ভাষাবিজ্ঞানী ড. মনিরুজ্জামান-এর সাক্ষাৎকার

ehsanul_kabir
Published : 14 Dec 2008, 07:17 AM
Updated : 14 Dec 2008, 07:17 AM


ড. মনিরুজ্জামান (জন্ম. নারায়ণগঞ্জ ১৫/২/১৯৪০)

ভাষাবিজ্ঞানী ড. মনিরুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে ১৯৬০ সালে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৬১ সালে স্নাতকোত্তর পাশ করেন। ভাষাবিজ্ঞানে পিএইচডি করেন ভারতের মাইশুর বিশ্ববিদ্যালয় হতে। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের সদ্যঅবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। কর্মজীবনের নানা সময়ে নজরুল ইনস্টিটিউটের পরিচালক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সভাপতি এবং কলা অনুষদের ডিন ছিলেন। তিনি 'লিঙ্গুইস্টিক সোসাইটি অভ ইন্ডিয়া',' দ্রাবিড়িয়ান লিঙ্গুইস্টিক এসোসিয়েশান', 'ফিলোলজিক্যাল এসোসিয়েশান অভ গ্রেট ব্রিটেন' সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা সংস্থা ও সংঘের জীবনসদস্য। ভাষা, সাহিত্য ও ফোকলোর বিষয়ে এযাবৎ তাঁর ২৭টি বই এবং শতাধিক গবেষণা-প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।একাধিক সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ভাষা, সাহিত্য, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি নিয়ে তাঁর সাথে কথা বলেন এহসানুল কবির।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: এহসানুল কবির

