কী লাভ হচ্ছে আওয়ামী লীগের..!?

পঙ্খীরাজ
Published : 4 Dec 2011, 05:26 AM
Updated : 4 Dec 2011, 05:26 AM

গুরুত্বপূর্ণ বা জাতীয় বিষয়ে জনমত উপেক্ষা করে সরকারের একতরফা সিদ্ধান্ত গ্রহনের আরো একটি নজির দেখা গেল। ঢাকা সিটি ভাগ হলো।

'সংসদে এটি আলোচনার যোগ্য কোন ব্যাপার নয়' মনে করেই হয়তবা সম্পুর্ণ আলোচনাবিহীন ভাবে মাত্র চার মিনিটে ভাগ হলো চারশ' বছরের ঐতিহ্যবাহী ঢাকা নগরী। প্রধানমন্ত্রী বললেন, ঢাকাবাসীর দুয়ারে-দরজায় সেবা পৌছে দেবার প্রতিশ্রুতি সামনে রেখেই এই 'ঢাকা ভাগ' সিদ্ধান্ত। তিনি এও বললেন যে, আসলে চার ভাগই করতে চেয়েছিলেন, টাকায় টান পড়ায় দুই ভাগ হলো।

কিন্তু তিনি বললেন না, যে এটি উনার একার সিদ্ধান্ত। ঢাকা সিটির নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ (মেয়র, কাউন্সিলর, এমপি)-দের কারো মতামত আমলে নেয়া হয়নি। এদেশের প্রায় সকল বিশেষজ্ঞ এবং সুশীল সমাজের কথায়ও কর্ণপাত করেনি সরকার। অন্য কোন রাজনৈতিক/অরাজনৈতিক কিংবা সামাজিক সংগঠনের সাথেও কোন আলাপ-পরামর্শ করা হয়নি। আর মিডিয়ার প্রতিবাদের কথা নাই বা বললাম।
এখন তড়িঘড়ি করে ৯০ দিনের ধোঁয়া তুলে হয়তো ঢাকার জন্য দুইজন 'শামীম ওসমান টাইপ' লোককে মনোনয়ন দেয়া এবং মেয়রও করা হবে। জনদরদী সরকার চাইলে কি না হয়!

সদ্য অতীতে নারায়ণগন্জ্ঞে হয়ে যাওয়া নির্বাচনে 'সেনাবাহিনী মোতায়েন' নিয়ে সরকার যেভাবে কমিশনের মাথার উপর ছড়ি ঘুরালো তা এক কথায় অতুলনীয়। এছাড়াও শেষ মূহুর্তে বিএনপি-কে বাদ দিয়ে আওয়ামী দুই ভাই-বোনের জমজমাট নির্বাচন-পূর্ব নাটক দেখলো দেশবাসী। তবে নারায়ণগন্জ্ঞবাসী কিন্তু সরকার মনোনীত গডফাদার প্রার্থীকে উচিৎ জবাবই দিয়েছে। মানুষের আশা ছিল সরকার এই নির্বাচন থেকে একটা শিক্ষা নেবে। তবে বেচারা জনগণের সে আশায় গুড়ে-বালি।

আসন্ন কুমিল্লা সিটির নির্বাচনও এক তরফাভাবেই করা হচ্ছে। বিরোধী কোন পক্ষের কোন মতামতকেই কোন প্রকার আমলে নেয়া হচ্ছেনা। বিএনপিকে 'ইভিএম' নিয়ে চ্যালেন্জ্ঞ জানানোর পরে এখন আবার বিএনপি ইভিএম পরীক্ষা করে দেখতে চাইলে ইসি এখন কেন পিছিয়ে গেলেন..!

