মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি: ছত্রপুর, ময়মনসিংহ

শামসুজ্জামান খান
Published : 25 March 2009, 07:47 PM
Updated : 25 March 2009, 07:47 PM


বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী

১৯৭১-এর পঁচিশে মার্চের বিকেল বেলায় আমরা জমায়েত হয়েছিলাম ময়মনসিংহস্থ পূর্ব পাকিস্তান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ দিকের লাগোয়া ছত্রপুর গ্রামে। উদ্যোগটি ছিলো 'ময়মনসিংহ বুদ্ধিজীবী সংগ্রাম শিবির'-এর। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের মর্মানুযায়ী গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে সহজ সরল ভাষায় আমাদের মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের বিষয়টা তুলে ধরার জন্যই ছিলো ওই আয়োজন।

সারা পূর্ব বাংলা তখন উদ্বেগ, উত্তেজনা আর গণবিপ্লবের প্রচণ্ড আলোড়নে কাঁপছে। মানুষ জানতে চায়, কী করতে হবে সেটা বুঝে নিতে চায়। তাই একদিক থেকে প্রবল আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসা, আর অন্য দিক থেকে কার্যকর যোগাযোগের জন্য গণমুখী ভাষার জোগান, জানা বোঝার একটা অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। ওই সভায় আমাদের বন্ধু বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী যতীন সরকার, যিনি এখন অধ্যাপক ও সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাতিমান, দেহাতি ভাষার সঙ্গে আবেগের বারুদ মিশিয়ে বলেছিলেন:

"'মারশিয়াল-ল' মানে হইলো শিয়াল কুকুরের মত মানুষ মারণের আইন। ওই যে বলছে 'মারশিয়াল-ল' ওই কথা দিয়া মিলিটারির বড় সাবরা সিপাইগো বুঝাইছে: যখন তারার অর্ডারে মানুষ মারতো, তখন মনে করবো মানুষ মারতাছে না, শিয়াল — আমরার ভাষায়, 'হিয়াল' মারতাছে। ভাইসব, বঙ্গবন্ধুর কথা মতো, যার যা আছে তাই লইয়া রুইখ্যা খাড়াইলে
পাকিস্তানি মিলিটারির আমরারে ওই বায় হিয়াল কুত্তার লাহান মারতারতো না।"

আমাদের মিটিং যখন শেষ হয়েছে ঢাকায় তখন শিয়াল-কুকুরের মতোই মানুষ মারার সব আয়োজন সম্পন্ন করছে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী। এবং গভীর রাতে শুরু হয়েছে ইতিহাসের সেই নিষ্ঠুরতম অভিযান। ২৬ শে মার্চ ছিলো সাপ্তাহিক ছুটির দিন। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক এলাকার আমরা তখন যে যার মতো ঘরে বসে আয়েস করছি বা কোনো কাজ। কেউ কেউ বাজার করতে গেছেন শহরে। আগের রাতে ঢাকায় কী ঘটে গেছে তার কিছুই জানি না তখনো। এমনি সময় খবর এলো উপাচার্য কাজী ফজলুর রহিম তক্ষুনি সকল শিক্ষক, কর্মচারীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথিশালার সামনে সমবেত হতে অনুরোধ জানিয়েছেন।

উদ্বেগ আর শঙ্কা নিয়ে ছুটে গেলাম অতিথি ভবনের সামনে। তবে কী ঘটছে তা আঁচ অনুমান করতে খুব অসুবিধা হয়নি। তখন প্রায় সবাই এসে গেছেন। ময়মনসিংহের আওয়ামী লীগ নেতা জনাব রফিকউদ্দিন ভুঁইয়াকেও দেখলাম উপাচার্যের পাশে দাঁড়ানো। এখানে ওখানে জটলার মতো, এ ওঁর সঙ্গে কথা বলছেন এবং এক মুখ থেকে অন্য মুখ হয়ে শরীরের রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে আসা ঘটনাবলী জানা হয়ে গেছে।

একটু পরেই উপাচার্যের সভাপতিত্বে যথারীতি সভা শুরু হলো। রফিক ভুঁইয়া সাহেব একটি ছোট তেজোদীপ্ত বক্তৃতায় ঢাকায় নিরীহ মানুষকে হত্যার কথা বললেন এবং বললেন বাঙালির রক্তের ঢলের মধ্যে জন্ম হয়েছে, 'স্বাধীন বাংলাদেশের'। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। গতকাল গভীর রাতে ময়মনসিংহ পুলিশ লাইনের মাধ্যমে পাওয়া গেছে স্বাধীনতার সেই ঘোষণা। ঘোষণাটি এখন পড়ে শোনাবেন মাননীয় উপাচার্য মহোদয়।

