সংসদই হোক সকল কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্র

আবদুল মান্নান
Published : 6 April 2011, 06:39 AM
Updated : 10 Sept 2013, 05:59 AM

প্রধানমন্ত্রী পরিষ্কার ভাষায় ঘোষণা করেছেন দশম সংসদের নির্বাচন আগামী বছরের জানুয়ারি মাসের ২৪ তারিখের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হবে। তাঁর এ ঘোষণা সংবিধানের প্রতি তাঁর অঙ্গীকারের পরিচয় বহন করে।

একজন প্রধানমন্ত্রীর সংবিধানের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যে কোনো গণতান্ত্রিক দেশে বাংলাদেশে যেভাবে নির্বাচনের ঘোষণা করা হয়েছে সেভাবেই হয়ে থাকে। একটি নির্বাচিত সরকার আরেকটি নির্বাচিত সরকারের হাতেই ক্ষমতা হস্তান্তর করে। এর মাঝখানে কিছু থাকা উচিত নয়। ত্রয়োদশ সংশোধনীর আগ পর্যন্ত এ ব্যবস্থাই বিদ্যমান ছিল।

এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় তিন জোট দাবি করেছিল যে এরশাদের অধীনে কোনো নির্বাচনে তারা যাবে না এবং কমপক্ষে তিনটি সাধারণ নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনে হতে হবে। তীব্র গণআন্দোলনের মুখে এরশাদের পতন হলে বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের আগমন ঘটে। তাঁর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর বিষয়টিও সাংবিধানিকভাবে ঘটে।

১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর এটি ধারণা করা হয়েছিল যেহেতু সকলে স্বৈরাচারী ব্যবস্থা হতে গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য দীর্ঘদিন রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে সেহেতু যে দলই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হোক সে দলই গণতান্ত্রিক আচরণ করবে।

সে কারণেই সম্ভবত তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামক কোনো ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি। এমন একটি ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা সাধারণত কোনো একটি নব্য স্বাধীন অথবা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে স্বল্পমেয়াদের জন্য কার্যকর থাকতে পারে, দীর্ঘমেয়াদের জন্য নয়। কারণ এটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ধ্যান-ধারণার পরিপন্থী যেমনটি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী (তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা) মামলায় উল্লেখ করেছেন।

কিন্তু ১৯৯১-১৯৯৬ সময়কালের বেগম জিয়ার সরকারের সময় এ ব্যবস্থার ব্যত্যয় ঘটেছিল। কারণ সে সময়কার সরকার মাগুরা এবং ঢাকা-১০ উপনির্বাচনে যে তামাশা করেছিল তাতে দেশের মানুষ অনেকটা নিশ্চিত হয়েছিল যে বেগম জিয়ার দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হওয়া সম্ভব নয়।

ওই নির্বাচনগুলির পর হতেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সুশীল সমাজের পক্ষ হতে দাবি উঠে, বিদ্যমান অবস্থায় সামনের সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হওয়া উচিত। কিন্তু এ ব্যবস্থা প্রবর্তনে তৎকালীন সরকারি দলের প্রচণ্ড অনীহা ছিল এবং সে সময় প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া মন্তব্য করেন- ''পাগল আর শিশু ছাড়া দেশে কোনো নিরপেক্ষ ব্যক্তি নেই''। তিনি অন্য সব দলের বর্জন সত্ত্বেও ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আরেকটা তামাশাপূর্ণ নির্বাচন করেন।

বিচারপতি আবদুর রউফ ১৯৯০ সালের ২৫ ডিসেম্বর হতে ১৯৯৫ সালের ১৮ এপ্রিল প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন। তার সময়ই উল্লিখিত দুটি চরম তামাশাপূর্ণ উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তীব্র গণআন্দোলনের মুখে বিচারপতি আবদুর রউফ পদত্যাগ করলে ১৯৯৫ সালের ২৭ এপ্রিল বিচারপতি এ কে এম সাদেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন।

বিচারপতি সাদেকের অমর কীর্তি ছিল ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির ভোটারবিহীন একদলীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান, যে নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর খুনি কর্নেল (অব.) আবদুর রশিদ পর্যন্ত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন (পরে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত, বর্তমানে পলাতক)।

