প্রধানমন্ত্রীর রবীন্দ্র ভাবনা, মধ্যবিত্তের রাজনৈতিক শ্রেণী চরিত্র এবং আমরা

মেহেদী হাসান সুমন
Published : 15 Jan 2015, 08:24 AM
Updated : 15 Jan 2015, 08:24 AM

চলচ্চিত্রের আদি পর্বে রাশিয়ান চলচ্চিত্র নির্মাতারা একটি অসামান্য সম্পাদনা কৌশল আবিষ্কার করেছিলেন। মূলত কুলেশভ এই কৌশলটি নিয়ে নিয়ে ব্যাপক পরীক্ষা নিরীক্ষা করলেও কৌশলটির সফল প্রয়োগ, বিস্তার ও তত্ত্ব গত ভাবে প্রতিষ্ঠা করেন, চলচ্চিত্রের উজ্জ্বল পুরুষ সার্গেই আইজেনস্টাইন। বিশ্বব্যাপী এই কৌশলটি মনতাজ নামে পরিচিত। পদ্ধতিটি হচ্ছে দুটি ভিন্ন ধর্মী শট যাদের নিজস্ব অর্থ থাকা সত্ত্বেও পাশাপাশি ব্যবহারের ফলে সম্পূর্ণ ভিন্ন আরেকটি অর্থ প্রকাশ করে। যেমন একটি দরিদ্র মানুষের ক্ষুদার্থ মুখের শটের পাশাপাশি যদি এমন একটি শট রাখা হয়, যেখানে ধনীদের খাবার ভর্তি টেবিলে প্রচুর খাবার নষ্ট হচ্ছে, তাহলে এই পাশাপাশি দুটি শট চলচ্চিত্রে একটি আলাদা ভাবার্থ তৈরি করতে সক্ষম যেটা দর্শককে ক্ষুধা ও সম্পদের অসম বন্টনের একটি গভীর অনুভূতিতে পৌঁছে দিবে।
আমার সমস্যা হচ্ছে- আমি গতকালের দুটো সংবাদকে একই নিউজ ফিডে পাশাপাশি পড়েছি। দুটো ঘটনাই একই দিনের। একটি হচ্ছে- চ্যানেল আইয়ে সকালের গানের অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রখ্যাত সংগীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরীর বন্যার জন্মদিনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি ফোনে শুভেচ্ছা জানানো। দ্বিতীয় ঘটনাটি হচ্ছে- রংপুরে অবরোধকারীদের নিক্ষিপ্ত পেট্রোল বোমায় মা ও ছেলের পুড়ে অঙ্গার হওয়ার কাহিনি। যেখানে আগুনের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ৪৫ বছর বয়সের মা তার ১২ বছর বয়সের ছেলেকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলেন। উদ্ধারকারী পুলিশ কর্মকর্তা কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, এমন নৃশংসতা আর দেখিনি। আমি এসে জড়িয়ে ধরা দুটো কঙ্কালকে আলাদা করে মর্গে পাঠিয়েছি।

দুটো ঘটনাই খুব ভিন্নধর্মী এবং সম্ভবত একটার সাথে আরেকটার কোন সম্পর্ক নেই। এক ফেসবুক বন্ধু ঘটনা ১ এর ক্ষেত্রে লিখেছেন- যদিও হরতাল, অবরোধ, গাড়ি পুড়ছে, মানুষ মরছে তথাপি বিষয়টা আমার ভালো লেগেছে। এই মতটার সাথে অনেকেই একাত্ম। আমি নিজেও। তবু ক্রিটিক্যাল প্রশ্নটা হচ্ছে…

…কেন ভালো লাগে ?

এর উত্তরও গতকালের অনেক বন্ধুর স্ট্যাটাসে আছে। অনেকের মতো অনেকেরই ভাবতে ভালো লাগে যে, আমাদের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মতো চিন্তা ভাবনা করেন। সাধারণ মানুষের মতো জীবন যাপন করেন। সকালে নামাজ পড়েন। রবীন্দ্র সংগীত শোনেন। তিনি আমাদের শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করেন। এই আমরা হচ্ছে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি, আওয়ামীলীগ যার প্রতিনিধিত্ব করে। এর বহিঃপ্রকাশ হিসেবে আমরা প্রধানমন্ত্রীকে দেখি নিজে বাংলাদেশের অসুস্থ দরিদ্র শিল্পীদের খোঁজ খবর রাখছেন, অর্থ সাহায্য করছেন। আগুনে পুড়ে যাওয়া পরিবারের সন্তানদের গণ-ভবনে ডেকে এনে নিজ হাতে বিয়ে দেন। রাজনৈতিকভাবে ভুল সীদ্ধান্ত হওয়া সত্ত্বেও শাহবাগের শহীদ রাজীবের বাড়িতে চলে যান, বিমানে সাধারণ যাত্রীদের চমকে দিয়ে সকলের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।  আবার সকালে টেলিভিশন চ্যানেলে প্রখ্যাত শিল্পীর জন্মদিনে সরাসরি ফোন করে শিল্পীকে বিস্মিত করেন, শুভেচ্ছা জানান। তিনি আসলে মধ্যবিত্তের শ্রেণি চেতনাকে ধারণ করেন। এটা নিশ্চিতভাবে আমাদের জন্য সুখবর যে, তিনি আসলে মধ্যবিত্তেরই প্রধানমন্ত্রী।

কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে এই মধ্যবিত্তের রাজনৈতিক চরিত্র নিয়ে  

যৌবনে মধ্যবিত্ত বাঙালী যুবকদের ভেতরে বিদ্রোহী ভাবটা যেন সহজাতভাবেই প্রকাশিত হয়। যেন এটা  যৌবনেরই স্ফুলিঙ্গ। যেকারণে আমাদের জাতীয় কবি হন বিদ্রোহী কবি। কিন্তু এই স্ফুলিঙ্গকে সংঘটনের মাধ্যমে আগুনে রূপান্তরিত না হওয়ার দরুণ, কোনদিন রাজপথে নেমে সত্যিকার রাজনীতিতে অংশগ্রহণ না করার দরুণ, একাজে নির্ভরযোগ্য নেতা ও দলের অভাবের দরুণ আমরা ভেতরে ভেতরে কোথাও খুব আওয়ামীলীগ হয়ে থাকি। কেননা আমি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি যে, আওয়ামীলীগ আমাদের শ্রেণি চরিত্রেরই প্রতিনিধিত্ব করে। ফলে প্রত্যক্ষ রাজনীতির সাথে যোগ না থাকা আমাদের শ্রেণির রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে-বিদ্রোহী আওয়ামীলীগার। কিন্তু ন্যায়ের পক্ষে না থাকলে বিদ্রোহের পক্ষে থাকা কঠিন। আবার ক্ষমতাসীন দল ও ন্যায় এ দুটি হচ্ছে বিপরীত শব্দ। ফলে ন্যায়ের পক্ষে থাকার অভিনয় করতে গিয়ে আমরা সুপ্ত আওয়ামীলীগাররা নিরপেক্ষতার ছদ্মাবরণের আশ্রয় নিতে বাধ্য হই। ঠিক এই কারণে একটি বিতর্কিত নির্বাচনকে আমরা যেমন মেনে নিতে পারিনা আবার প্রধানমন্ত্রীর মধ্যবিত্তসুলভ আচারণে আপ্লুত হয়ে পড়ি। এই জটিল রাজনৈতিক সংকটে বড় হয়ে ওঠে আমাদের বাঙালী মধ্যবিত্ত তরুণদের রাজনৈতিক শ্রেণি চরিত্র।

এই জটিল অবস্থানে দাঁড়িয়ে আপনার আমার মনে হয়- বিএনপি হচ্ছে রাজনৈতিকভাবে নির্যাতিত দল    

মধ্যবিত্ত চেতনার বাহক হিসেবে যেহেতু আপনার ভেতরে কোথাও একটি ন্যায়ের বীজ বাপিত হয়ে আছে, যেহেতু দেশে একটি অন্যায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেহেতু বিএনপির রাজনৈতিক অধিকার সংরক্ষিত থাকাটা আপনার কাছে ন্যায় সংগত মনে হয়। ফলে বিএনপি আয়োজিত সকল হরতাল, সকল অবরোধকে আপনি বিএনপির রাজনৈতিক কর্মকান্ড হিসেবে, রাজনৈতিক অধিকার হিসেবে মেনে নেন। অথবা না মানলেও অন্তত প্রতিবাদ করা থেকে বিরত থাকেন। ( মাত্র কয়েকদিন আগে বিবিসি বাংলার পাতা থেকে একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়া হয়েছিলে- 'আপনি বিএনপি'র অবরোধকে সমর্থন করেন কি'না ? সেখানে ১৬ হাজার বাঙালী কমেন্ট করেছেন যাদের অধিকাংশই এই অবরোধের পক্ষে মতামত দিয়েছেন।) ঠিক এই জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে ১০ ট্রাক বালুর জন্য বিএনপিকে আপনার রাজনৈতিকভাবে নির্যাতিত দল মনে হয়।


কিন্তু আসলেই কি তাই ? 

