তৌকির আহমেদের অজ্ঞাতনামা ও আমাদের না বলা গল্প

মেহেদী হাসান সুমন
Published : 17 Dec 2016, 03:48 PM
Updated : 17 Dec 2016, 03:48 PM

কালুখালি থানার ওসি সাহেব বিমর্ষ মুখে বসে আছেন। শ্রাবণ মাসের রাত। বাইরে প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে। এর মধ্যেই সরকারী আদেশ এসেছে, চোপগাদায় এক মৃত্যু সংবাদ পৌঁছে দিতে হবে। শেখ আব্দুল হাকিমের পুত্র আব্দুল ওহাব তিনদিন আগে আরব আমিরাতের আজমান শহরে এক দূর্ঘটনায় নিহত হয়েছে। একদিন পরেই এয়ারপোর্ট থেকে তার পরিবারকে সেটা রিসিভ করতে হবে।

চোপগাদা থানা থেকে দূরবর্তী এক গ্রাম। ঘোর বৃষ্টি মাথায় নিয়ে নদী পথে পুলিশের দলটি যখন চোপগাদায় আব্দুল হাকিমের বাড়িতে পৌঁছালো, তখন মসজিদের মাইক থেকে ফজরের আজান ভেসে আসছে। করিম সাহেব মসজিদে যাবার প্রস্তুতিতে ছিলেন। এর মধ্যেই এই চরম দুঃসংবাদ। কিন্তু একটা খটকার ফলে প্রাথমিক শোকের ধাক্কাটি কিছুটা স্থিমিত হলো। কারণ ওসি সাহেব বলছেন, তিনদিন আগে মারা গেছে, কিন্তু আব্দুল ওহাবের সাথে তার পিতার আগের রাতেই ২৫মিনিট কথা হয়েছে। তাহলে ঘটনাটা আসলে কি?

ঘটনাটা কি সেটা নিয়ে সম্প্রতি মুক্তি পেয়ে হল থেকে হারিয়ে গেছে তৌকির আহমেদ এর চলচ্চিত্র 'অজ্ঞাতনামা'। অনেকদিন পর বাংলাদেশে নির্মিত কোন চলচ্চিত্র দেখে এতোটা আবেগাপ্লুত হলাম। অনেকদিন পর বাংলাদেশের একজন চলচ্চিত্র নির্মাতার সাধারণ মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধ দেখে অনুপ্রাণিত হলাম।

'অজ্ঞাতনামা' চলচ্চিত্রে একটি খাবারের দৃশ্য আছে এমন, যেখানে পুলিশের দলটি অনেক ক্লান্তি ও পরিশ্রমের পর দুপুরে আব্দুল হাকিমের বাড়িতে দুটো খেতে বসেছে। এ সময় হাকিম সাহেব কথা প্রসঙ্গে ওসি সাহেবের কাছে জানতে চান, তার ছেলেমেয়ে কটি। ওসি সাহেব জানান তিনি নিঃসন্তান। বাংলাদেশের গ্রামের মানুষ এমনিতেই নিঃসন্তান মানুষের প্রতি এক ধরনের মমতা পোষণ করেন। তার উপর ভুল হলেও ভোররাতে ছেলের মৃত্যু সংবাদ শোনার পর থেকে ছেলের জন্য তাঁর মন উতলা হয়ে আছে। তিনি গভীর মমত্ববোধের জায়গা থেকে ওসিকে সান্ত্বনা দিলেন এই বলে যে, 'সবই আল্লাহারই খেলা। আপনার কোনদিন সন্তান হারানোর ভয় নাই।'

