সকল বিদ্যার রাণী

ফারসীম মান্নান মোহাম্মদীফারসীম মান্নান মোহাম্মদী
Published : 6 Jan 2011, 05:31 PM
Updated : 6 Jan 2011, 05:31 PM

সকল বিদ্যার রাণী গণিত। মহান গণিতবিদ পল এরডোস বলতেন, 'গণিত ছাড়া আর সবকিছুর মৃত্যু অনিবার্য।' জন ব্যারো মন্তব্য করেছেন, 'গণিত হলো চিন্তার সেই মহত্তম প্রকাশ যা ভৌতজগৎ সম্পর্কে গভীরতম চিত্র তুলে ধরে।' গণিত এমন এক ভাষা যা জগৎ সম্পর্কে আমাদের ভাবায়, বিস্মিত করে, বোঝায় এবং চিন্তার চ্যালেঞ্জ নিতে অনুপ্রাণিত করে। বড় কথা, গণিত আমাদের যুক্তিসঙ্গত চিন্তার সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম। কিন্তু প্রশ্ন হলো, গণিত কেন জগতের ভাষা বোঝে ? পদার্থবিদ ইউজিন উইগনার একটি অতি-বিখ্যাত প্রবন্ধ লিখেছিলেন যার শিরোনাম ছিল 'দ্য আনরিজনেবল এফেক্টিভনেস অব ম্যাথমেটিক্স'। এই শিরোনামটাও আমাদের ভাবায় গণিত কেন এতো কার্যকর, এর যুক্তি কী?

গণিতের একটা অন্তর্নিহিত লজিক-কাঠামো আছে। যার ফলে এটা জগৎকে শুধু কিছু অঞ্চলে কিংবা কিছু সময়ের জন্য বা আসন্নমানে নয়, বরঞ্চ সবস্থানে-সর্বকালে-সর্বত্রই ব্যাখ্যা করতে সক্ষম। পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, রসায়নের মতো মৌলিক বিষয়গুলোর মূলে আছে গণিত। তাই সম্ভবত গ্যালিলিও বলেছিলেন যে ভৌত বিধিসমূহ গণিতের ভাষায় রচিত। গণিতের অবিসংবাদিতা বিষয়ে এই অগাধ বিশ্বাস প্রকৃতির অনেক রহস্যময় কর্মকান্ডকে ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে। এমন অনেক দেখা গেছে যে, গণিতশাস্ত্রের এমন সব উপপাদ্য, ধারণা ও গাণিতিক পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে যা কেবল গণিতবিদদের বিশুদ্ধ চিন্তা ও বিমূর্ত সৌন্দর্য ও সৌকর্যের দাবী থেকে প্রমাণিত হয়েছে, যার কোনো ফলিত প্রয়োগই ছিল না। কিন্তু অনেককাল পরে দেখা গেল কিছু বিস্ময়কর ও রহস্যময় পর্যবেক্ষণের সমাধান দিয়েছে দূর-অতীতে গাণিতিক প্রক্রিয়ায় উদ্ভাবিত ঐসব গাণিতিক তত্ত্বাবলি। এভাবে তৈরি হয় নতুন ভৌততত্ত্ব, এভাবে এগিয়ে যায় বিজ্ঞান। এর এক ক্লাসিক উদাহরণ হলো সাধারণ আপেক্ষিকতত্ত্ব বা জেনারেল রিলেটিভিটি।