বস্তুত বিএনপি হচ্ছে জামাতের এজেন্ডা বাস্তবায়নকারী একটা দল যারা নিজেদের ভিশন সম্পর্কে পরিষ্কার নন এবং দেশের জনগণকে যারা উন্নয়নের কোন রোডম্যাপ ও কার্যকরী ম্যানডেট দেখাতে পারেননি। যে দলের পদ বঞ্চিত ছাত্র নেতারা নিজেদের ভেতরে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। দলের থিংক ট্যাংক হিসেবে পূর্বে কার্যকর থাকা অধিকাংশ প্রবীণ নেতার মৃত্যু হয়েছে। বাকি প্রবীণরা বিএনপিকে ছেড়ে নতুন দলের ঘোষণা দিয়েছেন। জীবিত প্রবীণ ও তরুণ নেতাদের অনেকে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন এবং  তৃতীয় সারির নেতারা দলের মহাসচিব পদে নিযুক্ত হয়ে দল চালাচ্ছেন। নিজস্ব কারণেই বিএনপি খুব দুর্বল দলে পরিণত হয়েছে। সেই অবস্থায় বাড়ির সামনে ১০ ট্রাক বালুর বস্তা আসলে নির্যাতন নয় বরং পরিহাস বলেই আমি মনে করি। এই পরিহাসকে ক্ল্যাসিক্যাল মর্যাদা দিতে আওয়ামীলীগ নেতারা খালেদাকে আন্দোলনের পদ্ধতি সম্পর্কে পরামর্শও প্রদান করেছেন। বিএনপির এই রাজনৈতিক ব্যর্থতার দায়  কোন অবস্থাতেই আমার আপনার উপর বর্তায় না।

তাই আরো একটি সংবাদ এবং… 

বাংলাদেশ কিন্তু মধ্যবিত্তের দেশ নয়। দারিদ্র্যের দেশ। এদেশের অধিকাংশ মানুষ এখনো কৃষিজীবি। গতকাল আরো একটি সংবাদ হয়তো আপনাদের নজর এড়িয়ে গেছে। টানা অবরোধের কারণে পাইকাররা কৃষকদের কাছ থেকে পণ্য কিনছেন না। কিন্তু বেগুন বা মরিচ বা ফুলকপি বা মটরশুঁটি বা টমাটো বা লালশাক বা ডাটাশাক বা পটল বা উচ্চে বা ইত্যাদি বা ইত্যাদি একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর কৃষককে ক্ষেত থেকে তুলতেই হয় এবং বিক্রি করতে হয়। এখন সবজির ভরা মৌসুম এবং টানা অবরোধের কারণে কৃষক তা পারছেন না। ক্ষেত থেকে তুলে কম মূল্যে এমনকি পচে নষ্ট হওয়া এড়াতে বিনামূল্যে মানুষকে পণ্য দিয়ে দিতে হচ্ছে। কোথাও কোথাও ক্ষেত থেকে তুলে বাজারে আনার খরচ পোশাবে না বলে ফেলে দিতে হচ্ছে। মনে রাখতে হবে- আপনাকে যিনি আহার জোগান- এইটুকুই তার সম্পদ। এই টুকুই তার সংসার-ছেলেমেয়ের শিক্ষা-পল্লী বিদ্যুতের বিদ্যুৎ-ঋণের কিস্তি-অসুখের চিকিৎসা-ঝাল-লবণ-তেলের নিশ্চয়তা।

ফলে হরতালের প্রতিবাদ করুন 

আপনি যে রাজনৈতিক চেতনাই লালন করুন না কেন, অবশ্যই আপনাকে হরতালের প্রতিবাদ করতে হবে। এই মানুষ পুড়িয়ে মারার প্রতিবাদ করতে হবে। কৃষক যাতে পণ্য বিক্রি করতে পারে তার জন্য সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করাসহ সর্বোপরি এই হরতাল অবরোধ থেকে দেশ ও দেশের মানুষের মুক্তির জন্য সরকারের প্রতি চাপ সৃষ্টি করতে হবে। দেশের মানুষের দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। মনে রাখবেন…

…যখন বাসে মানুষ পুড়ছিলো প্রধানমন্ত্রী তখন রবীন্দ্র সংগীত শুনছিলেন

এক ফেসবুক বন্ধু লিখেছেন- সাবধানে চলাচল করুন। ক্ষমতাসীন বা বিরোধী দল কেউই আপনার নিরাপত্তার দায়িত্ব নেবে না। তাই নিজের দায়িত্ব নিজে নিন। আমি বলি রাস্তায় সাবধানে চলাচল করুন। কোথাও মহিলা ও শিশুরা আক্রান্ত হলে তাদেরকে সহযোগিতা করুন।