রৌরব (কিস্তি ৪)

লীসা গাজী
Published : 15 Feb 2009, 11:42 AM
Updated : 15 Feb 2009, 11:42 AM

(কিস্তি ৩-এর পর)

কী ঘটতে পারে তা আগাম চিন্তা করে লাভলির চোখ মুখ রক্তিম হয়ে যাচ্ছে, মানে ওর ময়লা রঙের পক্ষে যতোটা রক্তিম হওয়া সম্ভব ততোটাই। এই চল্লিশ বছরেও ওর ময়লা রঙের কিচ্ছা শেষ হলো না। আম্মা কালকে রাত্রেই বললেন, ওর রঙটা ময়লা বইলা কি ওরে গাঙে ভাসায় দিতে হইবো নাকি! এইসব কথা সবই মুখলেস সাহেবের উদ্দেশ্যে বলা। তারপর গলা নিচু করে আরও এক দুই লাইন যোগ হয় — তোমার কী আসে-যায়, তুমি তো পার করতে পারলেই বাইচ্চা যাও। মেয়েদের জীবন যে কতো রঙের আমার জানা আছে; হাড়ে হাড়ে জানা আছে। যদিও মুখলেস সাহেব ভদ্রলোকের সাত চড়ে রা নাই অবস্থা। তবুও নীরবতা সম্মতির লক্ষণ না ধরে প্রতিবাদের লক্ষণ বলে ধরে নিলেন ফরিদা খানম। তাই মেয়েদের বিয়ে না দেয়ার পিছনে তার নানান যুক্তি তিনি দিনের মধ্যে বত্রিশবার আওড়ে যান। এই আনুষ্ঠানিক কৈফিয়ত জারি অবশ্য মাস খানেক হয় শুরু হয়েছে আর দিনকে দিন তা বাড়ছে। নইলে ফরিদা খানম দেবেন কাউকে কৈফিয়ত — এ কি কেউ স্বপ্নেও ভেবেছিলো? তাহলে কি সত্যিই তার শরীরের সাথে সাথে মনও নরম হয়ে আসছে? তার অবর্তমানে মেয়েদের ভয়াবহ পরিণতি কি তিনি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন?
—————————————————————–
লোকটার কথা শেষ হওয়ার আগেই ও পড়িমরি দৌড় লাগালো, পিছনে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে যায় লাল মাফলার। পার্কের সাধারণ জীবনে ঘূর্ণির সৃষ্টি হলো। বলা নাই কওয়া নাই একজন মহিলা হঠাৎ দৌড় দিলো, কেন দিলো, কী কারণে দিলো — এইসব বৃত্তান্ত জানার আগ্রহ পার্কবাসীর চোখেমুখে প্রকট হয়ে ওঠে। এই প্রথম লাল মাফলারের বিরক্ত লাগে। ছিটগ্রস্ত মহিলা ব্যাপারটা খারাপ না, কিন্তু এরকম লাগামছাড়া ছিটগ্রস্ত হলে তো বিপদ! কোনো রকম আগাম ওয়ার্নিং ছাড়া দৌড় দেয়, ইয়ার্কি আর কি! একজন দাড়িওয়ালা টুপিপরা লোক গম্ভীর মুখে এগিয়ে এলো।

— ভাইজান, মহিলা পকেটমার নাকি? এখনও দৌড় দিলে ধরতে পারবেন।

—————————————————————-
আচমকা একটা গানের সুর লাভলির মাথায় চক্কর খেয়ে গেলো, আর সেই মুহূর্তে লাল মাফলার ওর সামনে এসে দাঁড়ালো। এ নির্ঘাৎ ভবিতব্য, আর কিছু না, নির্ঘাৎ তাই!

'চলতে চলতে ইঁউহি কয়ি মিল গায়াথা, সারে রাহা চলতে চলতে…'

— পরামর্শ শেষ হলো আপনাদের? চলেন উঠি… সরি… মানে কী ঠিক করলেন… যাবেন আমার সাথে।

(– হ্যাঁ যাবো।)

— হ্যাঁ যাবো।

— বাসায় ফিরতে আপনার রাত হবে…।

— জানি।

লাভলি নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালো, সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ঝোলাটা কাঁধে নিলো আর তখুনি ও বাদামওয়ালাকে দেখে ফেললো। ওর বেঞ্চের ডান পাশের বিশাল গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে আর ওর দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ পড়তেই ঝটিতে উল্টামুখ হয়ে হাঁটা দিলো। এতক্ষণ বোধহয় ওখানেই দাঁড়িয়েছিলো। বেচারার ব্যবসা আজকে তাহলে আর বিশেষ জমে নাই। বাঙালি মরলোই পরের চরকায় তেল দিতে দিতে!

লাল মাফলার হাঁটছে আগে আগে আর লাভলি পিছে পিছে — আগে চলে দাসি বান্দি পিছে সখিনা! — বড় ভালো লাগছে ওর। এখন যদি ছেলেটা হাঁটাটা একটু ঢিমা করে আর ওর হাতটা ধরে, ও কিচ্ছু মনে করবে না। গানটা পুরো শরীরময় এখন ওঠানামা করছে। 'চলতে চলতে ইঁউহি কয়ি মিল গায়াথা, সারে রাহা চলতে চলতে…।' মাথা দু' ফাঁক করে বুকে নামছে, তারপর পেটে তারপর দু' পা বেয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে; আবার মাথায় উঠে আসছে। এ কী যন্ত্রণা!

বছর খানেক হলো মুখলেস সাহেব পুরানো হিন্দি গান শোনা ধরেছেন। এখন লাভলিদের বাসায় সারাক্ষণই শামশাদ বেগম, সুরাইয়া, মোহাম্মদ রফিরা রাজত্ব করছে। পয়লা পয়লা ওদের দুই বোনের অসহ্য লাগতো, আজকাল খুব ভালো লাগে, অপেক্ষা করে থাকে কখন মুখলেস সাহেব নূরজাহান ছাড়বেন বা গীতা দত্ত। কিন্তু তার আছর যে ওর উপর এইভাবে পড়বে সেটা কে জানতো!

— খাবেন কিছু?

হাঁটা থামিয়ে লাল মাফলার জিজ্ঞেস করলো। খাওয়ার কথা শুনেই পেট চোঁ চোঁ করতে থাকে লাভলির। পাঁচ টাকার বাদাম শেষ করেছিলো কি না তাও মনে করতে পারছে না। খিদার জন্যই তাহলে মাথাটা ধরেছে। ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। আলতো করে ঠোঁট চেটে নিলো লাভলি।

— না।

গলায় কোনো জোর পাওয়া গেলো না। দৃশ্যটা এরকম, লাল মাফলার আর ও দীঘি ঘেঁষে হাঁটছে। দীঘির পাশ দিয়ে পায়ে চলার পথ, পথের উপর ওরা দু'জন, সামনে লাল মাফলার পিছে লাভলি। ওদের ডান পাশে দীঘি আর বাঁ পাশে বিশাল তরুরাজি। কথাটা বলবার জন্য লাল মাফলার দাঁড়িয়ে পড়লো এবং পিছনে ফিরে জিজ্ঞেস করলো।

— খাবেন কিছু?