এহসানুল কবির: আপনার শৈশব ও বেড়ে ওঠার কথা দিয়ে শুরু করি।

মনিরুজ্জামান: আমার জন্ম সম্পর্কে আমার দাদাকে নিয়ে একটা মিথ আছে। উনি খুব স্পিরিচুয়াল লোক ছিলেন। আমার মায়ের কোনো পুত্রসন্তান বাঁচত না। পরপর দুটো পুত্র মারা যাওয়াতে আমার দাদা নাকি আল্লাহ্র কাছে দোয়া করলেন, 'আমাকে নিয়ে যাও, আমার ছেলেকে পুত্রসন্তান দাও।' দাদা মারা যাওয়ার পর আমার বড় ভাই হলেন, উনি বাঁচলেন। এরপর আমি হলাম (১৯৪০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি)। আমার পরিবারের সবার বিশ্বাস, দাদার ঐ দোয়ার কারণেই আমার বড়ভাই আর আমি বেঁচে যাই। আমার বাবা ছিলেন পুলিশ অফিসার, দারোগা। তৎকালীন চব্বিশ পরগনা জেলার অন্তর্গত ঝিনাইদহে কর্মরত ছিলেন। ওখানেই আমার জন্ম। প্রথমে নৈহাটি, পরে বরানগর, এরপর চব্বিশ পরগনার নামকরা স্কুল ডায়মন্ড হারবারে আমার পড়াশোনা। ৪৭-এর দেশভাগের সময় চলে আসি পৈত্রিক গ্রাম আদিয়াবাদে।
—————————————————————–
এটা ['পূর্ববঙ্গের ভাষা'] একটা লিংগুইস্টিক ক্যায়োস ছাড়া আর কিছুই না। এর জন্মটাই একটা প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থান থেকে। উনবিংশ শতকে মান বাংলা প্রণয়ন ও প্রচারের ক্ষেত্রে সাহিত্যকে ভিত্তি ও মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। আর এখন যে-ভাষারীতি প্রচলনের কথা বলা হচ্ছে সেটা করা হচ্ছে বিনোদন-মাধ্যমকে ব্যবহার করে। এর মাধ্যমে আদৌ মানসম্পন্ন সাহিত্যসৃষ্টি সম্ভব কিনা এ-বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। যা দেখতে পাচ্ছি তাতে অযোগ্যের হাতে পড়ে ক্রমাগত অবক্ষয়ের দিকেই এটা যাবে। আমার তো মনে হয় না এর সঙ্গে সত্যিকারের সাহিত্যিকেরা থাকবেন, শিক্ষকেরা থাকবেন। সাহিত্যিক আর শিক্ষকদেরকে বাদ দিলে একটা জাতির আর থাকে কী?
—————————————————————-
আদিয়াবাদ তখন ঢাকা জেলার অন্তর্গত, এখন নরসিংদি জেলায়। দেশে এসে গ্রামের স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হই। দেশে আসতে আমাদের খুব সমস্যায় পড়তে হয়। কারণ স্বরাজ আন্দোলনের কর্মীদেরকে — সরকারের ভাষায় 'ডাকাত' — সাহায্য করার কারণে আর শাহাদাৎ হোসেন, নজরুল ইসলাম এদের সঙ্গে বন্ধুত্বের কারণে আমার বাবা পাকিস্তান সরকারের রোষাণলে পড়েন। আমার বড়ভাই এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারেন নি। দাদা কেন মারা গেলেন, বাবার ওপর কেন এত টর্চার — এসব বলতে বলতেই তো উনি মারা গেলেন। আমার ছোটবোনের মৃত্যুটাও খুব করুণ। দেশে ফেরার পথে পানি খেতে চাইলে লোকজন তাকে ডাব এনে দেয়। সে তখন প্রেগন্যান্ট। পানিটা অল্প খাওয়ার পরেই বুঝতে পেরেছিল ওটাতে বিষ মিশানো। বেশি খায় নি, কিন্তু যেটুকু খেয়েছিল সেটা স্লো পয়জনিঙের কাজ করেছিল। বাচ্চাটা হওয়ার পরই সে মারা যায়। অসাধারণ সুন্দরী ছিল। কাননদেবীর সঙ্গে তার খুব ভালো যোগাযোগ ছিল। তার কারণেই কাননদেবী একবার আমাদের বাড়িতে আসেন, জহর গাঙ্গুলীকে নিয়ে। এসব কারণে বুঝতে পারি, আমাদের পরিবারটা তখন থেকেই এনলাইটেন্ড ছিল। এই যে বিভিন্ন সাহিত্যিকদের সঙ্গে বাবার সংযোগ, এটা তো কোনো পুলিশের দারোগার ক্ষেত্রে হওয়ার কথা না। বাবা খুব ভালো সাহিত্যবোদ্ধা ছিলেন।

এ ক: সাহিত্যে হাতেখড়িটা কখন কীভাবে হলো?

মনিরুজ্জামান: দেশভাগের কারণে হিন্দু টিচাররা ভারত চলে যাওয়াতে আমাদের স্কুলটা প্রায় শিক্ষকশূন্য হয়ে পড়েছিল। পাশের স্কুলের (পিটিআই) শিক্ষকেরা পার্ট টাইম আমাদের স্কুলে পড়াতেন। ওখানকার একজন ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন অসম্ভব ভালো ইংরেজি পড়াতেন। তাঁর বাচনভঙ্গি, পড়ানোর স্টাইল এসব আমাকে অসম্ভব মুগ্ধ করে। তিনি খুব সাহিত্যমনা ছিলেন। সাহিত্যসভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এসবের আয়োজন করতেন। আমি ওসব অনুষ্ঠানে অংশ নিতাম। ছড়া লিখতাম, নাটকেও অভিনয় করেছি। পরের বছর একজন বিএসসি টিচার এসেছিলেন। উনিও খুব সাহিত্যমনা ছিলেন। লিয়াকত আলীর মৃত্যুতে একটা শোকসভার আয়োজন করেছিলেন। ঐ সভা উপলক্ষে আমি একটা প্রবন্ধ লিখি এবং সভাতে সেটা পাঠ করি। আমার মনে আছে, ঐ প্রবন্ধটার প্রশংসা কেউ করল না, সবাই সমালোচনা করল। ওরা সবাই তো খুব পাকিস্তানপন্থি ছিল, আমার লেখায় সম্ভবত আমি বাংলাদেশের কথা একটু বেশি বলে ফেলেছিলাম, যেজন্য আমি খুব বিতর্কিত লেখক হয়ে গেলাম, ক্লাস এইটে থাকার সময়ই।

এ ক: এ তো গেল স্কুলের কথা। এরপরতো নটরডেম কলেজে পড়লেন। ওখানে কাদের সান্নিধ্যে আসলেন?