সে সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিরোধী দলের দাবি বেগম জিয়া মেনে নিতে বাধ্য হন। অনেকটা তড়িঘড়ি করে এ ব্যবস্থা ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করেন। কিন্তু পরবর্তীকালে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে নিজেদের পছন্দমতো প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করার জন্য বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা বাড়িয়ে ব্যবস্থাটিকে বিতর্কিত করা হয়।

এর ফলে ২০০৭ সালের এক-এগার এবং অসাংবিধানিকভাবে ফখরুদ্দিন সরকারের দু'বছর ক্ষমতা কুক্ষিগত করা, শেখ হাসিনা ও বেগম জিয়ার কারাবরণ আর দেশকে বিরাজনীতিকরণের প্রচেষ্টা। আরেকটি গণআন্দোলনের মুখে ২০০৮ সালে ফখরুদ্দিন সরকার সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হয় এবং সে নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে বর্তমানে সরকারে অধিষ্ঠিত আছে।

ত্রয়োদশ সংশোধনী উচ্চ আদালতে যে বাতিল হল সে মামলা সরকার করেনি। একজন সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তি ১৯৯৯ সালে করেছিলেন (আপিল) যার চূড়ান্ত রায় ২০১১ সালে দেওয়া হয়েছে। এর অর্থ, বাংলাদেশ আবার তার আদি সংবিধানে অর্থাৎ ১৯৭২ সনের সংবিধানের মূল কাঠামোয় ফিরে গেছে।

উল্লিখিত মামলার রায়ে যদিও বলা হয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক, তথাপি এমন একটি সরকার ব্যবস্থা দু'মেয়াদের জন্য বহাল করা যেতে পারে, তবে তা গঠিত হতে হবে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের দ্বারা। রায়ে বলা হয়েছে তা করার সম্পূর্ণ এখতিয়ার নির্বাচিত জাতীয় সংসদের, অন্য কারও নয়।

এটি এ কারণেই বলা হয়েছে যে, গণতন্ত্রের মূল স্পিরিটই হচ্ছে রাষ্ট্রপরিচালনায় জনগণের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে, আর নির্বাচিত সংসদ সদস্যরাই জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে। অনির্বাচিত সরকার থাকলে সেখানে জনগণ অনুপস্থিত থাকে। পূর্বে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত জিয়া আর এরশাদের ক্ষমতা দখলকেও অবৈধ ঘোষণা করেছে।

বাংলাদেশের সংবিধান প্রবর্তন করা হয় ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর। এরপর গণপরিষদ ভেঙে দেওয়া হয় এবং ১৭ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভা নতুন সংবিধানের অধীনে শপথ গ্রহণ করেন। ঘোষিত হয় ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

সুতরাং নতুন সংবিধানের অধীনে গঠিত প্রথম মন্ত্রিসভা ছিল একটি অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভা যে ব্যবস্থায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ফিরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন এবং তা তিনি বর্তমানে বলবত সংবিধানের আওতায় দিয়েছেন।

১৯৭২ সালের সংবিধানের ১২৩ ধারার অধীনে ১৯৭৯ সালে জিয়া, ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে এরশাদ আর ১৯৯৬ সালে বেগম জিয়া নির্বাচন অনুষ্ঠান করেছেন। ত্রয়োদশ সংশোধনীটি ১৯৯১-৯৬ সালের বেগম জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির কারণে অনেকটা অনিবার্য হয়ে উঠেছিল– ঠিক যেমনটি অনিবার্য হয়েছিল ১৯৯১ সালে।

সাংবিধানিকভাবে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার আগমন এবং নির্গমন দুটির জন্যই দায়ী বেগম জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকার। তাঁর আমলে যদি মাগুরা আর ঢাকা-১০ আসনের নির্বাচনের তামাশা না হত তাহলে বর্তমানে আসন্ন নির্বাচন নিয়ে যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে তা হত না।

দেশের মানুষ ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদের অধীনেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করত যেমনটি অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে হয়ে থাকে। অর্থাৎ নির্বাচনকালীন সময়ে একটি নির্বাচিত সরকার থাকবে এবং তারা রাষ্ট্রপরিচালনার দৈনন্দিন রুটিন-কাজ করবে এবং নির্বাচন অনুষ্ঠান করবে নির্বাচন কমিশন।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটি সরকার একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য গঠিত হয়। এ মেয়াদ সাধারণত চার বা পাঁচ বছরের জন্য হয়ে থাকে, যেমনটি ভারতে বা বাংলাদেশে। কোনো কারণে সংসদ ভেঙে না গেলে সেটি মেয়াদ পূর্ণ করে। তার আগে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে নির্বাচিত সদস্যরা শপথ না নেওয়া পর্যন্ত সংসদ সদস্য হিসেবে গণ্য হন না।

