল শৈশবে। সেইন্ট গ্রেগরিজ আর পগোজ — যে দুই স্কুলে পড়ে প্রবেশিকা পরীক্ষার বৈতরনী পার হই — দুইয়েরই ছিল গল্প করার মতো, গর্ব করার মতো পাঠাগার। লাইব্রেরি-ইন-চার্জ যিনি থাকতেন, তাঁর কাজই ছিল আমাদের প্রতি বিষ্যুদবারে হাফ স্কুল হয়ে ছুটির পর টিফিন খাওয়া হয়ে গেলে এক-এক ক্লাসের ছেলেদের লাইনে দাঁড় করিয়ে, তাদের নামে বই ইস্যু করে, হাতে ধরিয়ে দেয়া এবং পরে পঠিত বইয়ের ওপর আলোচনা করে ছেলেদের পাঠের আগ্রহ ও অর্জিত জ্ঞানের স্পট টেস্ট নেয়া। পগোজ স্কুলের লাইব্রেরির সব ক'টি আলমারির কয়েকশ' বই আমার পড়া হয়ে গিয়েছিল ঠিকই। কারণ বোধকরি, ওই নিয়ম করে প্রতি বিষ্যুদবারে, অর্থাৎ অন্য ক্লাসের ছেলেদের বই দেয়ানেয়ার দিনেও আমি আমার পড়া বই ফেরত দিয়ে একফাঁকে নতুন বই নিয়েই বাড়ি ফিরতাম বুক ফুলিয়ে। মা, কুটিখালা অথবা কুটিমামার সামনে দিয়ে ইচ্ছে করেই স্কুল লাইব্রেরির সিল দেয়া বইগুলো নিয়ে এঘর-ওঘর করতাম, যাতে আগ্রহী হয়ে ওঁরা সেগুলো হাতে নিয়ে, উল্টে-পাল্টে দেখেন। বিশেষ করে ইংরেজি টাইটেল দেখলে বাড়ির বাসিন্দাদের চোখেমুখে বেশ একটা সমীহের ভাব ফুটে উঠত, ভাবখানা এরকম — আমাদের সেই বাবু, যাকে বিকেলে, এক কাপ দুধ খাওয়াতে হলে চিংড়ি ফড়িংয়ের জন্মদিনে, ঘোড়ার ডিম, শিশুসাথীশুকতারার চল্‌তি ইস্যু ঘুষ দিতে হত — সে কিনা এখন ইংরেজির দুর্ধর্ষ টিচার মিঃ রাহ্‌মানের বেছে দেয়া স্যার ওয়াল্টার স্কটের আইভ্যানহো পড়ছে! কুটিমামা ভারিক্কি গলায় তো, বলে উঠতেন, "জান আমাদের বঙ্কিম বাবুকে ইয়াং বেঙ্গলের মদুসূদন দত্তরা 'বাংলার স্কট' বলে ডাকতেন?" তবে ফুটপাতের এলেবেলে দোকানে পুরনো বই ঘাঁটবার যে মজা — সে হল আবিষ্কারের আনন্দ। বড়দের আলোচনা, বন্ধুদের আড্ডায় অনেক বই আর লেখকের গল্প শুনতাম — যেগুলো আমার হাতে আসেনি। সেসব লেখক-কবি, ঔপন্যাসিক, ভ্রমণ কথাকার, ইতিহাসবিদ আর তাঁদের বিখ্যাত সব রচনায় নাম মাথায় গেঁথে যেত, মনে মনে খুঁজে ফিরতাম। সদরঘাট, বাংলাবাজার, পাটুয়াটুলি, পরবর্তী সময়ে জনসন রোড, নবাবপুর রোডের ধারে বসা বইওয়ালা, গুলিস্তান সিনেমার উল্টো ফুটে জিএমজি স্টোর্সের সামনে বসা বইয়ের দোকানি, স্টেডিয়ামের গেইটে বইয়ের ফেরিওয়ালার ভ্যান, বায়তুল মোকাররম মার্কেটের নিচের গলিতে বসা আমিরের দোকান, বিজয়নগর রোডে কামালদের বাড়ির মোড়ের দু'তিনটে বুকস্টল এবং আরো পরে ইউনিভার্সিটিতে পড়বার সময় নীলক্ষেত মোড়ের দোকানগুলোতে বইপত্র ঘেঁটে অনেক ভাল সময় কেটেছে। বহু দুষ্প্রাপ্য, দুর্মূল্য বই, পত্রিকার কোনো বিশেষ ইস্যু যেগুলো দোকানে ঠিক সময়ে কেনা হয়ে ওঠেনি, সেগুলো আমি ফুটপাত থেকে সংগ্রহ করেছি।


জনসন রোডের সেন্ট থমাস চার্চ

ছেলেবেলায় প্রবন্ধ পড়ে জেনেছিলাম, মহাজ্ঞানী মনীষী বলছেন, তাঁর সারাজীবনের জ্ঞান সাধনার অর্জন তেমন কিছুই নয়, জ্ঞানসমুদ্রের পারে দাঁড়িয়ে নুড়ি সংগ্রহের সামিল। এখন আমি ঊনষাটে পৌঁছে ভাবি, যে সামান্য ক'টি পত্রপত্রিকা নিয়মিত সংগ্রহ করি, তাই যে দেড়েমুষে পড়া হয় না। এখন যেহেতু অনেক বেশি অভিনিবিষ্ট হয়ে পড়ি, অত সময় আর হাতে নেই, একথা বেশ উপলব্ধি করি। প্রায় পাঁচ দশক আগে বাবার বিছানায় বালিশের নিচে আগাথা ক্রিস্টিকে আবিষ্কার করি। বাবার পাঠরুচি খুব জটিল কিছু ছিল না — গোয়েন্দা কাহিনী — শার্লক হোম্‌স, শশধরবাবুর দস্যু মোহন সিরিজের বই যেমন পড়তেন, তেমনি পাড়ার লাইব্রেরি থেকে আনানো শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর, বিমল মিত্র, মনোজ বসু, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, যাযাবর, শঙ্কর, নীহাররঞ্জন রায়, শওকত ওসমান, সরদার জয়েনউদ্দিন পড়তেন। দুনিয়া আর চাইনা শীর্ষক বইটি আমি চুরি করে পড়তে গিয়ে বকুনি খেয়েছি। হাসপাতাল পড়েও বকুনি খেয়েছি, কারণ ওটাও বড়দের বই নাকি। পরে প্রাপ্তবয়স্ক আমি তন্নতন্ন করে খুঁজেও ওতে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য লেখা কিছু পাইনি, যেমন পেয়েছি লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার-এ বা ফ্র্যাঙ্ক হ্যারিসের আত্মজীবনী পড়ে।