কাজী ফজলুর রহিম সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। লম্বা একহারা সুন্দর চেহারার মানুষ। মুখে চাপদাড়ি। উত্তেজনায় কাঁপছেন। ওয়্যারলেস মেসেজটি তিনি পড়ে শোনালেন। তাতে ঢাকাসহ অন্যান্য স্থানে বাঙালি নিধনের কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।

উল্লাসে, উত্তেজনায়, ক্রোধে সজোরে শ্লোগান উঠলো: 'জয় বাংলা'। উপাচার্য ঘোষণা করলেন: "আজ থেকে এ বিশ্ববিদ্যালয় 'বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যায়' নামে পরিচিত হবে।"

বাংলার মানুষ তখন স্বাধীনতার জন্য পাগলপারা। জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করতে এগিয়ে আসছে কৃষক, মজুর, খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। অমন ঐক্য, অমন মানবিক সহমর্মিতা বাঙালি আর কখনো দেখেছে বলে মনে হয় না। শরণার্থীদের জন্য খাবার ও পানি, উদ্বাস্তু শিশুদের জন্য দুধ, আর নিজেদের ঘর ছেড়ে দিয়ে আশ্রয় গ্রহণকারীর সেবার সেই অকৃত্রিম আত্মীয়তাসুলভ আচরণ বাঙালির এক মহৎ গৌরবের বিষয় হয়ে আছে।

এপ্রিল মাসের ২২ তারিখ পর্যন্ত ময়মনসিংহ ছিলো মুক্তাঞ্চল। ১৬ বা ১৭ এপ্রিল থেকে পেস্ট কন্ট্রোল বিভাগের একটি ছোট হলুদ বিমান খুব ধীরগতিতে ময়মনসিংহ শহর ও আশেপাশের অঞ্চলসমূহের ওপর দিয়ে নানাভাবে উড়তে থাকে। এটা ছিলো পর্যবেক্ষণমূলক উড়াল — এরপর একদিন ঢাকা থেকে দু'তিনটি সামরিক বিমান ও হেলিকপ্টার এসে ময়মনসিংহ শহর ও গফরগাঁয়ের ওপর বোমা ও গুলি বর্ষণ করে গেল। ত্রাস সৃষ্টি করে মুক্তাঞ্চল দখল করার কৌশল হিসেবেই এই বিমান হামলা।

এই আকস্মিক বিমান আক্রমণে নিদারুণ ভীতির সৃষ্টি হলো চারদিকে। লোকজন যেভাবে পারলো ছুটলো গ্রামের দিকে, নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। গফর গাঁ থেকে কয়েকজন গুরুতর আহত লোককে আনা হলো ময়মনসিংহ হাসপাতালে। গুলিবিদ্ধ, রক্তাক্ত দেহ দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। আমার ছোট দুটি কন্যা সন্তান, বৃদ্ধা নানী, মা, স্ত্রী ও আমাদের খবর নিতে এসে আটকেপড়া ছোট সম্বন্ধীকে নিয়ে তখন আমি প্রায় দিশেহারা। এই ভয়, ত্রাস ও প্রতিমুহূর্তের শঙ্কার মধ্যেই শুনতে পাচ্ছিলাম ভারি কামান ও মেশিনগানের পিলে চমকানো আওয়াজ। কোথা থেকে কীভাবে এই শব্দ আসছে প্রথম বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু শব্দ প্রতিদিনই নিকটবর্তী হচ্ছিলো। অতএব, প্রাণভয়ে প্রথমে আশ্রয় নিলাম বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন ছত্রপুর গ্রামের এক বাড়িতে — আমার পরিবার ও ইংরেজির নুরুল ইসলাম নাজমির পরিবার। আমার 'পাই' রেডিও ভালো কাজ করছিলো না। নাজমি সাহেবের বড়ো রেডিওতে বি.বি.সি, আকাশবাণী ও স্বাধীন বাংলা শুনতাম। কিন্তু সে গ্রাম থেকে কামান বন্দুকের শব্দ বড়ো বেশি শোনা যেতে লাগলো। তখনই জানা গেল পাকিরা ঢাকা থেকে অন্তত তিনদিক দিয়ে ময়মনসিংহ রেল লাইন ধরে বিমান আক্রমণের ছত্রছায়ায় সামরিক ট্রেনে গুলিবর্ষণ ও শেলিং করে করে অগ্রসর হচ্ছে।

এ অবস্থায় ভীত সন্ত্রস্ত আমরা রেল লাইনের নিকটবর্তী এই গ্রাম থেকে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ব্রহ্মপুত্র নদী পার হই। পানি সামান্য, চরই বেশি। বাচ্চা দুটোকে ওদের ছোট মামা সামলালেন। সমস্যায় পড়লাম ৮৫ বছরের ন্যুব্জ নানিকে নিয়ে। বিশাল চর হেঁটে অতিক্রম করার শক্তি তাঁর ছিল না। জিরিয়ে জিরিয়ে তাঁকে আমি কোলে করে নদী পার করলাম। দু'জনেরই খুব কষ্ট হচ্ছিলো। তিনি কেঁদে ফেলে একবার বললেন, 'আমাকে মেরে ফেলে এই খানেই কবর দিয়ে রেখে যাও। এ কষ্ট সহ্য হয় না।'