১৯১৪ সালের দিকে আইনস্টাইন গভীরভাবে ভাবছিলেন মহাকর্ষের একটি সাধারণ তত্ত্বের ব্যাপার। তাঁর স্বজ্ঞা অনুযায়ী স্থান-কালে বক্রতার সৃষ্টি হয় ভরের উপস্থিতির কারণে এবং এই বক্রতাই মহাকর্ষীয় ত্বরণের সৃষ্টি করে। মহাকর্ষকে ব্যাখ্যাকারী সমীকরণগুলো আইনস্টাইন এমনভাবে চাইছিলেন লিখতে যাতে সকল দর্শকের (তাদের গতি যা-ই হোক না কেন) কাছে মহাকর্ষের আইন একই দেখায় এবং সূত্রটি বক্র স্থান-কাল নির্দেশ করে। অনেক মাথা খাটিয়েও আইনস্টাইন ভেবে পাচ্ছিলেন না বক্র স্থান-কালের এই গণিত তিনি কীভাবে লিখবেন। ঊনবিংশ শতকে বার্নার্ড রিমান এবং অন্যান্যেরা দেখিয়েছিলেন যে সমতল জ্যামিতি ছাড়াও যে অন্য যেকোনো বক্রতার জ্যামিতি তৈরি সম্ভব। এই ধরনের একাধিক জ্যামিতি সম্ভব এবং এদের সাধারণ নাম অ-ইউক্লিডিয় জ্যামিতি। আইনস্টাইনের বন্ধু মার্সেল গ্রসম্যান তাঁকে শেখালেন বক্র স্থানের এই জ্যামিতি এবং তার অন্তর্নিহিত গণিত। এভাবেই সৃষ্টি হয়েছে আপেক্ষিকতার সাধারণতত্ত্ব যা চিন্তা, মনন, স্বজ্ঞা ও গণিতের সম্মিলনে তৈরি এক অসাধারণ কবিতা ! কিন্তু মনে রাখা দরকার, রিমানরা যখন অ-ইউক্লিডিয় জ্যামিতি সৃষ্টি করলেন তখন তাঁদের মাথায় কোনো বিশেষ প্রয়োগের চিন্তা-ভাবনা ছিল না। ইউকিøডের পঞ্চম-স্বীকার্যকে না মেনেও যে অর্থপূর্ণ ও সুসঙ্গত জ্যামিতি নিমার্ণ সম্ভব এই বিশুদ্ধ চিন্তাই ছিল তাঁদের একমাত্র চালিকা। তাই অ-ইউক্লিডিয় জ্যামিতি সৃষ্টির পেছনে আছে দু'হাজার বছরেরও বেশি গণিতচিন্তার ধারাবাহিক ইতিহাস।

নিউটনের মহাকর্ষসূত্রও একইরকম গাণিতিক চিন্তার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়েছে। ক্যালকুলাসের নীতির প্রয়োগের সাহায্যে নিউটন 'সেকেন্ড ডেরিভেটিভের' প্রয়োগে মহাকর্ষের সূত্রে উপনীত হন। 'সেকেন্ড ডেরিভেটিভের' আইডিয়া খুব সহজ নয়, অন্তত নিউটনের সময়ে তো নয়ই। শুদ্ধ গণিতের ভিত্তিতে নিউটন যে তত্ত্বে পৌঁছেছিলেন তার জন্য তিনি ইতালিয় বিজ্ঞানীদের করা পর্যবেক্ষণের উপর নির্ভর করেছিলেন। অনেককাল আগে করা এইসব পর্যবেক্ষণ ছিল বেশ সুশৃঙ্খল প্রকৃতির এবং এদেও সঠিকতা ছিল মাত্র ৪ শতাংশ। আজকাল নিউটনের তত্ত্বের সঠিকতা এক শতাংশের দশহাজার ভাগের একভাগ সূক্ষতায় মাপা সম্ভব হয়েছে। এই মহাকর্ষ সূত্র দিয়েই গ্রহগতির ব্যাখ্যা করা যায়। এটা গণিতের মাহাত্ম্য বটে!