কী পড়ব, কতটা পড়ব — এসব নিয়েও বিশেষ ভাবিনি কখনো। ভেবে লাভও নেই তেমন, মনে হয়। প্রায় চল্লিশ বছর আগে ডাঃ সারওয়ার মুর্শেদ শেকসপিয়ার পড়াতে এসে বলেছিলেন, মহাকবির জন্মসাল ১৫৬৪ সাল থেকে চারশ' বছরে যতগুলো দিন হয়, তারচেয়েও বেশিসংখ্যক আলোচক চার শতাব্দীরও বেশি সময়ে তার ঐ ক'টা নাটক আর সনেটের বিচার-বিশ্লেষণ করে শেষ কথাটি উপলব্ধি করতে, প্রকাশ করে উঠতে পারেননি। আরও বলতেন, 'পোয়েট্রি ক্যানট্ বি টট, ইউনো, কবিতা পড়তে হয় বারবার, বিভিন্ন মানসিক অবস্থায়, ভিন্ন ভিন্ন প্রতিবেশে…।' খুব বেশি না ভেবেও আমি নিশ্চিন্তে বলতে পারি, বন্ধুরও নখদাঁত থাকে, সেগুলো অবস্থাভেদে দেখতেও হতে পারে, কিন্তু বই নখদাঁত, ঈর্ষাদ্বেষহীন। কোনো কোনো বই হাতে নিলেই বোধ হয়, পুরনো বন্ধুর মত সে চাইছে, আমি তার পাতা ওল্টাই, বিশেষ বিশেষ জায়গায় দাঁড়াই, আশ্রয় প্রার্থনা করি, সেও দু'হাত বাড়িয়ে আছে পরমবন্ধুর মত — দেবার জন্যই। এরকম বইয়ের নাম আমি যেক'টি একনিঃশ্বাসে উচ্চারণ করতে পারি, সে বিষয়েও বলতে ইচ্ছে করে। ভাল লাগে। ভাললাগা মানুষের নাম বোধহয় অতক'টা বলা সম্ভব নয়। কিছু কিছু বই আমাকে এত ভালালাগা উপহার দিয়েছে, তার সঙ্গে তুলনীয় আর কিছু নেই।

খুব দুঃখ পেয়েছিলাম আমার ছাত্রজীবনের বইয়ের সংগ্রহ হারিয়ে ফেলাতে। একাত্তরে আমাদের বাড়ির সবকিছু অবাঙালিরা তালাবন্ধ বাড়ির দখল নিয়ে লুটেপুটে নিয়েছিল। আমার মা কষ্ট পেয়েছিলেন তাঁর সংসার, আসবাব, তৈজসপত্র লুট হওয়ায়। আমি, আমার বৃত্তির টাকায় কেনা দুর্লভ সাহিত্য, সিনেমা আর চিত্রশিল্প বিষয়ক গ্রন্থসম্ভার লুটে নেয়ায় কষ্ট পেয়েছিলাম এই ভেবে যে, ওই আলমারির অনেক বই আমার পড়া হয়নি, কিনে রেখে দিয়েছিলাম, এমএ পরীক্ষার পর নেড়েঘেঁটে দেখব বলে। পরীক্ষার পরপরই দেশে আগুন লাগল, মুক্তিযুদ্ধের ডামাডোলে সব চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল। কষ্ট পেয়েছিলাম ভেবে যে, আমর স্কুলজীবনের শেষ থেকে নটরডেম কলেজের দু'বছর আর ইউনিভার্সিটির চার বছরে তিলে তিলে গড়ে তোলা ব্যক্তিগত সংগ্রহ হয়ত কেউ নিয়ে সেরদরে বেচে দিয়েছে পুরনো খবরের কাগজক্রেতার ঘরে। অবশিষ্ট কয়েক ট্রাঙ্ক বই আমার খালাতো ভাই পান্নুর বাসায় ছিল। ওই বইগুলো সূর্যসেন হলে আমার ঘরে জমেছিল চার বছরে। তবে বিশেষ সংগ্রহটি ওয়ারির বাড়িতেই ছিল।

পান্নুভাই আমার চেয়ে ছ'বছরের বড়। স্কুলে উনি আমার ছ'বছরেরই সিনিয়র ছিলেন। আমি ক্লাস ফোরে যখন, পান্নুর দশম শ্রেণী। ওদের সময়ে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় বসতে হত। আমরা ডেঁপোরা বলতাম 'মাতৃকুলনাশন' পরীক্ষা। ওতে পাশ করা নাকি কঠিন এক পরীক্ষাই ছিল। আমার টিউটর বলতেন জীবনের প্রবেশিকা পরীক্ষা, কারণ ওই পরীক্ষা পাশের পরই প্রকৃত লেখাপড়া অর্থাৎ উচ্চতর শিক্ষাজীবন শুরু হত। অনেকেই পরীক্ষা পাশের পর জীবিকা অর্জনে ব্যস্ত হয়ে পড়ত। অনেকেই রাতে পড়ত, দিনে চাকরিবাকরি করত। পান্নুভাই হয়তো তার অজ্ঞাতসারেই নিজের পাঠাভ্যাস ও রুচি আমার মধ্যে খানিকটা চারিয়ে দিতে পেরেছিলেন। শিব্রাম-শরদিন্দু থেকে শুরু করে কলেজ ও ইউনিভার্সিটি পর্যায়ে বাংলা-ইংরেজি ক্লাসিক্স পড়ার তাগিদ ঐ পান্নুভাইয়ের পড়ার ধাত অনুসরণ করেই আমার স্বভাবের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছিল। আর, এটা-সেটা লেখার ব্যাপারতাতেও পান্নুভাইয়ের উৎসাহের যোগান কখনো কমেনি। উনি মনে করতেন, প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার চাইতে বেছে বেছে বিভিন্ন বিষয়ের উৎকৃষ্ট রচনা পড়ে, সমমনা পাঠকদের সঙ্গে আলোচনার পর নতুনতর তথ্য ও জ্ঞানের উৎসে পথ পরিক্রমা শ্রেয়তর।