মনিরুজ্জামান: নটরডেম কলেজের নাম তখন ছিল 'সেন্ট গ্রেগরি কলেজ'। ফাদার হেরিংটন তখন প্রিন্সিপাল ছিলেন। ওনাকে আমার খুব ভালো লাগত। ফাদার মার্টিনের নামটা হয়েছে বেশি, কিন্তু হেরিংটনের পাণ্ডিত্যটা ছিল বেশি। আমি উনার সান্নিধ্য পেয়েছি। বাংলার টিচার কলেজ বার্ষিকীতে সবার একটা করে লেখা নিলেও আমার লেখা নিলেন দুটো। আফসার উদ্দিন স্যার আমাকে বাংলা পড়ার জন্য উৎসাহিত করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আমি অন্য কোনো বিষয়ে পরীক্ষাই দিই নি। বাংলা বিভাগেই পরীক্ষা দিয়েছি, সেখানেই ভর্তি হয়েছি।

এ ক: পরিবারের দিক থেকে কার অনুপ্রেরণা সবচেয়ে বেশি ছিল?

মনিরুজ্জামান: আমার পড়াশোনায় সবচেয়ে বেশি যার অবদান তিনি আমার ভগ্নিপতি এম এ তাহের। উনি জিওগ্রাফির মাস্টার্স ছিলেন, কিন্তু উনার সাহিত্যবোধ ছিল অসাধারণ। স্টেটসম্যান পত্রিকায় গল্প কবিতা লিখতেন। এসবের অবশ্য কোনো বই উনি করে যান নি। জিওগ্রাফির বই লিখেছিলেন। উনি মুসলিম লীগ করতেন, কিন্তু মজার ব্যাপার হলো প্রগতিশীল সাহিত্যের প্রতি আমাকে প্রথম উনিই আকৃষ্ট করেছিলেন। সুকান্ত, মানিক এদের ব্যাপারে উনার কাছ থেকেই জেনেছিলাম। এমনকি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মারা যাওয়ার পর স্কুলে উনি শোকসভার আয়োজন করেছিলেন। বন্ধুদের কারণে ও অন্যান্য পারিপার্শ্বিক কারণে মুসলিম লীগ করলেও মুক্তবুদ্ধি বলতে যা বোঝায় সেটার চর্চা তার মধ্যে ছিল। এমনকি নামাজ-রোজার ব্যাপারেও উনার অন্যরকম বক্তব্য ছিল। খুবই সংস্কৃতিমনা ছিলেন। অভিনয় করতেন, নাচ শিখেছিলেন খুব ভালো। বুলবুল চৌধুরীর সঙ্গে উনার খুব প্রতিযোগিতা ছিল নাচে। দেবদাস ছবিতেও অভিনয় করার কথা ছিল, মুসলমান বলে উনাকে বাদ দেওয়া হয়। যাকে বলে সত্যিকারের ভার্সেটাইল, উনি তাই ছিলেন। রাবার চাষের ব্যাপারে সর্বপ্রথম পাকিস্তান সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন উনি। পাট চাষের ভবিষ্যৎ কী হবে এটা নিয়ে মর্নিং নিউজ-এ অনেকগুলো আর্টিকেল লিখেছিলেন। বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারেও লেখালেখি করেছেন। শেষ দিকে টি বোর্ডের সদস্য হয়েছিলেন। যখন দেখলেন বিদেশিরা কী বলে সেটাই নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে গুরুত্ব পাচ্ছে, তখন সদস্যপদ ছেড়ে দেন।

