‘বাংলার সংস্কৃতি আন্দোলন’: আত্মপ্রকাশের প্রেক্ষিত

admin
Published : 26 Dec 2008, 12:04 PM
Updated : 26 Dec 2008, 12:04 PM

অক্টোবরের ১৫ তারিখে কওমি মাদ্রাসার কয়েকশ ছাত্রের হুমকির মুখে ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবেশ মুখ থেকে নির্মাণাধীন বাউল ভাস্কর্য সরিয়ে নেয় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। এর পরপরই নির্মাণাধীন বাউল ভাস্কর্য ভাঙা ও অপসারণের প্রতিবাদে ঢাকার চারুকলা অনুষদকে কেন্দ্র করে '‌সচেতন শিল্পী সমাজ' নামে একটি আন্দোলন গড়ে ওঠে। চারুশিল্পী, সঙ্গীতশিল্পী, নাট্যকর্মী, আলোকচিত্রী, চলচ্চিত্রকর্মী, সাহিত্যকর্মী ও স্থপতিসহ সংস্কৃতির বিবিধ শাখার কর্মী ও সরকারী-বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা এই সংগঠনে যোগ দেয়। পরে ডিসেম্বরের ৫ তারিখে 'সচেতন শিল্পী সমাজ' চারুকলায় একটি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে 'বাংলার সংস্কৃতি আন্দোলন' নাম পরিগ্রহণ করে। নবগঠিত এই সংগঠন ডিসেম্বরের ১২ তারিখে ঢাকার দৃক গ্যালারিতে একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন করে। সভায় আন্দোলনের পক্ষ থেকে 'বাংলার সংস্কৃতি আন্দোলন: আত্মপ্রকাশের প্রেক্ষিত" নামে একটি লিখিত বক্তব্য পাঠ ও প্রচার করা হয়। বাংলার সংস্কৃতি আন্দোলন-এর সৌজন্যে লেখাটি এখানে ছাপা হলো। বি. স.


ঢা.বি. চারুকলা অনুষদে সংবাদ সম্মেলন। এ সম্মেলনে 'সচেতন শিল্পী সমাজ' এর নাম বদলে 'বাংলার সংস্কৃতি আন্দোলন' গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়।

বাংলাদেশের জনগণের প্রাত্যহিক জীবনযাপনের মতো সাংস্কৃতিক অঙ্গনও কখনোই নিরুপদ্রব ছিল না। নানান গণবিরোধী শক্তির খবরদারি ডিঙিয়েই এখানে সংস্কৃতিকর্মীদের জনগণের কাছে হাজির হতে হয়। সম্প্রতি ধর্মের নামে সেখানে নানামুখী উৎপাত সৃষ্টি করার ঘটনাও আমরা লক্ষ্য করছি। শুধু তাই নয়, ভাস্কর্যের ওপর আঘাত আসছে, নাটক নিষিদ্ধ হচ্ছে, এমনকি নাট্যকারকে হত্যার ঘোষণাও আমদের দেখতে হয়েছে। আমরা এও খেয়াল করছি যে, জাতীয় জীবনের সংকটময় মুহূর্তেই ধর্মের নামে উগ্র ও অসহিষ্ণু কার্যকলাপ দিয়ে ক্রমশ জনগণের অধিকার ও মুক্ত সংস্কৃতি চর্চার পরিসরকে সঙ্কুচিত করার প্রতিক্রয়াশীল কর্মসূচিই আসলে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এবং সব সরকারের আমলেই এ ধরনের কর্মসূচি প্রকাশ্যে বা গোপনে রাষ্ট্রীয় মদদও পেয়ে আসছে। অথচ এসব বিষয়কে মোকাবেলা করবার মতো কার্যকর সাংস্কৃতিক আন্দোলন যথেষ্ঠ মাত্রায় নেই। সেকারণেই আমরা অন্য অন্য সংগঠন ও ধারার পাশাপাশি নতুনভাবে সংগঠিত হওয়ার জন্য 'বাংলার সংস্কৃতি আন্দোলন'-এর মঞ্চ গঠনের উদ্যোগ নিয়েছি।