পেছনে মৃত্যু ভয় থাকলে এগোনোর তাগিদ প্রবল হয়। তাই শেষ পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্রের পূর্ব পাড়ের ভাগনামারি গ্রামে যেয়ে পৌঁছা গেল এবং আশ্রয় মিললো ফজলু মিয়াদের বাড়িতে। ফজলু মিয়ারা নিজেদের থাকার বড় একটি টিনের ঘর আমাদের জন্য ছেড়ে দিলেন। ঘরে বড়ো চৌকি, এমনকি টুল চেয়ারও ছিলো। ওই বাড়ির সবাই আমাদের আপন আত্মীয়ের মতোই গ্রহণ করলেন। ও গ্রামের প্রতিটি মানুষই ছিলেন অসম্ভব ভালো।

যে ক'দিন ভাগনামারি ছিলাম বড় নিশ্চিন্ত ছিলাম। বিপদের ভয় ছিলো; তবে সে বিপদ ভাগনামারির লোকদের যেমন, আমাদেরও তেমন। ওই ক'টা দিনে আমরাও যেন ভাগনামারির বাসিন্দা হয়ে গেছিলাম। ফজলু মিয়া, তাঁর বাবা মা স্ত্রী এবং বাড়ির অন্যান্যরা এবং ওই গ্রামের লোকদের ঋণ কোনো দিন শোধ করতে পারবো না।

২২শে এপ্রিল পাক-বাহিনীর একটি সামরিক ট্রেন সুতিয়াখালি এসে অবস্থান গ্রহণ করে। বিমান বাহিনীর কয়েকটি বোমারু বিমান তখন ময়মনসিংহ ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের আকাশকে চিরে চৌচির করছিলো। আমরা চৌকির নিচে ঢুকে নিরাপত্তা খুঁজছিলাম। আমার বড় মেয়ে কাঁকনকে যতবারই ঠেলে ধাক্কিয়ে চৌকির নিচে দেই সে ততবারই বেরিয়ে এসে বলে, 'আমি চৌকির ওপরে ছোব। আর এখন খিচুরি খাব।'

২২ এপ্রিলই দখলদার বাহিনী ময়মনসিংহ দখল করতে পারতো; কিন্তু সুতিয়াখালির পরই বিশ্ববিদ্যালয়, তাই একটু দেখে শুনে নিয়ে ওরা ২৩ তারিখ ভারী কামানের গোলা বর্ষণ করতে প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয় ও পরে শহর দখল করে। ২২ ও ২৩ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার হায়েনারা বিশ্ববিদ্যায়ের দু'জন কর্মচারীকে হত্যা করে। এদের একজন শাহজালাল হলের কমন রুম বেয়ারার বত্রিশ বছর বয়সের আক্কাস আলী, অন্যজন মাৎস্য বিজ্ঞান অনুষদের কর্মচারী ও ষাট বছরের বৃদ্ধ মধুসূদন।

আক্কাস আলী মারা যায় সুতিয়াখালি কালির বাজার সড়কের মাঝামাঝি ২২ এপ্রিল তারিখে। কামান, মেশিন গান আর মর্টারের শব্দে গ্রাম উজাড় করে যখন সবাই দিকবিদিক ছুটছে তখনও হানাদারদের রুখে দাঁড়ানোর দীপ্ত চেতনায় উজ্জীবিত আক্কাস আলী লড়াকু কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে ওদের রুখে দাঁড়ানোর মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত। সে সঙ্গীদের বলে গিয়েছিলো তোমরা তৈরি হও 'আমি দেখে আসি' ওরা কতদূর এলো। কিন্তু আর ফিরে আসেনি। সড়কের ওপরে যেতেই বর্বর বাহিনীর মেশিনগানের এক ঝাঁক গুলি ঝাঁঝরা করে দিল আক্কাস আলীর বুক।

মধুসুদনের কাজ ছিলো মাৎস্য বিজ্ঞান বিভাগের জন্য মাছ ধরা আর মাছের খাবার যোগান দেয়া। মাছের খাবার দেবার জন্যই সে ২৩ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে এসেছিলো তার বাড়ি কেওটখালি থেকে।

বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা বিরান। জনমনিষ্যির কোনো চিহ্ন নেই। এমনি সময়ে ঠা ঠা ঠা শব্দ এবং হানাদার বাহিনীর নিশ্চিত লক্ষ্যভেদ। মধুসূদন চিরতরে লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। হানাদাররা ব্রহ্মপুত্রের পানিতে ভাসিয়ে ছিলো মধুসূদনের মৃতদেহ। ভাগনামারি আর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝে ব্রহ্মপুত্র নদী। বেশ একটু দূরে, বাঁক খেয়ে যেতে হয় বলে দূরত্ব দাঁড়ায় প্রায় আড়াই তিন মাইলের মত। তবে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার খবর রোজই তাজা টাটকা পাওয়া যায়। দৈনন্দিন প্রয়োজনে এ গ্রামের অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ওপর দিয়েই শহরে যাতায়াত করেন। ভাগনামারির কিছু লোকও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোটখাটো চাকুরি করেন।

ময়মনসিংহ শহর হানাদার বাহিনীর কব্জায় চলে যাবার দশ-বারোদিন পরে খোঁজ-খবর নিয়ে জানা গেল পরিস্থিতি আপাততঃ বাহ্যিকভাবে শান্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহরাওয়ার্দী ও ফজলুল হক হল দুটি ও অতিথিশালাকে ক্যান্টনমেন্ট করা হয়েছে। চিন্তা ভাবনা করে ঠিক করলাম একবার ক্যাম্পাসে যেয়ে খোঁজ খবর নিয়ে আসা যায়। তাছাড়া টাকা পয়সাও শেষ হয়ে এসেছে — ব্যাংকেও যাওয়া দরকার।

টাকার প্রয়োজনেই মে মাসের ২ তারিখে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গেলাম। রাস্তায় চেনা, আধচেনা লোকদের সঙ্গে দেখা হলো। সবার মুখে চোখে কেমন একটা বিষাদ ও আতঙ্কের ছাপ। চোখ তুলে তাকাচ্ছি, সালাম বিনিময়ও হচ্ছে। কোনো কথা হচ্ছে না। তবু যেন কত কথা বলা হচ্ছে, বুঝতে পারছি একে অন্যকে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢুকে কেমন ভয় ভয় করছিলো। সুনসান চারদিক। দু'একজন লোকও দেখলাম এদিক ওদিক। মাপা, হিসেবি চলাফেরা।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টরের বাড়িতে গেলাম। তিনি ক্যাম্পাসেই ছিলেন। তাঁর কাছে খবর পেলাম অনেকেই ফিরে এসেছেন। ব্যাংকে গেলাম। সেখানেও কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে দেখা, তাঁরাও বল্লেন ফিরে আসতে পারেন। গ্রামে থাকা তো খুব নিরাপদ নয়। ওখানেও ওরা হামলা চালাবে। সেদিক থেকে শহরই অপেক্ষাকৃত বেশি নিরাপদ।

৪ মে সকাল দশটা নাগাদ পরিবার পরিজন নিয়ে ক্যাম্পাসে ফিরে এলাম। সে দিনেরই দুপুর বেলা। খেতে বসবো এমনি সময় দেখি নিচ থেকে বন্দুকধারী দু'জন জোয়ান আমাকে ডাকছে। ওদের দিকে তাকিয়ে মনে হলো দু'জন যমদূতকে দেখছি। ওদের চেহারায় বেশ কঠিনতা। আমার মা, নানী, স্ত্রী ততক্ষণে দোতলায় আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। ছোট সম্বন্ধীও দরজার সামনে উঁকি দিয়েছিলো, ওকে ভেতরে যেতে বল্লাম। কারণ, আমাদের পরিচয় ওদের কাছে গ্রহণযোগ্য হলেও ওকে ওরা সন্দেহ করতে পারে।

ভয়, দ্বিধা, নিজেদের মধ্যে কী করা না করা নিয়ে কিছু কথাবার্তায় একটু দেরি হলো নিচে নামতে। এরই মধ্যে বজ্রনিঘোষে ধ্বনিত হলো: 'দের মাত করো। জলদি ইধার আও।' আর দেরি নয়। একটু পেছনে তাকালাম, সবারই মুখ ফ্যাকাসে। প্রথমে চাপা কণ্ঠে বিকৃত কান্নার শব্দ শুনলাম। পরে দেখি কান্নারত অবস্থায় সবাই দোতলার বারান্দায় সেজদা দিয়ে আল্লাকে ডাকছেন।

