বাংলাদেশে আইসিস তৎপরতা ও পশ্চিমা বিশ্বের ‘নির্ভরযোগ্য’ তথ্যসূত্র

মেহেদী হাসান সুমন
Published : 1 Oct 2015, 06:38 PM
Updated : 1 Oct 2015, 06:38 PM

এই লেখাটি যখন লিখতে বসেছি, তার কিছুক্ষণ আগে বারাক ওবামার কাছ থেকে ঘোষণা এসেছে, 'আইসিসকে দমন করতে বাশার আল আসাদকে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হবে।' এতোদিন বিশ্ববাসী আইসিস এর কার্যক্রম দেখার সুযোগ পেয়েছেন। এখন এর কার্যকারীতা দেখার সুযোগও ঘটবে। বস্তুত ওবামা সরাসরি না বললেও, আসাদের প্রতি এই হুমকি অনেকদিন ধরেই বলবৎ আছে। তিনি শুধু আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিলেন।


ওবামা বুশের চেয়েও ভদ্রলোক। সভ্য মানুষ। এই সভ্যতার উচ্চতাকে মাপার একটি পন্থা হচ্ছে, স্বার্থ সিদ্ধির জন্য, পৃথিবীব্যাপী হত্যাকান্ড চালাতে ক্ষমতাধর মানুষেরা কত যুক্তিগ্রাহ্য কারণ সৃষ্টি করতে পারছেন তার উপর। মধ্যযুগ সবেমাত্র গত হয়েছে। কানকে ঘুরিয়ে নাক ধরার চক্রান্তের স্বার্থকতার উপরই দাঁড়িয়ে আছে চলমান সভ্যতা।

বাংলাদেশে পৃথিবীব্যাপী এই হানাহানির প্রেক্ষাপট খুবই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে একারণে যে, এটা সৃষ্টির একটি টুলস সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে, বাংলাদেশে আইসিস সক্রিয়। সম্প্রতি ঢাকার কুটনীতিক পাড়ায় ইতালী নাগনিক খুন হওয়ায়, বিশ্ব গণমাধ্যমসহ বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোতেও একই ধরনের আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। যার একমাত্র তথ্যসুত্র হচ্ছে, রিতা খাজ পরিচালিত সার্চ ফর ইন্টারন্যাশনাল টেররিস্ট এনটিটি'স (সাইট) ইন্সটিটিউট এর ওয়েব সাইট।

আশা করেছিলাম, বাংলাদেশের সাংবাদিকরা, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে হেয় প্রতিপন্ন করে এমন সংবাদের তথ্যসূত্রের প্রাসঙ্গিকতা ও যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন। কিন্তু এই বিষয়ে তাঁদের আশ্চর্য নিরাবতা- সেকুল্যারিজম চর্চার প্রতি বিপথগামী আকাঙ্খা না তাদের অজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ, আমার কাছে স্পষ্ট নয়। সুতারং কিবোর্ড হাতে তুলে নিলাম।


কে এই রিটা খাজ ?
বেশিদূর যেতে হবে না। উইকিপিডিয়াতেই রিতা খাজকে নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ আর্টিকেলের পাশাপাশি অনেক আর্টিকেলের লিংক রয়েছে। সেখান থেকে জানতে পারছি, রিতা খাজ এমন এক ইরাকি বংশোদ্ভুত ইহুদি, যিনি শৈশবে তার বাবাকে হারিয়েছিলেন খুব দুঃখজনক ঘটনার মধ্য দিয়ে। রিতার বাবাকে সাদ্দাম হোসেনের শাসন আমলে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে গোয়েন্দা তৎপরতা চালানোর দরুন গ্রেফতার করা হয় ও প্রায় ৫০ হাজার মানুষের সামনে হত্যা করা হয়। রিতার মা তার তিন শিশু সন্তানকে নিয়ে ইসরাইলে পালিয়ে আসতে সক্ষম হন। ইসরাইয়ে থাকাকালীন সময়ে রিতা তেল আবিব ইউনিভার্সিটিতে পড়ার পাশাপাশি ইসরাইলের ডিফেন্স ফোর্সে চাকুরী করতেন। ১৯৯৭ সালে স্বামীর চাকরী সূত্রে আমেরিকা আসার আগে তিনি ইসরাইল ছাড়ার ব্যাপারে খুবই দ্বিধাগ্রস্থ ছিলেন। তিনি মনে করন, প্রত্যেক ইহুদীকেই ইসরাইলকে ধারণ করা উচিত।