একই রকম গাণিতিক সাফল্য আমরা দেখি কণাপদার্থবিজ্ঞানে গণিতের গ্রুপ থিওরির তত্ত্বসমূহের প্রয়োগ থেকেও। গ্রুপ থিওরি অনুযায়ী কিছু বিমূর্ত গাণিতিক প্যাটার্ন আছে যা প্রকৃতির বলসমূহ ও মৌলিক কণারা অনুসরণ করে। এবং এই প্যাটার্ন ব্যবহার করে কণাপদার্থবিদরা একের পর এক মৌলিক কণাদের পরিবার আবিষ্কার করে চলেছেন। গ্রুপ থিওরির উচ্চতর প্রতিসাম্য ব্যবহার করে কণাপদার্থবিদরা প্রকৃতির তিনটি বলকে একত্র করে স্ট্যান্ডার্ড মডেল তৈরি করেছেন যার কিছু কিছু বিষয় বর্তমানে সার্নের লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারের গবেষণার বিষয়। মূলত এই কোলাইডারটি বানানোই হয়েছে স্ট্যান্ডার্ড মডেল টেস্ট করার জন্য। এভাবে সুসঙ্গত গাণিতিক বিমূর্ত আইডিয়া অনুসরণ করে যেসব প্যাটার্ন পাওয়া যাচ্ছে, দেখা যায় অতিক্ষুদ্রের জগতে প্রকৃতি সেসব নকশা অনুসরণ করছে। প্রশ্ন হলো, প্রকৃতি কেন গণিতের বিমূর্ত আইডিয়া অনুসরণ করে ? উচ্চতর ও বিমূর্ত গাণিতিক নান্দনিকতার প্রতিফলন কেন ভৌত জগতে পড়ে ? গণিতের ফ্র্যাকটাল বা খন্ডিত বা ভগ্নাংশের মাত্রার আইডিয়া সমুদ্রতটবর্তী এলাকার জরিপে, গ্যালাক্সির স্তবক গঠনের ব্যাখ্যায়, অর্থনীতির জটিলতায়, সামাজিক নেটওয়ার্ক, এমনকি বৈদ্যুতিক গ্রিডের ক্যাসকেডিং ফেইলিয়র ব্যাখ্যা করছে।

দেখা গেছে, গাণিতিক প্রমাণ মিললে বিজ্ঞানীরা কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের আর কোনো প্রমাণ চান না। গাণিতিক সৌন্দর্যে বিজ্ঞানীরা এতোই মুগ্ধ যে পর্যবেক্ষণের আর তোয়াক্কাই করেন না। এ প্রসঙ্গে এক মজার কৌতুক আছে। ১৯১৯ সালে সূর্যগ্রহণ থেকে ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা সাধারণ আপেক্ষিকতত্ত্বের পর্যবেক্ষণসম্মত প্রমাণ প্রকাশ করলে আইনস্টাইনকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যদি এই প্রমাণ না মিলত তবে কী হতো। তিনি বলেছিলেন যে, সেক্ষেত্রে ঈশ্বরের জন্য দুঃখপ্রকাশ করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকত না। তাঁর তত্ত্বের গাণিতিক ভিত্তির প্রতি তাঁর যে পর্বতপ্রমাণ আত্মবিশ্বাস ছিল তা বলাই বাহুল্য।

কিন্তু প্রকৃতি গণিতের ভাষা বোঝে কেন? কেন গণিতের বিমূর্ত সংকেত পড়ন্ত আপেল থেকে মৌলিক কণার আচরণ, সূর্যের চারপাশে সৌরজগতের ঘূর্ণন থেকে এই মহাবিশ্বের গঠনের তাবৎ ব্যাখ্যা, বিদ্যুতের গ্রিড থেকে শুরু করে ইন্টারনেটের সিকিউরিটি– এসবই ব্যাখা করে? বাস্তবতার গণিত-ভিত্তিক লজিক কী? উইগনারের মতো বলতে হয়, "ভৌতজগতের ব্যাখ্যায় গণিতের ভাষার সার্বজনীনতার অলৌকিক ব্যাপারটি আমাদের জন্য এমন এক বিস্ময়কর উপহার যা আমরা বুঝিও না, যার যোগ্যও আমরা নই।"

গণিতের দার্শনিক এবং অন্যান্য ভাবুক যাঁরা, যাঁরা জানতে চান গণিতের অর্থ কী, এসবের মানে কী, তাঁরা এই সমস্যার সমাধান চারটি উপায় বাতলেছেন। এই চারটি পন্থা আসলে গণিতের একেকরকম ইন্টারপ্রেটেশন অর্থাৎ মানে করা আর কি। এই চারটি মতবাদের নাম হলো ফরমালিজম, ইন্ভেন্শনিজম, কন্স্ট্রাক্টিভিজম এবং রিয়ালিজম। বাংলায় কাঠামোবাদ, উদ্ভাবনবাদ, নিমার্ণবাদ ও বাস্তববাদ।