কাট টু ক্লোজআপে এক সদ্য সন্তান হারানো পিতা, কেয়ায়েত উদ্দিন প্রমাণিক। যার ছেলে আছির উদ্দিন প্রমাণিক সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করে রমজান দালালের মাধ্যমে আব্দুল ওহাবের গলাকাটা পাসপোর্টে মিডলইস্ট গিয়েছিল। কাট টু ওসি সাহেবের চিন্তিত মুখ। কাট টু রমজান দালাল। কাট টু পুলিশের টু শট। সকলেই চিন্তিত। কাট টু লং শটে নদী, ট্রলার। ব্যাকগ্রউন্ডে অর্কেস্টেশন। ট্রলারের একঘেয়ে ভটভট শব্দ। নদীতে তখন সন্ধ্যা নামছে। এক গভীর শোক ও অনিশ্চয়তার রাত্রি নেমে আসছে। ‌‍অজ্ঞাতনামা' বাংলাদেশের চলচ্চিত্র। মেলোড্রামা। কিন্তু নির্মাতা, শিল্পী ও ইউনিটের কঠিন পরিশ্রমের ছবি। কোন প্রণয়োপাখ্যান নয়। বরং এ হাজির করেছে বাংলাদেশের এমন এক প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষের সংগ্রামের গল্প, যারা বৈদেশিক কর্মসংস্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী করলেও চিরকাল অবহেলিত থেকে গেছেন। যাদের গল্পগুলো এর আগে কখনোই এদেশের সাহিত্য বা চলচ্চিত্রে বলা হয়নি।

অজ্ঞাতনামার শুটিঙে যে কফিনটি ব্যবহার করা হয়েছিল, সেখানে কোন লাশ ছিল না। কারণ সম্পূর্ণ চলচ্চিত্রে কখনো লাশ দেখানোর প্রয়োজন হয়নি। চলচ্চিত্র নির্মাণের সেটে শুধু ততোটুকুই প্রপস হাজির করা হয়, যা ক্যামেরাতে দেখা যাবে। এর অর্ন্তগত রস সৃষ্টির ভার থাকে নির্মাতার হাতে। কিন্তু অজ্ঞাতনামার কফিনটি খালি থাকলেও, লাশটা ছিলো আমাদের কফিনে। আমার পিতার মরদেহ, যা আমরা দুইভাই শাহজালাল ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের হ্যাঙার গেইট থেকে রিসিভ করেছিলাম। আমাদের পিতা এক প্রবাসী শ্রমিক ছিলেন। যিনি সৌদিআরবের জেদ্দার একটি হাসপাতালে সম্পূর্ণ আত্মীয় পরিজনহীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছিলেন। তিনি তার প্রবাস জীবনের এগার বছর ধরে দেশের জন্য রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন। ২০১৩ সালের ২৮ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আমরা তাঁর লাশ দেশে ফিরিয়ে আনতে গিয়ে, একটি অজ্ঞাতনামা অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই।

২.
আমাদের কোন ধারণাই ছিল না বিদেশ থেকে কিভাবে মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনা যায়। সেই সময়ে আমার এক সহকর্মীর বন্ধু ছিলেন জেদ্দার বাংলাদেশ কনস্যুলেটের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। আব্বার মৃত্যু সংবাদের এক ঘন্টার ভেতরেই টেলিফোনে তাঁর সাথে কথা বলা সম্ভব হয়েছিল। তিনি যথেষ্ট আন্তরিকতা ও সহমর্মীতার সাথে আমার সাথে কথা বলেন। জানান, আব্বার পাসপোর্টটি জেদ্দার বাংলাদেশ কনস্যুলেটে জমা দিতে হবে। এরপর হাসপাতাল থেকে ডেথ সার্টিফিকেট ও কোম্পানি থেকে একটা ক্লিয়ারেন্স সংগ্রহ করতে হবে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে চার-পাঁচদিন, বড়জোর এক সপ্তাহ লাগতে পারে। তিনি আব্বার পাসপোর্ট নম্বর, কোম্পানির তথ্য, ওয়ার্ক পারমিট ইত্যাদি দিয়ে সৌদি কনস্যুলেট বরাবর একটা আবেদন দিতে বললেন। এই নির্দেশনাটি আব্বার রুমমেটকে ফোন করে জানাতেই, তিনি আমাদেরকে ভিন্ন ধরনের নির্দেশনা দিলেন। আব্বা স্ট্রোকের পর যখন আটদিন হাসপাতালের আইসিইউতে ছিলেন, তখন সকল দায়িত্ব তিনিই পালন করেছিলেন। এখন এই মরদেহ পাঠানোর দায়িত্বটিও তাঁর কাঁধে। ফলে তাঁর দিকনির্দেশনাটাই আমাদের জন্য জরুরি ছিল। আমরা ঠিক করলাম, দুটো পথেই এগুবো হবে। যেভাবে আগে হয়। আব্বার রুমমেট ভদ্রলোক জানালেন, কোম্পানি ক্লিয়ারেন্স এর জন্য বাংলাদেশ থেকে ওর জন্য একটা পাওয়ার অব এ্যাটর্নি পাঠাতে হবে। ইংরেজি ও আরবীতে। তিনকপি। এরপর শুরু হলো আমাদের যুদ্ধ।