নিচে নামলাম। আমাদের বাড়ির সামনের ছোট আমগাছের নিচে ওরা দাঁড়ানো। কাছে যেতেই বুকে বন্দুকের নল ঠেকালো। এমন সময় ঝম ঝম শব্দে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকাগামী একটি ট্রেন যাচ্ছিল। ওরা ট্রেনটির দিকে তাকালো। এমনকি সাদা জোয়ানটি আমার বুক থেকে বন্দুকও সরিয়ে নিল। কিন্তু খিস্তি খেউর চালাল বেশি করে। একটু যেন বেঁচে যাওয়ার ভরসা পেলাম। গালাগাল থামলো। একবার শুধু কালো চিৎকার করে বলল: 'শালা বাঙালি ইনসান নেহি? আমি উত্তর দিলাম না, তখন সে যা বলল, তার অর্থ হল: 'শালা হারামি, বুদ্ধুর মতো তাকিয়ে আছ কেন? একটা আস্ত শয়তান, তোমরা মানুষ না। সে এর কারণ দেখিয়ে বলল: ট্রেনটির দিকে তাকিয়ে দেখ। রেলের বিহারি কর্মচারীদের ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছে। বেশির ভাগেরই হাত পা কাটা। কাউকে কাউকে পুড়িয়ে মেরেছে — তোমাদের 'জয় বাংলা'র লোকেরা। এই কথা বলেই সে আবার আমার বুকে বন্দুক ঠেকাল। ভাবলাম এবার শেষ, নির্ঘাৎ মৃত্যু। এক মুহূর্ত। কালো জিজ্ঞেস করলো: তুম এঁহা কেয়া করতা হ্যায়? আমি বললাম, প্রফেসর। সাদা বলল: পরফেসর! লেকিন ইনসান নেহি। যাও।'

আমি তখন চলৎ শক্তিহীন। নড়ার শক্তি পাচ্ছি না। সাহসও পাচ্ছি না। ঘুরে যে ওপরে যাবার সিঁড়ির দিকে যাব তাতেও ভয় হচ্ছে পেছন থেকে যদি গুলি করে দেয়। না, ওরাই ধীরে ধীরে চলে গেল। ভালো করে দেখেশুনে নিচে নেমে এল আমার মা, স্ত্রী। অন্য ফ্লাটের লোকজন উঁকি মেরে দেখছিলেন। ভয়ে কেউ নামেননি। নামা সম্ভব ছিলো না ওই পরিস্থিতিতে।

ভয়ভীতি, শঙ্কায় মাস দেড়েক একরকমভাবে কেটে গেল। এরপর নানা খবরাখবর পেয়ে আমরাও কিছুটা সাহসী হলাম। একদিন প্রফেসর ইসলাম খবর পাঠালেন যে, Washington Post-এর একজন সংবাদদাতা এসেছেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলতে চান। প্রফেসর ইসলামের বাড়ি ছিল আর্মি অফিসারদের বাসস্থান বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি ভবনের কাছাকাছি। তাছাড়া তাঁর এবং উপাচার্যের বাড়ির ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখছিল হায়েনারা। তাই ড. মোস্তফা হামিদ হোসেনের নদী তীরবর্তী প্রান্তিক বাড়িটিতে আমি আর ড. হোসেন পড়ন্ত বিকেলে বসলাম সেই সাংবাদিকের সঙ্গে। দেড় ঘণ্টা ধরে আলাপচারিতায় তিনি বহু তথ্য লিখে নিলেন। তবে শর্ত থাকলো আমাদের নাম ব্যবহার করা হবে না। সাংবাদিক চলে গেলেন। আমার বাড়ি ফিরতে একটা বড় রাস্তা পার হতে হয়। তারপর পুকুরপাড়ের নির্জন রাস্তা পেরিয়ে পশ্চিমদিকের রেল লাইনের কাছাকাছি আমার বাড়ি। ভীষণ ভয় হচ্ছিল ওই সন্ধ্যায়। মনে হচ্ছিলো ওরা নিশ্চয় এই গোপন সাংবাদিক সাক্ষাৎকারের খবর জেনেছে। যেকোন মুহূর্তে মিলিটারি ঝঁপিয়ে পড়বে আমার ওপর। কিন্তু না, বিপদ হয়নি সেদিন। তবে ভয়ে রাতেও বার বার ঘুম ভেঙে যাচ্ছিলো।

এর কিছুদিন পরে এক দুপুরে আমাদের ছাত্র হাফিজ একটি চৌদ্দ-পনের বছরের ছেলে নিয়ে আমার বাড়িতে হাজির। ছেলেটির মুখ শুকনো। খায় নি সকাল থেকে। ওদের খেতে দিলাম। হাফিজ মুক্তিযোদ্ধা। ছোট ছেলেটিও। ওরা খেতে খেতেই প্রয়োজনীয় তথ্যাদি জেনে চলে গেল। হাফিজকে বললাম আমরা আছি ক্যান্টনমেন্টের একেবারে ভেতরে। এখানে এসে কিন্তু দুঃসাহসের পরিচয় দিয়েছো। ও বলল: 'স্যার কী আর হবে, বড়জোর মৃত্যু।'