গত শতকের পুরোধা গণিতবিদ ডেভিড হিলবার্ট ছিলেন কাঠামোবাদী। তিনি বললেন যদি আমরা একগুচ্ছ স্বতঃসিদ্ধ নিয়ে এগোই, তারপর কিছু নির্দিষ্ট নিয়মাবলির অধীনে এদের উপর যুক্তি প্রক্রিয়া খাটাই, তাহলে আমরা একগুচ্ছ সূত্রাবলি পাবো, সেটাই গণিত। ইউক্লিডের জ্যামিতি যেমন ক্রমান্বয়িক আরোহণ (ইনডাক্শন) প্রক্রিয়ার সাহায্যে গুটিকয়েক স্বীকার্য থেকে অসংখ্য উপপাদ্যের সৃষ্টি করে, ঠিক তেমনি। এতে করে কূটাভাসের (প্যারাডক্স, যেমন সেইসব সেটের সেট যারা নিজেরা নিজেদের সদস্য নয়, কিংবা সেই নাপিত যে শুধু তাদেরকেই শেভ করে যারা নিজেদের শেভ করে না কিন্তু তাকে শেভ করবে কে, ইত্যাদি) অস্তিত্ব এড়ানো যায় বলে তিনি মনে করতেন। ফরমালিজমের এই ধারায় গণিত একটা পদ্ধতিগত যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত হয়। সকল সম্ভাব্য স্বীকার্য, যারা নিজেরা সাংঘর্ষিক নয়, নিয়ে শুরু করে সকল ধরনের সম্ভাব্য অর্থপূর্ণ যৌক্তিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা গণিতের পুরো সৌধটি নির্মাণ করতে পারি। এই পদ্ধতিতে গণিতের আলাদা কোনো মানে নেই, কাগজে-কলমে যুক্তিনিষ্ঠ সিদ্ধান্ত-অনুসিদ্ধান্ত ও উপপাদ্যের সমাহারই গণিত। হিলবার্ট ও তাঁর সহযোগীরা মনে করতেন এইভাবে সকল সম্ভাব্য প্রস্তাবনা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। শুরুর স্বীকার্য ও তার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত যৌক্তিক প্রক্রিয়ার আরোহণ পদ্ধতিতে প্রমাণ করা সম্ভব হলে কোনো প্রস্তাবনা সত্য হবে, নচেৎ নয়। কিন্তু কাঠামোবাদের এই চমৎকার মেকানিকাল সৌধটি চুরমার করে দিলেন ১৯৩১ সালে ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কুর্ট গোডেল। তিনি দেখালেন যে, যে স্বীকার্য দিয়েই শুরু করা হোক না কেন, তারা যতোই সত্য হোক না কেন, এবং যৌক্তিক প্রক্রিয়াগুলি ও সংকেতগুলো যতোই অ-সাংঘর্ষিক ও সুসংহত হোক না কেন, প্রতিষ্ঠিত সংকেত দিয়ে এমন এক প্রস্তাবনা সবসময়েই লেখা সম্ভব যার সত্যতা বা অসত্যতা ঐ সিস্টেমের মধ্যকার কোনো প্রক্রিয়া দিয়েই প্রমাণ করা যায় না। অর্থাৎ সকল ধরনের কাঠামো অসম্পূর্ণ হতে বাধ্য– এটাই কুর্ট গোডেলের ইন্কমপ্লিটনেম থিওরেম। বোঝা গেল, গাণিতিক সত্যকে কেবল স্বীকার্য এবং নিয়ম ও সূত্রের গ্রন্থিতে বেঁধে রাখা যাবে না। এটা কোনো যান্ত্রিক প্রক্রিয়াও নয় যে স্বীকার্যসমূহ ও নিয়মাবলি জানা থাকলে সকল সম্ভাব্য উপপাদ্য ক্যালকুলেটিং মেশিন দিয়ে প্রমাণ করে দেওয়া সম্ভব হবে।