একসময় প্রগতি প্রকাশনীর গ্রন্থাবলীর বড় আদর ছিল আমাদের কাছে। নটরডেম কলেজে আমাদের জীববিজ্ঞান পড়াতেন দ্বিজেন শর্মা। বাংলা পড়াতেন মিয়া মুহম্মদ আবদুল হামিদ। দুজনেই আমাদের বইয়ের তালিকা তৈরি করে দিতেন। উচ্চ মাধ্যমিকের পর কার্জন হল এলাকায় কিছুদিন ঘোরাঘুরি করে উপলব্ধি করলাম, সয়েল সায়েন্স বা ফিজিক্স পড়া আমার কম্ম নয়। আর্টস ফ্যাকাল্টির ডিন সম্পর্কে নানা হন। দেখা করলাম। মার্কশীট দেখতে চাইলেন। বাংলা-ইংরেজিতে বোর্ডের সর্বোচ্চ নম্বরধারী হওয়ার সুবাদে তাঁর নিজের ডিপার্টমেন্ট ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে ভর্তি হবার সুযোগ করে দিলেন। বিশেষ ভর্তি পরীক্ষায় বসতে হয়েছিল অবশ্য। ডিপার্টমেন্ট হেডের নির্দেশে মুনিম স্যর তাঁর চেম্বারে আমাকে ঢুকিয়ে দিয়ে, আধঘণ্টা সময়ে 'প্লেজার' বিষয়ে আমি যা জানি, তাই লিখে ফেলতে বলে, বাইরে থেকে দরজার পাল্লা টেনে বন্ধ করে দিয়ে চলে গিয়েছিলেন।

সতেরো বছর বয়সে ঐ বেমক্কা রকমের বিমূর্ত বিষয়ে আধঘণ্টায় পাঁচশ' শব্দের রচনা লেখার চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করেই ইংরেজি পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। ভর্তি হয়ে যখন ঐ কেতাদুরস্ত ডিপার্টমেন্টের রীতিনিয়ম সম্পর্কে খানিক ওয়াকিবহাল হলাম, তখন আমার রীতিমত নাস্তানাবুদ হাল। ড. হুসেইন অর্থাৎ ডিপার্টমেন্ট হেড বারোমাস কালো স্যুট পরেন। কালো চকচকে জুতো। লাল টাই, সাদা শার্ট, হাতে বিলেতি কায়দার গোটানো ছাতা। কেবল হ্যাট্‌টাই বাকি। অফ হোয়াইট স্কোডা গাড়িতে চড়তেন। আমার সাধারণ পরিধেয় ছিল খালাসি নীল তসরের ট্রাউজার্স, সাদা বুশশার্ট, পায়ে স্যান্ডেল স্যু। ঐ পোশাকে আমাকে বারান্দায় দেখে উনি একদিন নিজের চেম্বারে ঢুকলেন। কেটে পড়তে যাব, তাঁর খাস বেয়ারা দবির ভাই এসে জানাল, 'স্যরে সালাম দিছেন।' ভেতরে ঢুকে সালাম দিলাম। মেরুন টাইয়ের নট ঢিলে করতে করতে উনি সংশোধনের সুরে বললেন, 'নৌ নৌ, দ্যাট ওউন্ট ডু, ইশুড হ্যাভ সেইড, গুড আফটানুন, স্যর। অরাইট, প্লিজ সিডাউন।' তারপর যা বললেন, তাতে রক্ত হিম হবার যোগাড়। আমার আড্ডা, সিনেমা, বইপড়া মাথায় উঠল। আমাকে নাকি ভদ্রলোক হয়ে উঠতে হবে এবং একজন আদর্শ ফ্রেশম্যান।

বাড়ি গিয়ে মাকে জানালাম, তার সায়েব মামুর মাথায় আমাকে মানুষ করার সখ চেপেছে। মা তো খুব খুশি, ভবিখানা — এবার কেমন জব্দ? ডাক্তারি, এঞ্জিনিয়ারিং পড়বে না, বিজ্ঞান পড়বে না, এবার বোঝো। সখের ইংরেজি পড়ার ঠেলা সামলাও। কুটিমামা শুনে গজগজ থামালেন না, 'তখনি বলেছিলাম বু' তোমাকে, তোমার ঐ বড়ছেলেকে দুলাভাই লাই দিয়ে মাথায় তুলছেন। ওর পড়াশুনো আর হবে না। ঠিক আছে, এখন ওকে ওই ইংরেজিই ভালভাবে মন দিয়ে পড়তে বল। নিদেন পাকিস্তান ফরেন বা সিভিল সার্ভিসে চলে যাবে আর কি।' আর ফরেন সার্ভিস, আমার তখন শিরে সংক্রান্তি। ঐযে তিনি ডেকে পাঠালেন, তার ঠিক দু'দিন বাদে নোটিসবোর্ডে দেখি, আমাকে হুসনেআরা হকের গ্রুপ থেকে সরিয়ে হেডের টিউরিয়াল গ্রুপে ঢোকানো হয়েছে। তড়িঘড়ি জিন্নাহ্ এভিনিউয়ের বাটার দোকানে গিয়ে কালো অক্সফোর্ড জুতো কিনতে হল একজোড়া। ম্যানেজার কুটিমামা দৃশ্যতঃ খুশি। বেশ দামি একজোড়া জুতো উপহারই দিয়ে বসলেন ভাগ্নেকে। সেলসম্যানকে বল্লেন, 'আমার নামেই বিল করো। আমার মামুর ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হয়েছে কিনা। ঠ্যালা বুঝবে এইবার।' জুতো কিনে মামার সঙ্গে উল্টোদিকের লা সানি রেস্তোরাঁয় যেতে হল। জম্পেশ করে বসে মামা বেশ মেজাজে চারতলা ক্রিম প্যাস্ট্রি, শিক কাবাব আর ওভালটিন দিতে বললেন। বললেন, এও মন্দ হয়নি, ইংরেজি পড়ো, কিন্তু ঐ আড্ডা-টাড্ডা বাদ দিতে হবে, নইলে কিন্তু শেষে মফস্বলের কলেজ মাস্টারি ছাড়া আর কিছুই জুটবে না, বুঝলে বাবা?'

