শিল্পগুরু সেলিম আল দীনের সঙ্গে (কিস্তি ২)

saymon_zakaria
Published : 14 Jan 2009, 06:23 AM
Updated : 14 Jan 2009, 06:23 AM


সেলিম আল দীন (১৮/৮/১৯৪৯ – ১৪/১/২০০৮), ছবি: নাসির আলী মামুন

১৪ জানুয়ারি লেখক-নাট্যকার সেলিম আল দীন-এর তিরোধান দিবস। সে উপলক্ষে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার, ঢাকা থিয়েটারসহ সারাদেশের বহু নাট্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন সেলিম আল দীন স্মরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে। ঢাকা ও কলকাতার লেখক-নাট্যকর্মীগণ যোগ দিচ্ছেন। সেলিম আল দীন-এর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে লেখাটির দ্বিতীয় কিস্তি প্রকাশিত হলো। প্রথম কিস্তি প্রকাশিত হয়েছিল গত বছর সেলিম আল দীন জন্মোৎসবে।

যে জন কেবল দেশী ফুলে মুগ্ধ
পুঠিয়ায় এক শীতের ভোরে আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুললেন সেলিম আল দীন। বললেন, চল হেঁটে আসি গ্রামের ভেতর। তড়িঘড়ি বিছানা ছেড়ে প্রস্তুত হয়ে নিলাম। এবার আমাকে সঙ্গে নিয়ে ঘর থেকে বাইরে এসে শিশির ভেজা গ্রামীণ পথ ধরলেন। পথের শুরুতেই একটা মরা নদী। তার শান্ত বুকে সারি সারি বেগুনি ও সাদা রঙের আবেশ ছড়ানো কচুরি ফুলে আমার চোখ মুগ্ধতায় আঁটকে গেল। সদাই ফুলে মুগ্ধ, ফুলে আনন্দিত গুরুকে সেই সকালে মুগ্ধতায় ফেলে দেওয়ার কৃতিত্ব লাভের প্রত্যাশায় বেগুনি-সাদার আবহে ভাস্বর কচুরির ফুলকে ইঙ্গিত করে মুগ্ধতা প্রকাশ করলাম। কিন্তু ব্যর্থ হলাম তাঁকে মুগ্ধ করতে, বরং তার বদলে ভীষণ কড়া একটা ধমক খেলাম। মনে মনে খুব কষ্ট পেলাম, মনে হলো আজকের সকালটাই মাটি হয়ে গেল, আবার ভাবলাম, ব্যাপারটা আসলে কী? কোনো ফুল দেখে তো তাঁকে কোনোদিন মুগ্ধতা প্রকাশে দ্বিধা করতে দেখিনি, আজ হঠাৎ এমন কী হলো! গতকাল ঢাকা থেকে এই রাজশাহীর পুঠিয়া আসার পথেও তো তিনি ছিলেন ফুলের প্রতিই মুগ্ধতা প্রকাশে উচ্ছল। এইসব ভাবনার মধ্যে একসময় নিরবতা ভেঙে সেলিম আল দীন বললেন, তোর এই মুগ্ধতাটা আমার ভালো লাগলো না। কারণ, ওটা আমাদের দেশি ফুল নয়।

মানে?

