ভূমিকম্প মুহূর্তের যে ভিডিও ফুটেজগুলো দেখলাম, টেলিভিশনের লাইভ অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে নেপালের রাস্তা হয়ে বাংলাদেশের বসুন্ধরা সিটি পর্যন্ত। তাতে বোঝা গেল, জীবনের যে বোঝা মানুষ বইছে, তাতে সঠিক বোঝাপড়াটা না হলে, হেলেপড়া বা ধ্বসে যাওয়া বিল্ডিঙে চাপাপড়ে বোঝা মুক্ত হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। যেহেতু একযাত্রায় বাঁচা গেছে, এখন দেয়াল চাপার সাধারণ সূত্রগুলো শিখে না নিলে তা অনেকের কপাল চাপার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এই সংক্রান্ত অনেকগুলো জরুরী লেখাও দেখলাম। ভুল সঠিক মিলিয়ে একাকার। যিনি প্রচার করছেন, তিনি দায়িত্ব নেবেনতো তার পদ্ধতির ? জানা নেই। ভূমিকম্পের মুহুর্তে নিজের করনীয় সম্পর্কে খুবই বোকাসোকা ছিলাম। নিজের প্রয়োজনেই শিখতে হলো। সেটাই শেয়ার করছি।
ভূমিকম্পে ভীত সন্ত্রস্ত আমার এক কলিগ, ভূমিকম্পের সময় করনীয় সম্পর্কে যুক্তিগ্রাহ্য যে ভাবনাগুলো আমাকে শেয়ার করলেন, তার একটি হচ্ছে, একটি ভবনের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় হচ্ছে, সিঁড়ি। আমারও সেটাই মনে হলো। পরে শিখতে গিয়ে দেখলাম, এই ধারনা কতখানি ভুল ও মারাত্মক। এই ধরনের আপাত যুক্তিগ্রাহ্য ভুল ধারনার বশবর্তী হওয়া আমাদের মূল্যবান জীবনকে বিপন্ন করতে পারে। তাই এই লেখাটি জরুরী মনে করছি।
ভূমিকম্পের সময় করনীয় : (যদি ঘরে থাকেন) DROP, COVER, HOLD
০১. প্রথম কথা হচ্ছে, যদি ঢাকা শহরের মতো একটা শহরে থাকেন, তাহলে ভূমিকম্পের সময় কোন অবস্থাতেই বাইরে বের হবেন না। যারা অনেক উঁচু উঁচু দালানে থাকেন, তারা তো বের হবার চেষ্টাই করবেন না। কারণ এসময় কোন অবস্থাতেই লিফট ব্যবহার করা যাবে না, সিঁড়ি ব্যবহার করা যাবেনা। এমনকি ঘরের ভেতরেও কয়েক স্টেপের বেশি হাঁটা যাবে না।
এই পরিস্থিতিতে বাইরে বের হবার চেষ্টাই সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ ছুটন্ত অবস্থায় আপনার কোন সেল্টার থাকেনা। বিল্ডিঙের ভাঙা অংশ, ছাদ, অন্য বিল্ডিঙের অংশ, উড়তে থাকা জানালার কাচ, বাইরের দেয়াল ইত্যাদি যে কোন কিছুর আঘাত আপনাকে মাটিতে ফেলে দিতে পারে। আর সেই অবস্থায় আসতে পারে পরবর্তী আঘাত।
০২. ভূমিকম্প থেকে বাঁচার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে, বুঝতে পারার কয়েক মুহুর্তের মধ্যে কোন বিমের আড়ালে বা দেয়ালের কোনায় একটি বিশেষ পদ্ধতিতে আশ্রায় নেয়া। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমিকম্পের পর উদ্ধার অভিযানে যত লাশ উদ্ধার করা হয়, তাদের অধিকাংশই থাকে, বিভিন্ন জিনিষের তলায় ভুলভাবে আশ্রয় গ্রহণকারী মানুষ। অথচ ঘরের শক্ত আসবাবপত্রই ভূমিকম্পের সময় আপনার সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়। তাই সঠিকভাবে আশ্রয় নেবার পদ্ধতি সম্পর্কে জানা থাকা প্রয়োজন।
ঘরের কোথায় আশ্রয় নেবেন
আশ্রয় নেবার জায়গা বেছে নেবার সময় মাথায় রাখতে হবে
নিজের চেয়ে লম্বা কোন আসবাবের কাছে নয়, আপনি সেটার নিচে চাপা পড়তে পারেন। কোন অবস্থাতেই সিলিং ফ্যানের নিচে নয়। রান্নাঘর বা কিচেন কেবিটেনের সামনে নয়। বারান্দা বা জানালার কাছাকাছি নয়। তাহলে পাশের বিল্ডিঙের ধ্বসের অংশ ও জানালার কাচ দ্বারা আহত হবার সম্ভাবনা সাংঘাতিক।
আশ্রয় নেবার সবচেয়ে ভালো স্থান হচ্ছে, ঘরের ভেতরের কোন দেয়ালের কাছাকাছি, পিলার বা বিমের কাছে।
ট্রায়াঙ্গেল অব লাইফ
সিঁড়ি কেন ব্যবহার করবেন না?
