স্মৃতি, মিথ ও তরুণ ঘোষের চিত্রকলা

ashraful_shawan
Published : 12 Dec 2008, 06:16 AM
Updated : 12 Dec 2008, 06:16 AM

অনেকক্ষণ গল্প করার সময় হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, কী ব্যাপার আপনি চুপ করে আছেন কেন — মানে আপনি মনে করতে থাকবেন, ভাবতে থাকবেন। তরুণ ঘোষের কর্ম একভাবে বিক্রিয়া করে। তাকে একটা ভ্রমণের মধ্যে আবিষ্কার করা যায়। তরুণ ঘোষ বললেন, 'আর্টিস্ট আসলে প্রতিটি মানুষ। কেউ শিল্পকে ধারণ করতে পারে কেউ পারে না। কেউ ক্রিয়া করতে পারে, কেউ পারে না।'

…..
তরুণ ঘোষ
……
তরুণ ঘোষ কোনো কাহিনী আঁকার চেষ্টা করেননি, এঁকেছেন অনুভূতি। প্রতিদিন খাদ্য বিপাকের মতো মানুষের মধ্যে ক্রিয়াশীল হাজার হাজার মিস্ট্রি। শৈশবের বয়ে চলা নদীটাই স্মৃতির প্রতীক। তার ভিতর ডুব দেয়ার অনুভূতিটাই একটা রিফ্লেকশন। তারপর ক্রমাগত সংঘর্ষ বাঁধছে ঘোরের মধ্যে। খেলা চলছে। মায়ার রংরূপ বেদনা তামাশার ভেতর আবিষ্কারের তাড়না। ১৯৭১-কে মেট্রিকের ছাত্র তরুণ যে ভঙ্গিতে প্রত্যক্ষ করেছেন — 'এই মুহূর্তে একজন মারা যাচ্ছে একজন বেঁচে যাচ্ছে চারপাশ থেকে নানান খবর আসছে।' মুক্তিযুদ্ধকে ফেলে আসা নানা বিষয়ের অনুভূতিতে এঁকেছেন। দৃষ্টির অস্থিরতা নামে সেই সিরিজের একটি কাজ '১৯৭১-১'।


১৯৭১ – ১, কাগজে কলম, ২৫ সেমি x ১৩.৫ সেমি। ১৯৮২।

কাজটি করেছেন ১৯৮২ সালে ভারতের বরোদায় মাস্টার্স পড়বার সময়। সে সময় এই সিরিজের বড় বড় অনেক কাজ তিনি করেছেন। সিরিজ-৭১-এ প্রকাশভঙ্গির অস্থিরতা ফর্মের গতিশীল বিন্যাস চোখে পড়ে আর মুখগুলো নানান ভঙ্গিতে লেপ্টে থাকে। যেন ফিসফাস শোনা যায় আবার সিসিফাসের গড়িয়ে পড়া পাথরখণ্ড মনে হয়। ক্যানভাসে চোখ ঘুরতে থাকে। ওই বয়সে শিল্পীর মনে মাধ্যম ও বিষয় নিয়ে নানানভাবে শিল্পচর্চার যে ডিসকার্সন চলে তাতে মুক্তিযুদ্ধের অনুভূতি সোশিও পলিটিক্যাল একটি চেতনাকেই বহন করে। তরুণ ঘোষ বলেন, "জীবনেরও তো অনেক অনুভূতি আছে। সেগুলোও তো আঁকতে চাই। সেগুলো কীভাবে আঁকবো, সেগুলো আঁকার ভাষাটা কী হবে। ছোটবেলায় দেখা সেই লোকজ পুতুল, পাল পাড়ায় দেখা সেই রং আমাকে নাড়া দেয়। তাই ছোটবেলাকেই খোঁজা। দুয়ারের কাছে বাটিতে লাল, নীল, সবুজ রংগুলো থাকতো — আমাকে এখনো ভাবায়। হ্যাজাক লাইটে রং বার্নিশের গন্ধ এখনো জীবন্ত মনে হয়। পাঁচালী অনুষ্ঠান দেখেছি, কাহিনী শুনেছি। ভিস্যুয়ালি পটচিত্র দেখেছি। ছোটবেলা থেকে অনেক মিস্ট্রি আমি উদ্ধার করলাম। এইভাবে লোকশিল্প আর বেহুলাকে নিয়ে কাজ শুরু হল। বরোদায় থিসিসের বিষয়ও নিলাম 'বাংলাদেশের লোকশিল্প'।"

