মায়েরা সন্তান হত্যা করেন কেন?

মেহেদী হাসান সুমন
Published : 4 March 2016, 08:37 PM
Updated : 4 March 2016, 08:37 PM

বাতাসে বসন্ত। নাগরিকদের কারো কারো মনে যখন, পলাশ ফুলের কোমল, পেলব স্মৃতি। ক্রিকেটে বাংলাদেশ দলের ধারাবাহিক সাফল্য সেই আবহাওয়াকে উৎসবমুখর করে তুলেছে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে এদেশের মানুষ থমকে দাঁড়িয়েছে একটি হৃদয় বিদারক খবরের সামনে। একজন মা তাঁর দুই শিশুকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছেন।

যদিও প্রথম দিকে নিহতের পরিবার থেকে দাবী করা হয়েছিলো, আগের দিনে চাইনিজ রেস্তোরায় বেঁচে যাওয়া খাবার খেয়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে ভিকটিমদের মা স্বীকার করেন, তিনি নিজ হাতে তার সন্তানদের হত্যা করেছেন।

এমন ঘটনার মুখোমুখি হলে, আমাদের মনে যে স্বাভাবিক প্রশ্নটি জাগে, তা হচ্ছে- কেন ?

র‌্যাবের প্রেস ব্রিফিং এর পর বাংলাদেশের দুটি শীর্ষ নিউজ পোর্টালে শিরোনাম করা হয়েছে, 'পরকীয়ার জেরে দুই সন্তানকে হত্যা মায়ের।' এই সংবাদের তথ্য সূত্র হিসেবে র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক Ziaul Ahsan এর ফেসবুক স্ট্যাটাসের স্ক্রিন শট ব্যবহার করা হয়েছে। যেখানে তিনি বলেছেন,

Mental anxiety, family/social disorder, Psychological illness, extra affir, grabbing of wealth & propertyetc are the main causes of child Killing.

Rab has apprehended the main suspect Mrs Mahfuja Maleq@Jesmin, the mother of two sibling (aroni and alvi) Both Child of two mother on 29 Feb 2016 approx pm in Rampura Banasree due to family Crisis.


সম্ভবত ভাষাগত দূর্বলতার কারণে পত্রিকা দুটির সাংবাদিক, এই বক্তব্যের ভুল অর্থ করেছেন। বাংলায় অনুবাদ করে সেখানে লেখা হয়েছে, '‌‌র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া স্ট্যাটাসে বলেন, মাহফুজা মালেক জেসমিনের পারিবারিক কলহ, মানসিক বৈকল্য, বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক, অর্থ-সম্পত্তির লোভ প্রভৃতিই এ হত্যাকাণ্ডের প্রধান কারণ।' এরপর শিরোনাম করার ক্ষেত্রে, পরকীয়াটাই প্রাধান্য পেয়েছে।

এদেশের সাংবাদিকদের দায়িত্বশীলতা নিয়ে নতুন করে কিছু লিখবার নেই। কিন্তু এই ধরনের সংবাদ তৈরি ও প্রচার করে তাদের পোর্টালগুলো জনমনে যে অস্থিরতা, নিরাপত্তহীনতা ও ক্ষোভের সৃষ্টি করলেন, তার দায়ভার সংশ্লিষ্টদেরকেই বহন করতে হবে।

কিন্তু এরচেয়েও বড় প্রশ্নটি হচ্ছে- একজন মা তাঁর সন্তানদেরকে হত্যা করেন কিভাবে ? র‌্যাবের মহা পরিচালক তার বক্তব্যে শিশু হত্যার কয়েকটি সাধারণ কারণের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এই টার্মটিকে শিশুহত্যা না বলে, সন্তান হত্যা বললে আরো পরিস্কার হবে। যার ইংরেজি প্রতিশব্দ Child Killing নয়, Filicidal– যার অর্থ পিতা মাতা দ্বারা নিজের সন্তান হত্যা করার মতো ঘটনা সংগঠিত হওয়া। যদিও সাধারণ মানুষের কাছে এটা প্রায় অসম্ভবই মনে হয় যে, পিতামাতারা তাদের সন্তানকেও হত্যা করতে পারেন।

কল্পনা করে নিই, অরনী (১৪) ও আলভী (৬) দুজনেরই চাইনিজ রেস্তোরার খাবার খুব প্রিয়। তাদেরকে হত্যা করা হবে বলে, তাদের মা শেষ বারের মতো কোন একটি উপলক্ষ্যে চীনে খাবার খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। পরদিন সকালে ছেলেমেয়েদের জন্য নিজ হাতে ভাত রেঁধেছেন। আর দুপুরে সেই হাতেই শ্বাসরোধ করে তাদেরকে হত্যা করেছেন। যখন ৬ বছরের আলভী ঘুমিয়ে ছিলো। ঠিক কি ধরনের জটিল মনস্তত্ত্বকে ব্যাখ্যা করলে এই আচরণের একটি গ্রহণযোগ্য উত্তর পাওয়া সম্ভব ? সোজাসাপ্টা ভাবে, প্রশ্নটি হচ্ছে- কেন একজন মা তার সন্তানদেরকে হত্যা করেন ? অন্তর্জালের দুনিয়া ঘেটে, আমি এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি। যে সামান্য ধারণা হলো, তা আপনাদের সাথে শেয়ার করে নিচ্ছি।