ইন্ভেন্শনিজম বা উদ্ভাবনবাদীরা বলেন আমরা গণিত উদ্ভাবন করি, আবিষ্কার করি না। তাই গণিতবিদরা না থাকলে গণিতও থাকত না। এঁদের মতে গণিত দিয়েই আমরা ভৌত বিধি বোঝার চেষ্টা করি, তাই এসব বিধিকে গাণিতিক মনে হয়। রঙিন চশমা দিয়ে দেখলে চশমার রঙেই আশপাশ রঙিন হয়। কিন্তু অধিকাংশ গণিতবিদ এই ব্যাখ্যা মানেন না। অর্থনীতিবিদ বা সমাজ-বিজ্ঞানী যেভাবে গণিতের ব্যবহারে অভ্যস্ত, গণিতবিদেরা তাদের থেকে বাড়া। তাই গণিতের এই অর্থ তাঁরা মানেন না। রবীন্দ্রনাথের 'সোনার তরী', নজরুলের 'অগ্নিবীণা', মাইকেলের 'মেঘনাদ বধ' যথাক্রমে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-মাইকেল না থাকলে কোনোদিন লিখিত হত না, কিন্তু পিথাগোরাসের উপপাদ্য অন্য যে-কেউ 'আবিষ্কার' করতে পারত। তাই মনে হয় যেন গণিতের যৌক্তিক কাঠামোর একটা ছাপ আমাদের অবচেতনে রয়েই গেছে।
কিন্তু রিয়ালিস্টরা বিশ্বাস করেন এমন এক আদর্শ জগৎ আছে যেখানে সকল গাণিতিক রূপরেখার আদর্শটি সংরক্ষিত আছে। আমরা কেবল তার অনাদর্শ রূপটি গণিতের ভাষা দিয়ে বুঝবার চেষ্টা করি। ভাবনার এই আদর্শ জগৎটির নাম প্লেটোনিক জগৎ। পল এরডোস বলতেন সকল উপপাদ্য প্লেটোনিক জগৎ কিংবা ঈশ্বরের কাছে রক্ষিত এক পবিত্র গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে। গণিতবিদেরা মাঝে-সাঝে এইসব পবিত্র উপপাদ্যের দেখা পান। বলা বাহুল্য, এই মতবাদীরা মনে করেন গণিতকে উদ্ভাবনের কিছু নেই, গণিতবিদেরা না থাকলেও গণিত থাকে, তাই তাকে আবিষ্কার করা যায় মাত্র। ঈশ্বর যদি একজন গণিতবিদ হন, তবে এই জগতের গণিত-ভিত্তির একটা বড় যৌক্তিক কারণ থাকার কথা। এই মতবাদের একজন বিখ্যাত প্রবক্তা হলেন রজার পেনরোজ। তিনি তাঁর ঢাউস বইয়ে ('দ্য রোড টু রিয়ালিটি,' ২০০৪) বলেছেন, "কোনো গাণিতিক প্রস্তাবনার প্লেটোনিক অস্তিত্ব আছে- এ কথা বলার অর্থ হলো ঐ প্রস্তাবনাটির একটি নিরপেক্ষ অস্তিত্ব স্বীকার করে নেওয়া।"