৭১ বা বেহুলা সিরিজের বড় বড় চিত্রপট থেকে ক্রমে শিল্পী নিমগ্ন হয়েছেন আরো বহুবিধ বিষয় ও অনুভূতি নিয়ে। বিহেভিয়ার অব বার্ডস, পোর্ট্রেট, নেচার এসব নিয়ে করেছেন দীর্ঘ সিরিজ। প্রদর্শনীতে নেচার সিরিজের ছোট ছোট অনেকগুলো কাজ দেখা গেল। এর বাইরে নানান ইমেজ অনুভূতি নানান মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কখনো তা ড্রয়িং, কখনো পেইন্টিং, কখনো বা ছাপচিত্রের আদল, কখনো ভাষ্কর্য বা ইন্সটলেশন হয়ে গেছে। তরুণ ঘোষের কাজের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো ছবি আঁকার মাধ্যম ও প্রয়োগ। আপনার মনে হবে মিডিয়া কোনো ফ্যাক্টর নয়, নিয়ন্ত্রণটাই ফ্যাক্টর। মিডিয়া নিয়ে কোনো পরিকল্পনা হয়তো থাকে না, কিন্তু ব্যাপক অ্যারেঞ্জমেন্ট থাকে; তাই বাদ পড়ে না হাতের কাছের কোনো উপাদান। রাংতা কাগজ, লিকার, সিগারেটের অ্যাশ, পুরনো কাগজ, কাগজে ছাপানো ইমেজ, ধূলাবালি কিংবা টুকরো-টাকরা বিভিন্ন বস্তু, বস্তুর ফর্ম। কলম, কালি, তুলি, তুলিতে জলরং, তেলরং অ্যাক্রেলিক, প্যাস্টেল, পেনসিল। কখনো কাগজ ক্যানভাস বদলে চলে এসেছে প্যানাফ্ল্যাক্সের শিট। পুরনো টাইপ রাইটারের সাথে সাইকেলের হ্যান্ডেল যুক্ত করে অদ্ভুত এক বাহন তৈরি করেছেন যা গতির প্রতীক কিন্তু স্থির। আরো এমন অনেক কিছু যা নিয়ত সন্ধানী চোখে চিমটি কাটে, থমকে যায়, অনবরত ভাবায়। তরুণ ঘোষ সেসব দিয়ে তার জগত সাজিয়েছেন। ক্রমাগত আবিষ্কারের ডুব। নিজের ভেতর ডুব দিয়ে ভেসে ওঠা, অথবা ভেসে ভেসে মিলিয়ে যাওয়া। জন্মাবধি মায়ার ভেতর ডুবে থাকা। ভেতর ও বাইরের রহস্যের ভাঁজে শিল্পী বিমূর্ত ইমেজগুলো আঁকার চেষ্টা করেছেন, খোঁজার চেষ্টা করেছেন। আনন্দসংকুল ভীতি, আবার সাহসিকতার অনুভূতি, মিশ্র অনুভূতি, বেদনা প্রশান্তি আবার দ্বন্দ্বের অনুভূতি।


ছিন্নপত্র, ক্যানভাসে মিশ্র মাধ্যম। ১৯১ সেমি x ১৬৮ সেমি। ২০০৮।

তরুণ ঘোষের কাজে আরোপিত কৌশল আর কচলানি নেই। কেউ হয়তো খুঁজে পাবেন দারিদ্র কিন্তু আবিষ্কারের চমক আছে। 'ছিন্নপত্র' ১৯১ সেমি x ১৬৮ সেমি একটি ক্যানভাস। মনে পড়লো ভূর্জ্যপত্রের কথা। একটি মৃত কাগজ — যখন এটা নষ্ট হয়ে যায়। ডাবল রাইটিং অনেক সময় ঝাপসা হয়ে আসে। কেমন যেন একটা রং আবার একটা দুইটা শব্দ পাওয়া যায়, কিছু মৃত শব্দ অক্ষর। ক্ষত আছে অনেক জায়গায়, পুরনো কিছু প্রতিধ্বনী। তারপর বেহুলাকে দেখি — শিল্পী এই মেয়েটিকে আবিষ্কার করেন যার ভেতর একটি স্যাক্রিফাইসিং বিষয় আছে। ভালবাসার জন্য যে একটা মৃতদেহকে আকঁড়ে ধরে জীপন পন করেছিল। এক অনিশ্চিত ভ্রমণ অজানায়। সফল হয়েছিল বেহুলা।


বেহুলা সিরিজ – ২১। কাগজে অ্যাক্রেলিক। ২০ সেমি x ২৭.৫ সেমি। ২০০০।

'ঢের ছবি দেখা হল — ঢের দিন কেটে গেল — ঢের অভিজ্ঞতা
জীবনে জড়িত হয়ে গেল, তবু, নক্ষত্রের রাত্রের মতন
সফলতা মানুষের দুরবীণে রয়ে গেছে — জ্যোতির্গ্রন্থে'

তরুণ ঘোষ কোনো জ্যোতির্ময় সফলতার জন্য বৈতরণীর খেয়ায় পাড়ি জমান নি — এ এক রহস্যের গল্প, যাদুবাস্তবতার ঘোর। "আমি যখন কোনো পোড়োবাড়িতে গেছি, শুনেছি জমিদারবাড়ি ছিল। বাড়িটার মধ্যে বটগাছ জীবন্ত হয়ে উঠেছে। বটগাছ বাড়িটাকে ধরে রেখেছে। বটগাছ শুরু হল, শুরু হল উঠোন, শুরু হল আঙিনা, শুরু হল করিডোর। শুরু হল বিভিন্ন রূপ, বিভিন্ন জানালা, জানালাগুলো ভাঙা। তখন ঐ আঙিনায় নিজে নিজে ভাবতাম, আরে এই জায়গাটা মনে হয় আমি দেখেছি। নতুন বাড়ি মনে হত, মনে হত জমিদারীটা দেখছি। সিঁড়িটাকে দেখে শিউরে উঠতাম। ওটাকে সরাতে গিয়ে সাপ দেখেছি কালো কুচকুচে। আমার কাছে এগুলো খুব মিষ্ট্রি মনে হত।"

উত্তরার গ্যালারি কায়ায় সম্প্রতি আয়োজিত 'মিথ, মেমরি অ্যান্ড মাদারল্যান্ড' প্রদশর্নী বিষয়ে