ভারতে বর্তমান লোকসভা পনেরতম। এর মধ্যে ছয়টি পূর্ণ মেয়াদ শেষ করেনি। বাকিগুলি শেষ করেছে এবং তা করার পূর্বেই সে দেশের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করা যেতে পারে, তবে এ ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে এবং তা তিনি করেন প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে। সংবিধান অনুযায়ী জরুরি প্রয়োজনে পুরানো সংসদ আবার অধিবেশনে বসতে পারে। তবে একবার নবনির্বাচিত সদস্যরা শপথ নিয়ে নিলে ওই ব্যবস্থা আর সম্ভব নয়।

বাংলাদেশেও একই রেওয়াজ এবং তা ১৯৭২ সালের সংবিধানেরই ১২৩ নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে। জিয়ার আমলে একটি (১৯৭৯), এরশাদের আমলে দুটি (১৯৮৬ ও ১৯৮৮) এবং বেগম জিয়ার আমলে একটি (১৯৯৬) এ বিধি-বিধানের অধীনেই হয়েছে।

এরশাদ এবং জিয়ার শাসনামলকে দেশের সর্বোচ্চ আদালত অবৈধ ঘোষণা করেছে। সুতরাং নির্বাচিত সরকারের আমলে প্রকৃত অর্থে একটি নির্বাচন (১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি) অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনটি ছিল সম্পূর্ণভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে।

কারণ পূর্ববর্তী সংসদ ছিল গণপরিষদ এবং তা গঠিত হয়েছিল সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের দ্বারা। ১৯৯৪ সালে বেগম জিয়া সরকার যদি মাগুরা আর ঢাকা-১০ আসনে জোরপূর্বক বিজয়ী হতে না চাইত তাহলে পুনরায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন দেখা দিত না।

বিএনপি তথা ১৮ দল বাতিলকৃত তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রর্বতনের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলনের নামে নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে এবং আগামীতে আরও করবে বলে ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছে। ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল সরকার নয় দেশের সর্বোচ্চ আদালত করেছে। তারা পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার জন্য গো ধরেছেন। কিন্তু সে ব্যবস্থায় আবার সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হককে চান না। কী চান তা তারা পরিষ্কার করে বলেন না।

আদালত তাদের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করে তা বাতিল করেছে। বলেছে, সংসদ যদি মনে করে তাহলে আগামী দু'টার্মের জন্য তা বহাল করা যেতে পারে, তবে তা হতে হবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা এবং এ বিষয়ে নতুন করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্পূর্ণ এখতিয়ার জাতীয় সংসদের। তা না হলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ছেদ পড়বে যা কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়।

দেশের মানুষ নৈরাজ্য চান না। বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন দাবি করছে, আর তাদের প্রধান শরিক দল জামায়াত যুদ্ধাপরাধের দায়ে যারা অভিযুক্ত ও দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন যারা তাদের মুক্তি চায়। উভয়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আগামী দিনে দেশে একটি চরম নৈরাজ্য সৃষ্টি হতে পারে।

বেগম জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি দেশে দু'বার ক্ষমতাসীন ছিল। জনগণ চাইলে আবার ক্ষমতায় ফিরতে পারে। মানুষ তাদের কাছে আরও দায়িত্বশীল আচরণ আশা করে। ক'দিন পর জাতীয় সংসদ অধিবেশন বসছে। তাদের উচিত সংসদে উপস্থিত হয়ে সংবিধানের আওতায় নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হওয়া উচিত তা নির্মোহভাবে উত্থাপন করা।

আর সরকারি দলেরও উচিত বিরোধী দলের গঠনমূলক প্রস্তাবে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করা। সকলের সামনে এখন সময় এসেছে দায়িত্বশীল আচরণ করে দেশকে গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।

সংসদই হোক সকল কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্র। হানাহানি শুধু দেশের নিরাপত্তা নয়, সার্বভৌমত্ব বিঘ্নিত করে।

সিরিয়া বা মিশর আমাদের সামনে বড় উদাহরণ।

ড. আবদুল মান্নান : সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।