ছেলেটার পাঁচ গজ পিছনেই ছিলো লাভলি। অতর্কিত প্রশ্নে ও থমকে দাঁড়ালো।

— না।

সাথে সাথে আশপাশটা ছবির মতো হয়ে গেলো। লাভলির ঠোঁট চাটা লক্ষ্য করে ছেলেটা হেসে ফেললো। অপেক্ষা করছে লাভলির এগিয়ে আসার। এগিয়ে আসবে না টের পেয়ে সেই পায়ে পায়ে ওর কাছে গেলো।

— আপনাকে দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে খুব ক্ষুধার্ত। কী ব্যাপার, আপনার কি খুব শীত করছে?

মোটেও শীত করছে না, ছেলেটা কাছে আসাতেই কুঁকড়ে গেছে ও। শালটা ভালো করে জড়িয়ে নিলো। চারদিক চোখের কোণা দিয়ে দেখে নিলো। রমনা পার্কে এখন কেউ নাই নাকি? জনমানুষের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না আশেপাশে কোথাও। সবাই ভোজবাজির মতন উড়ে গেছে। মনে হলো, এই দুনিয়াছাড়া পার্কটাতে শুধু ওরা দু'জন অনন্তকাল ধরে দাঁড়িয়ে। দমকা বাতাসে কেঁপে উঠলো লাভলির অন্তরাত্মা। প্রচণ্ড ভয়ে অসাড় হয়ে গেলো, মনে হলো বুঝি কাপড় নষ্ট করে দিবে। আগুপিছু চিন্তা না করে অসাড় শরীরটাকে নিয়ে ও বেদম ছুটতে শুরু করলো। পিছনে তাকাবার সাধ্যও ওর নাই। কিছুক্ষণ ছোটার পর হঠাৎ করে আসা ভয়টা হঠাৎই উবে গেলো, সাথে সাথে ও দরদর করে ঘামতে লাগলো। একটু দূরেই পার্ক থেকে বের হবার বড় গেইটটা চোখে পড়লো — 'ফি আমানিল্লাহ' নিঃশব্দে বলে উঠলো ও। এবার বেশ কয়েকজন পার্কবাসী মানুষজনের দেখা পেলো। পিঁপড়ার সারির মতো সাহস ফিরে আসছে। একটা বড় গাছের ছায়ার নিচে লাভলি দাঁড়ালো, দেখতে চায় লাল মাফলার এইদিকে আসে কি না। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করবার জন্য ও মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করে নিলো। ঝোলার ভিতর ছুরিটা থাকা সত্ত্বেও কেন যে এত ভয় পেলো সেটা ভেবে লাভলির এখন নিজেকে বোকা বোকা লাগছে। সাধে কি আম্মা ডাকেন, 'বেকুবের বেকুব'!

— খুব ভয় পাইছিলাম।

( — আমিও।)

— তুমি ভয় পাও নাকি?

(– আজকে তো পাইলাম।)

— এতো ভয় পাইলাম কেন?

(– আপুমনি, এইখানে দাঁড়ায় আছেন কেন?)

— লাল মাফলার এই পথে যায় কি না দেখি। লাবলিকে খোঁজা দরকার।

( — মানে?)

— আরে, পানি পিপাসা লাগছে।

(– অ… )

— ঐ ওই যে ঐ যে লাল মাফলার। বুদ্ধি দাও, যাব নাকি দাঁড়ায় থাকবো? এমনিতে তো সারাক্ষণ ফড়ফড় করে লেকচার মারতে থাকো। … কী করবো… এখন মনে হয় আমার সাথে কথা বলবে না। কী করবো, চলে যাবো?

( — জানি না আপুমনি, আজকে আমার বুদ্ধির চাইতে আপনারটার ধার বেশি।)

— আশেপাশে অনেক মানুষ, এইখান থেকে রাস্তা দেখা যায়, গাড়ির হর্ন শোনা যায়, গেটের সামনে দুইটা সিএনজি দেখছো? ভয় কীসের?

কথাগুলো মাথার ভিতরের লোকটাকে বললো না নিজেকে বোঝা গেলো না। এর মধ্যে লাল মাফলার বেশ কাছাকাছি এগিয়ে এসেছে, যদিও এখনও লাভলিকে দেখে নাই। মাথা নিচু করে হাঁটছে। লাভলি আবারও ভিজে গেলো, নিজের গালে নিজের চড় দিতে ইচ্ছা করছে। এটা কী ধরনের তামাশা? ছেলেটার সাথে কথাবার্তা বললো, ছেলেটার বাড়িতে যেতে রাজি হলো, আবার খামাখাই গাধার মতো দৌড় দিলো — ঢঙ আর কী! লাল মাফলার এখন চোখ তুললেই লাভলিকে দেখতে পাবে। যদি না তাকিয়ে ঘুরে যায় তাহলে আর হবে না! লাভলি দোয়া পড়ছে, 'আল্লাহ দেক, ছেলেটা তাকাক, আল্লাহ দেক ছেলেটা তাকাক'। — এবং তাকালো।

লাল মাফলার অবাক হয়ে লাভলির দিকে তাকিয়েই রইলো। মুহূর্তের জন্য দুই ভ্রূ বাঁকা হয়ে গেছিল, কিন্তু তা মুহূর্তের জন্যই শুধু। আবার ভ্রূজোড়া সোজা হলো, ওর মুখের উপর দিয়ে ছেলেটার দৃষ্টি মেঘে ঢাকা রোদের মতো দেখা দিয়ে মিলিয়ে গেলো। ছেলেটা ওকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। লাভলির চাউনি হতাশায় নেমে যাচ্ছে।

— আপনি এরকম দৌড় দিলেন কেন? যেতে না চাইলে যাবেন না। আমি তো আপনাকে জোর করি নাই।

দু'এক পা এগিয়ে গিয়ে লাল মাফলার আবার ওর ঠিক মুখের সামনে ফিরে এলো।

— কয়টা বাজে।

— পাঁচটা বিশ।

— বাসায় যাবো।

— চলেন আপনাকে নামিয়ে দিয়ে আসি। অসুবিধা নাই তো…?

— অসুবিধা আছে, তবুও চলেন।

নিজের সাহসে লাভলি আজকে বারবার চমৎকৃত হচ্ছে। পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে!

