অগ্নিপরীক্ষা এবার সমর্থকদের

আমিনুল হক পলাশ
Published : 5 July 2015, 06:43 PM
Updated : 5 July 2015, 06:43 PM

নিয়মিত বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের খেলা দেখতে দেখতে অভ্যাস এমন হয়ে গিয়েছে যে, খেলা না থাকলে কেমন যেন খালি খালি লাগে! মনে হয় কি যেন নেই, কি যেন নেই। আমি জানি শুধু আমার একার না, ক্রিকেট অনুরাগী আরও অসংখ্য ভক্তের এই অনুভূতি হয়। অবশেষে আমাদের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে আজ থেকে আবারো মাঠে নামছে টাইগার বাহিনী। প্রতিপক্ষ সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম ভয়ংকর দল সাউথ আফ্রিকা। লোকে যদিও তাদের চোকার বলে, কিন্তু কখন তারা চোক করবে সেটা তো তারা ছাড়া আর কেউ জানে না! তাই তাদেরকে কঠিন প্রতিপক্ষ হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে।

এই সিরিজটা আমার দৃষ্টিতে একটু অন্যরকম গুরুত্ব বহন করছে। সাউথ আফ্রিকার দুর্ধর্ষ বোলিং, ব্যাটিং ও ফিল্ডিং এর বিরুদ্ধে মাঠে যেমন আমাদের টাইগারদের নিজেদের সেরাটা ঢেলে দিতে হবে ঠিক তেমনি মাঠের বাইরে আমাদের সমর্থকদের অগ্নিপরীক্ষা নিবে এই সিরিজ। দেশের মাটিতে পরপর বেশ কয়েকটি ভালো সিরিজ জয়ে আমাদের প্রত্যাশার পারদ আকাশচুম্বী। আমরা ধরে নিয়েছি টাইগাররা মাঠে নামবে আর জয় নিয়ে ফিরে আসবে। বাস্তবতা এমন নয়। ভালো সময়ে সমর্থকের অভাব হয় না, প্রশংসাবাণীরও অভাব হয় না। কিন্তু দলের খারাপ সময়ে সমর্থকরা কিভাবে আচরণ করে সেটাই বেশি গুরুত্বপুর্ন। ভারতের সাথে সিরিজ জয়ী হয়েও তৃতীয় ম্যাচে হারার পর সংবাদ সম্মেলনে মাশরাফিকে পর্যন্ত আমাদের এই অতি আশাবাদী মনোভাব নিয়ে কথা বলতে হয়েছে।

সাউথ আফ্রিকা দলটি খুব চনমনে অবস্থায় আছে। বিশ্বকাপের পর তারা আর কোন টুর্নামেন্ট খেলেনি। লম্বা ছুটি কাটিয়ে প্রোটিয়াসদের সবাই এখন ফিট এবং পারফর্ম করার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। বোলিং ব্যাটিং ও ফিল্ডিং তিন ডিপার্টমেন্টে তাদের বিশ্বসেরা প্লেয়ার রয়েছে। অতএব এই সিরিজে বাংলাদেশ দলকে কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়তে হবে। আশার কথা হলো আমাদের টাইগাররা সবাই ভালো ফর্মে আছে এবং মাঠে নেমে তারা প্রতিনিয়ত নিজেদের উজাড় করে দিচ্ছে। তারপরও এই সিরিজে আমাদের অতি আশাবাদী হওয়া উচিৎ হবে না। অতি আশাবাদ হতাশা ডেকে আনে এবং সেই হতাশা থেকে সমর্থকরা এমন ব্যবহার করে যা পরিস্থিতিকে খারাপের দিকে নিয়ে যায়, আমাদের লজ্জিত করে।

সত্য বলতে সাম্প্রতিক সময়ে আমরা সমর্থকরা আমাদের খেলোয়াড়দের প্রতি যথাযথ আচরণ করতে ব্যার্থ হয়েছি । খেলোয়াড়দের ফেসবুক পেজে অযাচিত, অশালীন মন্তব্য করে তাদের মনে কস্ট দিয়েছি। এমনকি সাম্প্রদায়িক মন্তব্যও করা হয়েছে। শুধু সাম্প্রতিক সময়ে না, সমর্থক হিসেবে আমাদের অতীত আচরণও মোটেই আশবাদী হবার মতো না। আমরা খুব অল্পতে কাউকে মাথায় তুলে ফেলি, আবার সেখান থেকে আছাড় দিতেও সময় নেই না। গঠনমূলক সমালোচনা না হয়ে আমাদের সমালোচনাগুলো বেশিরভাগ সময় ব্যক্তিগত আক্রমনে পরিণত হয়। সাকিবের স্ত্রীকে গ্যালারিতে কটুক্তি করা কিংবা তামিমের খারাপ পারফরম্যন্সের জের ধরে তার স্ত্রীকে ফোনে গালাগালি করা, সমর্থক হিসেবে আমাদের ব্যর্থতা ও লজ্জার উদাহরন হয়ে আছে।