ওটা বহু বছর আগে এক বন্যায় এই দেশে ভেসে এসেছে।

বুঝলাম, শিল্পগুরু সেলিম আল দীনের শিষ্য হিসেবে মুগ্ধতা প্রকাশেও দেশজ হতে হবে।


ছাত্রসঙ্গে সেলিম আল দীন

প্রতিটি শিক্ষার্থীকে সৃজনশীল করে তোলার শিক্ষা
আমাকে একদিন (২০০৭ খ্রিস্টাব্দের কোনো এক দিন) প্রথমবর্ষের প্রথম ক্লাসে নিয়ে গেলেন। ছাত্রদের সঙ্গে তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে পরিচয় করে দিলেন এমন ভাবে যে, আমি খুব বড় মাপের লেখক, কবি, নাট্যকার এবং এতো বড় সব্যসাচী লেখক হবার পরও তাঁর অধীনে পিএইচ.ডি. গবেষণা করছি। যতবার তিনি নতুন করো সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিতেন ততবারই এই ব্যাপারটি তিনি করতেন, কিন্তু আসলে আমি তাঁরই জোর ইচ্ছেয় তাঁর অধীনে এম.ফিল. গবেষক হিসেবে ভর্তি হয়েছিলাম, এমনকি আমার এম.ফিল. গবেষণার বিষয়বস্তুও তিনি নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। আজ তাঁর শারিরীক অনুপস্থিতিতে অনুভব করছি — তাঁর অধীনে এম.ফিল. ভর্তি হতে গিয়ে আমার একটি বড় স্বীকৃতি মিলেছে — তাঁর স্বহস্তে লেখা একটি প্রসংশাপত্রে, যেটা এম.ফিল. ভর্তির আবেদনপত্রের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হয়েছিল। সে যাই হোক, তাঁর অধীনে এম.ফিল. ভর্তি হবার পর থেকে দেখা গেল যে, তিনি প্রায় সবখানে আমার পরিচয় দিতে থাকলেন আমি তাঁর অধীনে পিএইচ.ডি. গবেষণা করছি, অধিকাংশক্ষেত্রে আমি শুধরে দিতাম। তাই সেদিন প্রথমবর্ষের ক্লাসে বসেও তাঁকে বিষয়টি শুধরে দিতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু তিনি আমাকে বললেন — 'থাম, তোকে তো আসলে পিএইচ.ডি. দেবার জন্যই ভর্তি করেছি।'

শেষতক সেলিম আল দীন নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের প্রথমবর্ষের ক্লাস শুরু করলেন। শুরুতেই ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন, 'তোমরা কে কে কবিতা লিখতে পারো?'

কেউ কোনো কথা বলছে না দেখে তিনি এবার বললেন, 'যারা কবিতা লিখতে পারো তারা হাত তোলো।'
একজন কি দুজন ছাড়া কেউ হাত তুললো না।

সেলিম আল দীন বললেন, 'কিন্তু কবিতা না লিখতে পারলে সামনে এগোবে কীভাবে, নাটক করবে কীভাবে? আচ্ছা, তোমরা কবিতা-ছড়া জানো তো?'

কেউ কেউ বলল, জানি স্যার।

সেলিম আল দীন বললেন, "আমি জানি সবাই জানো। একটা ছড়া সবাই একসঙ্গে আবৃত্তি করো তো। কিন্তু কোন ছড়াটি আবৃত্তি করবে? আচ্ছা এক কাজ করো, 'ছিপখান তিন দাঁড় তিন জন মাল্লা' এই ছড়াটি নিশ্চয় সবার জানা আছে? তাহলে সবাই হাতে তালি দিয়ে ছন্দ ঠিক রেখে এই ছড়াটি আবৃত্তি করো।"

সেলিম আল দীনের এই কাণ্ড দেখে আমি তো অবাক। অনার্স প্রথমবর্ষের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে এমন ছেলে বেলার খেলা খেলার কোনো অর্থ হয়!

যা হোক, ক্লাসের সবাই সেলিম আল দীনের নির্দেশনা অনুযায়ী নির্বাচিত ছড়াটি হাতে তালি দিয়ে একসঙ্গে আবৃত্তি শুরু করলো। বেশ কিছুক্ষণ পর সেলিম আল দীন তাঁদেরকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, "এবার তোমরা প্রত্যেকে এই ছন্দে যে কোনো বিষয়ে একটা করে ছড়া বা কবিতা লেখো তো। সময় পাঁচ মিনিট। পাঁচ মিনিটে পারবে তো? না পাঁচ মিনিটেই লিখে ফেলো।"

কেউ একজন প্রশ্ন করলো, 'স্যার কী বিষয় নিয়ে লিখবো?'