এ ক: আপনার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন ও সাহিত্যচর্চা সম্পর্কে বলুন।

মনিরুজ্জামান: বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম ৫৭-এ। আমি, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, মনজুরে মওলা, আতাউল হক এদেরকে নিয়ে আমাদের একটা গ্র"প ছিলো 'নীরব সঙ্ঘ' নামে। মাঠের এক কোণায় সেই 'নীরব সঙ্ঘে'র সভা বসত। ঐ কোণা থেকে আবার মেয়েদের কমন রুম দেখা যেত। মেয়েরা ঠাট্টা করে ঐ কর্নারের নাম দিয়েছিল 'ইডিয়টস কর্নার'। আমরাও নামটা মেনে নিয়েছিলাম। তখন ডাকসু ও অন্যান্য সাহিত্য সংগঠনের উদ্যোগে সাহিত্যসভা হত। সেখানে বড় বড় সাহিত্যিকরা আসতেন। সুফিয়া কামাল এসেছিলেন, মাহ্মুদা খাতুন সিদ্দিকা এসেছিলেন। কবিতা প্রতিযোগিতায় আমি পরপর দুবছর প্রথম পুরস্কার পাই। গাফ্ফার চৌধুরী, শওকত আলী, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, মমতাজউদ্দীন আহমদ এরা আমাদের সিনিয়র গ্র"প ছিলেন। মাঝে মাঝে উনাদের সঙ্গেও আড্ডা হতো। সওগাত, উত্তরণ, সমকাল, কাফেলা — প্রায় সব পত্রিকাতেই তখন আমার লেখা বেরোচ্ছে।

এ ক: আপনার সহপাঠিনীদের মধ্যে লেখালিখি করতেন বা পরবর্তী কালে নাম করেছেন এমন কেউ ছিলেন না?

মনিরুজ্জামান: হ্যাঁ, নাজমা জেসমিন চৌধুরী আমাদের সহপাঠিনী ছিলেন। রফিকুন্নেসা পারুল বলে একজন ছিল, অল্পবয়স থেকেই খুব ভালো ছড়া লিখত, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগেই আমি ওর ছড়া নানা পত্রিকায় পড়েছি। পরে অবশ্য তার লেখা চোখে পড়ে নি।

এ ক: সাহিত্য থেকে ভাষাবিজ্ঞানের দিকে ঝুঁকলেন কখন, কীভাবে?

মনিরুজ্জামান: এটা পুরোপুরিই ধ্বনিবিজ্ঞানী আবদুল হাই সাহেবের কারণে। তখন তো ভাষাবিজ্ঞানের তেমন কোনো বই-ই ছিল না। কিন্তু হাই সাহেবের ক্লাস করার পর আর বইয়ের দরকার হত না। চট্টগ্রাম কলেজে শিক্ষক হিসাবে যোগ দেওয়ার পরে তখনকার প্রিন্সিপাল আবদার রশীদ সাহেব আমাকে বললেন ভাষাবিজ্ঞান অংশটা পড়াতে। তখনই আমি ভাষাবিজ্ঞানের নানান বিষয়ে ভাবতে ও লিখতে শুরু করি। পরে লেখাগুলো জড়ো করে ভাষা সমস্যা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ বইটা বের করলাম। এ-বইয়ের ভূমিকা লিখেছিলেন আবুল ফজল। ভাষাবিজ্ঞানে আমার পড়াশোনা তখনও তেমন বিস্তৃত হয় নি। আসল পড়াশোনাটা হল যখন আমি পিএইচডি করতে যাই মহীশূরে।

এ ক: ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত উপভাষা চর্চার ভূমিকা বইয়ের প্রাক কথনে আপনি লিখছেন, 'আবদুল হাই এর পরে আর কোনও উদ্যোগই সেখানে কোনও তাৎপর্য বহন করে নি। ভাষা চলেছে তার আপন স্রোতের টানে; নীরব অভিমানে।' এ-অভিমান কেটে যাওয়ার মতো কোনো কাজ আজ পর্যন্তও কি হয়েছে? হয়ে থাকলে কাদের কাজ গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনি মনে করেন?