এর সূত্রপাত বিমানবন্দরের সামনে (লালন চত্বরে) ভাস্কর্য ভাঙ্গার প্রতিবাদে চারুশিল্পীদের তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ থেকে। প্রতিবাদ ক্রমশই আন্দোলনের রূপ নিতে থাকে। ধর্মের দোহাই তুলে শিল্পচর্চা বন্ধের ওই ঔদ্ধত্যে বিভিন্ন স্তর ও বিভিন্ন মাধ্যমে চর্চারত প্রতিবাদমুখর শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মীদের একটি বড় অংশ চারুশিল্পীদের সঙ্গে একাত্ম হন। ওই সম্মিলিত সংহতি থেকে অনেকটা স্বতস্ফূর্তভাবেই গড়ে ওঠে 'সচেতন শিল্পী সমাজের' ঐক্যমঞ্চ। এই মঞ্চ গোড়া থেকেই চারুকলা, সংগীত, চলচ্চিত্র, আলোকচিত্র, নাটক, সাহিত্য, স্থাপত্যসহ সৃজনশীলতার সকল ক্ষেত্রে সক্রিয় ব্যক্তিবর্গের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটাতে চেয়েছে, তাদের সাধ্যমতো সামিল করেছে প্রতিবাদের সারিতে। বিশেষত সংগীত শিল্পীদের ব্যাপক অংশগ্রহণে চারুকলার বকুলতলায় লাগাতার প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এই ইস্যুতে সব সংস্কৃতিকর্মীদের কাছাকাছি আসবার একত্রে বসবার ক্ষেত্র তৈরি হয়। শুধু অনুষ্ঠানের মঞ্চেই নয় সেই সংহতি রাজপথ পর্যন্ত প্রসারিত হয়। গোড়া থেকেই আমরা প্রতিবাদের নতুন ভাষা নির্মাণে সচেষ্ট ছিলাম। সে সময় সবার অংশগ্রহণে লাগাতার ২৩ দিন ধরে রাজপথে গানের মিছিল, পুতুল মিছিল, আলোর মিছিল, পতাকা মিছিল করেছে সচেতন শিল্পী সমাজ। গান, নাটক, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে সংহতি জানিয়েছেন শত শত মানুষ। দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে এই লাগাতার প্রতিবাদের মিছিলে সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা এবং স্বতস্ফূর্ত জনতার অংশগ্রহণে দারুণ ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। শিল্পচর্চার ওপর হামলা অব্যাহত থাকলে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-ছাত্রীরা রাজপথে নেমে প্রতিবাদের মুষ্ঠি তোলে। সংস্কৃতির উপর আগ্রাসন রুখে দাঁড়ানোর শ্লোগান নিয়ে সকল অপশক্তিকে রুখে দাঁড়ানোর শপথ নেয়।

অন্যদিকে, গোড়া থেকেই আমরা এ আন্দোলনকে প্রথাগতভাবে তথাকথিত 'মৌলবাদ' বনাম 'প্রগতি'র লড়াই হিসেবে দেখতে চাইনি। একে নিছক সাময়িক প্রতিবাদ হিসেবেও দেখিনি। সেজন্য ভাস্কর্য ভাঙার ঘটনার তীব্র বিরোধিতার পাশাপাশি এ আন্দোলন প্রশ্ন তুলেছে অপরিকল্পিতভাবে যেনতেন ভাস্কর্য নির্মাণের বিষয়েও। আমরা বলেছি নগরসজ্জা বা বিউটিফিকেশনের নামে ঢাকাসহ সারা দেশে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় স্থাপনা নির্মাণ আর ধর্মের দোহাই দিয়ে সেসব ভাঙা দুটোর দায়ই সরকারের। শিল্পী নামধারী একটি ব্যবসায়ী শ্রেণী, আমলা আর স্পন্সর যোগানো কর্পোরেটদের একটি লুটপাটের চক্র যেভাবে এসব করছে তাও কোনো অংশে কম ক্ষতিকারক নয়। আমরা দাবি করেছি আমাদের শিল্প-সংস্কৃতি-ইতিহাসের যথার্থ প্রতিফলনের স্বার্থে জনগুরুত্বপূর্ণ উন্মুক্ত স্থানে শিল্পকর্ম স্থাপনের বেলায় শিল্পী, স্থপতি, নগরপরিকল্পনাবিদ, প্রত্নতত্ত্ববিদ, ইতিহাসবিদসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এ বিষয়ে একটি সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়নের। একইসঙ্গে সেসব সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকাও জরুরি। এ বিষয়ে আমরা শিল্পী, স্থপতি, শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে নানা পর্যায়ে মতবিনিময় করেছি এবং তাদের একাত্মতা আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছে। পাশাপাশি এসব দাবি বাস্তবায়নে দীর্ঘমেয়াদী লড়াইয়ের প্রয়োজনীয়তাও আমরা অনুভব করেছি।