— আপনের বাসায় আমি আজকে যাবো না। আমার বোনকে ছাড়া আমি কিছু করতে পারি না, হাজার চেষ্টা করলেও না। বিউটির জন্য খারাপ লাগে।

— ঠিক আছে, আরেক দিন না হয় বিউটিকে সাথে নিয়েই আসবেন।

লাল মাফলারের কথায় লাভলি হেসে ফেললো — এত সহজে আরেক দিন যেতে বললো যে না হেসে কোনো উপায় ছিলো না। আহারে লোকটার কোনো ধারণাই নাই লাভলিদের জীবন কেমন। সেখানে আরেক দিন আসে না। সেখানে একই দিনের পুনরাবৃত্তি ঘটে বছরের পর বছরের পর বছর! যদিও বা ধূমকেতুর মতো অন্য রকম কোনো এক দিনের দেখা মেলে তবে তা ধূমকেতুর মতোই — দেখা দিয়ে মিলিয়ে যায়।

— বিউটির রঙ আমার চেয়ে পরিষ্কার, আপনের পছন্দ হবে।

লাল মাফলারকে কথাটা কেন বললো লাভলি জানে না। কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করে গেইটের দিকে পা বাড়ালো। লাল মাফলার সুবোধ বালকের মতো ওর পিছু নিলো।

(– আপুমনি, সত্যি সত্যি বাসায় চলে যাচ্ছেন। এমন একটা হিরো মার্কা ছেলে… এত যে বিউটি বিউটি করেন, বিউটি আপা তো পরোয়া করে না। রিয়াজের সাথে আপনের গোপন লীলাখেলা খালাম্মা টের পেলেন কেমনে বলেন? নিজেকে কখনও জিজ্ঞাসা করছেন কথাটা? বিউটি আপা ভাঙ্গানি দিছে… )

আরও কী কী যেন বলে যাচ্ছিলো লোকটা কিন্তু লাভলি আর শুনতে চায় না, লোকটার কথা শেষ হওয়ার আগেই ও পড়িমরি দৌড় লাগালো, পিছনে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে যায় লাল মাফলার। পার্কের সাধারণ জীবনে ঘূর্ণির সৃষ্টি হলো। বলা নাই কওয়া নাই একজন মহিলা হঠাৎ দৌড় দিলো, কেন দিলো, কী কারণে দিলো — এইসব বৃত্তান্ত জানার আগ্রহ পার্কবাসীর চোখেমুখে প্রকট হয়ে ওঠে। এই প্রথম লাল মাফলারের বিরক্ত লাগে। ছিটগ্রস্ত মহিলা ব্যাপারটা খারাপ না, কিন্তু এরকম লাগামছাড়া ছিটগ্রস্ত হলে তো বিপদ! কোনো রকম আগাম ওয়ার্নিং ছাড়া দৌড় দেয়, ইয়ার্কি আর কি! একজন দাড়িওয়ালা টুপিপরা লোক গম্ভীর মুখে এগিয়ে এলো।

— ভাইজান, মহিলা পকেটমার নাকি? এখনও দৌড় দিলে ধরতে পারবেন।

লোকটার দিকে কোনো রকমে এক ঝলক তাকিয়ে লাল মাফলারও ঝেড়ে দৌড় দিলো — যেন পকেটমার আসলে সে নিজেই আর লোকজন তাকে ধরার জন্য পিছে পিছে ধাওয়া করছে। শুধু তাই না এই যাত্রা ছুটে পালাতে না পারলে বাঁচার সম্ভাবনা জিরো। — ছুটতে ছুটতে রমনা গেইটের মুখে এসে দেখে লাভলি এরই মধ্যে একটা সিএনজিতে উঠে পড়েছে। ঠিক উঠে পড়বার মুহূর্তে লাভলি চকিতে পিছন ফিরে তাকালো — চোখোচোখি হলো লাল মাফলারের সাথে — ওর চোখ ছাপিয়ে পানি পড়ছে। দেখার ভুলও হতে পারে, ভাবলো লাল মাফলার। এমনিতেই দৌড়ে এতো দূর আসায় কুকুরের মতো জিহ্বা বের করে খাবি খাচ্ছে সে — যখন দেখলো লাভলি একটা সিএনজিতে উঠে পড়েছে আর সিএনজিটা প্রায় চলতে শুরু করেছে তখন ভিতরে একটা প্রচণ্ড তাড়া অনুভব করলো, — চোখের পলকে আরেকটা সিএনজিতে উঠে সামনেরটার পিছে পিছে যেতে বললো সে।

লাভলি বসে আছে আর সিএনজি ছুটছে নিজের ক্ষমতাকে অতিক্রম করে।

(– আপুমনি, লাল মাফলার সাহেব পিছনে আছেন, চিন্তা নাই।)

লাভলি দুই হাঁটুর মাঝখানে মুখ গুঁজে দিলো, শাল দিয়ে কান মাথা ঢেকে ফেললো। নদীর তোড়ের মতো কান্না আসছে। অনেক দিন পর কাঁদতে পারার এই স্বাধীনতা প্রাণভরে উপভোগ করলো ও। কাঁদছে লাভলি কাঁদছে।

(– আপুমনি এইটা কী শুরু করলেন। উঠেন, সামলান। র‌্যাব লিডার বাসায় কালো কাপড় পরে অপেক্ষা করতেছেন… )

লোকটার শেষের কথাগুলো লাভলি আর শুনতে পেলো না, ওর মনে পড়লো সেদিন ও খুব কষ্ট পেয়েছিলো। কী হয়েছিলো, ফরিদা খানম রিয়াজকে কী বলেছিলেন — তার কিছুই ও জানে না। ফরিদা এই ব্যাপারে ওর সাথে একটা কথাও বলেন নাই। শুধু একদিন ফাঁসির রায় ঘোষণার মতো শুনলো রিয়াজ আর আসবে না। বুকের পাঁজর গুঁড়িয়ে যাচ্ছিলো ওর, অথচ বিউটি বেশ ফুরফুরে মেজাজে সেদিন রূপচর্চা করলো। ওর পিঠছাপানো কালো চুলে ডিম দিলো, ডিম ডিম গন্ধ নিয়ে খামোখাই এ ঘর ও ঘর ঘুরে বেড়াতে লাগলো। ফরিদা খানমের সাথে স্বভাবসুলভ তর্ক বাদ দিয়ে সখী ভাব নিয়ে কথা বললো, হেসে ঢলে পড়লো। হ্যাঁ, সবই মনে পড়ছে লাভলির।

— ছিনাল! ছিনাল মেয়ে মানুষের ছিনালি যায় না। ছিনালি বার করতাছি আমি। কীসের এত চুলকানি বার করতাছি। কত বড় শয়তান ছেলে, কত বড় শয়তান!

দাঁতের ফাঁক দিয়ে বিষ উগরে দিচ্ছিলেন ফরিদা খানম। সেই প্রথম তিনি নিজের কর্তৃত্ব এবং নজরদারির উপর সন্দিহান হলেন। তার দৃষ্টি এড়িয়ে বলতে গেলে তার প্রায় নাকের ডগার সামনে এতো বড় কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে দিনের পর দিন আর তিনি ঘূণাক্ষরেও টের পান নাই!