তা বোঝা গিয়েছিল শীগগিরই খুব ভালভাবে। ড. হুসেইন টিউটরিয়াল ক্লাস নিতেন নিজের চেম্বারে। প্রথম ক্লাসে খুব নার্ভাস ছিলাম। পোশাকে দৈন্য তো ছিলই, কেবল জুতোজোড়া যা নতুন। গ্র"পের বাকি সবাই মেয়ে। স্যর এবং মেয়েরা সবাই আমার দিকে আপাদমস্তক তাকিয়ে। আড়চোখে দেখছিলাম, ওদের কেউ হাসছে কিনা। না, ড. হুসেইনের সামনে বসে কারো ওরকম ইচ্ছে হত না। উনি আধো অপ্রসন্নমুখে কেবল উচ্চরণ করলেন, 'বেটার। বাট নিড ইমপ্রুভমেন্ট — আ লট।' বুঝলাম, সেলিম সারোয়ারের মত কড়া ইস্তিরি পুরোহাতা শার্ট ট্রার্ডজার্সের ভেতর গুঁজে পরলে ইমপ্রুভমেন্ট হিসেবে ধরা যেতেও পারে। দেখা যাক। আলোচনা করলেন সাবলীল অক্সনিয়্যন অ্যাকসেন্টের ইংরেজিতে। বিষয় আর্থার ক্যেসলারের ডার্কসেন এ্যাট নুন। পরের ক্লাসের টাস্ক হল — বইটি পড়ে তৈরি হয়ে আসতে হবে — সম্ভাব্য বিষয়ে আলোচনা লিখতে হবে চল্লিশ মিনিট ধরে, লিখে খাতা জমা দিয়ে যেতে হবে।

সঙ্গে সঙ্গে লাইব্রেরিতে গিয়ে বইটি ইস্যু করিয়ে নিলাম। পাবলিক লাইব্রেরির নিচে সাইকেল স্ট্যান্ডের একধারে বসে পড়তে লাগলাম। নটরডেমে পড়ার সময়ে একবার আমরা 'শহীদ মিনার গড়ব' পণ করে স্ট্রাইকে নেমেছিলাম। কলেজের সদর দরজা বন্ধ করে দিয়ে আমরা বাইরে স্লোগান দিচ্ছি। শিক্ষকরা যথারীতি ভেতরে ঢুকছেন। ছাত্রদের আমরা বাধা দিচ্ছি। সাজিদ ইস্পাহানিকে কে যেন ধাক্কা দিয়ে পাশে নর্দমায় নামিয়ে দিল। ধবধবে সাদা পোশাকে দুনিয়ার নোংরা নিয়ে উঠে এসে সাজিদ বিড়বিড় করে আমাদের গুষ্টি উদ্ধার করতে করতে ওর অপেক্ষমান দুধসাদা মার্সিডিজের সাদা আসন কলঙ্কিত করে জেবড়ে বসে মগবাজারের বাড়িতে চলে গেল। ইপসু (ইস্ট পাকিস্তান স্টুডেন্টস ইউনিয়ন) নেতৃবৃন্দ — রেজা আলী, রাশেদ খান মেনন, মতিয়া চৌধুরী এসে কলেজের উল্টোদিকে মোতিঝিল কলোনির কৃষ্ণচূড়া গাছে মাইক বেঁধে আমাদের সংগ্রামী চেতনাকে উদ্দীপ্ত করছেন। মেনন ভাইয়ের ছোটভাই বাদল আমাদের কলেজেই তখন ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছে। এসএসসি-তে ফার্স্ট হওয়া ছেলে বাদল আমাদের সঙ্গে ধর্মঘট করছে। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর মোনেম খাঁর বাসভবনে গিয়ে স্মারকলিপি দেবার মধ্য দিয়ে সেবার ধর্মঘটে ইতি টেনেছিলাম। কলেজের ক্রীশ্চান হস্টেলের সামনের পুকুর বুঁজিয়ে শহীদ মিনার গড়া হয়েছিল। আর্থার ক্যেসলার পড়তে পড়তে আমার সামাজিক চেতনার সেই উন্মেষকালের কথা মনে পড়ছিল।

পরের সপ্তাহে টিউটরিয়ালে বসে চল্লিশ মিনিট পুরোদমে লিখে 'বি' পেয়েছিলাম। শতকরা পঞ্চাশের ঘরে চুয়ান্ন পর্যন্ত নম্বর পেলে 'বি'। মরিয়ম মাদানি, শাহীন মাহ্বুবা কবির আর নাজমা খালেদা-ও তাই পেয়েছিল। নিজাম, সেলিম, ফতে আলীদের মতে অত্যন্ত উঁচুদরের স্কোর। ড. হুসেইনের নম্বরদানে কাপর্ণ্য সুবিদিত ছিল। পরের টিউটরিয়ালের আলোচ্য বিষয় ছিল 'দ্য গড দ্যাট ফেইল্ড'। পরপর ওই দু'টি বই পড়তে পড়তে হঠাৎ আমার মনে হল, ড. হুসেইন আমাদের ক'জনের মাঝে বোধহয় ইস্ট্যাবলিশমেন্টের দুর্নিবার, অপরাজেয় ভূমিকা বিষয়ে একধরনের সমীহ জাগাতে চেয়েছিলেন। অজান্তেই ভেতরে ভেতরে প্রতিরোধ গড়ে উঠতে লাগল। অবশ্য টিউটরিয়ালের রচনা লেখার সময় আমি বস্তুনিষ্ঠ থাকতে চাইতাম। ফলে, নম্বর ভালই পেতাম। ড. হুসেইন স্পষ্টতঃই বেশ মনোযোগের সঙ্গে সাহিত্য বিশ্লেষণের কাজটি করতে চাইতেন। কিন্তু তাঁর বিষয়ের প্রতি পক্ষপাতিত্ব আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। তাঁর কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ, কারণ বইয়ের তালিকা তৈরি করে দিতেন তিনি, আমরা যে যেমন পারতাম, সেগুলো সযত্নে পড়ে যেতাম।