সাইট ইন্সটিটিউট
রিটা খাজের সাইট ইন্সটিটিউট হচ্ছে এমন একটি প্রাইভেট অর্গানাইজেশন, যারা অন লাইনে ইসলামি জঙ্গী সংগঠনগুলোর কার্যক্রমকে পর্যবেক্ষণ করে থাকে। এই সংক্রান্ত এনালিটিক্স, জিহাদী হুমকী ও জিহাদী ফোরামের প্রতি নজরদারী, ডিপ ওয়েব জিহাদী এক্টিভিটিজ গুলো পর্যালোচনার মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্যগুলোকে তাদের ক্লায়েন্টের কাছে অতি উচ্চমূল্যে বিক্রি করে থাকে। পশ্চিমা বিশ্বের জিহাদী তৎপরতার খবরাখবরের বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি ও একাডেমিক পর্যায়ে বেশ চাহিদা আছে বলেই মনে হয়। যদিও এই সমস্ত তথ্যের উৎস সম্পর্কে কোন পরিস্কার ধারনা কারো নেই। তবু কিভাবে কিভাবে জানি, পশ্চিমা সরকারসহ মিডিয়া সমূহ কোন প্রশ্নব্যাতীত রিটা খাজের এই তথ্যগুলোকে গ্রহণযোগ্য ও অথেনটিক মনে করে থাকেন। তবে সর্বাধিক প্রচলিত মতামত হচ্ছে, সাইটে প্রকাশিত সকল তথ্যই ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ কর্তৃক সরবরাহকৃত।

বিতর্ক
রিটা খাজ সারা পৃথিবীতে আলোচনায় এসেছেন কিছু বিতর্কিত ভিডিও টেপ প্রকাশের মাধ্যমে। এর অধিকাংশই আল কায়েদা ও আইসিস এর কর্মকান্ডের। এই লেখাটি যেহেতু আইসিস সংক্রান্ত, তাই আমি আল কায়েদার প্রসঙ্গে না গিয়ে আইসিস বিষয়ে সাইট কর্তৃক প্রকাশিত বিতর্কিত ভিডিও টেপগুলোর কয়েকটির মধ্যে আমার আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব।

রিটা খাজের সাইট ইন্সটিটিউট ২০০৮ সাল থেকে আইসিসের অনেকগুলো ভিডিও টেপ প্রকাশ করে, যেগুলোতে দেখা যায় আইসিস সদস্যরা বারাক ওমাবার প্রতি কিছু বানী প্রদর্শন পূর্বক James Foley, Stephen Sotloff, David Haines, Alan Henning, Peter Kassig ইত্যাদি সিআইএ এজেন্ট/ আমেরিকান সাংবাদিকদের গলায় ছুরি চালিয়ে হত্যা করছে। সবগুলো ভিডিও টেপ একই ধরনের, সুনির্মিত, হরর ইফেক্টে ভরপুর। এমন একটি ভিডিও দেখতে এখানে ক্লিক করুন

চলচ্চিত্র নির্মাণের কৌশলে নির্মিত এই সমস্ত ভিডিও টেপগুলোর নির্মাণ শৈলী মুগ্ধ হবার মতো। প্রয়োজনীয় জায়গায় ফেড ইন, ফেড আউট ইফেক্ট, হত্যার আসল অংশটি এড়িয়ে যাওয়া, প্রয়োজনীয় ট্রাক শট, ম্যাক্সিমাম হরর ইফেক্ট ইত্যাদি বিষয়গুলো এই ভিডিও টেপগুলোর সত্যতা সম্পর্কে সারা পৃথিবীতেই বিতর্ক তৈরি করেছে। আর এই যুগে ফটোশপের সামান্য জ্ঞান নিয়েই এই ধরনের ভিডিও প্রস্তুতের পাঁচটি সহজ এস্টেপ দেখে নিন এই ভিডিও থেকে। ভিডিও লিংক