সে দিনই সন্ধ্যাবেলায় প্রথমে কলিং বেল বাজলো। পরে দরোজায় ধাক্কা। একজন অফিসার আর দু'জন সেপাই ঘরে ঢুকলেন। জানালেন, ঘর সার্চ করবেন। তন্ন তন্ন করে সব ঘর, বাথরুম, স্টোর খুঁজলেন। যাবার সময় অফিসার বললেন: 'sorry to disturb you' 'খবর মিলা ইধার মুক্তি আয়া।' ভাগ্যিস কদিন আগেই আমার স্ত্রীর ভাইটি চলে গিয়েছিলেন। তা না হলে বিপদটা তারই হতো।

অক্টোবর-নভেম্বর মাসে একের পর এক অনেক ঘটনা ঘটে গেল। বাংলাদেশের মানুষ তখন বিজয়ের আভাস পাচ্ছে। তাই তাদের মধ্যে উল্লাস এবং সংগ্রামকে তীব্র করার আয়োজন। অন্যদিকে শত্রুপক্ষও মরণ কামড়ের জন্য প্রস্তুত। রাজাকার, আলবদররা কুত্তার মত হন্যে হয়ে শিকার খুঁজছে।

৬ নভেম্বর গভীর রাতে আমাদের সহকর্মী ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শফি আহমেদকে আল-বদর ও পাকবাহিনী বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেল। ছয়-সাতজন আলবদর ও একজন সুবেদারের নেতৃত্বে সাত আটজন খানসেনা একটি ট্রাকে করে এসে তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। কিছুদূর যেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রজেক্ট অফিসের কাছে ট্রাকটি থামে। ট্রাক থেকে নামানো হয় জনাব শফিকে। জনাব শফির ভাষ্য: "আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ, আমি ক্লাশে পাকিস্তানবিরোধী কথাবার্তা বলে ছাত্রদের উত্তেজিত করি এবং পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করি। আমি তাদের ক্লাশে যোগদান করতে নিরুৎসাহিত করি। আমি ভারতের দালালী করি। আমি বাংলাদেশ আন্দোলনের সাথে পরোক্ষভাবে জড়িত। — যখন সবই অস্বীকার করে যাচ্ছি তখন সুবেদারটি আমার মুখে বুকে পিঠে মাথায় ক্রমাগত ঘুষি, কিল ইত্যাদি মারতে শুরু করেছে। তার সাথে সাথে চার পাঁচজন সিপাহী ও বদর বাহিনীর চার পাঁচজন যুবক এক সঙ্গে আমার ওপর হিংস্র হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিল, ঘুষি, লাথি, রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত এক সাথে আমার ওপর পড়তে থাকে। এক সময়ে আমার পা দুটো ট্রাকের ওপর তুলে দু'জন খানসেনা তা চেপে ধরে এবং আমার সারা শরীর মাটির দিকে ঝুলন্ত অবস্থায় রেখে ট্রাক চালিয়ে দেয়। এক সময় আমাকে উপুড় করে আমার মাথায় রাইফেলের নল ধরে গুলি করবে বলে ভয় দেখায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সমস্ত ছাত্র মুক্তিবাহিনীতে ছিল এবং যে সমস্ত শিক্ষক ও কর্মচারী পাকিস্তানবিরোধী তাদের নাম বলতে তারা আমাকে পীড়াপীড়ি করে।"