শোনা গিয়েছিল বর্তমান ইসি'র মেয়াদ প্রায় শেষ, কাজেই তাদের সময়ে আর কোন নির্বাচন হবে না। কিন্তু এখন আর একথা শোনা যাচ্ছেনা। মনে হচ্ছে, এই বাতিল ইসি দিয়েই সরকার বাকী কয়টা নির্বাচন এক তরফাভাবেই শেষ করে নিতে চাইছে।

অন্য প্রসংগে আসি, টিপাইমুখ নিয়ে বলবো..!? থাক, টিপাইমুখ বাধ নিয়ে লিখতে গেলে বাংলার দু:খ-গাথা'র বিরাট উপন্যাস হয়ে যাবে। তবে 'ট্র্যানজিট' নিয়ে না বললেই নয়। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহনের সফর থেকে প্রাপ্তির ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থ আমাদের সরকার। তিস্তা চুক্তি নিয়েই চরম মিথ্যাচার করেছেন আমাদেরই মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেষমূহুর্ত পর্যন্ত! ওপারের মন্ত্রী মমতা'র এপারের আমার সুজলা বাংলা মায়ের প্রতি অমমতাময়ী আচরনের সাক্ষী হয়ে থাকবে ইতিহাস। সরকার যদিও পরিস্হিতি সামলানোর জন্য তখন 'তিন মাসে'র একটা কথা বলেছিলো, যা এখন অনেকটা সেই 'দশ টাকার চাল'-য়ের মতই কখনো বলা হয়নি বলে প্রচার চালানো হচ্ছে।

যদিও সরকারের সবচেয়ে বড় চমকটা ছিল কিছুদিন পরে, অনেকটাই চুপিচুপি, সবার অগোচরে, কেমন যেন রাখ-রাখ, ঢাক-ঢাক ভাব। মূলত পত্রপত্রিকা ও মিডিয়ার মাধ্যমেই দেশবাসী জানতে পারে ভারত সরকারকে ট্র্যানজিট দিয়ে দিয়েছে আমাদের সরকার। অতি দু:খের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, আজও এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে সরকারের গ্রহনযোগ্য মহল থেকে কিছুই বলা হয়নি। তবে সরকার কিছু না বললেও বিগত দুই ঈদে বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ 'ট্র্যানজিট'য়ের কুফল 'হাড়ে-হাড়ে' টের পেয়েছে। অসংখ্য মানুষ অমানবিক দুর্ভোগ পুহিয়েও বাড়ি পৌছুতে পারেন নাই সময়মতো। মানুষ বাদ দিলাম, গত কোরবানির ঈদে হাটগুলোতে গরু-ছাগলও পৌছতে পারে নাই, ঢাকা ও আশেপাশের হাট গুলোতে পশুর জন্য জনসাধারণকে চরম দুর্ভোগের শিকার হতে হয়েছে। হাটের উদ্দেশ্যে আসার জন্য পশুগুলিও ট্রাকে ঘন্টার পর ঘন্টা আটকে পরে ছিল। ইন্ডিয়ান হেভি-ডিউটি ও ওভার-ওয়েইট ট্রাক-লরি চলাচলের ফলে প্রায় সারা বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারেই ভেঙে পড়েছে। কোন মহাসড়কই আর চলাচলের যোগ্য নয়। অবস্হা সংশ্লিষ্ট মহলের নজরে আনতে 'সড়ক-পরিবহণ মালিক সমিতি' ঈদের আগে বাড়তি ব্যবসার বদলে ধর্মঘট ডাকতে বাধ্য হয়! অথচ আমাদের যোগাযোগমন্ত্রী আবুল শুধুই হাসেন!
সরকার অতি সম্প্রতিই দুজন অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতাকে মন্ত্রীসভায় নিলেন। প্রধানমন্ত্রী জানালেন, সরকারের কাজে আরো গতি আনতেই এই নিয়োগ। কিন্তু, আজ পর্যন্ত এই দুজনকে দপ্তরবিহীনই থাকতে হচ্ছে কেন!!?? সরকার কি সিদ্ধান্ত না নিয়েই তাদের নিয়োগ দিয়েছেন! উক্ত দুজন নেতা সাম্প্রতিক সময়ে সরকারী দলের হয়েও সরকারের কাজের গঠনমূলক সমালোচনা করার কারনেই ছিলেন আলোচিত। আমি একশত ভাগ নিশ্চিত আজ যদি উনাদের মন্ত্রী করা না হতো তবে তারা 'ঢাকা ভাগ' বিষয়ে অবশ্যই কথা বলতেন। নব-নির্বাচিত নারায়ণগন্জ্ঞের মেয়র আওয়ামী লীগেরই নেত্রী ডা: সেলিনা হায়াৎ আইভী দায়িত্ব গ্রহনের মূহুর্তেই সরকারের কড়া সমালোচনা করেছেন; তিনি প্রশ্ন রাখেন, সরকার যেখানে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্হা বাতিল করলো সেখানে সিটি কর্পোরেশনে কেন প্রশাসক নিয়োগ? তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ঢাকার মেয়র খোকার চলে যাওয়া আর তার গত মেয়াদের চলে যাওয়ার মধ্যে কোন তফাৎ নেই।