মনিরুজ্জামান: আসলে সমালোচনা করতে গেলে অনেক কিছুই বলার থাকে। বিশ্বের মানে বিচার করতে গেলে তেমন কোনো কাজই হয় নি। আবার আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বিচার করলে কিছু যে একেবারে হয় নি তাও নয়। মনসুর মুসা, দানিউল হক, রাজীব হুমায়ুন, আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ, হুমায়ুন আজাদ এঁরা কিছু কাজ করেছেন, আমি করেছি। কিন্তু, ওঁরা সবাই টেক্সট বই লেখার দিকে গেছে। মনসুর মুসা ব্যতিক্রম, রাজীব হুমায়ুনও কিছুটা ব্যতিক্রম। কিন্তু আমি যেরকম ভাষাবিজ্ঞানের সবগুলো দিকে গেছি, এঁরা সেরকমটা যান নি।

এ ক: হ্যাঁ, আপনি ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্বে পিএইচডি করলেন, উপভাষা বিষয়ে মৌলিক গবেষণাগ্রন্থ লিখলেন, আবার কবিতার ভাষার মতো বিষয়েও অত্যন্ত গভীর ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণী প্রবন্ধ লিখলেন, 'পান্থজনের ভাষা' নিয়ে লিখলেন, ভাষায় 'কালার কোড' নিয়ে লিখলেন, এমনকি তোতলানোর ভাষার গঠন নিয়ে লিখলেন — ভাষাচর্চায় একইসঙ্গে এত বিস্তৃত ও গভীর বিচরণ, সেরকমটি কেন আর কারও ক্ষেত্রেই আমরা পেলাম না?

মনিরুজ্জামান: আসলে আমার প্রিপারেশনটাও অন্যরকম ছিল। আমি একাধিক সামার স্কুল অ্যাটেন্ড করেছি, হাইয়ার সামার স্কুল অ্যাটেন্ড করেছি, লন্ডনে দিল্লিতে মহীশূরে হায়াদ্রাবাদে মাদ্রাজে বিশ্বের নানা জায়গায় আমি পেপার পড়েছি। এসবের জন্য আমাকে প্রচুর খাটতে হয়েছে, কাজ করতে হয়েছে। আমার তত্ত্বাবধায়ক পদ্মশ্রী ডি পি পট্টনায়কের কাছে যে-ট্রেনিংটা আমি পেয়েছি সেটার তো কোনো তুলনা হয় না। সেই তুলনায় বলতে গেলে আমি কোনো কাজই এখনো করতে পারি নি। আর এইসব বিষয়ে কাজ করার মতো পরিবেশও এখানে নেই। আমার পিএইচডি থিসিসটা পর্যন্ত এখনও কেউ প্রকাশ করতে রাজি হয় নি। আমার অনেক লেখাই তো গ্রন্থভুক্ত হয় নি। এই যে ওরা টেক্সট বই লিখছে, সেটা অকারণ নয়। ওরা দেখেছে টেক্সট বইয়েরই প্রকাশক পাওয়া যায়, গবেষণামূলক বই ছাপানোর লোক নেই।

এ ক: হুমায়ুন আজাদও তো দুটো টেক্সট বই লিখেছেন — তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান আর অর্থবিজ্ঞান। ভাষাতত্ত্বে উনার মৌলিক কাজ বলতে এক বাক্যতত্ত্বই। এটাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?