ওখান থেকে অত্যাচারের প্রথম পর্ব শেষ করে তারা আমাকে সেই ট্রাকে করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে — তখনকার ব্রিগেড হেড কোয়ার্টার্সে নিয়ে আসে। — কিছুক্ষণ পরই ক্যাপ্টেনের রুমে আমার ডাক পড়ল। ক্যাপ্টেন আমাকে জিজ্ঞেস করলো: আমার বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ আনা হয়েছে তা সত্যি কিনা! আমি প্রাণের ভয়ে তা অস্বীকার করি। — বদর বাহিনীর সেই কমান্ডারকে তখন ডাকা হয়। সে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সে ক্যাপ্টেনের সামনে আমাকে পাকিস্তানবিরোধী প্রচারণার দায়ে অভিযুক্ত করে। ক্যাপ্টেন তখন আমাকে মিথ্যেবাদী বলে কুৎসিৎ গালাগালি করে আমাকে শেষ করে ফেলার নির্দেশ দিল। — লেফটেন্যান্টটি তখন কয়েকজন খান সেনা ও বদর বাহিনীর সদস্য নিয়ে আমাকে গেস্ট হাউস সংলগ্ন নদীর পাড়ের বধ্যভূমিতে নিয়ে গেল। সেখানে তারা আমার পরনের গেঞ্জি ও সার্ট খুলে আমার হাত-পা বেঁধে ফেলে। আমাকে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হতে বলা হয়। বদর বাহিনীর একজন সদস্য বেয়নেট হাতে আমার দিকে এগিয়ে আসে। সে গর্বভরে জানায়, সে ইতিমধ্যে এখানে এই বেয়নেট দিয়ে আটজনকে শেষ করেছে। আমাকে নিয়ে তার সংখ্যা হবে নয়। আমার প্রতি তখন নানা কটুক্তি ও বিদ্রূপবাণ বর্ষিত হতে থাকে। সবই বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতি কটাক্ষ। রাত ২-২৫ মিনিটে বলা হয় ২-৩০ মিনিটে আমার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে। আমি তখন নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি। আর মাত্র পাঁচ মিনিট পরেই আমার জীবনপ্রদীপ নিভে যাবে। — আমার স্ত্রী ও একমাত্র ছেলে, যার বয়স তখন চার মাস — তাদের কথা মনে পড়তে থাকে। আমি তখন নিশ্চল। এর মধ্যে একজন খানসেনা একটি জ্বলন্ত সিগারেট আমার পিঠে ঠেসে ধরে। আমি যন্ত্রণায় কাতরিয়ে উঠি। ককাতে ককাতে লেফটেন্যান্টের কাছে সে রাতের মত প্রাণভিজ্ঞা চাই। কী মনে করে সে আমার প্রার্থনা মঞ্জুর করে। মনে হল যে পরের দিন সবাই ব্যাপারটি জানবে এবং চেষ্টা তদবির করলে হয়ত প্রাণে বেঁচেও যেতে পারি। আমাকে আবার ট্রাকে তোলা হল। চেয়ে দেখলাম ওপরে মুঠোমুঠো তারার হাতছানি এবং নিচে আমার পরিচিত ক্যাম্পাস ঝিমিয়ে আছে। মনটা বেদনায় ভরে গেল। সবই আমার অতি পরিচিত কিন্তু তাদের কিছু করার নেই।"

৭ই নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী ছাত্রাবাস ক্যান্টনমেন্টে আমার ওপর কয়েক দফা নির্মম নির্যাতন চলে। বেলা দুটোর সময় আমাকে একজন ক্যাপ্টেন এসে ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার্সে নিয়ে যায়। সেখানে আমাকে একটি মুচলেকায় সই করতে বলা হয়। প্রাণরক্ষার আশায় আমি তাতে সই করি। বেলা তিনটা নাগাদ আমাকে ছেড়ে দেয়া হয়।"

এর কয়েক দিন পর একদিন রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তর পশ্চিমের গ্রামটিতে যায় দুইজন আর্মি জোয়ান। এক গৃহস্থ বাড়িতে যেয়ে এক তরুণী বধূকে ধরে ফেলে। বউটি বুদ্ধি করে ওদের একটু বসতে বলে — বলে কাপড় বদলে আসি। ঘুরে অন্য দিক থেকে এসে একটি ধান রাখার মর্টকিসের আড়াল থেকে ধারালো দায়ের এক কোপে একজনের ধর নামিয়ে ফেলে। এই আকস্মিক আক্রমণে অন্যজন পালায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের ল্যাবরেটরী অ্যাটেনডেন্ট হাসান আলী সুদর্শন তরুণ। শত্রবুহ্যের মধ্যে থেকেও তিনি ছিলেন সহযোগী যোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ছিল তার গোপন যোগাযোগ। পাকবাহিনীর গতিবিধি এবং প্রয়োজনীয় তথ্যাদি মুক্তিবাহিনীকে অবহিত করতেন তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি-নিবাস ছিল পাক সেনাদের ময়মনসিংহ সেক্টরের সদর দফতর। সোহরাওয়ার্দী এবং ফজলুল হক ছাত্রাবাস দু'টি ছিল ক্যান্টনমেন্ট। সর্বত্র সতর্ক দৃষ্টি নিয়ে ঘুরতেন হাসান। সংগ্রহ করতেন তথ্য। ময়মনসিংহে চরম আক্রমণের পূর্বে তার ওপর ভার পড়েছিল পাকসেনাদের অবস্থানের মানচিত্র সরবরাহের। কিন্তু সে কাজ তিনি সমাধা করতে পারেননি। ম্যাপসহ ধরা পড়েছেন কুখ্যাত আলবদরের হাতে। আলবদর বাহিনী তাকে সোপর্দ করে দেয় জল্লাদ খানসেনাদের নিকট। চরম অমানুষিক নির্যাতন করা হয় তার ওপর। খানসেনারা ক্রমাগত দু'দিন চাবুক মেরে জর্জরিত করে তাকে। অবশেষে ২১শে নভেম্বর অতিথি নিবাসের বধ্যভূমিতে গুলি করে তাকে হত্যা করে তার মৃতদেহ ভাসিয়ে দেয় ব্রহ্মপুত্রে।

এরপর ময়মনসিংহ ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার থেকে এলো এক নির্দেশনামা। বর্বর হানাদার বাহিনীর লেঃ কর্ণেল আমির মোহাম্মদ খানের স্বাক্ষর সম্বলিত শাস্তির পরোয়ানা।