সেইবার আঠারো দিন ঘর-বন্দি থাকলো লাভলি। সেই প্রথম লাভলির কারণে ওরা দুই বোন এতো দীর্ঘ দিনের জন্য ঘরে আটকা পড়লো। কিন্তু সে জন্য বিউটির মধ্যে কোনো খেদ লক্ষ্য করা গেলো না। সে রূপচর্চা করলো আর ভিসিআরে হিন্দি সিনেমা দেখে খুশি থাকলো। মাঝে মাঝে বিউটির ঘর থেকে মা-মেয়ের সম্মিলিত হাসির শব্দ শোনা যেত। ফরিদা লাভলির ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হয়তো ওকে শুনিয়ে বুয়াকে বলতেন বিউটির প্রিয় কোনো খাবার রান্না করতে। রাতের খাবারের সময় বিউটির দরজা খুলে দিতেন, এমনকি বিউটির জন্য একদিন একটা তাঁতের শাড়িও কিনে আনলেন। একদিন ওর শাস্তির মেয়াদ শেষ হলো, ফরিদা দরজা খুলে দিলেন — লাভলি তখন চুপচাপ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিলো, লক খোলার শব্দে ঘাড় ফিরিয়ে দেখলো ফরিদা খানম দরজা আগলে দাঁড়িয়ে আছেন, চাপা গলায় হিসহিস করে বললেন, "আমারে চিনস নাই, জানে শেষ করবো।"

এর উত্তরে লাভলি মিষ্টি করে হাসলো। ফরিদা খানম ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। জীবন চলতে লাগলো গৎবাঁধা, যেমনকে তেমন। নিস্তরঙ্গ জীবন কোথাও কোনো ঢেউ নাই। রিয়াজ প্রসঙ্গে আর কোনো কথা লাভলিদের বাড়িতে কেউ কখনও উচ্চারণ করে নাই। রিয়াজ কখনও এ-বাড়িমুখো হয় নাই, এমনকি রিয়াজের মা ওদের ছোটো খালাও আর কোনোদিন লাভলিদের বাড়িতে আসেন নাই। কোনোদিন কথাটা অবশ্য পুরোপুরি সত্য না। নয় বছর আগে একদিন সকাল সাড়ে নয়টায় ছোটো খালা আসলেন সাথে খালুজান। খালুজান একটা কথাও খরচ করলেন না। গম্ভীর মুখে বসে রইলেন। খালার মুখ অবশ্য গম্ভীর ছিলো না। তাচ্ছিল্যের হাসি সারাক্ষণই ঠোঁটের প্রান্তে ঝুলে ছিলো। ওরা এসেছিলেন রিয়াজের বিয়ের কার্ড নিয়ে। নয় বছর আগে একদিন। রিয়াজ যে কাজে কামে কতো ভালো করছে তার ফিরিস্তি শোনালেন, পাত্রীর গুণগান করলেন শতমুখে এবং চড়া গলায়। যাওয়ার সময় দরজায় দাঁড়িয়ে ওদের দুই বোনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, "তোমাদের শরম লাগতে পারে, তোমাদের আগে ছোট ভাইয়ের বিয়া হয়ে যাচ্ছে, তাও পারলে আইসো।"

অবশ্য ফরিদা খানম ছাড়া ওরা কেউ গেল না। লাভলির যেতে খুব শখ হয়েছিলো, কিন্তু মা'কে ভয়ে বলতে পারে নাই। ফরিদা খানম যাওয়ার পর ওরা দুই বোন প্রথম ভয়ঙ্কর খেলাটা খেললো। খেলার আইডিয়াটা যদিও ছিলো বিউটির কিন্তু নিখুঁতভাবে খেলে গেল লাভলি। তারপর ঠিক এক মাস দশদিন পরে মাথার ভিতরের লোকটা লাভলিকে তার অস্তিত্ব জানান দিলো।

(– আপুমনি, এত রোজা রেখে লাভ কী? মটকা মেরে পড়ে থাকেন।)

* * *

লাভলি আর বেশিক্ষণ মটকা মেরে পড়ে থাকলো না। এতক্ষণ দুই হাঁটুর ভাঁজে নিঃসাড় হয়ে পড়েছিলো। এবার ধীরে মাথা তুললো। চলন্ত বাতাসের দাপট আর রোজকার রাস্তার শব্দ তাকে চাবুকের ঘায়ে বর্তমানে ফিরিয়ে আনলো। ঘাড় ঘুরিয়ে সিএনজির পর্দা সরিয়ে দেখবার চেষ্টা করলো লাল মাফলার সত্যিই আসছে কিনা। বুঝতে পারলো না। পিছনে সারবাঁধা গাড়ি, বাস আর তারই ফাঁকে-ফোঁকরে সিএনজিরা ছুটে আসছে। ঘ্যাঁচ করে ট্রাফিক লাইটের সামনে এসে থেমে গেল, সিএনজিওয়ালার বোধহয় ইচ্ছা ছিলো টেনে বেরিয়ে যাবে কিন্তু বাধ সাঁধল ট্রাফিক পুলিশ, লাঠি উঁচিয়ে বাড়ি মারারও ইঙ্গিত করল সে।

— খানকির পোলা তোর বাপেরটা খাই নিহি?

চাপা গলায় হিসহিসিয়ে ওঠে সিএনজি-ড্রাইভার।

— শুনেন, আমি আছি পিছনে। আপনি ভয় পাচ্ছেন না কি?

লাল মাফলার কখন নিঃশব্দে এসে সিএনজির গা ছুঁয়ে দাঁড়িয়েছে লাভলি খেয়াল করে নাই। প্রশ্ন শুনে কেঁপে উঠলো।

— না, একটু। একটা কথা, বাসার সামনে আমি নেমে যাবো, আপনে কিন্তু নাইমেন না। সোজা চালায় যেতে বইলেন। আম্মার ঘর থিকা রাস্তা দেখা যায়, আম্মা পর্দা ধরে দাঁড়ায় থাকবেন।

কথা কয়টা শেষ করলো কি করলো না পিছনের গাড়ির বহর পাগলা হয়ে উঠলো। হর্নের শব্দ আর ছিটকে আসা গালি-গালাজে বোঝা গেল লাল বাতি সবুজ হয়েছে। লাল মাফলার লাভলির কথায় কোনো রকমে মাথা ঝাঁকিয়ে ফিরে গেলো।

"বাড়িত যান, রাস্তায় খাড়ায়া পীড়িত কীসের?" বাসের গায়ে থাপ্পড় মেরে কন্ডাক্টর রসিকতা করে, দাঁতের ফাঁক দিয়ে থুথু ফেলে রাস্তায়।

বাকি পথটুকু আর কোনো ঘটনা ঘটল না। বাসার কাছের কুপারস পেরিয়ে যেতেই লাভলির ভয় শুরু হলো। এক মনে 'সুবাহানাল্লাহ' 'সুবাহানাল্লাহ' পড়ছে তো পড়ছেই। এক সময় বাসার সামনের কলাপসিবল গেইটের একটু সামনে গিয়ে সিএনজি থামলো। লাভলি ভিতরে বসেই খানিকটা সময় নিয়ে ভাড়া মিটাল। ও দেখতে চায় লাল মাফলার কখন ওদের বাসা ছাড়িয়ে চলে যায়। কিন্তু পিছনে আর কোনো সিএনজি ছিল না। এক সময় হাজারো ক্লান্তি নিয়ে লাভলি ঘাড় নুইয়ে সিএনজি থেকে নামে। ধীরে গেইট পর্যন্ত হেঁটে যায়, তারপর যখন গেইটের পেটের ছোট্ট গেইট খুলে ভিতরে এক পা রাখে ঠিক তখুনি ওর পিছন দিয়ে হুঁশ করে আরেকটা সিএনজি বেরিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে লাভলির। গলার কাছে দলা পাকানো কী একটা ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়। তারপরও আশ্চর্য সংযমে পিছন ফিরে তাকাল না লাভলি — কারণ ও নিশ্চিতভাবেই জানে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছেন ফরিদা খানম। যদিও শীতের সন্ধ্যা নেমে এসেছে, সময় ছয়টা চল্লিশ; চারপাশ ঘন কালো চাদরে ঢেকে যাচ্ছে। তবুও লাভলি কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি না।