বিমানবন্দরের ঘটনায় সাধক লালনের নামটিকে জড়িয়ে আমাদের সংস্কৃতির মর্মমূলেই আঘাত হানার চেষ্টা করা হয়েছে। আমরা বলেছি যেভাবেই হোক লালনের নাম যেহেতু যুক্ত হয়েছে তাই যেনতেন প্রকারে কোনোকিছু নির্মাণ না করে আগে বিমানবন্দর গোলচত্বরকে 'লালন চত্বর' ঘোষণা করা হোক। গত ২৩ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলন করে আমরা চত্বরটিকে 'লালন চত্বর' ঘোষণা করেছি। সরকারিভাবে ওই ঘোষণা বাস্তবায়ন করে সেখানে 'লালন চত্বর' শীর্ষক একটি নামফলক স্থাপনের দাবিতে গণস্বাক্ষরও সংগ্রহ করা হয়। শিল্পী-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিকর্মী, ছাত্র-তরুণসহ সাধারণ মানুষ ব্যাপকভাবে এ দাবির প্রতি তাদের সমর্থন জানায় এবং দাবি আদায়ে স্বাক্ষর দেয়। গত ২৭ নভেম্বর আমরা একটি স্মারকলিপিসহ হাজার হাজার মানুষের ওই গণস্বাক্ষর সংবলিত দাবিনামা ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের কাছে হস্তান্তর করেছি।

এভাবে আন্দোলন যতই এগিয়েছে ততোই একটি দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের প্রয়োজন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিমানবন্দরের সামনের ভাস্কর্য ভাঙার পরপরই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই ঘটনার প্রতিবাদে মঞ্চস্থ নাটককে কেন্দ্র করে আবারও জল ঘোলা করার চেষ্টা করা হয়েছে। ধর্মের দোহাই তুলে সংস্কৃতিকর্মীদের হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়েছে এবং এবারেও রাষ্ট্র নীরব থেকে ধর্মব্যবসায়ী নিপীড়ক মহলটিকেই আরও উস্কে দিয়েছে। এমনকি সবাইকে স্তম্ভিত করে দিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ 'মান্দার' নাটক এবং 'ধূমকেতু নাট্য সংসদকে' নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। আমরা সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির দাবি জানিয়েছি। সরকারের নীরবতাকে সমর্থন ধরে নিয়ে ধর্মীয় মাফিয়াগোষ্ঠী মতিঝিলের 'বলাকা' ভাস্কর্যের গায়েও আঘাত হেনেছে।

একের পর এক এসব আক্রমণ আমাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছে অতীতের মুখোমুখি। মিছিলের মতো ভীড় করে এসেছে উদীচীর অনুষ্ঠানে — সিনেমা হলে হলে বোমা হামলা, বোমার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত রমনার বটমূল-রক্তাক্ত পহেলা বৈশাখ, হুমায়ুন আজাদের ওপর প্রাণঘাতী হামলা, বগুড়ায় পথকবি মোসলেহ উদ্দিনকে হত্যা, ফতোয়ার সন্ত্রাসে কবি-লেখকদের দেশত্যাগ, কার্টুন প্রকাশকে কেন্দ্র করে প্রকাশনা নিষিদ্ধ করাসহ প্রস্তাবিত নারীনীতিকে বাতিল করতে বাধ্য করার মতো অগণিত ঘটনা। এরকম নানান পথে জনসংস্কৃতির উদার ও সংগ্রামী ধারাকে নিষ্পেষিত করার অপচেষ্টা ক্রমেই বলশালী হচ্ছে।