'যে কোনো বিষয়। তবে প্রজাপতি, ফড়িং, পাখি, নদী, মানুষ, মাঠ ইত্যাদি নিয়ে লিখলেই ভালো। লেখো তাহলে। এখন থেকে সময় শুরু হলো। এখন বাজে…' ঘড়ি দেখে সময়টা বলে ঠিক পাঁচ মিনিট পর সেলিম আল দীন বললেন, 'সময় শেষ। সবাই লেখা বন্ধ করো। এইবার এক এক করে সবার কবিতা শুনবো।'

সবাই একে একে তাদের সদ্য রচিত ছড়া-কবিতা পাঠ করল। সবার লেখা নিয়ে আলাদা আলাদাভাবে মন্তব্য করলেন। আর সবশেষে বললেন, "তোমরা সবাই যে লিখতে পারো, তোমাদের ভেতর যে লেখার শক্তি আছে সেটা কি তোমরা জানতে?"

একজন বলল, 'না স্যার, কোনোদিন জানতাম না, আমি লিখতে পারি।'

আরেকজন বলল, 'আমারও স্যার একই কথা, আমি লিখতে পারি এটা জানতাম না।'

এবার আমার কাছে সেলিম আল দীনের এধরনের ক্লাস নেবার মর্ম স্পষ্ট হয়ে উঠলো। সেলিম আল দীন বললেন, 'আসলেই তোমরা জানতে না যে, তোমরা প্রত্যেকেই লিখতে পারো। এখন তোমরা বিশ্বাস করেছো তো তোমাদের সবার ভেতরেই লেখার শক্তি আছে। আমি আজকের এই প্রথম ক্লাসে তোমাদের সেই শক্তিটাকে চিনিয়ে দিলাম। এখন থেকে এই শক্তিটাকে কাজে লাগাবে তোমরা সবাই। আর মনে রাখবে প্রতিটি মানুষই সৃজনশীল।'

ক্লাস থেকে বের হয়ে এসে মৃদু হেসে আমার কাছে জানতে চাইলেন, 'কেমন হলো রে আমার ক্লাসটা?'
আমি বললাম, 'খুব ভালো স্যার। নতুন দীক্ষা পেলাম।'

যাঁর জন্য হয়েছি রে সঙ্গীতের পথিক
১৯৯৬ থেকে ২০০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে যখন সেলিম আল দীনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর হয়ে ওঠে তখন তাঁকে গান পাগল এক নাট্যকার হিসেবে আবিষ্কার করি। তিনি মাঝেমধ্যেই কথার ফাঁক-ফোঁকরের মধ্যে বলতেন, গান ছাড়া বাংলা ভাষায় লেখালেখি করা অর্থহীন। রবীন্দ্রনাথের দিকে তাকা, নজরুলের দিকে তাকা। আর যদি প্রাচীন ও মধ্যযুগের কবিদের দিকে তাকাস, তাহলে দেখবি — কে জানতো না গান।

মাঝেমধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে তাঁর বাসায় গেলেই হারমোনিয়াম নিয়ে গানের সুর করার চেষ্টা করতেন। আমার সঙ্গীত বন্ধু সাইম রানার কণ্ঠে নিজের লেখা ও সুর করা গানগুলো শুনতে খুব আনন্দ পেতেন।

গানের রাগ-রাগিনী, তাল, সুরের চলন, বাণী, গাহনরীতি বা গাহন সময় নিয়ে তিনি এমনভাবে কথা বলতেন যেন তিনি রাগ-রাগিনীর স্রষ্টাদের সঙ্গে বসে বসে নিজেই উদ্ভাবন করছেন গানের সুর। ভীমপলশ্রী, পটমঞ্জরী, ভৈরবী, বাগেশ্রী রাগের প্রতি তাঁর মুগ্ধতার শেষ ছিল না।