মনিরুজ্জামান: এটাও ঠিক মৌলিক গবেষণা নয়। হয়তো তাঁর পরিকল্পনা ছিল আরও কাজ করার। তিনি বারো-তেরো খণ্ডে একটা বই লেখার কথা ভেবেছিলেন, কিন্তু সেটা করে যেতে পারেন নি। বাংলা একাডেমী তার পরিকল্পনাটা গ্রহণ করে নি। সেটা না হয় হল না, কিন্তু আমি মনে করি ছোট করে হলেও তাঁর কিছু একটা করে যাওয়া উচিত ছিল এই লাইনে। বাক্যতত্ত্ব বইটা আসলে এ-বিষয়ে একটা ভূমিকাই।

এ ক: আপনি তো দীর্ঘদিন পশ্চিমবঙ্গে ছিলেন, গবেষণাকাজ করেছেন এবং আমরা জানি আপনি তরুণতম লেখকটিরও লেখাপত্রের খোঁজ রাখার চেষ্টা করেন। তো, দুই বাংলার সাহিত্য ও ভাষাচর্চা সম্পর্কে আপনার তুলনামূলক মূল্যায়ন কী?

মনিরুজ্জামান: ভাষার দিকে টানটা বেশি ছিল বলে সাহিত্যের খুব গভীরে যাওয়ার সুযোগ আমার হয় নি। আর ভাষাচর্চা বিষয়ে বলতে গেলে পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় আমরা অনেকখানি পিছিয়ে আছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ত্ব বিভাগ খোলার পরে কিছু কাজ হচ্ছে। অনেকেই বাইরের খবরাখবর রাখেন। আর ভাষা ইনস্টিটিউটে যারা আছেন তারাও কিছু কাজ করছেন। পশ্চিমবঙ্গের পবিত্র সরকার, প্রবাল দাশগুপ্ত, উদয়নারায়ণ সিংহ এঁদের তুলনায় আমাদের এখানকার কাজগুলো বেশ সাধারণ মানের। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগটা আরও অনেক ফ্রিকোয়েন্ট হওয়া দরকার।

এ ক: আপনার সর্বশেষ যে-বইটা বেরিয়েছে সেটা গোষ্ঠীপত্রিকা বিষয়ে। এর আগে দুটো কবিতার বই বেরোলো। ভাষাবিজ্ঞানে আপনি এখন কী কাজ করছেন বা এ-বিষয়ে আপনার নতুন কিছু করার পরিকল্পনা আছে?

মনিরুজ্জামান: হ্যাঁ, ভাষা পরিবর্তন, উপভাষা ও উপজাতীয় ভাষা নিয়ে মৌলিক কিছু কাজ এখন হাতে আছে।

এ ক: আমরা জানি, শিক্ষাব্যবস্থা বিষয়ে আপনার দীর্ঘদিনের কিছু চিন্তাভাবনা আছে। আপনার গ্রামের বাড়িতে একটা বিদ্যালয়ও স্থাপন করেছিলেন একসময়। এ-বিষয়ে এখন কী ভাবছেন?

মনিরুজ্জামান: হ্যাঁ, গ্রামে স্কুল করেছিলাম। এখানেও ইউনেস্কোর সিইউআরডিপি (চিটাগাং ইউভার্সিটি রুরাল ডেভেলাপমেন্ট প্রজেক্ট)-তে আমি এজুকেশান ডেভেলাপমেন্ট উইং-এ দায়িত্বে ছিলাম। ওখানে মইনুদ্দিন সাহেব ছিলেন প্রোডাকশন উইং-এ আর ইউনূস ছিলেন গ্রামীণ পদ্ধতি উইং-এ। সেখানে আমি নতুন কিছু মেথডও আবিষ্কার করি, যেগুলো পরে গ্রামীণ ব্যাংক পদ্ধতি চালুর ক্ষেত্রে ইউনূসের কাজে লেগেছিল। একসময় আমি পিএইচডি করতে চলে গেলাম, মইনুদ্দিন সাহেবও চলে গেলেন, শুধু ইউনূসই থাকলেন। পরে পুরো প্রজেক্টটা ব্যাংকিংয়ের দিকেই চলে গেল।

এ ক: আমাদের দেশে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাব্যবস্থা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। এ-সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী?