অন্য প্রসংগে যাই, সুপ্রিম কোর্টের আদেশ দেখিয়ে পনেরতম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান থেকে 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্হা' বাতিল করা হলো। আওয়ামী লীগ এক সময় এই 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্হা'র জন্য দুর্বার আন্দোলন করেছিলো, আন্দোলনের নামে তখনো দেশের অসংখ্য সম্পদ ধংস্ব করা হয়েছিল। তৎকালীন বিএনপি সরকার সংসদ ভেঙে নির্বাচন দিয়ে দেশকে চরম অরাজক পরিস্হিতির হাত থেকে রক্ষা করেছিল। এখন সেই আওয়ামী লীগই আবার দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের বিধান করলো।

মুসলিম প্রধান দেশ বাংলাদেশ। অথচ নিজেদের অসাম্প্রদায়িক প্রমান করতে ছেলেমানুষীর মতো সরকার একদা'র যে বাংলার গ্রামে-গন্জ্ঞে হাজারও পীর-আউলিয়ার পদচারনের মুখরিত ছিলো, সেই বাংলাদেশের ধর্মভীরু সাধারন মানুষের অন্তরে আঘাত দিয়ে পবিত্র সংবিধান থেকে মুছে দিলো "মহান আল্লাহর উপর সম্পূর্ণ আস্হা ও বিশ্বাস" কথাটি! সরকারের মনে থাকা উচিৎ, অসাম্প্রদায়িকতা ব্যপারটি চর্চা-ভিত্তিক প্রক্রিয়া, এটি চর্চার মাধ্যমে কাজের দ্বারা অর্জন করতে হয়, কাগজে-কলমের লিখে সার্টিফিকেট নেয়ার মতো নয়।

এসব ছাড়াও সরকার আদালতের উপর নিজেদের প্রয়োজনের এমন কি একাধিক বার নগ্নভাবে হস্তক্ষেপ করেছেন। বিচারক নিয়োগে বাংলাদেশের ইতিহাসে এতো সমালোচনা আগে কখনো হয়নি। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার বলে ফাঁসির দন্ড-প্রাপ্ত আসামীদের দলবেঁধে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে। অথচ আজ নরসিংদীর জনপ্রিয় চেয়ারম্যান লোকমান হত্যাকান্ডের এজাহারভুক্ত আসামীরা আদালতে প্রকাশ্যে আসলেও তাদের ধরা হচ্ছেনা। বরং সরকার ঘটনা ভিন্নখাতে ঘোরানোর জন্য বিএনপি'র নেতা খায়রুল কবির খোকন'কে গ্রেফতার করেছিল হাস্যকর কিছু অভিযোগ দায়ের করে।

'বিডিআর' থেকে 'বিজিবি' করা ছাড়া এত্তোবড়ো ঘটনা 'বিডিআর বিদ্রোহ'র উভয়পক্ষেরই ক্ষতিগস্তদের জন্য গ্রহনকৃত কোন পদক্ষেপটি সরকার সমপন্ন করতে পেরেছে? এর যে বিচার কাজ চলছে তা থেকেই বুঝা যায় সরকার 'বিডিআর বিদ্রোহ' কতটা সিরিয়াসলি নিয়েছিলো। খালেদা জিয়ার বাড়ি ভেঙ্গে সেখানে বিদ্রোহে নিহত সেনা অফিসারদের পরিবারের জন্য বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট ভবন তৈরী করে দিবেন- এই কথা দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরে বিএনপি নেত্রীকে বাড়ি থেকে পুলিশ দিয়ে উচ্ছেদ করে দেয়া হয়েছিল। দেশের জনগণ তা কখনই ভূলবেন না।