সম্প্রতি সাইটের সবচেয়ে আলোচিত ফেইক ভিডিওটি হচ্ছে- এই বছরই জর্দানের পাইলট সাইফ ইউসুফ আল কাসাফকে আইসিস কর্তৃক একটি খাচার ভেতর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা। ভিডিওটি দিয়ে দিলাম, বিশ্বাস করুন একটি হলিউডি ছবির উত্তেজনায় আপনি এই পুরো ছবিটি দেখতে পারবেন।

ইহুদি সংবাদ মাধ্যম ফক্স নিউজে প্রকাশিত এই ২২ মিনিটের ভিডিও টেপে ক্লোজ শট, লং শট, এক্সট্রিম লং শট, ম্যাক্সিমাম ইফেক্ট সব ধরনের ভিসুয়্যাল ল্যাঙ্গুয়েজ সংবলিত উচ্চমানের ক্যানিবাল এ্যাকশান ভিডিও টেপ। যে ভিডিও নির্মাণে অংশগ্রহণ করেছে জর্দান আর্মি স্বয়ং। জর্দান আর্মির হাতে জর্দানের পতাকাকে শুধু কালো করে দেয়া হয়েছে। ভিডিও লিংক

সাইটের প্রোপ্রাগান্ডা ও আইসিসের প্রয়োজনীয়তা
আফগানস্তানে সামরিক অভিযান পরিচালনার জন্য যেমন ওসামা বিন লাদেনের প্রয়োজন ছিল। সিরিয়া আক্রমনের ভেতর দিয়ে আর কিছুদিনের মধ্যেই আইসিস এর প্রয়োজনীয়তা বিশ্ববাসীর কাছে খুব পরিস্কার হয়ে উঠবে। জঙ্গীগোষ্টিগুলোর ভেতর এতো কমিটেড আর্মি এর আগে আর দেখা যায়নি।

আরব বিশ্বে সিরিয়ান রাষ্ট্রপতি বাশার আল আসাদ ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই মার্কিন ও ইসরায়েলি স্বার্থের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছেন। ইরাকের সাথে সিরিয়ার দীর্ঘ দিনের বিরোধ থাকা সম্পর্কে বৈরিতা থাকা সত্ত্বেও তিনি ইরাকে ২০০৩ সালে যৌথ বাহিনীর আক্রমনের বিরোধীতা করেছিলেন। জাতি সংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হিসেবে সিরিয়া এই অভিযানের বিপক্ষে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে। এই কারণসহ লেবাননের প্রধানমন্ত্রী রফিক হারিরির হত্যাকান্ডে মার্কিনদের জড়িত থাকার সন্দেহে ও অবিরত ভাবে ইসরাইলের বিরোধীতা করার জন্য মার্কিন-সিরিয়ান কুটনৈতিক সম্পর্কের চিড় ধরার বয়স প্রায় এক দশকের বেশি। অপরপক্ষে মার্কিন নীতির সমর্থক আরবদেশগুলোর ভেতরে, বিশেষ করে সৌদি আরবের সাথে সিরিয়ার সম্পর্কের তেমন কোন উন্নতি ঘটেনি। ইরানের সাথে সিরিয়ার ঘনিষ্ট কুটনৈতিক সম্পর্কও আসাদের অন্তিম ঘন্টা বাজানোর কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

তবে আইসিস এর সাথে সাইটে'র সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে আমার কাছে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়, ২০০৬ সালে লেবানন-ইসরায়েল যুদ্ধ। ঐ বছরের ১৫ আগস্টে বাশার আল-আসাদ মতামত দেন যে উক্ত সংঘর্ষে ইসরায়েলের শোচনীয় পরাজয় ঘটেছে ও ইসরায়েলী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লেবানিজ প্রতিরোধ অসীম সাহসিকতা দেখিয়েছে ও সাফল্য লাভ করেছে। বাশার আল-আসাদের এই মন্তব্য আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমগুলোতে ব্যাপক ভাবে প্রচারিত হয় ও অধিকাংশ গণমাধ্যমের কাছে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে।