ইসলামী বিধান অনুযায়ী, একজন মানুষের মৃত্যুর পর খুব দ্রুত তাঁকে দাফন করতে হয়। ব্যক্তিগতভাবে আমি ধর্মের বিধিবিধানকে অতটা গুরুত্বের সাথে পালন না করলেও, ধর্মের মতো মৃত্যুও খুবই সামাজিক বিষয়। ফলে যে মাটিতে মুহম্মাদ (সা:) ঘুমিয়ে আছে, সেই পবিত্র ভূমিতেই তাঁর দাফন হোক বলে অনেকে পরামর্শ দিলেন। কিন্তু আমাদের মন মানছিল না। এই পৃথিবী যদি আল্লাহ'র হয়ে থাকে, তবে তার সব মাটিই পবিত্র। অন্যচিন্তাটা হলো, মা আর বোনকে শেষবারের মতো একবার ওঁর মুখটা না দেখাতে পারলে, শুধু এই টেলিফোন নির্ভর একটি মৃত্যু সংবাদ ভবিষ্যতে ওদের মনে স্থায়ী প্রত্যাশা তৈরি করতে পারে। গুজবও শোনা গেল। সৌদিতে লাশ দাফনের কয়েকদিনের মধ্যেই না'কি ট্রাক্টর দিয়ে চাষ করে, হাঁড়গোড় সমুদ্রে ফেলে দিয়ে জায়গাটিকে নতুন কবরের জন্য প্রস্তুত করা হয়। এর সত্যমিথ্যা তখন যাচাই করবে কে? আর সবকিছু মিলে মাত্র চারটে দিনেরই তো বিষয়।

সেদিন জন্মাষ্টমীর বন্ধ ছিল। ফলে কোন অফিসিয়াল কাজ করা গেল না। পরদিন একজন উকিল খুঁজে পেতে তাঁকে দিয়ে পাওয়ার অব এ্যাটার্নি লেখানো হলো। এটা লিখতে গিয়ে দেখা গেল অনেক তথ্যই হাতের কাছে নেই। কিছু তথ্য সৌদি আরব থেকে সংগ্রহ করতে হবে। কিন্তু বাবার রুমমেটের সাথে দিনে একবারমাত্র কথা বলা যায়। কারণ তিনি যেখানে কাজ করেন, সেখানে ফোন সাথে রাখা যায়না। আর যোগাযোগের অন্যমাধ্যম যেমন ইমেইল, ম্যাসেঞ্জার, ফেসবুক ইত্যাদি সম্পর্কেও তার কোন ধারণা ছিলনা। ভদ্রলোক প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে আব্বার কাজগুলোকে এগিয়ে নিতেন। তাঁর ঋণ শোধ করার সাধ্য আমাদের কখনো হবেনা।

পাওয়ার অব এ্যাটর্নি অনুবাদ করাতে গিয়ে দেখলাম, ফকিরাপুলের কাছে দোকানগুলোতে এই জিনিসের ফরমেট করাই আছে। উকিলের প্রয়োজন ছিলো না। কিন্তু ওরা জানালেন, এই কাগজগুলোকে বাংলাদেশের সৌদি দূতাবাস খেকে এ্যাটাচডেট করাতে হবে। তবে তার আগে কাগজগুলোতে আইন মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে স্বাক্ষর করাতে হবে।

একটা মূল্যবান দিন হাতের ভেতর থেকে বেরিয়ে গেল। সদ্য এতিম হয়েছি। ভাইয়ারা গতকালই যশোরে মা'র কাছে চলে গেছে। তাঁর কাছে তো কারো থাকা দরকার। আমি কাজগুলোকে এগিয়ে নেবার জন্য ঢাকাতে থেকে গেছি। গতকাল সারাদিন মাকে ফোন দিইনি। কথা বলার সাহস পাচ্ছিলাম না। আজ সকালে কথা হয়েছে। তিনি শক্ত হতে বললেন। জানালেন, গতরাত্রে কিসব ইংগিতপূর্ণ স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন।