আমি যেহেতু সেলিম আল দীনের নাট্যদর্শনের অনুসারী হয়েই নাট্য রচনা শুরু করি তাই আমিও তাঁর এই গানের পাগলামীকে স্রেফ পাগলামী বলে হেলা করি না। বরং গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে নিয়ে ধ্র"পদী কণ্ঠসাধনের জন্যে বাংলাদেশের বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী ও সঙ্গীতগুরু সুমন চৌধুরীর কাছে ভর্তি হই। এমনকি কুষ্টিয়ার সাধু-ফকিরদের কাছ থেকে একতারা সংগ্রহ করে গলা সাধতে থাকি, গান বাঁধতে থাকি, হারমোনিয়াম কিনে আনি এবং ক্ষেত্রবিশেষে ঘরে বসে গান গাইতে চেষ্টা করি। এখনও যদি আমার প্রথম দিকের লেখার খাতার দিকে তাকাই দেখবো কবিতার পাশাপাশি বহু গানও সেখানে লিপিবদ্ধ রয়েছে।

আমরা প্রত্যক্ষ করেছি সেলিম আল দীনের নাটক মানেই মার্গীয় ভাষারীতির প্রয়োগ এবং সঙ্গীতের অসাধারণ ব্যবহার। মধ্যযুগের পাঁচালিরীতির ধারা দৃষ্টে তিনি তাঁর নাট্যে সঙ্গীতকে আশ্রয় দিয়েছেন একথা মানতে আমাদের কোনো বাঁধা নেই। আর মধ্যযুগের প্রেরণার অধিক নাটকে সঙ্গীত ব্যবহারের সাহস খুঁজে পেয়েছি সেলিম আল দীনের নাটক পাঠে এবং দর্শনে। পেছনে তাকিয়ে দেখি আমার প্রথম নাটক শুরু করি ভূমির নামে থেকে ন নৈরামণি, মহামানবসংহিতা, মলুয়া, কবি, বিদগ্ধ ডানার প্রজাপতি কিংবা এ নিউ টেস্টামেন্ট অব রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট ইত্যাদি সব নাটকেই সঙ্গীত এসেছে খুব সম্ভবত সেলিম আল দীনকৃত নাট্য দর্শনের প্রেরণায়। আসলে, আমার গ্রামীণ নাট্য দর্শন অভিজ্ঞতায় অর্জিত সঙ্গীত প্রয়োগে নাট্য রচনা হতে এখনো কিছু সময় লাগবে বৈকি, তার আগ পর্যন্ত সেলিম আল দীনকে বন্দনা করতেই হবে আমাকে।

নাটক পাঠের অভিজ্ঞতা
নিজের সৃষ্টির ভুবনেই সর্বক্ষণ বসবাস ছিলই সেলিম আল দীনের সবচেয়ে প্রিয় বিষয়। নতুন নাটক লেখার মুহূর্তে তিনি জগতের সকলকে যেন বলতে চাইতেন, এই দেখো আমি একটা কিছু সৃজন করছি, করে চলেছি, যার কাছে তোমরা নতজানু হও, আমি তো আগে থেকেই নতজানু হয়ে আছি, এবার তোমরা নতজানু হও। সম্ভবত এই অনুভব থেকে তিনি তাঁর নতুন নাটক লেখার মুহূর্তে যেই সামনে যেতেন বললেন, এই শোন গতকাল কী লিখেছি? তারপর স্বকণ্ঠে মোহাচ্ছন্ন ঋষির মতো নিজের নাটকের বর্ণনা-সংলাপ-গান পাঠ করে যেতেন, একবার নয়, দুইবার নয়, বারবার। একই নাটকের একই পৃষ্ঠা বারবার পাঠ করে শোনাতে কোনোদিন তাকে ক্লান্ত হতে দেখিনি, নিজের সৃষ্টি প্রতি এতো সুতীব্র মুগ্ধতাও আমি আমাদের সময়ের অন্যকোনো লেখক-কবির দেখিনি।

তিনি তাঁর জীবনের প্রতিটি লেখাকে মর্যাদা করতেন নিজের ঔরসজাত সন্তানের অধিক। নিজের কোনো সন্তান ছিল না বলেই কী সেলিম আল দীন তাঁর নাটকের চরিত্রগুলোকে সন্তান জ্ঞান করতেন!