এইভাবে আমার রাশ্যান সাহিত্য, বিশেষ করে গল্প ও উপন্যাস বেশ পড়া হয়েছিল। ওয়র এ্যান্ড পিস, আনা কারেনিনা, দ্য ইডিয়ট, ক্রাইম এ্যান্ড পানিশমেন্ট, ব্রাদার্স কারমাজফ, — পুশকিন, টুর্গেনেফ। ফরাসী সাহিত্যের দিক্পালদের রচনা — জাঁ ক্রিসতফ, নানা, জার্মিনাল, লে মিজেরাব্‌ল। ফ্লবেয়ার, আঁদ্রে জিদ, ভলত্যের, রুশো — স্প্যানিশ স্যরভান্টিস — ইতালিয়ান বোক্কাচিও, মাকিয়াভেলি। আর বাংলা কবিতা পড়তাম ফতে আলী আর এক বছরের সিনিয়র হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে। হুমায়ুন ভাই আমাকে জীবনানন্দ পড়িয়েছিলেন। শুরু হয়েছিল রূপসী বাংলা দিয়ে। অনেকগুলো কবিতা আমার মাথায় গেঁথে গিয়েছিল। ধানসিঁড়ি, সুগন্ধা, — কিশোরীর চালধোয়া শীত হাতখান, কার্তিকের কুয়াশা, গোলপাতা ছাউনি। কোলরিজের 'কুবলা খান' যেমন স্বপ্নে পাওয়া কবিতাংশ — জীবনানন্দের বাংলার কবিতা পড়ে মনে হত, এতসব স্বপ্নে পাওয়া যায়?

সহপাঠী ফতে আলীর উৎসাহে আধুনিক বাংলা কবিতা পড়া এগিয়েছিল। জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে সুধীন দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী আর বিষ্ণুদে পড়ছিলাম। আরেক সহপাঠী কবি আবুল হাসান সেকেন্ড ইয়ারে প্রমোশন না পেয়ে আমাদের সঙ্গে ফার্স্ট ইয়ারে ক্লাস করত। ফরাসী সাহিত্যের ইংরেজি অনুবাদ পড়তে পড়তে নতুন ভাষা শেখার ইচ্ছে জাগত। সেকেন্ড ইয়ারে প্রমোশন পেয়ে ফরাসী ভাষা শিক্ষার সার্টিফিকেট কোর্সে ভর্তি হলাম। শেষ পর্যন্ত সারওয়ারউদ্দিন আহমেদ আর আমি টিঁকেছিলাম। দু'বছর পড়ে আমরা সার্টিফিকেট আর ডিপ্লোমা পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট আর সেকেন্ড হই। আমি আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে সান্ধ্যকালীন লাইব্রেরিয়ানের কাজ পেলাম। সঙ্গে আরো দু'টো ভাষা শিখতে চেষ্টা করেছিলাম। ইরানিয়ান কালচারাল ইন্সটিটিউটে ফারসি ক্লাস করতাম সপ্তাহে তিন বিকেলে। আর বাড়িতে টিচ্ ইওরসেল্‌ফ সিরিজের প্রাইমার পড়ে রাশ্যান শেখার মহড়া দিতাম। আমার বাবা মাঝে মাঝে মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করতেন, 'আচ্ছা, বাবু, তুমি ইংরেজি পড়াটা কি একেবারে ছেড়ে দিলে?' আমি মৃদু হেসে বলতাম 'লাইব্রেরিতে আর আড্ডায় আমার ক্লাসের পড়া তৈরি হয়ে যায়, টিউটরিয়ালে তো মোটামুটি নম্বর পেয়ে যাই। ব্যস।'


লালকুঠি

এরিমধ্যে জেমস্ বন্ডের দুর্ধর্ষ একশ্যন ছবি ড. নো এলো ঢাকায়। নভোকভের লোলিটা এলো বলাকায়-য়। ছবি দেখেই আমি আর পান্নুভাই ইয়ান ফ্লেমিংয়ের যে ক'টা উপন্যাস পাওয়া যাচ্ছিল, কিনে ফেললাম। পড়াও হয়ে গেল। নভোকভের আরো যা বই ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরিতে ছিল, পড়লাম। ক্লাস আর সান্ধ্যকালীন চাকরির ফাঁকে পাবলিক লাইব্রেরিতেও ঢোকা হত। দুনিয়ার পত্রপত্রিকা, ম্যাগাজিন ওখানেই পড়তাম। অত কি আর কেনা যায়। পাসোকা-র (Pakistan Students' Work camp association) সদস্য হিসেবে বিরল একঝাঁক প্রতিভাবান সিনিয়র, জুনিয়র আর সহপাঠী বন্ধু আর বড়ভাই জুটেছিল। সকাল থেকে পড়াশোনা, ব্যায়াম আর অন্য কাজের ফাঁকে চুটিয়ে আড্ডা চলত আমাদের। মধুর ক্যান্টিন, শরীফ মিয়ার দোকান, আফসারের চা-দোকান আর রেসকোর্স পেরিয়ে রমনা রেস্তোরাঁয় আড্ডার ঠেক ছিল। আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে যাওয়া-আসার পথে আড্ডা জমত এলিফ্যান্ট রোডের 'সেবা ফার্মেসি', 'শাফকাত মেডিক্যাল সাপ্লাইজ' অথবা 'জাহাজী'র কাফেতে। ল্যাবরেটরির ভেতরে পান্নুভাইদের আস্তানা তো চব্বিশ ঘণ্টার আড্ডাই ছিল।