লাভলি গেইটের ভিতরে ঢুকে নিজের অজান্তেই মাথার উপর শাল চড়াল। মাগরিবের নামাযও ক্বাযা হয়ে গেছে। আন্তরিকভাবে দুঃখবোধ করলো। বাসায় ঢুকেই ওযু করে ক্বাযা নামাযগুলো আদায় করতে হবে, ভাবল লাভলি। বুকের উপরে চেপে বসে থাকা ভয়টা জোর করে হটিয়ে সাহস আনার চেষ্টা করলো। ধীরেসুস্থে দোতলা বাড়ির দিকে এগোচ্ছে। অনেক কষ্টে বিশেষ একটা জানালার দিকে তাকাবার ইচ্ছা সংবরণ করলো। চুপচাপ ঢুকে গেল বাড়ির ভিতর, সেখানে সিঁড়ির মুখে আরেকটা তালা দেয়া গেইট। ও ভেবেছিল গেইট খোলা থাকবে, কিন্তু ছিল না, — কলিং বেলে চাপ দিল আর সাথে সাথে ছুরিটার কথা মনে পড়ে গেল লাভলির। চোখের পলকে ঝোলার চেইন খুলে আছাড়ি বিছাড়ি খুঁজতে থাকে। — ঝোলার একদম তলা থেকে খয়েরি কাগজে মোড়ানো ছুরিটা বের করে নিঃশ্বাস বন্ধ করে কামিজের নিচে শেলওয়ারের গিঁঠে আটকে রাখে। ভালো করে ওড়না আর শাল দিয়ে নিজেকে ঢেকে ফেলে। উত্তেজনায় বুক ধ্বক্ ধ্বক্ করছে। বড় জোর তিরিশ সেকেন্ড লেগেছে পুরো কাজটা সম্পন্ন করতে কিন্তু ওতেই ওর হয়ে গেছে! তখনও দোতালার দরজা খোলার আওয়াজ পায় নাই। কিছুক্ষণ দম নিলো লাভলি তারপর আবার কলিংবেল টিপে ধরল। ভিতর থেকে এক ধরনের অবুঝ, বাগ না মানা গোঁ পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। যা হবার হবে। টিপে ধরেই থাকল। অনন্তকাল কী ধরেছিলো? — দরাম করে দরজা খোলার শব্দ পেল লাভলি, কলিং বেলের উপর থেকে হাত সরিয়ে দিল।

— বড় খালা আসতাছি, খাড়ান।

ইবলিশটার গলা। সন্তানের ভালোবাসায় ছুরিটায় পরম আদরে হাত বুলালো লাভলি।

(– সাবাশ আপুমনি! আমি ভাবলাম আজকে বোধহয় দরজাই খুলবে না।)

সিঁড়ি ভেঙে ধুপধাপ নিচে নেমে আসছে পিচ্চি আর লাভলি সিঁড়ি-গোড়ায় দাঁড়িয়ে দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

দুই
আজ ফযরের নামাযের ওয়াক্ত পার হয়ে যাওয়ারও মিনিট কুড়ি পরে ফরিদার ঘুম ভাঙলো। আজকাল প্রায়ই এরকম হচ্ছে। আগে যেমন ঘুম ভাঙার সাথে সাথে চাবুকের মতো সপাং করে উঠে বসতে পারতেন আজকাল সময় লাগে। মনে হয় বিছানায় আরও কিছুক্ষণ পড়ে থাকলে কী আর এমন কেয়ামত উপস্থিত হবে। আজকে যদিও ম্যালা কাজ, তবুও উঠতে উঠতে দেরি হয়েই গেলো। কাজে লাগার আগে ওযু করে নামায পড়লেন তারপর রান্নাঘরে উঁকি দিলেন। রাবেয়ার মাও বোধহয় এখনই উঠেছে, চোখের পাপড়িতে তখনও ঘুম লেগে আছে। খুবই বিরক্ত হলেন ফরিদা। কালকে রাতেই বলেছেন ঘুম থেকে উঠে প্রথমে মুখলেস সাহেবের জন্য কয়েকটা আটার রুটি বানিয়ে রাখতে। সবার জন্য আজকে লুচি হবে কিন্তু উনার শরীরটা ভালো না, লুচি পেটে সহ্য হবে না। সেজন্যই কথাটা বলা।

— তুমিও দেখি কম যাও না। বাসা ভরতি সব নবাবের বাচ্চা।

— রুটি বেলতে বেশিক্ষণ লাগব না খালাম্মা।

— পিচ্চি কই? শয়তানটা এখনও ঘুমায় না কি?

— না, উঠছে। দেখলাম তো ঘর ঝাড়ু দিতে গেছে।

— ওরে ডাক দাও। ডিম আনতে হবে।

রাবেয়ার মা তাড়াহুড়া করে লুচি বানাবার জিনিসপত্র এগিয়ে দিতে চেষ্টা করলো।

— সং-এর মতো খাবলাখাবলি করতাছো কেন? বললাম না পিচ্চিরে ডাকো। যখন যা বলব সাথে সাথে করবা। নিজে মাতব্বরি করবা না।

রাবেয়ার মা পিচ্চিকে ডাকতে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে গেলো। ফরিদা ছোট সসপ্যানে পানি গরম বসালেন। লুচির ময়ান তৈরির জন্য একটা এনামেলের বাটি, ময়দা, তেল আর লবণ হাতের কাছে মজুদ রাখলেন, তারপর পানি ফুটবার জন্য অপেক্ষা করে রইলেন।

— নানি ডাকছেন?

— ডিম নিয়া আয়, ১২টা আনবি। রাস্তায় দাঁড়ায়া তামশা দেখবি না। যাবি আর আসবি।

পিচ্চি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো। ফরিদা আঁচলের গিঁঠ খুলে টাকা বের করে দিলেন। রাবেয়ার মা এসে নিঃশব্দে আটার রুটি বানাবার তোড়জোর শুরু করেছে।

— রুটি বানায়া একটা সব্জির লাবড়া বানাও। লাউ আছে না?