প্রোটিয়াসদের বিরুদ্ধে আজ থেকে শুরু হতে যাওয়া সিরিজে নিঃসন্দেহে আমরা আন্ডারডগ। এমন হতে পারে যে এই সিরিজে আমরা একটা জয়ও পেলাম না! এটা অসম্ভব না। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের দর্শকদের অবশ্যই মার্জিত ব্যবহার করতে হবে, খেলোয়াড়দের প্রতি সহানূভুতিশীল মনোভাব প্রদর্শন করতে হবে, তাদের পাশে থেকে উৎসাহ দিয়ে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে একটা সিরিজে খারাপ করা মানে সব শেষ হয়ে যাওয়া নয়। তাছাড়া নিজেদের সর্বোচ্চ চেস্টা করে যোগ্য দলের বিরুদ্ধে পরাজিত হবার মাঝে লজ্জার কিছু নেই। একজন দর্শক হিসেবে অবশ্যই আমরা সর্বোচ্চ ভালো ফলাফল প্রত্যাশা করবো, কিন্তু সবচেয়ে খারাপ ফল পেলেও আমাদের অনুভুতি প্রকাশে সচেতন হতে হবে। নিজেদের নিয়ন্ত্রন করতে হবে।

আরেকটি ব্যাপারে দৃষ্টি দেয়া দরকার। ভারতের বিরুদ্ধে প্রথম দুই ম্যাচ শেষে দেখা গিয়েছে প্রচুর দর্শক মাঠে ঢুকে যাচ্ছেন। এটা কোনভাবেই গ্রহনযোগ্য না। ভালোবাসা প্রকাশের উপায় এটা হতে পারেনা। এতে করে খেলোয়াড়দের নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়া প্রতিপক্ষ দল এটা নিয়ে অভিযোগ করতে পারে আইসিসির কাছে। সেক্ষেত্রে আইসিসি এটার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিবে। দর্শকদের এমন আচরণের জন্য কলকাতার ইডেন গার্ডেন দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বাইরে ছিল। দর্শকদের সাময়িক উত্তেজনার জন্য আমাদের মিরপুর বা অন্য কোন ভেন্যুকে যেন এমন পরিণতি বরন করতে না হয় সেই ব্যাপারে বিসিবির কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার আহবান জানাচ্ছি।

আমি জানি ক্রিকেট এখন আমাদের কাছে খেলার থেকেও বেশি কিছু। এটা আমাদের সমর্থকদের আবেগের একটা বড় অংশ দখল করে নিয়েছে। এই আবেগের প্রতি সম্মান রেখে বলছি, অতি উৎসাহে কিংবা অতিরিক্ত প্রত্যাশা কখনো ভালো ফল বয়ে আনে না। মনে রাখতে হবে আমাদের ক্রিকেটাররাও মানুষ। খেলার বাইরে তাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত, পারিবারিক জীবন আছে। আমরা সমর্থকরা তাদের সব ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাতে পারিনা। খেলার মাঠে তাদের কখনো ভালো সময় যাবে, কখনো খারাপ সময় যাবে। বিশেষত খারাপ সময়ে আমরা কিভাবে তাদের পাশে থাকি সেটাই নির্ধারণ করবে সমর্থক হিসেবে আমরা আসলে কেমন। আমাদের টাইগাররা প্রতিনিয়ত নিজেরদের পারফরম্যান্সের উন্নয়ন ঘটাচ্ছে, এবার আমাদের পালা সমর্থক হিসেবে নিজেদের পারফরম্যান্সের উন্নয়ন ঘটানো। সাউথ আফ্রিকার বিরুদ্ধে এবারের সিরিজ তাই  সমর্থকদের জন্য হবে এসিড টেস্ট।