মাঝেমধ্যেই বলতেন, 'বুঝলি সাইমন, কখনো কখনো মনে হয়, আমার মৃত্যু শয্যার পাশে এসে দাঁড়াবে আমার বনশ্রী, ছায়ারঞ্জন, আনারভাণ্ডারি, কেরামত, সোনাই, ডালিমন — আর কত নাম, যাদের জন্ম হয়েছে আমার হাতে, জীবনের আনন্দ-বেদনার ভার দিয়ে যাদেরকে আমি ঠিক ঠিক তুষ্ট করতে পারিনি। কিন্তু আমার মৃত্যু শয্যার পাশে সত্যি যদি তারা এসে দাঁড়ায় একদিন, তাহলে আমি কী তাদের কাছে ক্ষমা চাইলে ক্ষমা পাবো না?'

আমি আশ্চর্য হয়ে ভাবি, হায় স্রষ্টা সেলিম আল দীন, আপনি আপনার নাটকের চরিত্রদের এতোটা ভালোবাসেন! সৃষ্টির বহু বছর পরেও আপনি তাদের আনন্দ-বেদনার ভার নিয়ে সংশয়ে এবং কাগুজে চরিত্রদেরকে রক্তের মাংসের অধিক জ্ঞান করে নতুন নাটক রচনায় মেতে ওঠেন।

প্রাচ্য, বনপাংশুল, নিমজ্জন, স্বর্ণবোয়াল, ধাবমান, ঊষা-উৎসব ও স্বপ্নরমনীগণ, পুত্র এতো সৃষ্টি তো সেলিম আল দীন আমাদের চোখের সামনেই রচনা করেছেন। প্রথম দিকে বিকালের দিকে সেলিম আল দীনের বাসায় যেতাম, সন্ধ্যায় তাঁর সঙ্গে জাহাঙ্গীরগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত হেঁটে এসে প্রান্তিক কিংবা ডেইরি গেটে চা আর আড্ডা দিয়ে এসে রাতের খাবার সমাপণান্তে শুরু হতো সেলিম আল দীনের নাটক পাঠ শোনার চমৎকার অভিজ্ঞতা। আগেই বলেছি একটি নাটকের একটি পৃষ্ঠা তিনি বারবার পড়ে শোনাতেন এবং আমার চোখে-মুখে তাকিয়ে বিচার করে নিতে চাইতেন তাঁর লেখাটি আসলে খুবই শিল্পসম্মত বা ভিন্ন ধরনের কিছু হচ্ছে কি-না? কখনো কখনো তিনি সন্দেহ করতেন, তিনি একই একই পৃষ্ঠা বারবার পড়ছেন, আমি বোধ হয় তাতে ঠিক মতো মনোযোগ দিচ্ছি না, তাই তিনি একসময় লেখা আমার হাতে দিয়ে বলতেন, এবার তুই পড়।

আমি পড়তে শুরু করলাম। ওমনি তাঁর হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি হতে দু'একটি শব্দ ভুলভাবে পড়লে এমনভাবে ধমক দিয়ে উঠতেন যেন তাঁর সন্তানকে আমি থাপ্পড় মেরেছি। তারপর আমার হাত হতে পাণ্ডুলিপিটি কেড়ে নিয়ে আবার নিজেই পড়তে শুরু করতেন। সাধারণত রাত তিনটা পর্যন্ত এরকম চলতো। একসময় তিনি নিজ হাতে মশারি টানিয়ে দিয়ে লাইট অফ করে নিজের ঘরে গিয়ে শুতেন। তিনি চলে যাবার কিছুক্ষণের মধ্যে পারুল আপা এসে ডাক দিলেন, সাইমন ঘুমিয়ে গেছো না-কি?