নির্মাণবাদী বা কন্স্ট্রাক্টিভিস্টরা বলছেন যে মূল কিছু স্বীকার্য থেকে সামান্য কিছু বা গুটিকয়েক সসীমসংখ্যক নিয়মের অধীনে যেকোনো গাণিতিক সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায়। গাণিতিক প্রস্তাবনা নির্ধারণের নিয়মগুলির মধ্যে তাই গণিতের অর্থ নিহিত থাকে। লিওপোল্ড ক্রনেকার যেমন বলেছিলেন,"ঈশ্বর কেবল পূর্ণসংখ্যার সৃষ্টি করেছেন, বাকি সব মানুষের তৈরি"– এইটিই নির্মাণবাদীদের মূল সারকথা। জন ব্যারোর মতে পর্দাথবিজ্ঞানে নিমার্ণবাদী অ্যাপ্রোচ মানা হয় না। এই মতবাদের পূর্বসুরী হলো হিলবার্টের ফরমালিজম ধারা। গোডেল প্রমাণ করেছিলেন ফরমালিজম ধারার অসম্পূর্ণতা। কিন্তু নির্মাণবাদীরা বললেন, সে তো ঠিক আছে, কিন্তু যে সব প্রস্তাবনা প্রমাণযোগ্য তাদের ব্যাপারে আমাদের সিদ্ধান্ত কী হবে ? এমন কোনো মেশিন কি সম্ভব যা সকল প্রমাণযোগ্য প্রস্তাবনার সত্য-মিথ্যাকে প্রমাণ করতে সক্ষম ? কিন্তু অ্যালান টুরিং, এমিল পোস্ট ও আলোঞ্জো চার্চ প্রমাণ করলেন যে কোনো কোনো প্রস্তাবনার সত্য-মিথ্যা প্রমাণ করতে কোনো মেশিনের অসীমকালের প্রয়োজন পড়বে। এসব গাণিতিক প্রস্তাবনার বৌদ্ধিক গভীরতা এতো বেশী যে ধারাবাহিক গণনার ধাপে-ধাপে আঁক কষে যুক্তির জাল বিছিয়ে এদরকে ধরা যাবে না। এ ধরনের সার্বজনীন গণনার মেশিনকে বলে টুরিং মেশিন বলে। টুরিং মেশিন ইনপুট পড়ে, মেশিনের বর্তমান দশা ডিসপ্লে করে এবং এই দশা থেকে পরবর্তী দশা গণনা করে বের করে। এই মেশিন সসীম সময়ে যে সব প্রস্তাবনার সত্যতা প্রমাণ বা অপ্রমাণ করতে পারে, তাদেরকে গণনাযোগ্য (কমপিউটেবল) সমস্যা বলে, যাদের জন্য অসীম সময় লাগে তারা অ-গণনাযোগ্য (নন-কমপিউটেবল)। কিন্তু টুরিং ও অন্যান্যেরা দেখিয়েছেন যে, গণিতের পুরো কাঠামো একটা মেশিন দিয়ে মিমিক করা যায় না। তাই কেউ যদি মনে করেন গণিতে সৃষ্টিশীলতার আর কোনো সুযোগ নেই, তবে তিনি বা তাঁরা ভুলের মধ্যে আছেন। গণিতে, বা তেমন করে বললে পুরো ভৌতবিজ্ঞানে (কারণ বিজ্ঞান গণিত মেনে চলে), সৃষ্টিশীলতার সুযোগ অবশ্যই আছে এবং থাকবে। কারণ প্রকৃতিতে অ-গণনাযোগ্য সমস্যার অন্ত নেই বলেই মনে হয়। অতিক্ষুদ্রের জগতের কোয়ান্টাম মেকানিক্স কিংবা মানুষের চেতনার ব্যাখ্যা, মস্তিস্কের এমার্জেন্ট বিহেভিয়ার, মৌলিক কণিকাদের গ্রুপ-প্রতিসাম্য– এগুলোর সমাধান কোনো গণনাযোগ্য প্রস্তাবনা বা গুচ্ছ-প্রস্তাবনা থেকে আসবে বলে মনে হয় না।

চিন্তার ইতিহাস নিয়ে একটু ভাবলে দেখা যায়, যখন যে তত্ত্ব-কাঠামো বিশ্ব সম্পর্কে সর্বাধিক সার্থক কথা বলে, তখন সে তত্ত্বই আমাদের ধারণা-জগৎকে আচ্ছন্ন করে রাখে। পুরাকালের ঋষিরা মনে করতেন মাটি-পানি-আগুন-আকাশ এসবই জগতের মূলে। গ্রিক দার্শনিকরাও অনুরূপ ধারণা করতেন। পরে এলো জ্যামিতির জগৎ, সবাই মনে করত তাহলে বিশ্ব জ্যামিতিক-ধারা অনুসরণ করে। বিশ্বের মূল কাঠামোও ঘনকের বিভিন্ন আদর্শ রূপের অনুরূপ। তারপর নিউটন-পরবর্তী যুগে মানুষের মনে গতিবিজ্ঞানের প্রতি ব্যাপক আস্থা এলো। মানুষ মনে করত বিশ্ব-জগৎ ঘড়ির কাঁটার মতো নিশ্চয়তাভিত্তিক নিউটনীয় বিধিমালা মেনে চলে। তারপর এলো শিল্প-বিপ্লব। বাষ্প এঞ্জিন ও তৎসংক্রান্ত তাপ গতিবিদ্যার নিয়মাবলিই তখন মানুষের ভাবনা-জগৎ আচ্ছন্ন করে রাখত। মানুষ মনে করল জগৎ যন্ত্রময়। যন্ত্রের যন্ত্রণায় মানুষের আর্তনাদ ঢাকা পড়ে গেল। একালে এসে জানা গেল জগৎ বহুমাত্রিক, স্ট্রিং থিওরি দিয়েই তার ব্যাখ্যা হচ্ছে। এভাবে চিন্তা-জগতের প্যারাডিম শিফটের সাথে সাথে বিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণার আমূল বদল ঘটেছে। এভাবে একের পর এক চলতি ফ্যাশনের ভৌতমডেলকে কেন্দ্র করে আমাদের জগৎ-ভাবনা বিবর্তিত হচ্ছে। টমাস কুনের এই বিজ্ঞান দর্শন মনে হয় এখনো জারি আছে।