— আছে, অর্ধেকটা।

— লাউ, আলু, বেগুন আর ফুল কপি দিও। বাগারের সময় হইলে আমারে ডাকবা। হাত চালাও।

ফরিদা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। বাসার প্রতিটা জিনিস ঝকঝক তকতক না করা পর্যন্ত তার শান্তি হয় না। নিজেই দিনের মধ্যে হাজারবার জিনিসপত্র মোছেন। মেয়েদের ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দু'জনের দরজাতেই রোজকার মতো কড়া নাড়লেন।

— লাভলি উইঠা পড়, ফযরের নামায ক্বাযা করিস না। বিউটি উঠ, দয়া কইরা ওযু কর, নামায পড়।

ফরিদা টের পান বড় মেয়ে লাভলি উঠে পড়েছে কিন্তু ছোট মেয়ে বিউটির ঘর নীরব, সুনসান। সুনসান থাকবে নয়টা দশটা পর্যন্ত। নবাবজাদীর ঘুম ভাঙার পর শুরু হবে কিচ্ছা কাহিনী। থাক্, যা করে শান্তি পায়, ফরিদা ভাবেন। আজকে তার মনটা নরম। আজ বড় মেয়ে লাভলির জন্মদিন। দেখতে দেখতে চল্লিশ বছর পার হয়ে গেল। মেয়েটার জন্য হঠাৎ করেই ফরিদার ভিতরটা হাহাকার করে ওঠে। এই ধরনের অনুভূতিকে তিনি কখনই প্রশ্রয় দেন না। কিন্তু আজকে অনেক কিছুই তার নিয়ন্ত্রণে নাই। যেই মনের উপর দখল সবচেয়ে বেশি সেটাই কাবু হয়ে বসে আছে। নিজের উপর ভালোই বিরক্ত হলেন ফরিদা।
শোবার ঘরে ঢুকে ঠাহর করতে পারলেন না কী কাজে সেখানে গেছেন। এই উপসর্গও ইদানিংকালের। কিছুই মনে থাকে না — এক্ষণের কথা এক্ষণ ভুলে যান। বেশির ভাগ সময় পেটে আসে মনে আসে না। তবুও ফরিদা মনে পড়বে ভেবে কিছুক্ষণ খাটের উপর বসে থাকলেন, মনে পড়লো না — স্বামীর লেপ মুড়ি দেয়া মাথার দিকে পলকহীন তাকিয়ে রইলেন। কালকে না পরশু কবে জানি দেশের বাড়ি যাবে বলছিলো? জমি জমার বিলি ব্যবস্থা যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব করা দরকার। পরে শরীরে আরও কুলাবে না।

— খালাম্মা, পানি ফুটছে।

দরজার ওপাশ থেকে রাবেয়ার মা'র ক্ষীণ আওয়াজে চিন্তার খেই হারিয়ে ফেললেন।

— আসতেছি যাও। বড় আপার জন্য পানি গরম বসাও, গোসল করবে। বড় পাতিলটাতে বসাও, অর্ধেক পানি খালুজানরে দিও।

হুকুমজারি করে ফরিদা আবার পায়ে পায়ে রান্নাঘরের দিকে হাঁটা দিলেন। লুচির ময়ান তৈরি করে ভেজা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখলেন, খাওয়ার সময় গরম গরম বানিয়ে দিবেন। বটি টেনে নিয়ে সব্জি কাটতে শুরু করলেন।

— রুটি যেন পাতলা হয়। কামলাদের মতো ধাবড়া সাইজের বানাইয়ো না। একই কথা ডেইলি বলি তবু কোনো ফারাক দেখি না।

অনবরত কথা বলছেন আর সব্জি কেটে যাচ্ছেন ফরিদা।

— ফ্যাঁৎ ফ্যাঁৎ কইরা নাক টানতেছো ক্যান? সুয়েটার পরো। সুয়েটার কি সাজায় রাখার জন্য দিছি না কি?

ফরিদাও কথা বলে যাচ্ছেন, রাবেয়ার মাও নিঃশব্দে রুটি বেলে যাচ্ছে। এইসব বকাবাজিতে তার অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন আর গায়ে মাখে না। নিজের মেয়েদের সাথেই যে মানুষ এমন তার সাথে তো তাও কমই আছে, রাবেয়ার মা ভাবলো।

— আম্মা, কী করেন?

লাভলি রান্নাঘরে উঁকি দিলো।

— কী, নামায পড়ছিস? গুসলের পানি বসাইছে গুসল কইরা নাস্তা খাবি, আয়।

লাভলি মাথা নাড়লো।

— লুচি না কি?

— লুচি, সব্জি আর ডিম ভাজি।

সব্জি কাটায় ফিরে যান তিনি। রান্নাঘরের দরজার পাল্লা ধরে লাভলি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে আর মায়ের সব্জি কাটা দেখে। মেয়ের মনটা খুশি করতে ইচ্ছা করলো ফরিদার। স্বাভাবিক গম্ভীর মুখে মেয়েকে বললেন, "গাউছিয়া গেলে চল। দেখ বিউটি যাবে কিনা। মহারানী তো মটকা মাইরা পইড়া আছে।"

মায়ের প্রস্তাবে লাভলির নিষ্প্রাণ চোখ এক মুহূর্তেরও কম সময়ের জন্য জ্বলে উঠলো তারপর যে কে সেই। কারণ ও নিশ্চিতভাবেই জানে বিউটিকে রাজি করানো যাবে না। আর রাজি করানো না গেলে ওরও যাওয়া হচ্ছে না। কারণ নাস্তা খাওয়া শেষ হওয়ার পর ফরিদা জন্মদিনের গৎবাঁধা মেনু রাঁধতে বসবেন। তাহলে আর ও যাবে কার সাথে? মৃত পায়ে বিউটির দরজার কাছে আসলো ও। তখন বাজে আটটা পঁচিশ, বিউটির জন্য প্রায় মাঝরাত। তাও কোনো দ্বিধা না করে দরজায় বাড়ি মারতে থাকলো লাভলি। ভিতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। ধৈর্য হারিয়ে আরও কয়েকবার বেশ জোরেই ধাক্কা দিলো লাভলি, সেই শব্দে বরং ঘুম জড়ানো ভীতু চোখ নিয়ে মুখলেস সাহেব ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। হয়তো ভেবেছিলেন ফরিদা এই সক্কাল বেলাতেই মেয়েদের উপর চড়াও হয়েছেন। লাভলিকে দেখে তার চোখের ভীতুভাব সহজ হলো, তিনি আবার নিজের ঘরে ফিরে গেলেন। লাভলি নিঃশব্দে বাবার যাওয়া দেখলো তারপর আরও কয়েকটা ঘা দিলো জোরে।

"দরজা ভাঙবি না কি? গুসলে যা। রাবেয়ার মা পানি দিয়া আসো।" রান্নাঘর থেকে ফরিদা ধমকে উঠলেন।