আমি আবার উঠে বসলাম। এবার শুরু হলো পারুল আপা'র কথা শোনার পালা। এরমধ্যে সেলিম আল দীন এসে জুটলেন এবং পারুল আপাকে ধমক দিয়ে বললেন — 'এই তুমি ওকে ডেকে তুলেছো! ও ঘুমাবে না!'
আর এভাবেই পারুল আপাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে আমাকে বহু রাত তিনি জাগিয়ে আবার ঘুমের সুযোগ করে দিতেন।

শেষের দিকে রাত জাগা এবং একই সঙ্গে একই নাটকের একই পৃষ্ঠা বারবার শোনার ভয়ে বিকেলের দিকে আর সেলিম আল দীনের বাসায় যেতাম না। যেতাম খুব সকালে। বহু সকালে তিনি ঘুম থেকে ওঠার আগেই আমি হাজির হতাম এবং তিনি ঘুম থেকে উঠলে একসঙ্গে সকালের নাস্তা ও নতুন নাটক রচনা এবং লেখক হিসেবে আমাদের করণীয় সম্পর্কে আলাপ সারতাম।

সেলিম আল দীনের সমাধিতে মাটি অর্পণ
সেলিম আল দীন এক সম্মোহনের নাম। তিনি যে কোনো মানুষকে খুব সহজেই সম্মোহিত করতে পারতেন। তাঁর সম্মোহনী শক্তির গুণে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন কলাভবনের আমগাছের পাদদেশে বসা দৃষ্টিহীন সিগারেট বিক্রেতা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী-শিক্ষক, বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের শত শত কর্মী তাঁকে অন্তরে স্থান দিয়েছিলেন গভীর ভক্তিতে ও প্রেমে। আমিও তাঁর সম্মোহনীশক্তির বাইরে থাকতে পারি নাই। আর পারি নাই বলেই তো এদেশের বহু লেখক-কবি-নাট্যকার-গবেষক-শিল্পীদের সঙ্গে যে ঘনিষ্ঠতা আমার হয়নি, ঢাকার শহর থেকে একটু দূরে তাঁর আবাস হলেও সেলিম আল দীনের সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক ছিল অনেক গভীর, সে গভীরতার কথা অন্য কোনোদিন বলা যাবে। আজ শিল্পগুরু সেলিম আল দীনের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী দিনে ঠিক এক বছর আগে তাঁকে সমাধিস্থ করার কথা খুব মনে পড়ছে।

যখন সেলিম আল দীনকে সমাধিস্থ করা হচ্ছিল তখন মন থেকে আমি তাঁর সমাধিতে মাটি দিতে চাই নি, মনে হচ্ছিল — না, সেলিম আল দীনকে এই মাটির গহরে দেবার পক্ষে আমি নই, আমি তবে কেন তাঁর সমাধিতে মাটি দেব, নিজের সঙ্গে নিজের একটা যুদ্ধ চলতে থাকলে অনেকক্ষণ, ভাবছিলাম — কী করি?

সহসা মনের গভীর থেকে একটা ভয় এসে আমাকে তাড়া করলো, যদি তাঁর সমাধিতে মাটি না দিই তিনি নিশ্চিত স্বপ্নের ঘোরে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করবেন — 'সাইমন, তুই না আমার পুত্র, তুই আমাকে মানে আমার সমাধিতে মাটি দিলি না! কিন্তু কেন দিলি না, তাহলে কি তুই আমাকে ভালোবাসতি না, আমাকে ভক্তি করতি না?

এমন প্রশ্নের প্রান্তে দাঁড়িয়ে আমি অনেকটা ভয়ে মাটির সমাধিতে শুয়ে পড়া সেলিম আল দীনের মুখটা একটুখানি দেখে তাঁর পায়ে ভেজা কুসুমের মতো এক মুঠো মাটি অর্পণ করলাম, আর মনে মনে বললাম, স্যার অজানা অনন্তের দিকে আপনার নতুন অভিযাত্রা শান্তি ও স্বস্তিময় হোক।

ঢাকা, ১৪/১/২০০৯

saymonzakaria@gmail.com