মনিরুজ্জামান: বিদেশি সংস্থাগুলো যেভাবে আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাইভেটাইজেশনের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে তাতে গ্রামেও এখন কিন্ডার গার্টেন ঢুকে পড়েছে। সেখানে পড়ছে অধিকাংশই সুবিধাবাদী, ফড়িয়া লোকদের ছেলেমেয়েরা। আমাদের দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কহীন একটা প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে। ফলে, আগামী এক দশকের মধ্যে আমাদেরকে এর জন্য চরম মূল্য দিতে হবে। কারণ এই উটকো প্রজন্মটাই তখন দেশের নিয়ন্তা হয়ে উঠবে। আর এর সুযোগ নিবে বিদেশিরা। দেশাত্মবোধহীন প্রজন্মের কাছে দেশের তেল গ্যাস মাটি পানি কিছুরই কোনো মূল্য নেই। তারা এগুলি বিদেশের কাছে বিক্রি করে তাদের বিলাসিতার উপকরণ কিনবে। সরকার যদি এখনই শিক্ষানীতি বিষয়ে গভীর মনোযোগ না দেয়, সুষ্ঠু ব্যবস্থা না নেয়, তা হলে আমাদের জন্য খুব খারাপ সময় অপেক্ষা করছে।

এ ক: বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাব অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন যে-কৌশলপত্র প্রণয়ন করেছে সেটা বাস্তবায়িত হলে একসময় মধ্যবিত্তের জন্য উচ্চশিক্ষা অসম্ভব হয়ে পড়বে। শোনা যাচ্ছে, মাস্টার্সে ভর্তি হতে এবারে নাকি পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা করে ফি দিতে হবে। এভাবে চলতে থাকলে উচ্চশিক্ষা শেষ পর্যন্ত কোথায় নামবে?

মনিরুজ্জামান: শিক্ষা তো দূরের কথা, মানুষের টিকে থাকাই তো দায় হয়ে পড়েছে দ্রব্যমূল্যের কারণে। ফলে, দেশে সন্ত্রাস আরো বাড়বে, সংস্কৃতিবিরোধী কর্মকাণ্ড বাড়বে। দেশটা যে কোথায় তলিয়ে যাচ্ছে!

এ ক: ভাষারীতি বিষয়ে একটা প্রশ্ন দিয়ে শেষ করি। ইদানীং আমাদের দেশে 'পূর্ববঙ্গের ভাষা' বলে একটা ভাষারীতি চালুর কথা বলা হচ্ছে, তা নিয়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনা, লেখালিখিও হচ্ছে। এ-বিষয়ে আপনার মতামত কী?

মনিরুজ্জামান: এটা একটা লিংগুইস্টিক ক্যায়োস ছাড়া আর কিছুই না। এর জন্মটাই একটা প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থান থেকে। উনবিংশ শতকে মান বাংলা প্রণয়ন ও প্রচারের ক্ষেত্রে সাহিত্যকে ভিত্তি ও মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। আর এখন যে-ভাষারীতি প্রচলনের কথা বলা হচ্ছে সেটা করা হচ্ছে বিনোদন-মাধ্যমকে ব্যবহার করে। এর মাধ্যমে আদৌ মানসম্পন্ন সাহিত্যসৃষ্টি সম্ভব কিনা এ-বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। যা দেখতে পাচ্ছি তাতে অযোগ্যের হাতে পড়ে ক্রমাগত অবক্ষয়ের দিকেই এটা যাবে। আমার তো মনে হয় না এর সঙ্গে সত্যিকারের সাহিত্যিকেরা থাকবেন, শিক্ষকেরা থাকবেন। সাহিত্যিক আর শিক্ষকদেরকে বাদ দিলে একটা জাতির আর থাকে কী?

—-

ফেসবুক লিংক । আর্টস :: Arts