এইসব আড্ডাই মূলতঃ আমার জন্য সাহিত্যের পঠনপাঠন, লেখা, অনুবাদ, সম্পাদনায় হাত মকশো করার সুযোগ করে দিয়েছিল। নির্দোষ, নির্মোহ, উৎসুক মনের মেলা, বিশুদ্ধ আড্ডা। শরীফ মিয়ায় দোকানে বসে শফিক ভাই, সালাউদ্দিন জাকী, মুহম্মদ খসরুর নির্দেশনায় আমরা 'সিনে আর্ট সার্কল' নামে শুদ্ধ চলচ্চিত্র প্রদর্শনের উদ্যোগ নিয়েছিলাম ঐ '৬৭-'৬৮ সালেই। বহুসংখ্যক 'মন ভাল হয়ে যায় দেখলে' ধরনের ছবি দেখাব সুযোগ হয়েছিল তখন। আমাদের তথাকথিত রাজনৈতিক দল 'আমার দল'-এর চীফ মনজুর ভাই আর আমি একবার দ্য ডেইজ অব ম্যাথুজ ছবিটি দেখার পর খুব মন খারাপ নিয়ে হল থেকে বেরিয়েছিলাম। চীফ কেবল সিগ্রেট টানছিলেন। সেদিন রমনার আড্ডায় সবাই বেশ চুপচাপ — সাদাসিধে গ্রামীণ যুবক ম্যাথুজের দিনযাপনের কথাই বোধকরি ভাবাছিল সবই। ছবি দেখে আমরা যাকে বলে 'প্রফাউন্ড্লি মুভড্'। শেষ দৃশ্যে ম্যাথুজ নিজেকে সর্বক্ষেত্রে ব্রাত্য ভেবে নিয়ে শেষ বিকেলে নিজের ছোট্ট, সরু ডিঙিটা নিয়ে গাঁয়ের লেকের ঠিক মাঝে পৌঁছে, দাঁড়িয়ে উঠে বৈঠার লোহাবাঁধানো বল্লমের মতো চোখা প্রান্ত দিয়ে ডিঙির তলা ফুটো করে ফেলে, পানি উঠতে থাকে দ্রুত, ম্যাথুজ দু'পা সামান্য ফাঁক করে সটান দাঁড়িয়ে। দৃষ্টি দূরের পাহাড়চূড়ায় নিবদ্ধ, পানি ওর ছেঁড়াফাটা ফিতেবিহীন জুতো ডুবিয়ে, বিবর্ণ ট্রাউজার্সের প্রান্ত ডোবাল, সে অবিচল দূরে তাকিয়ে, সারাগাঁয়ের মানুষের প্রতি তীব্রতম অভিমানে বেপথু। ধীরে ধীরে লেকের ওপারে সূর্য ঢলে যায়, ম্যাথুজ জলমগ্ন হয়, একটিও পাখি ডাকে না, সবশেষে ওর একমাথা ঝাঁকড়া কালো চুল কয়েক সেকেন্ড আল্গা হয়ে ভেসে থাকে নিস্তরঙ্গ জলে, তারপর কেবল আয়নাসদৃশ জলের বিস্তার, আঁধার ঘনায়। চীফ মনজুর ভাই কিছুদিন পরই আত্মহত্যা করেন।

নটরডেমে পড়ার সময় আমাদের কয়েকজন বন্ধুর ক্ষেত্রে সিনেমা দেখা প্রায় প্রাত্যহিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কামাল (বর্তমানে নাভানা গ্রুপের চেয়ারম্যান), বাবু (পল্লীকবির ছোট ছেলে), চুনী, মনি, গাফফার, মাহবুব আর আমি প্রায় প্রতিদিনই হয় নাজ, নয়তো গুলিস্তানে মিডডে শোতে ইংরেজি ছবি দেখতাম। সবার পকেটে রেস্ত থাকত না, কাজেই সস্তার টিকিট কাটা হত। তবে আমোদের কোন খাম্তি ছিল না। আমি পান্নুভাইয়ের সঙ্গে বাছাই ছবিগুলো আবার দেখতাম। ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে ছবি দেখার জায়গা পাল্টে গেল। বলাকায় কোন মিডডে শো বাদ যেত না প্রায়। ক্লাস, জিমন্যাজিয়ামে হাজিরা, মাঝেমধ্যে মাঠে দৌড়নো, বিদেশি ভাষা শেখা, লাইব্রেরিতে পড়াশুনো, সহপাঠী মোস্তাফার বাড়িতে বসে ওর সযত্নে তৈরি করা নোটস্ পুনর্বিন্যাসকরণ, টিউটরিয়ালের প্রস্তুতি আর বছরে দু'চারবার ঢাকার বাইরে কোথাও গিয়ে কোন মফস্বলের স্কুল বা কলেজে পাসোকা'র পক্ষ থেকে ক্যাম্প বসিয়ে দিন সাতেক স্বেচ্ছাশ্রম দান করে পুকুর খুঁড়ে দেয়া বা ঘর তুলে দেয়ার কাজ করে আসার সঙ্গে সঙ্গে নানাবিষয়ে জ্ঞানার্জনের স্পৃহা ক্রমশঃ বাড়িয়ে তোলার চেষ্টায় কোন কম্তি ছিল না। একথা বলা যায় স্বচ্ছন্দে, আমরা আনন্দে সময় কাটাতাম অঢেল। মনের আকাশে মেঘ জমতে দিতাম না, রোম্যান্টিক ব্রুডিং-কে প্রশ্রয় দেয়ার অবকাশ ছিল না মোটে।

সোসিওলজি'র বন্ধুদের উৎসাহে সেকেন্ড ইয়ারে উঠেই পাসোকা'র সদস্য হয়েছিলাম। বাবলু, মাহ্বুব (বর্তমানে ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর) বলাবলি করত, আমি যেমন ভবঘুরে স্বভাবের — একবার পাসোকার সদস্য হলেই আমার ঘোরাঘুরি অনেকটা নিয়ন্ত্রিত হবে, সুসংগঠিত সমাজসেবার সুযোগ পেয়ে আমি কৃতজ্ঞ থাকব। তা' হয়েছিলাম। তিন-চার বছর পাসোকান হিসেবে বাংলাদেশ — তখনকার পূর্ব পাকিস্তান চষে বেড়িয়েছি। ঘোর শীতে একবার দেশের একেবারে উত্তর-পূর্বের সুনামগঞ্জে পৌঁছে গেছি। সিলেট রেলস্টেশনে নেমে বাড়িতে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছি — পাসোকা'র অভিযানে সুনামগঞ্জ যাচ্ছি। আবার ঢাকার কাছেই সোনারগাঁ গিয়েছি দল বেঁধে। হাইস্কুলে ক্যাম্প করে স্কুলের নতুন উইং তৈরির কাজে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়েছি দিনভর, সন্ধ্যেবেলা ডাল-ভাত-ভর্তা-টমাটোর চাট্নি তৈরি করে হৈচৈ করে খেয়ে, সার সার মাটিতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি। ডেমরায় যেবার টর্নাডো হ'ল — আমরা ছুটে গেছি রিলিফ নিয়ে সেদিনই বিকেলে।