২.
শিশু হত্যা আমাদের দেশে ঠিক অপ্রচলিত বিষয় নয়। তার নজির যেমন প্রতিদিনের পত্রিকার পাতাগুলোতে দেখা যায়, পত্রিকার খবর হবার যোগ্য নয় এমন ধরনের শিশু হত্যাকান্ড এদেশসহ সমগ্র পৃথিবীতেই ঘটে থাকে। সন্তান হত্যার ঘটনাও কিন্তু অপ্রতুল বা অস্বীকৃত নয়। জন্মানোর ২৪ ঘন্টার ভেতরে- এদেশে ও পৃথিবীর অনেক স্থানে মায়েরা তাদের সন্তানকে হত্যা করেন। নারীদের বিবাহের আগে জন্মানো সন্তানের জীবন, ভীষণ রকম অনিশ্চিত ও প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে পারে, এমন আশঙ্কায় মায়েরা তাঁদের সন্তানকে হত্যা করেন বা হত্যা করার অনুমতি দেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এ ধরনের হত্যাকান্ডে মায়ের মতামতকে অগ্রাহ্য করা হয়।

ব্রিটিশ মনোবিজ্ঞানী ড. সান্ড্রা উইথলি মনে করেন, যে সকল বাবা মা তাদের সন্তানকে হত্যা করবেন বলে ঠিক করেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্তটা ঠিক তাৎক্ষণিক ভাবে গ্রহণ করা হয় না। সন্তানটি নবজাতক অথবা যে বয়সেরই হোক না কেন, তাদের হত্যা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাঁরা ভালো মন্দ অনেক কিছুই বিচার করেন এবং এই হত্যা সেই সন্তানের জন্য মঙ্গলজনক হবে, এমন একটি সিদ্ধান্তেও তাকে পৌঁছাতে হয়। যদিও বোঝা খুব কঠিন যে, কি ধরনের বিষয় বা আলামতগুলো বাবা মাকে সন্তান হত্যায় প্ররোচিত করে।

Case Western Reserve University School of Medicine এর মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. ফিলিপ রেজনিক প্রস্তাব করেন, এই ধরনের সন্তান হত্যা হচ্ছে altruistic filicide- (সন্তানের মঙ্গল কামনায় তাকে হত্যা করা)। কিন্তু এটাই একমাত্র ধরন নয়। অনাকাঙ্খিত সন্তানকে হত্যা, দুর্ঘটনাবশত সন্তান হত্যা যেমন হয়। সন্তান হত্যার মতো বিষয়ে আরেকটি কারণ খুব প্রাধান্য পেয়েছে, সেটি হচ্ছে স্বামী স্ত্রী পরস্পরের প্রতি প্রতিশোধ গ্রহণের মনোবৃত্তি।

২০০৬ সালে আমেরিকাতে এলেনি কম্পিওনির ঘটনাটা পৃথিবী বিখ্যাত। এলিনি তার দুটি চমৎকার সন্তানদের সাথে খেলতে খেলতে ও আদর করতে করতে বাথটাবে নিয়ে হত্যা করে। আর পুরো বিষয়টি একটি ভিডিও টেপ তৈরি করে রাখে, তার প্রাক্তন স্বামীর জন্য একটা বার্তা রাখে, যেখানে সে প্রশ্ন করে, এখন কেমন লাগছে তোমার ? এলিনি তার সন্তানদের হত্যা করার পর নিজেও আতœহত্যা করার চেষ্টা করেছিলো কিন্তু সফল হননি। তবে আমাদের দেশে সন্তান হত্যা করার পর মায়েদের নিজেদের আত্মহত্যার ঘটনা প্রায়ই দেখা যায়।