লাভলির জন্মের সময়টা তার স্পষ্ট মনে পড়লো। কমলাপুরের কাছে জসিম উদ্দিন রোডের ভিতরের দিকে তিন কামরার টিনের বাড়িতে তারা থাকতেন। মুখলেস সাহেব, তার মোটামোটি নতুন বউ ফরিদা আর মুখলেস সাহেবের চাচাতো ভাই আব্দুল বশির। আব্দুল বশির তাদের বাসার একটা কামরা সাবলেট নিয়েছিলেন। মুখলেস সাহেব তখন সবে টিএন্ডটি বোর্ডের সেকেন্ড ক্লাস অফিসার হয়েছেন। বশির সাহেব পেশায় ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার, রোডস এন্ড হাইওয়েজে চাকরি করতেন। তার স্ত্রী, তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে ফৌজদারহাটে বাবার বাড়িতে থাকতো। তাদের সাথে বশির সাহেবের সম্পর্ক কেমন ছাড়া ছাড়া মনে হতো। এই সব নিয়ে মুখলেস সাহেব বা তার স্ত্রী কেউই খুব একটা মাথা ঘামাতেন না। তাদের ছোটো সংসারে বাড়তি একটা আয়ের পথ পাওয়া গেছে এটাই ছিলো বিবেচ্য।

লাভলির জন্মের সময়টা ভাবতে গিয়ে বশিরের কথা মনে পড়ায় যারপরনাই বিরক্ত হলেন ফরিদা। নিজ থেকেই কপাল জুড়ে কঠিন ভ্রূকুটি দেখা দিলো। সারাদিনে এই ভ্রূকুটি আর সোজা হলো না, বিরক্তি আর দুশ্চিন্তার মাত্রা বিশেষে কম বেশি হলো মাত্র কিন্তু একেবারে মিলিয়ে গেলো না।

— খালাম্মা রুটি হইছে, টেবিলে দিব?

— টেবিলে দিবা না তো কী করবা? কাঁচা আবু হইয়া যাইতাছো না কি দিনকে দিন? টেবিল লাগাও আগে। পিচ্চি হারামজাদা ডিম নিয়া আসছে?

— আসছে, সিঁড়ি মুছতাছে। কয়টা ডিম ভাজবো?

— এখন দুইটা ভাজো, ছোটো আপা উঠলে আরেকটা ভাইজা দিও। আগে গিয়া দেখো খালুজানের গুসল হইছে না কি? গুসল হইলে টেবিলে আসতে বলো।

উলের বল মাটিতে গড়িয়ে পড়লে যেভাবে উল বের হতে থাকে, বলের পিছনে যতো ছোটা যায় ততো বের হয়, ঠিক তেমনি আব্দুল বশিরের নাম মাথায় আসার সাথে সাথেই একের পর এক স্মৃতি ফরিদাকে বেসামাল করে ফেললো, একটার লেজ ধরে আরেকটা — না, এইসব হাবিজাবি ভেবে আজকের দিনটাকে সে কোনো মতেই নষ্ট হতে দেবে না।

রাবেয়ার মাকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে ফরিদা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। বাসার সবাইকে নাস্তার টেবিলে আসার জন্য ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকি শুরু করে দিলেন।

— লাভলি, আয় জলদি, সব ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। তোরা বসলে আমি গরম গরম লুচি ভাইজা দিবো। বিউটি কি উঠছে? এই বিউটি, এই ধামড়ি, উঠ — দয়া কইরা নাস্তা খাইয়া উদ্ধার কর।

শেষের কথা কয়টা বলতে বলতে বিউটির দরজায় দুমদাম কয়েকটা বাড়ি দিলেন। কাজের কাজ অবশ্য কিছুই হলো না। বিউটি এত সহজে উঠবার পাত্রী না। তারপর একই ব্যস্ততায় নিজের শোবার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন ফরিদা, স্বামীর গোসল শেষ হয়েছে কিনা সেটাই বোধহয় দেখতে চান। মুখলেস সাহেব গোসল শেষ করে সবে নামাজে দাঁড়িয়েছেন। ঘরে ঢুকে কী একটা বলতে গিয়ে ফরিদা যখন দেখলেন মুখলেস সাহেব জায়নামাজে তখন কথাটা তিনি গিলে ফেললেন। কিন্তু ভিতরের অস্থিরতা চাপা দিতে পারছেন না কিছুতেই। জানালার কাছে গিয়ে পর্দা সরালেন। বাইরে মনিপুরি পাড়া তখনও আলসে আর ঘুমকাতুরে। নিস্তেজ গলির দিকে তাকিয়ে ফরিদা এক মনে 'ইয়া নফসি' পড়তে লাগলেন। হঠাৎ করে কী একটা মনে পড়ায় ঝটিতে আবার ঘর থেকে বের হলেন।

খাবার টেবিলে নাস্তা দেয়া হয়েছে। রাবেয়ার মা গ্লাসে পানি ঢালছে।

— রাবেয়ার মা, ডিপের থিকা হাঁস বার করো। কুসুম পানিতে ভিজায় রাখো।

* * *

হাঁস কেনার ব্যাপারে কোনো ঝুঁকির মধ্যে আর যান না ফরিদা। মাস খানেক আগেই হাঁস কিনে ডিপ ফ্রিজে রেখে দেন। 'শেষ মুহূর্তে পাওয়া গেলো না' — এই সম্ভাবনা খারিজ করতে বেশ কয়েক বছর ধরে তিনি তাই করছেন। ডিপ ফ্রিজে রেখে হাঁস খাওয়াটা যদিও তার একেবারেই পছন্দ না। কিন্তু কী করা! নাই মামার চাইতে কানা মামা ভালো। তাছাড়া সব কিছু যেন প্রকৃতির নিয়মের মতো নিখুঁতভাবে হয় সারাক্ষণ এটাই নিশ্চিত করতে জীবনপাত করছেন তিনি। লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে শেষ অব্দি কিছুই নিখুঁতভাবে হচ্ছে না। এই খবর ফরিদাও জানেন। তাই চেষ্টা আর একাগ্রতা দিনকে দিন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

লাভলি গোসল সেরে বের হলো, চুল ভালো করে মোছা হয় নাই। গোড়া থেকে টপ টপ পানি পড়ছে। ও আবার ঘরে ঢুকে গেলো। ভালো করে না মুছলে ঠাণ্ডা লেগে যাবে। এত লম্বা চুল মুছতে অসহ্য লাগে আবার কাটতেও মায়া লাগে। বিউটি তো সেদিন, একটু হলে ওর ঘুমের মধ্যেই কাঁচি চালিয়ে দিয়েছিলো। রাবেয়ার মা চা দিতে ঘরে ঢুকে দেখলো ছোট আপা কাঁচি হাতে বড় আপার মাথার কাছে উবু হয়ে আছে, আর যায় কোথায়, দিলো এক চীৎকার তাতেই ঘুম ভেঙে গেলো লাভলির। আচমকা ঘুম ভাঙায় লাভলি যতটা না ধড়ফড়িয়ে উঠলো তার চাইতে বেশি ঘাবড়ে গেলো বিউটি নিজেই। এতটাই চমকে গেছিলো যে নিজের হাত-টাত কেটে একটা কাণ্ড করলো। ফরিদা সেদিন রাবেয়ার মাকে বিদায় করেই দিচ্ছিলেন। তাকে হাজারবার করে নিষেধ করা আছে আগ বাড়িয়ে সে যেন কোনো আপার ঘরে না যায়। যখন যেতে বলা হবে শুধু তখনই যেন যায়। কে শোনে কার কথা — সুযোগ পেলেই বড় আপা বা ছোট আপার কারো না কারো ঘরে তার যেতেই হবে। ফরিদা শরীরে আর মনে একটু নরম হয়ে যাওয়ায় রাবেয়ার মা'র চাকরিটা শেষ পর্যন্ত রক্ষা পেলো। বছর চার-পাঁচ আগে হলেও তৎক্ষণাৎ বিদায় করে দিতেন। আজকাল ভালো কাজের মানুষ পাওয়া আকাশের চাঁদ পাওয়ার সামিল হয়েছে। তাছাড়া রাবেয়ার মা'কে রাখার অনেক সুবিধাও আছে। তিন কুলে কেউ নাই। একটাই মেয়ে ছিলো রাবেয়া, সেও কোন ছোট বেলা মারা গেছে সেই দিন-ক্ষণ সেও ঠিক করে বলতে পারে না। কথা কম বলে, হাজার বকা দিলেও রা কাড়ে না। শুধু মাঝে মধ্যে একটু টেলিভিশন দেখতে চায়। সে ফরিদা মানা করেন না। ওরাও তো মানুষ!