তাহলে এখানে গণিতের স্থান কোথায় ? গণিতের সাহায্যে আমরা ভৌত বিধিগুলো সংক্ষিপ্ত আকারে লিখে থাকে। প্রকৃতির সকল পর্যবেক্ষণ এক বিরাট-বিপুল ডেটাসেট নির্দেশ করে। এই প্রায়-অসীম ডেটাসেটকে সংক্ষেপে কিছু বিমূর্ত-প্রতীক ও চিত্রের সাহায্যে কিছু যুক্তির-শৃঙ্খলে বেঁধে ফেলাই গণিতের কাজ। অসংখ্য পর্যবেক্ষণ থেকে সাধারণীকরণের মাধ্যমে বিমূর্ত আইন সৃষ্টিই বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য। এ কাজে গণিত এক বিরাট সহায়ক। কিন্তু গণিত সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় মানুষের চেতন-শক্তির একটা বিরাট ভ'মিকা আছে। এই প্রক্রিয়া এখনো পুরো বোঝা যায়নি। মানব-মনীষার এক অসাধারণ সৃষ্টি গণিত। কিন্তু আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের কেমন গণিত শেখাচ্ছি?
আমাদের দেশীয় পাঠ্য-পুস্তকগুলো নিয়ে এবং শিক্ষানীতি নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে এবং যাচাই-বাছাইয়ের যেন শেষ নেই। আমরা একইসাথে কোয়ালিটি চাই, আবার জিনিস সহজ চাই। কিন্তু সেরকম পাঠ্যপুস্তক আমরা লিখি না, আমাদের গণিত-শিক্ষকরাও যথাযথা প্রশিক্ষণ পান না। গণিত অলিম্পিয়াড জাতীয় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার ফলে এই বিষয়ে সম্প্রতি কিছু আশার সঞ্চার হয়েছে। শীতের হিমেল সকালে নানা বয়েসের শিক্ষার্থীরা দলবেধে গণিতের পরীক্ষা দিতে আসছে– এই অভাবনীয় দৃশ্য আমার নিজের চোখে দেখা। এই বাচ্চারা শুধু গণিত শিখতে আসে না, তারা জানে না যে তারা আসলে বিশ্ব-জগতের ভাষা শিখবার পাঠে প্রথম হাতেখড়ি দিচ্ছে। তবে গণিতকে শুধু প্রবলেম-সলভিংয়ের হাতিয়ার মনে করলে ভুল হবে। তাহলে আমরা আমাদের মনন-শক্তির এত অসাধারণ অংশের অতিসামান্যই আয়ত্ত করতে পারব। গণিতকে একটি মানসিক প্রক্রিয়া হিসেবে বুঝে নিতে হবে। এই কাজে আমাদের পাঠ্যপুস্তকগুলো নিদারুন ব্যর্থ। পঞ্চম শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ে গড়ের সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি, অথচ গড়ের উপর একটি অধ্যায় আছে। গণিতের মানে জানারও দরকার আছে। একাজে অবশ্য গণিত-জনপ্রিয়কারী বইয়ের লেখকরা এগিয়ে এসেছেন। এটা একটা ভালো লক্ষণ।