সন্তান হত্যা করার আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে, মানসিক রোগ। স্ফিৎজোফ্রেনিয়া একটা ভালো উদাহরণ হতে পারে। এই ধরনের মানসিক রোগের কিছু জটিল পর্যায় রয়েছে। এক্ষেত্রে মেগান হান্টসম্যানের ঘটনা খুব উল্লেখযোগ্য। তিনি পর পর ছয়টি সন্তানকে জন্মানোর পর পর হত্যা করেন। তবে তিনিই একমাত্র নন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, অপরাধী তার আগের অপরাধকে মনে রাখতে পারছে না। বাংলাদেশের বিখ্যাত কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের এই ধরনের সন্তান হত্যা নিয়ে 'জিনের বাদশা' নামে একটি গল্প রয়েছে। যেখানে একজন মা বিশ্বাস করতেন, তার সাথে জ্বীনের বাদশা বাস করেন। আর সেই জ্বীন প্রতিহিংসাবশত তার সন্তান জন্মানোর পরপরই তাদেরকে হত্যা করে।

অর্থের অভাব বা বিশেষ পরিস্থিতিতে পরিবারের লোক সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সন্তান হত্যা করার ঘটনা ঘটে। ঐতিহাসিকভাবে এস্কিমোদের যখন জমজ সন্তান হয়, তখন তারা একজনকে গ্রহণ করে আর আরেকজনকে মৃত্যুর জন্য বরফের উপর রেখে আসে। এর কারণটা হচ্ছে ঐ মায়ের বুকে দুজন শিশুকে খাওয়ার মতো দুধ হয় না।

রেজনিকের মতে, একই রকম পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক অভাবের কারণে আমাদের সমাজেও সন্তান হত্যার ঘটনা ঘটে থাকে। এখানে একটা সামাজিক সমস্যা মানসিক সমস্যায় পরিণত হয়।

Brown University, Alpert Medical School একটি গবেষক দল, আমেরিকার ৩২ বছর ধরে রেকর্ডকৃত ৯৪০০০ সন্তান হত্যার ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে দেখেন যে, শিশুরা তাদের বাবা মায়ের কাছেও ঝুঁকির মধ্যে থাকতে পারে। বাংলা নিউজ২৪. কমের শেয়ার করা নিউজের নিচে একজন পাঠক মন্তব্য করেছেন, 'বাঘ তার সন্তানদের খেয়ে ফেলে, কিন্তু বাঘিনী তাকে রক্ষা করে। এই মাকে বাঘিনীও বলতে পারছি না। বাঘ মা বলতে হবে।' সেই পাঠকের উদ্দেশ্যে বলছি, এ্যালপার্ট মেডিকেল স্কুলের উক্ত গবেষণার প্রধান টিমোথি মারিয়ানো মনে করেন- প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী মনে করা হয়, মায়েরাই কেবল সন্তানদের হত্যা করতে পারেন। কিন্তু আমাদের গবেষণায় যে উদ্বেগজনক তথ্যটি বেরিয়ে এসেছে, তা হচ্ছে সন্তান হত্যায় একজন বাবাও একজন মায়ের সমান ভূমিকা রাখতে পারে।

সন্তান হত্যাকারী বাবা মায়ের মনস্তত্ব খুব জটিল হলেও, ঈশ্বরের ইচ্ছায় আপনার আমার এই ধরনের কর্মকান্ডের ভুল দিকগুলো বোঝার ক্ষমতা রয়েছে। তাই কোন কোন সামাজিক সমস্যাগুলো মানুষের মানসিক সমস্যায় পরিণত হচ্ছে- এটা ভাবার প্রয়োজন রয়েছে। এক্ষেত্রে অরনী ও আলভীর মা মাহফুজা মালেকের বক্তব্য হচ্ছে, সন্তানদের ঠিক মতো পড়াশোনা না করাটাই সন্তান হত্যার কারণ।

একটি দরিদ্র দেশ তার নাগরিকদের জন্য শিক্ষার যে স্বল্প সুযোগ তৈরি করতে পারে, সেটা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এক অন্যায় প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করেছে। আর এটি প্রদান ও অর্জনের ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের অভিভাবকদের মনে এমন সব হতাশার জন্ম দিয়েছে যা খুবই নেতিবাচক। প্রত্যেকের সন্তানই পরীক্ষায় সমান ভালো করবেন না- এটা বুঝতে না পারা অভিভাবকদের হতাশা এমন তলানিতে ঠেকেছে যে, এর আগে আমরা পঞ্চম শ্রেণীর প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনাও প্রত্যক্ষ করেছি। এবার জানা গেল- এই জটিল পরিস্থিতি মানুষকে দিয়ে তার সন্তানকেও হত্যা করিয়ে নিতে পারে।

মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই ধরনের জটিল পরিস্থিতিকে আমাদের আরো গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতায় এগুলোকে 'পরকীয়ার জের' বলে উড়িয়ে না দিয়ে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তায় এই বিশেষ ক্ষেত্রগুলোতে চিকিৎসা গবেষণা ও সামাজিক গবেষণা করা প্রয়োজন। আরো গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে গৃহিত ব্যবস্থায় আমরা এধরনের হৃদয় বিদারক ঘটনাকে কমিয়ে আনতে পারি।