রাষ্ট্রবিরোধী কার্জের জন্য শাস্তি। পাকিস্তান বিরোধীতার জন্য শাস্তি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বারোজন অধ্যাপক, কর্মচারী ও ছাত্রের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার নির্দেশ। এরা হলেন: পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের ড. মোস্তফা হামিদ হোসেন। বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ অলি নওয়াজ, অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক এ, বি, এম নুরুল ইসলাম নাজমী, উদ্ভিদবিদ্যার অধ্যাপক আবদুল বাকী, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যক্ষ এ, আর, এম মাসুদ, ছাত্রনেতা (শহীদ) শামসুল হক তালুকদার, উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আবদুল হক, পরীক্ষাসমূহের নিয়ন্ত্রক মুহাম্মদ হোসেন, কৃষি শিক্ষা সম্প্রসারণ বিভাগের অধ্যাপক আবদুল হালিম। এ নির্দেশনামা জারি করা হয়েছিল ৩রা ডিসেম্বর। বিশ্ববিদ্যালয় তা এসে পৌঁছে ৬ই ডিসেম্বর।

ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে ব্যাপক যুদ্ধ। মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সমন্বিত দুর্বার আক্রমণে ওরা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন। দিশেহারা ও পশ্চাদপসরণে ব্যস্ত। তাই আমাদের এই ক'জন শিক্ষক-কর্মচারী বেঁচে গেলেন অলৌকিকভাবে। আর মুক্তিযোদ্ধা ছাত্রনেতা শামসুল হক শহীদ হয়েছিলেন অনেক আগেই।

এই নির্দেশ আসার অনেক আগেই তৎকালীন উপাচার্য আমীরুল ইসলামের নির্দেশে আমি ঢাকায় চলে আসি। এবং অক্টোবর নভেম্বর মাস ঢাকা ও আমার গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জ মহকুমার (বর্তমান জেলা) চারিগ্রামে থাকি। তিনি বলেছিলেন: "পালান। তা না হলে বাঁচাতে পারবো না। ঢাকায় এসে উঠি ধানমণ্ডির ৭২৭ নম্বর সাত মসজিদ রোডের শামসুল ইসলাম খানের বাড়িতে। তিনি আমার আত্মীয়। তাঁর সঙ্গে যেতাম জনাব আবুল মনসুর আহমদের বাড়িতে — ইসলাম সাহেব মনসুর সাহেবকে চাচা বলতেন। সেই সুবাদে তিনি আমাকে নাত জামাই ডাকতেন, তাঁর বাড়িতে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খান সাহেবও আসতেন।

একদিন আতাউর রহমান খান ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকার কথা তুললেন। আবুল মনসুর আহমদ উত্তরে বলেন, "ওই মহিলা না হলে আমরা ইঁদুর বিড়ালের মতো মরে পচতাম বিশ্ব জানতো কিনা বলতে পারি না। তাঁকে আমি কৃতজ্ঞতা জানাই। তিনি ব্যাপারটা সারা বিশ্বের দৃষ্টিতে এনেছেন।"

মোনায়েম খাঁকে হত্যা করার পর দিন মুক্তিসেনারা মির্জা গোলাম হাফিজ সাহেবকে নিউ মার্কেটের কাছে প্রায় ধরে ফেলেছিলো। তাঁর ড্রাইভার কোনো রকমে গাড়ি চালিয়ে জান বাঁচিয়ে আসতে সক্ষম হয়। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে, তিনি নিজ বাড়িতে না যেয়ে ইসলাম সাহেবের বাড়িতে আশ্রয় নেন। হাফিজ সাহেব ভুট্টোর দূত মাহমুদ আলী কাসুরীর সঙ্গে নিজ বাড়িতে সভা করে উপনির্বাচনের ব্যবস্থা সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে চেয়েছিলেন।


১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজী ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করছেন।

ডিসেম্বর মাসে ময়মনসিংহ ফিরি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্ল্যাটে না উঠে শহরের আকুয়া মাদ্রাসা কোয়ার্টার্সে আমার স্ত্রীর বড় ভাইয়ের বাসায় উঠি। ভারতীয় ও মুক্তিবাহিনীর বিক্রম ও বোমা বর্ষণ দেখি — জেনারেল মানেক'শ বঙ্গোপসাগরের তীরে সমবেত ও অন্যত্র পলায়নরত পাকিস্তান বাহিনীর প্রতি আত্মসমর্পণের ঘোষণা শুনি। ৯ ডিসেম্বর রাতে ব্রহ্মপুত্র পুল ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে পাকিরা পালায়। ১০ তারিখে মুক্ত হয় ময়মনসিংহ।

—-
ফেসবুক লিংক । আর্টস :: Arts