স্বাভাবিক সংখ্যার সিরিজ সম্পর্কে বার্ট্রান্ড রাসেল মন্তব্য করেছেন যে, "সভ্যতার অত্যন্ত উচ্চ-স্তরে পৌঁছলে তবেই আমরা আমাদের সকল আলোচনার সূত্রপাত এই সিরিজ থেকে শুরু করতে পারি"। তিনি বলেছেন সংখ্যার ধারণা এতো বিমূর্ত একটা কনসেপ্ট যাতে পৌঁছতে মানুষের অনেক সময় লেগেছে। এই কথাগুলো অত্যন্ত সুন্দর ও সহজভাবে ১৯৮৭ সালের 'মাধ্যমিক গণিতের' বইয়ে লেখা হয়েছিল :
"(স্বাভাবিক) সংখ্যাগুলো আমাদের আবাল্য পরিচিত ও গণনার মত বস্তুনিষ্ঠ প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত বলে, এরা যে মানুষের কল্পনার ও চিন্তার ফসল সে কথা হয়ত আমরা লক্ষ করি না। বাস্তব জগতে তিনটি আম, তিনটি গরু, এসবের অস্তিত্ব থাকলেও শুধুমাত্র 'তিন' ত্রিভুবনে কোথাও নেই। 'তিন' হচ্ছে সেই বিমূর্ত ধারণা, যা তিনটি আম, তিনটি বই, তিনটি গরু ইত্যাকার তিনটি সদস্যবিশিষ্ট সকল সেটের সাধারণ বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে। স্বাভাবিক সংখ্যার শেষ নাই।"
এতো সুন্দর করে সংখ্যা সম্পর্কে আলোচনা আজকালের কিশোর-কিশোরীদের শেখানো হয় বলে মনে হয় না। আজকাল শুধু প্রবলেম সলভিংয়েই গণিত সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। বার্ট্রান্ড রাসেলের অসাধারণ বই 'ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথেম্যাটিকাল ফিলোসফি' সবার পড়া উচিত, সেখানে এসবই সুন্দর করে লেখা আছে। গণিত যে মানুষের চিন্তার ইতিহাসের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট আবিস্কার সেটা আমরা ভুলেই যাই।

সাধারণ পর্যবেক্ষণ থেকে সাধারণীকরণের মাধ্যমে সংখ্যার বিমূর্ত ধারণায় পৌঁছনো চিন্তার ইতিহাসে একটা মাইলফলক। এটা একদিনে হয়নি। বহু প্রকৃতি-দার্শনিকের সুদীর্ঘ চিন্তার ফসল সংখ্যার বিমূর্ত ধারণার আবিষ্কার। বিমূর্ত সংখ্যা যখন প্রতীকের ভাষায় মূর্ত হলো, তখন তার উপর গাণিতিক প্রক্রিয়া আরোপ করা সহজ হলো। এভাবে একের পর এক গাণিতিক যুক্তি প্রয়োগের ফলে আমরা উচ্চতর গণিত সৃষ্টি করতে পেরেছি। সবশেষে আমরা দেখলাম গণিত শুধু চিন্তার জিমন্যাস্টিক ব্যায়ামই নয়, এর প্রয়োগও আছে। প্রাচীন মিশরীয়রা জমি-জরিপ ও পিরামিড নির্মাণের কাজে জ্যামিতি প্রয়োগ করতে জানতেন। একালের মানুষ পুরো বিশ্বজগৎকে গণিতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে। এখন সে প্রশ্ন করছে, এসবের মানে কী ? গণিত কেন এত সার্বজনীন, কেন এতো কার্যকর ? এর কি আলাদা কোনো বাস্তব অস্তিত্ব আছে ? প্রকৃতি কেন গণিতের ভাষায় কথা বলে ? আমরা, এই মানুষেরাই বা গণিত সৃষ্টি করলাম কেন ?
বাতাসের মধ্যে বাস করেও মানুষ যেমন ভুলে যায় যে সে বাতাসের সমুদ্রে ডুবে আছে। তেমনি গণিতের ভেতর থেকেও আমরা ভুলে থাকি যে জগৎ গণিতময়। চিন্তার চ্যালেঞ্জে যারা গণিতকে সাথী করে না, তারা সত্যিই দুর্ভাগা।

১) "দ্য আনরিজনেবল এফেক্টিভনেস অব ম্যাথমেটিক্স ইন দ্য ন্যাচারাল সায়েন্সেজ", ইউজিন উইগনার, পিওর অ্যান্ড অ্যাপ্লায়েড ম্যাথমেটিক্স, খন্ড ১৩, সংখ্যা ১, ফেব্রুয়ারি ১৯৬০।
২) বিটউইন ইনার স্পেস এন্ড আউটার স্পেস, জন ব্যারো, অক্সফোর্ড ইউনিভাসিটি প্রেস, ২০০৮।
৩) ইনট্রোডাকশন টু ম্যাথমেটিকাল ফিলোসফি,বার্ট্রান্ড রাসেল, রাউটলেজ, ১৯১৯।

ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী :  শিক্ষক, গবেষক, গ্রন্থকার এবং বিজ্ঞান সংগঠক।