সত্তরে আমরা পাসোকান ক'জন সদরঘাট থেকে রকেট স্টিমারে চড়ে গিয়ে পৌঁছলাম খুলনা। ক্যাম্প করলাম খুলনা কমার্স কলেজে। সুন্দরবন দেখব বলে দক্ষিণে যাত্রা করলাম। রূপসা নদীর ওপর তখন সেতু ছিল না। নৌকায় পার হয়ে ন্যারো গেজ ট্রেনে উঠে বাগেরহাট চললাম। ছোট্ট ট্রেন। সামনের কয়লার এঞ্জিন থেকে প্রচুর কয়লার গুড়োঁ উড়ে এসে আমাদের সর্বাঙ্গে লিপ্ত হচ্ছিল। শুনলাম, স্থানীয় মানুষ কাপড় বদলে এই ট্রেনে উঠে, সফরশেষে নেমে, আবার কাপড় বদলে, হাতমুখের কয়লাগুঁড়ো ধুয়েমুছে গন্তব্যমুখী হন। বাগেরহাটে সেবার ষাটগম্বুজ মসজিদ, খান জাহান আলীর মাজার দেখা হল। ওখান থেকে মংলা সমুদ্র বন্দর। মংলা বন্দর তখনো সেভাবে গড়ে ওঠেনি। আমরা যে যেমন পারলাম, বিলেতি সিগ্রেট আর পানীয় নিলাম। তারপর নৌকো চেপে ওপারে সুন্দরবন দেখতে গেলাম। ওপারে গিয়ে নৌকো পারে ঠেকানোর আগেই অধের্য্য আমি লাফিয়ে কাদার ভেতর পড়তেই কোমর পর্যন্ত অদৃশ্য। আমি আতঙ্কে চেঁচিয়ে সুন্দরবন মাথায় তুলেছি ততক্ষণে। দু'জন মাল্লা চট্ করে আমার ওপরে তোলা দু'হাত ধরে ফেলে প্রাণপনে টেনে নৌকোর পাটাতনে তুলল। আমাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে বলে ওরা বাল্তি বাল্তি জল ছুঁড়ে মারতে লাগল কোমর থেকে নিচে। অবশেষে কাদা ধুয়ে গেলে আমি প্যান্ট গুটিয়ে হাঁটু পর্যন্ত তুললাম। ততক্ষণে মোটা তক্তা দু'টো পাশাপাশি ফেলে আমাদের ডাঙায় নামার পথ করা হয়েছে। আমি দৌড়ে নেমে রিয়ারগার্ড বনরক্ষীর সামনে সিঙ্গল ফাইলে জায়গা করে নিলাম।

ডাঙায় পা দিতেই বুঝে গেলাম, ওখানে 'খাপ খুলতে যাওয়াই' আমার বোকামি হয়েছিল। সুন্দরবন সিলেট বা চিটাগাং-য়ের জঙ্গল নয় মোটেই। এক সেকেন্ডের অমনোযোগে মারাত্মক প্রাণঘাতী ক্ষয়ক্ষতি হয়ে যাবার সমূহ শঙ্কা প্রতি পদক্ষেপেই — কারণ সুন্দরবনে পথ নেই, হাঁটা দুষ্কর। পদে পদে শূলো অর্থাৎ বাদাবনের নানা প্রজাতির গাছের শ্বাসমূল ভেজা মাটি বিদীর্ণ করে উর্ধ্বমুখী। পায়ের তালু যখন-তখন ছেঁদা হয়ে যেতে পারে। অতি সাবধানে ওই উর্ধ্বমুখ মাইনসদৃশ শূলো এড়িয়ে পা না ফেললে। অতএব, বেশিদূর যাওয়া হয়নি আমাদের সেবারে। মিনিট পনেরো নতমুখী হয়ে হেঁটে, টেনশ্যন আর অজানা ভয়ে ঘেমে-নেয়ে আমরা সিঙ্গল ফাইলে, সামনে-পেছনে দুই রাইফেলধারী বনরক্ষী গাইড নিয়ে নৌকোয় উঠে ফিরে এসেছিলাম। না, বাঘের দেখা পাইনি, রক্ষে। বোঁটকা গন্ধ অবশ্য নাকে আঘাত করেছিল কারো কারো, তো সেটা বুনো শূওরেরও হতে পারে। এপারে ফিরে তুমুল গবেষণা চলেছিল তা নিয়ে বহুক্ষণ।

খুলনা থেকে যশোর এসেছিলাম বাসে। এমএম কলেজে ক্যাম্প। বাসভাড়া করে সাগরদাঁড়িতে মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়ি যাওয়া হয়েছিল। যাওয়া আসার পথে দত্তকবির গ্রাম ও আশপাশের জঙ্গুলে বাসিন্দা হনুমান ও বানর দেখেছিলাম, মনে পড়ে। তারপর কুষ্টিয়া এসে শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ি দেখতে গিয়েছিলাম। ওখান থেকে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পেরিয়ে পাবনা পৌঁছে এডওয়ার্ড কলেজে ক্যাম্প করে হেমায়েতপুরে পদ্মার ধারে মানসিক হাসপাতাল দেখতে গিয়েছিলাম। আর গিয়েছিলাম শ্রী অনুকূলচন্দ্র ঠাকুরের আশ্রমে। পাবনা থেকে নাটোর। রানি ভবানীর প্রাসাদ, কিছু দূরে দীঘাপাতিয়ার রাজার বাড়ি দেখা হয়েছিল। পরবর্তী গন্তব্য ছিল বগুড়া। যথারীতি আযিযুল হক কলেজে ক্যাম্প এবং মহাস্থানগড় ভ্রমণ। পরদিন রংপুর পৌঁছে কারমাইকেল কলেজে আস্তানা গেঁড়ে পায়রাবন্দে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের বাড়ি দেখতে গিয়েছিলাম। রংপুর থেকে দিনাজপুর। রামসাগর দেখে অবাক সকলেই। অত প্রকাণ্ড দীঘি তার আগে আর দেখিনি। দিনাজপুর থেকে ট্রেনে ফুলছড়িঘাট, বাহাদুরাবাদ ঘাট হয়ে ময়মনসিংহ হয়ে ঢাকায় এসে নেমেছিলাম। কারো অসুখবিসুখ হয়নি, কোনো অঘটন ঘটেনি, ভাগ্যিস।