আমরা মনে করি এসব বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয় বরং সমাজের মধ্যে এ ধরনের ঘটনা ঘটার পরিস্থিতি তৈরি করে রাখা হয়েছে এবং করা হচ্ছে। তাই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে সংস্কৃতি চর্চা ও উপভোগ বিষয়ে আরো স্বচ্ছ বোঝাপড়ার। তাগিদ এসেছে অমানবিকতার বিরুদ্ধে মানবিকতার জাগরণকে এক সূত্রে গাঁথবার। আমরা একমত যে, ধর্মের নামে চিহ্নিত মাফিয়াগোষ্ঠী বিচ্ছিন্ন কোনো শক্তি নয়। তারা বিদ্যমান প্রশাসন, সকল সরকারসহ নানান গোষ্ঠীর মদদপুষ্ট। রাজনীতি ও ক্ষমতার খেলায় তাদের দেশ ও জনগণ বিরোধী ভূমিকা সম্পর্কেও আমরা সচেতন। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং সরকারের আশকারা পেয়েই ধর্মীয় উগ্রবাদীরা জনগণকে খোঁয়াড়ের জীব বানাবার স্পর্ধা করেছে। দেশে কী হবে আর কী হবে না দিন দিন তারা যেন তার সিদ্ধান্তদাতা হয়ে উঠছে।

আসলেই এটা কেবল 'মৌলবাদ' বনাম 'প্রগতির' লড়াই নয়। এর শেকড় অনেক গভীরে। ধর্ম তাদের উছিলা মাত্র। তাদের আসল লক্ষ্য মতপ্রকাশ ও অধিকারের দমবন্ধ করে দুঃশাসন চাপিয়ে দেওয়া। মিথ্যা ফ্যাসাদ সৃষ্টি করে জনগণকে বিভক্ত করে মাতিয়ে রাখা। আজ তারা শিল্প ও শিল্পীকে আঘাত করছে, কাল জনজীবনকেই কামড়ে ধরবে। যার নমুনা আমরা ইতিমধ্যেই দেশব্যাপী দেখতে পাচ্ছি। তবে এই 'তারা' বনাম 'আমরা' কিংবা 'ইসলামপন্থি' বনাম 'ইসলামবিরোধী' ধরনের বিভেদের ছক দেশের জন্য কল্যাণকর নয়। তা আসলে নৈরাজ্য সৃষ্টির অশুভ প্রকল্পেরই অংশ, শান্তি ও গণতন্ত্র বেহাত করার ফন্দি। আমরা আমাদের আন্দোলনকে এসব ফন্দিবাজি প্রকল্পের বাইরে রাখতে চাই। একইসঙ্গে সরকারি প্রতিষ্ঠান তথা সরকারকে সংবিধান নির্দেশিত উদার ও মানবতাবাদী দায়িত্বের কথাও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।

শিল্প সৃষ্টি ও উপভোগে শিল্পীসমাজ ও জনগণেরই এখতিয়ার। ধর্মীয়করণের মত বাণিজ্যিকীকরণ একাজে এক বিষাক্ত বাধা। তাই বিজ্ঞাপন বাণিজ্য ও স্পন্সরশিপের নামে মুনাফার খোরাক হিসেবে শিল্প ও জনগণের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সীমাছাড়া অপব্যবহারও আমাদের চিন্তিত করে তুলছে। আমাদের জাতীয় দিবস, দেশপ্রেম, সংগ্রামী চেতনা এবং ভালবাসাকে বিদেশি কর্পোরেটের পণ্য বিক্রির ক্যনভাসারগিরিতে লাগানোর এখতিয়ার তাদের কে দিয়েছে? একইসঙ্গে এদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলা ক্ষমতার রাজনীতির লেজুড়, উন্নয়ন ব্যবসার সহযোগী এবং কালচার ইন্ডাস্ট্রির খোরাক বানানোর মেকি-সংস্কৃতিরও আমরা ঘোর বিরোধী। মানুষকে স্বপ্নহীন করা, বিভক্ত রাখা, দেশ-জাতি-ইতিহাস ও পরিবেশ সম্পর্কে অচেতন করে রাখা বা জনগণের মধ্যে বিষাক্ত মতাদর্শের বিস্তার ঘটিয়ে আধিপত্য বজায় রাখাই তাদের উদ্দেশ্য। এই দুই শক্তির আগ্রাসী থাবার তলে সংস্কৃতি চর্চা এখন এক কষ্টকর সংগ্রাম হয়ে উঠেছে।


শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে 'বাংলার সংস্কৃতি আন্দোলন'-এর গণশোকমিছিল।

পরিস্থিতি খুবই নাজুক এবং এসবের বিরুদ্ধে নতুন সাংস্কৃতিক জাগরণ এখন সময়ের দাবি। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, সেরকম কোনো জোরালো তৎপরতা আমাদের সমাজে নেই। একদিকে বিশ্বায়নের হাত ধরে ভোগজর্জর সংস্কৃতির আগ্রাসী হাতছানি অন্যদিকে ধর্মীয় মাফিয়াতন্ত্রের থাবা আমাদের সংস্কৃতিকে শেকড়ছাড়া করছে। এই দুইকে বুঝে, সকলরকম আগ্রাসী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে দেশজ-লোকজ-মানবিক সংস্কৃতিকে চিনে নিতে হবে এবং এসব নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ বিতর্কের মধ্য দিয়ে নতুন জ্ঞান বিকশিত করতে হবে। তাকে যুক্ত করতে হবে আমাদের মাতৃভূমিসহ বিশ্বের মহান মুক্তিকামী চেতনার সঙ্গে। এই কাজ একার নয়, এবং শিল্পীসমাজের একার পক্ষেও তা করা সম্ভব নয়। আমরা এই শূন্যতা পূরণের তাগিদ অনুভব করি। এবং মনে করি যে, সেটা কোনো মৌসুমী কাজ নয়, এর জন্য চাই নিরন্তর প্রচেষ্টা। সেজন্যই আমাদের এই আন্দোলনকে কেবল অপশক্তির অপকর্মের প্রতিক্রিয়া নয়, সংস্কৃতির মানবিকীকরণের ক্রিয়া হিসেবে নির্মাণ করতে চাই। এসব নিয়ে প্রয়োজনীয় বিতর্কের, সংহতির মঞ্চ হিসেবে একে গড়ে তুলতে চাই। এর জন্য প্রয়োজন বিভিন্ন ফোরামে, সংগঠনে, অঞ্চলে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সক্রিয় সাংষ্কৃতিক ধারা ও ব্যক্তিবর্গের যোগাযোগ ও জোটবদ্ধতা। প্রয়োজন নিবিড় যোগাযোগ, বহু স্বরের ঐকতান এবং শত ফুল ফোটানোর পরিবেশ। শিল্প জনগণের শ্বাস-প্রশ্বাস, জনমানসের প্রতিচ্ছবি ও আশা আকাক্সক্ষার আধার। কায়েমি স্বার্থের হুমকিতে নুয়ে থাকা কিংবা মুনাফার জোয়াল বওয়া শিল্পীর কাজ নয়। এই ডাক নিয়ে বাংলাদেশের সকল সংস্কৃতি কর্মী, শিল্পী, শিল্পানুরাগী, ছাত্র-তরুণদের সঙ্গে নিয়ে এ আন্দোলনকে আমরা ক্রমান্বয়ে জনসাধারণের মধ্যে নিয়ে যেতে চাই।

এমন সামগ্রিক বিবেচনা থেকেই আমাদের মঞ্চের নাম পরিবর্তন করে তাকে মানুষের আরো কাছাকাছি এবং যথাযথ চিন্তাবহনের উপযুক্ত করার জরুরত আমরা বোধ করেছি। কেবল 'সচেতন' বা 'শিল্পী' হিসেবে নয়, সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে সংষ্কৃতি চর্চাকারী হিসেবে সর্বোপরি দায়বদ্ধ নাগরিক হিসেবেই আমরা সেই দায়িত্ব পালন করতে চাই। একইসঙ্গে আমরা বলতে চাই, আমাদের সংগ্রাম মূলত সাংস্কৃতিক সংগ্রাম। বাংলাদেশের সকল জাতি-ধর্ম-শ্রেণী ও নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক বৈচিত্র রক্ষা ও বিকাশে কাজ করাই হবে আমাদের লক্ষ্য। এই সংগ্রাম হবে নেতির বিরুদ্ধে ইতির, অসহিষ্ণুতার বিপরীতে সহনশীলতার এবং আধিপত্যের বিরুদ্ধে মুক্তির সংগ্রাম।