লাভলি চুল ভালো করে মুছে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে একটু শুকিয়ে নিল। বিউটির কানে শব্দ গেলে বিপদ হবার কথা। সে রূপচর্চা বিষয়ে পণ্ডিত হয়ে উঠছে দিনকে দিন। কোন ম্যাগাজিনে পড়েছে হেয়ার ড্রায়ার ব্যবহার করা চুলের জন্য ক্ষতিকর — তাই সে এখন নিজে ব্যবহার তো করেই না লাভলি ব্যবহার করুক সেটাও তার চক্ষুশূল। অথচ এই হেয়ার ড্রায়ারটা সেই ফরিদাকে নিয়ে গিয়ে ইস্টার্ন প্লাজা থেকে কিনে এনেছিলো। মজার ব্যাপার হলো লাভলির যা কিছু আধুনিক ব্যবহার্য আছে সবগুলোরই এক সময়ের মালিক বিউটি। যখন তার জিনিসগুলো থেকে মন উঠে যায় তখনই সেটা লাভলির কপালে জোটে। যেমন লাভলির ঘরে একটা ছোট্ট সিডি প্লেয়ার আছে, সেটাও বলা বাহুল্য বিউটির। অনেক দিন চালানোর পর এক দুপুর বেলা সে লাভলির ঘরে দিয়ে গেলো। "আপা, এই সিডি প্লেয়ারটা তুমি নিয়ে নেও।"

— আমি নিয়ে কী করবো?

— কী করবা মানে, গান শুনবা। এরকম বেকুবের মতো কথা বলো কেন?

— আমি তো তোর ঘরেই শুনতে পারি।

— আমার ঘরেও শুনতে পারবা, আম্মাকে বলছি একটা নতুন কিনে দিতে।

— কেন এইটা কী হইছে?

— পুরান হইছে আর কী হবে!

সিডি প্লেয়ারটা পেয়ে অবশ্য লাভলির খুব লাভ হলো। শব্দ কমিয়ে যখন খুশি তখনই শুনতে পারে, বিউটির মুডের উপর নির্ভর করতে হয় না।

নামাজ শেষ করে মুখলেস সাহেব নাস্তার টেবিলে আসলেন। ইদানিং সকাল বেলা উঠেই একটা পাগলা ক্ষুধা লাগে। চেয়ারে বসে অসহায় বোধ করছেন তিনি, মা মেয়ে কারুরই দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। মনে একটা ক্ষীণ সন্দেহ হচ্ছে, ফরিদা আদৌ তাকে লুচি খেতে দিবে কিনা। টেবিলে লুচি দেখে যাচ্ছে না, কিন্তু করা হয়েছে নিশ্চয়ই, আজকে তো লাভলির জন্মদিন।

— হাত গুটায়া বইসা আছো কেন? খাও।

— লাভলি খাবে না?

— খাবে, খাবে না কেন? — লাভলি তোর গুসল হয় নাই?

লাভলি খাবার ঘরে ঢুকে ওর নির্দিষ্ট চেয়ারে বসলো।

— রাবেয়ার মা লুচি ভাইজা আনো।

ফরিদার এই প্রস্তাবে লাভলি এবং মুখলেস সাহেব একসঙ্গে ফরিদার দিকে তাকালো। কারণ এই লুচি ভাজার প্রক্রিয়াটি একান্তভাবেই ফরিদার নিজস্ব, সেখানে তিনি আর কাউকে ভাগ বসাতে দিবেন সেটা ভাবাই যায় না। অবশ্য চার মাস আগে বিউটির জন্মদিনেও পায়েস নাড়ার দায়িত্ব পড়েছিলো লাভলির উপর। প্রকৃতির নিয়মও তাহলে বদলায়।

রাবেয়ার মা'কে লুচি ভাজতে বলায় ফরিদা নিজেই বেশ কুণ্ঠিত বোধ করলেন। তিনি যে ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন আর কর্তৃত্বও যে দুর্বল হয়ে পড়ছে এটা যেন দিনকে দিন প্রকট হয়ে উঠছে।

— সব্জি বাগাড় দিতে গিয়া গরম লাগতেছে। তুমরা শুরু করো। — রাবেয়ার মা লুচি যাতে ফুলে। — পাকঘরের ফ্যান বদলাইতে হবে। ঘুরে না। মিস্ত্রি ডাইকা আগে দেখাইতে হবে ঠিক হবে কিনা।

— ঠিক বোধহয় হবে না, দশ-বারো বছর তো গেছে।

— ঠিক না হইলে বদলাবো, দেখাইতে তো দোষ নাই।

— তাতো ঠিকই।

মুখলেস সাহেব চুপ করে গেলেন। ফরিদাকে চটিয়ে লুচি পাবার সম্ভাবনাকে মাটি করতে চাইলেন না। পিচ্চি নাস্তার প্লেটে দু'টা লুচি নিয়ে এলো। ফরিদা প্রথমে গভীর মনোযোগে লুচি পর্যবেক্ষণ করলেন, তারপর একটা লুচি লাভলির প্লেটে উঠিয়ে দিলেন। মনটা তার একটু দমে গেছে। নাহ, ভালোই তো ফুলেছে!

— ফরিদা, আজকে বিশেষ একটা দিন, একটা দুইটা লুচি খাইলে কিছু হবে না।

— কিছু হবে না তোমারে কে বললো? তুমি কি ডাক্তার?

— আম্মা, একটা খাইতে দেন।

— এখন তো বাপের জন্য আহ্লাদ দেখাইতেছো। অসুখে পড়লে সেবা করতে হবে আমারেই। — আচ্ছা যাও, একটা খাও।

কে বলেছে কর্তৃত্ব যেতে বসেছে, এখনও এই সংসারে তার কথাই শেষ কথা — সন্তুষ্ট বোধ করলেন ফরিদা। স্বামী এবং মেয়েকে পরম মমতায় নাস্তা খাওয়ালেন। যেমনই হোক তার নিজের স্বামী, নিজের মেয়ে!

রচনাকাল: ২০০৮, লন্ডন

অলঙ্করণ: রনি আহম্মেদ