সিড়ি হচ্ছে একটি ভবনের মূল কাঠামোর বাইরের অংশ। ভূমিকম্পের সময় যখন ভবনের দেয়ালগুলো ভেঙে পড়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করে তখন সিঁড়িতে ভিন্ন ধরনের ফ্রিকোয়েন্সি যুক্ত হয়। ফলে সেটার দুই মাথা ভেঙে পরস্পরের দিকে চলে যেতে পারে। এবং ঐ মুহুর্তে সিঁড়ির থ্রেডগুলো বন্দুকের গুলির মতো ছুটে গিয়ে আপনাকে কিমা বানিয়ে দিতে পারে। দ্বিতীয় এই ফ্রিকোয়েন্সির সাথে যোগ হয়, বাইরে যেতে চেষ্টা করা বিল্ডিঙের আর সমস্ত মানুষের চাপ। ফলে ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে। তাই ভুলেও সিঁড়ি নয়।
ভূমিকম্পের সময় করনীয় : (যদি লিফটে থাকেন) DROP, COVER, HOLD
একই সূত্র। DROP, COVER, HOLD। এরপর ভূমিকম্প থামলে বা কমলে, কাছাকাছি ফ্লোরে নেমে আবার আশ্রয় নিন।
ভূমিকম্পের সময় করনীয় : (যদি বাইরে থাকেন) DROP, COVER, HOLD
প্রথমত আপনাকে ফাঁকা ও নিরাপদ স্থানে যেতে হবে। যেখানে কোন গাছ, ইলেকট্রিক পোস্ট, ইলেকট্রিক তার, অন্য দালানের কড়ি বরগা, জানালার কাচ ছুটে এসে আপনার গায়ে না লাগে। এরপর আবার পুরনো সূত্র। DROP, COVER, HOLD – তবে এবার হোল্ডের অর্থ ভিন্ন। নিজের মাথাকে ধরে রাখতে হবে।
ভূমিকম্পের সময় করনীয় : (যদি গাড়িতে থাকেন)
গাড়িতে বসে যদি অনুভব করেন, ভূমিকম্প হচ্ছে, তাহলে গতি কমিয়ে কাছাকাছি কোন ফাঁকা স্থানে গাড়ি থামান। খেয়াল রাখবেন, পাশে কোন গাছ, ইলেকট্রিক খুঁটি বা ভেঙে পড়ার মতো দালান যেন না থাকে। নামবেন না। সিটবেল্ট বাঁধুন। ভূমিকম্প থামার অপেক্ষা করুন।
তবে যদি ফাঁকা স্থানে না যেতে পারেন। তাহলে গাড়ির সাথে একটি ট্রায়াঙ্গেল অব লাইফ সৃষ্টি করে আশ্রয় নিন। কোন অবস্থাতেই ফ্লাইওভার বা ফুট ওভার ব্রিজের নিচে গাড়ি থামাবেন না। এমনকি ব্রিজের উপরেও নয়। এটা খুব সহজে ভেঙে পড়তে পারে। গাড়ি সমেত বা গাড়িসহ আপনার মাথায়।
ভূমিকম্পের পরের ৩০ মিনিট
০১. গ্যাস লাইন ও ইলেকট্রিসিটির লাইন বন্ধ করে দিন।
০২. জরুরী সাপ্লাই লাইনগুলো চালু রাখার চেষ্টা করুন। ফায়ার সার্ভিস ও এ্যাম্বুলেন্সের পথ রোধ করবেন না।
ভূমিকম্পের পূর্বে করনীয়
০১. ভূমিকম্পের সময় কোথায় আশ্রয় নিবেন, এখনই ঠিক করে রাখুন।
০২. শক্ত আসবাবের তলায়, যেখানে আপনি লুকাতে পারবেন, সেখানটা অন্যকিছু দিয়ে পরিপূর্ণ থাকলে, সেটা সরিয়ে পরিস্কার রাখুন।
০৩. একটি প্যাকেটে কয়েকদিনের খাবার, ধূলোর হাত থেকে বাঁচার জন্য মুখ ঢাকার কাপড়, ফাস্ট এইড বক্স, একটি টর্চ, টর্চ ও মোবাইলের এক্সট্রা ব্যাটারি সংরক্ষণ করুন।
০৪. ধ্বসে পড়া ভবনে উদ্ধারকর্মীদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ঐ প্যাকেটে একটা হুইসেল রাখুন।
০৫. আর হ্যাঁ, অবশ্যই কয়েক গ্যালন খাবার পানি সংরক্ষণ করুন।
এই পদক্ষেপগুলো, মহাদূর্যোগে আপনার বেঁচে থাকার সম্ভবনাকে বাঁড়িয়ে তুলবে।