কোনোরকম পরিকল্পনা থেকে নয়, এলোমেলো জীবন যাপনের ছন্দেই ছাত্রাবস্থায় ড্রামা সার্কেল এবং ক্রান্তি-র কর্মকাণ্ডে অনায়াসে সম্পৃক্ত হয়েছিলাম। শুরু সম্ভবতঃ ইউনিভার্সিটিতে ঢুকেই — '৬৬ বা '৬৭ সালে — পাসোকা-র বন্ধুদের সৌজন্যেই বেশিরভাগ — প্রধানতঃ মনিরুল আলম বা মনুভাই এবং শফিকুর রহমান বা বুড়োর উৎসাহী ইঙ্গিতে। গণসঙ্গীতে গলা মেলাতে দেশের কত জায়গায় চলে গেছি, শ্রমিক বস্তিতে, যমুনার চরে — খাসিয়া পাহাড়ের নিচে। টিএসসিতে গানের রিহার্সালে, কাগজের ভাঁজে কার্বন গুঁজে সবার জন্য নতুন গানের কপি তৈরিতে মিটু ওস্তাদ ছিল। বলত, 'গানের গলা নেই তো, তোমাদের স্বচ্ছন্দে গাওয়ার সুবিধেটুকু অন্তঃত করে দিই।' কতরাত এখানে-ওখানে, মনুভাইয়ের আস্তানায় কিংবা কেনেডি-মাহবুবদের পল্টনের বাড়িতে আড্ডা দিয়ে, গান গেয়ে কেটেছে, তার ইয়ত্তা নেই। শহীদ আলতাফ মাহমুদের বাসায়, লিনু বিল্লাহ্দের বাড়িতে, এইচবিএফসি-র পেছনের বাড়িতে, টিএসসি-তে গান আর নাটকের রিহার্সাল চলত। বড়ভাই অর্থাৎ আমাদের সিনিয়রদের অনেকে তখন নানা পেশায় ঢুকে গেছেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রাজনীতিতে হাত পাকাচ্ছেন, মাহবুব জামিল ফিলিপ্স-এ কর্মরত, বাচ্চু ভাই ব্যবসা শুরু করেছেন, কেবল শামীম ভাই, আব্দুল্লাহ্ ভাই আমাদের সঙ্গ দিচ্ছেন আর পাশ করার পর ক'বছর ভবসংসার ঘুরেফিরে দেখা অবশ্যকর্তব্য — সে বিষয়ে নিরন্তর জ্ঞানদান করছেন।

দেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড তখন বাম-ডান নানা দিকনির্দেশনা ঘুচিয়ে ক্রমশঃ একমুখী স্বাদেশিকতায় পুনরুজ্জীবিত এবং একীভূত হয়ে উঠছে। আমরাও 'চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান' আপ্তবাক্য তখনকার মতো তুলে রেখে আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের জন্য সরকারের ওপর চাপসৃষ্টির মোর্চায় যোগ দিয়েছি। ক্লাস নিয়মিত না হওয়ায় পড়াশোনা তেমন হচ্ছে না ভেবে আমার অভিভাবকেরা পরামর্শ করে আমাকে সিলেটে কুটিমামার ওখানে পাঠিয়ে দিলেন, বইপত্তর সঙ্গে। রোজার মাস চলছে। আমি, কুটিমামানী আর সিরাজ মামা চুটিয়ে রোজার উপবাসের সঙ্গে নামাজ, আড্ডা আর সেহরির পর সকাল পর্যন্ত কোরান পড়ার উৎসবে মেতে উঠলাম। সেবার আমার পিকটালের ইংরেজি অনুবাদে কোরান পড়া হল বেশ। ছেলেবেলায় মা বাড়িতে আরবি শেখানোর চেষ্টা করেছিলেন। আমার চারভাইবোনের কোরান পড়া হয়েছিল, কোনো কারণে আমার হয়নি। উনিশ-কুড়িতে হল। তাই সই। পরবর্তী জীবনে ঐ পাঠ পেশাদারি জীবনে কখনো-সখনো বেশ কাজে লেগেছে। যেমন সুরা বাকারায় শিশুদের মায়ের বুকের দুধ পান করানোর বিষয়ে যে নির্দেশনা-পরামর্শ দেয়া হয়েছে, সেটা ইউনিসেফের 'ব্রেস্টফিডিং প্রমোশ্যন ক্যামপেইনে' তথ্য পরামর্শকের ভূমিকা কার্যকরীভাবে পালনে আমাকে বেশ সাহায্য করেছিল ১৯৯০-এ।

সিলেট থেকে একসময়ে ঢাকায় ফিরতে হল। আবার মেতে উঠলাম '৬৯ সালের গণআন্দোলনে। তখন অত্যন্ত অস্থির টালমাটাল সময় কেটেছে। একসময় সারাদেশের সবাই আগরতলা মামলার গতিপ্রকৃতি বুঝতে আগ্রহী হয়ে উঠল। আমরা কজন কলাভবনের সামনের বটতলায় অনশনে ব্রতী হলাম। আগরতলা মামলা তুলে নেয়া হল। ছাত্রজনতার প্রথম বিজয়। অনার্স পরীক্ষা এসে গেল। ফ্রেঞ্চ সার্টিফিকেট পরীক্ষাও। পরীক্ষার মাঝেই লর্ড জিম ছবি এল মধুমিতায়। কনর‌্যাডের উপন্যাস রাত জেগে পড়ছি। পরদিন ছবিটা দেখব। টিকেট কাটা হয়েছে অগ্রিম। বাবা রাত জেগে রেডিও শুনছেন। চাঁদে নাকি মানুষ নামছে। ভয়েস অব আমেরিকা আর বিবিসি ২৪ ঘণ্টা মানুষকে উৎসাহী করে রেখেছে। চাঁদে মানুষ নামল। আমারও লর্ড জিম পড়া শেষ হল। বাবা, আমি ঘুমোতে গেলাম।

চলবে

ছবি: মুস্তাফিজ মামুন