সারা বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের দাবি 'যুদ্ধাপরাধীর বিচার'। এই বিচার নিয়ে সরকার নিজেই বিতর্কিত ব্যক্তিকে আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালের প্রধান করে বিরোধীদলগুলির হাতে ইস্যু তুলে দিয়েছে। এখন ট্রাইবুনাল সংশোধন করার একটা সুযোগও এসেছিলো কিন্তু সরকার গা করেনি। অপরাধীদের যেভাবে মামলা দায়ের করার আগেই অ্যারেস্ট করা হয়েছে, এতে করে সরকারের পদ্ধতিগত অপরিপক্কতারই প্রকাশ পেয়েছে। শুরু থেকেই এ মামলার হয় তড়িঘড়ি নয় সবকিছুতেই গাছাড়া ভাব বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়। দিনে দিনে পরিষ্কার হচ্ছে এই 'যুদ্ধাপরাধীর বিচার' এই আমলে শেষ করার সদিচ্ছা সরকারের নেই। হয়তো সরকার এই 'যুদ্ধাপরাধ' ইস্যুটি ইচ্ছে করেই জিইয়ে রাখতে চাইছে। এই 'যুদ্ধাপরাধ' ইস্যুকে দাঁড় করিয়ে ফায়দা নেয়ার ইতিহাস এদেশের রাজনীতির রয়েছে।

এসব ছাড়াও শেয়ার মার্কেট, কাচা-বাজার, বিদ্যুৎ, আইন-শৃংখলা পরিস্হিতি, শিক্ষা-বাণিজ্য, ব্যবসা-বিনিয়োগ, সাংস্কৃতিক জগত কোথায় এই সরকারকে আপনি পাস মার্ক দিবেন? শোনা যাচ্ছে এই বছরে বিজয়ের মাস ডিসেম্বরেই আমাদের দেশের সিনেমা হল গুলোতে ভারতী্য় চলচ্চি্ত্র পরিদর্শন করা পাকাপাকি ভাবে শুরু হতে যাচ্ছে। এটি কে হয়তো সরকার আমাদের 'সৌভাগ্য'ই বলবেন!

এখন এই 'ঢাকা ভাগ' নিয়েই যে আমাদের রাজনীতি আবারো সংঘর্ষের পথে পা বাড়ালো তা অনেকটাই পরিষ্কার। বিরোধীদল আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছে। সারা দেশে সফল শান্তিপূর্ণ রোড-মার্চের কর্মসূচীর পর বিএনপি'র মাঝে এ সরকারের আমলে এই প্রথমবার বেশ একটা চাঙা ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে বিএনপি এতোদিন না থাকতে পারলেও আগামী দিনগুলিতে রাজপথে থাকবে।

১/১১-র পর, দিন বদলের কথা দিয়ে আওয়ামী লীগ গণমানুষের সমর্থনে বিশাল বিজয়ের মাধ্যমে সরকার গঠন করেছিলো। আজ দিন বদলের অবস্হার কথা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। এই আমলের কাজের মূল্যায়ন আওয়ামী লীগ কিভাবে করবে?!

আমরা কি এই সংঘর্ষের রাজনীতি থেকে কোনদিনও বের হতে পারবো না?! সময়ানুযায়ী সবার অংশগ্রহনের জাতীয় নির্বাচন হবে কি? ঢাকার রাজপথ কি আবারও সাক্ষী হবে লগি-বৈঠা'র তান্ডবের? নাকি বর্তমান দলীয় রাজনীতিকে 'অচল' দাবি করে আবারো কোন সামরিক শাসকের হাতে পড়তে যাচ্ছে আমাদের সবার প্রিয় এই বাংলাদেশ?! নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা আমাদের কোন বাংলাদেশের কথা বলে? শিল্পী সুলতান সুঠাম-পেশীবহূল যে বাংলার কৃষককে তুলিতে এঁকেছিলেন, সে কৃষকের শরীর আজ কেন এতোটা জীর্ণ..?! বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কিংবা শহীদ জিয়া কি এমন অবিশ্বাসে ভরা বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন..!??

পাঠক, আপনার কি ধারনা, জানাবেন..