এই মন্তব্যে বাশার আরও বলেন যে ইসরায়েল প্রকৃতপক্ষে শান্তির শত্রু। এর সাথে কোনরূপ শান্তি আলোচনা করে সাফল্য পাওয়া অসম্ভব কেননা ইসরায়েল ও তাদের বৃহত্তর মিত্ররা আগ্রাসী আচরণ করে ও একে অপরের আগ্রাসনকে সমর্থন করে।

ইসরায়েলের এহেন শত্রুর প্রতি রিটা খাজ তথা তার প্রতিষ্টান সাইট তৎপরতা চালাবে এটাই স্বাভাবিক। ফলে সিরিয়ার পেটের ভেতরে একটি সু-সংগঠিত আর্মিকে দাঁড় করানো ও বিশ্বব্যাপী তাদের নৃশংসতাকে প্রকাশ করা এবং সর্বশেষ পর্যায়ে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে দেশটির দখল নেবার কৌশলকে বুঝতে আমাদের বাকি থাকে না।

বাংলাদেশে আইসিস তৎপরতার খবর ও সরকারের করনীয়
এহেন তৎপর রিটা খাজের বাংলাদেশের প্রতি হঠাৎ আগ্রহ দেখানোর সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত কারণ সম্ভবত, সাইটের সর্ভিস প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদেশকে নতুন ক্লায়েন্ট হিসেবে বিবেচনায় আনা। মাত্র গত সপ্তাহে ওয়াশিংটন টাইমস পত্রিকায় প্রধানমন্ত্রীর পুত্র ও উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় এর নিবন্ধ‌ 'আনমাস্কিং টেররিস্টস ইন বাংলাদেশ' প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ ইসলামী মৌলবাদ দমনে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা কামনা করে প্রকাশিত এই নিবন্ধের সাথে রিটা খাজের আগ্রহের সম্পর্ক আছে কি'না সেটা বিবেচনায় আনা আবশ্যক।

আমরা শুধু সবগুলো সম্ভাবনাকে যাচাই করে দেখতে চাই। যদি তা না হয়ে থাকে, তাহলে ধরে নিতে হবে, উপমহাদেশে ভূ-রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রনের জন্য বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আবার মার্কিন আগ্রাসনের ট্রেন্ডকে পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, কোন স্থানে সংকট তৈরির ক্ষেত্রে তারা দেড় দুই দশক আগে থেকেই সেই সমস্ত অঞ্চলে নানা ধরনের তৎপরতা চালিয়ে আসে। সেই হিসেবে রিটা খাজ বা তার প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশে আইসিস এর তৎপরতা চিহ্নিত করার খবর খুব সুখকর নয় এবং প্রাসঙ্গিকভাবেই তা উদ্বেগজনক। এটাকে জঙ্গি থ্রেট হিসেবে চিহ্নিত না করে মার্কিন থ্রেট হিসেবে চিহ্নিত করাই অধিক যুক্তিযুক্ত। বাংলাদেশে আইন শৃংখলা বাহিনী, ইন্টিলিজেন্স, নীতি নির্ধারক, বুদ্ধিজীবি সকলেরই এই থ্রেটকে যথাযথ গুরুত্বের সাথে পর্যালোচনা করে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেবার আহ্বান জানাচ্ছি।

একই সাথে এই দেশের নাগরিকদের আহ্বান জানাচ্ছি যে, ইতালীয় নাগরিক হত্যাকান্ডে আইসিসের সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ করে এদেশে পশ্চিমা মিডিয়ার বাংলা পেইজগুলো থেকে 'আইসিস কি, কেন, কিভাবে' টাইপ নিউজগুলোতে একবগগাভাবে ইসলামের ঘাড়ে ফেলে ব্যাখ্যা করার স্বভাব সুলভ অপপায়তারা কষা হচ্ছে, সেগুলোকে এককভাবে গলধকরণ না করে, এই ইন্টারনেট বিশ্বে একটু পড়াশোনা করে নিন। জানা থাকলে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণে সরকারের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারবেন।

(আমার ফেসবুক প্রোফাইল)

তথ্য সূত্র :
1. https://goo.gl/81bjhZ
2. https://goo.gl/PZz9lx
3. https://goo.gl/JUCI9q
4. http://goo.gl/uCqFeF
5. http://goo.gl/TkAXCl
6. http://goo.gl/6VRBoj
7. https://goo.gl/9NrWaZ