আমার পরদিনের সকাল শুরু হলো আইন মন্ত্রণালয়ের অফিসে। যে কর্মকর্তার স্বাক্ষর প্রয়োজন, তাঁর অফিস সহকারি আমাকে নিচে পাঠিয়ে দিলেন নিচতলার একটি নির্দিষ্ট দোকান থেকে কিছু কাগজের ফটোকপি করতে। ফটোকপির দোকানদার তার কাজের ফাঁকে আমাকে জানালেন, এই কাগজতো আমি আজকে পাব না। এখানে দুই একদিন লাগবে। এরপর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আরো দুএকদিন লাগবে। তিনি বিকল্প পথের সন্ধানও দিলেন। সরকারি স্বাক্ষরের বিভিন্ন প্যাকেজের রেট সম্পর্কে ধারণা পেলাম। অবশ্য আমি সেই সাহায্য গ্রহণ করিনি। সরাসরি কর্মকর্তার সাথে দেখা করে, তাঁকে আমার সমস্যা বললাম। তিনি সাথে সাথেই স্বাক্ষর করে দিলেন।

এরপর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সময় নিয়ে মহা ফাঁপড়ে পড়েছি। সব জায়গাতেই বড় বড় সিরিয়াল। আইন মন্ত্রণালয় থেকে বের হতে হতে দুপুর গড়িয়ে গেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে হয়তো কোনভাবে কাগজ জমা দেয়া যাবে। কিন্তু ঐদিন সেটা পাবার আর কোন সম্ভাবনা নেই। মাঝখানে শুক্র-শনি দুইদিন সরকারি ছুটি। আমি কাগজ জমা দিয়ে যশোরের বাসে উঠে পড়লাম।

গত কয়েক দিনের শোক, পরস্পর বিরোধী তথ্য, গুজব ইত্যাদি আমাদেরকে গভীর অনিশ্চিয়তায় ফেলে দিয়েছে। এর মধ্যে বিএমএটি'র (ব্যুরো অব ম্যান পাওয়ার এম্পলয়মেন্ট এন্ড ট্রেনিং) এক সদ্য সাবেক পরিচালক মহোদয় আমার পরিচিত ছিলেন। তাঁর সাথে কথা হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, যে কাগজপত্রের জন্য আমি এই মুহূর্তে ছুটছি, সেগুলো মরদেহ আনার জন্য প্রয়োজন নেই। সৌদিতে মৃতের কোন সম্পত্তি থাকলে সেগুলো ফেরত আনার জন্য পরে প্রয়োজন হবে। এই মুহূর্তে এগুলো ছাড়াই মরদেহ চলে আসার কথা। কিন্তু আব্বার রুমমেট জানাচ্ছেন, পাওয়ার অব এ্যাটর্নি ছাড়া তিনি কোন পদক্ষেপই নিতে পারছেন না।

রবিবার সকালে ঢাকাতে পৌঁছালাম। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সহজেই কাগজ পেয়ে গেলাম। এরপর যেতে হলো সৌদি দূতাবাসে। সেখানে দীর্ঘ লাইন। মোবাইল টোবাইল রেখে ঘন্টা চারেক বসে থাকতে হলো। এক ভদ্রলোক জানালেন, এ্যাটাচটেড ওখানে হয় না। এটা আবার বাইরের একটা কোম্পানিকে আউটসোর্স করা। তারাই কাগজপত্র প্রোসেস করে দূতাবাসে জমা দিবে। কাগজ সংগ্রহও করতে হবে তাদের অফিস থেকে। দূতাবাস থেকে যখন বেরিয়েছি, তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। গুলশান-২ এ অফিস। এই এলাকা আমার পরিচিত না। অনেকক্ষণ খুঁজতে হলো। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখি আরেক মহা ফাঁপড়।

এই অফিসেও অনেক ভীড়। জানা গেল আজ আর এখানে কাগজ জমা দেয়া যাবে না। সকালে আসতে হবে। তখন তো বিকেল। তবে এরচেয়ে ভয়ংকর তথ্য হচ্ছে, জমা দেয়া কাগজ ফেরত পেতে ২৮ দিনের মতো লাগবে। আর প্রত্যেক কপির জন্য ৭ হাজার টাকা করে মোট ২১০০০ টাকা জমা দিতে হবে। এখানে আমার মতো অনেককেই দেখলাম, কাগজের অপেক্ষায় আছেন। এদের প্রত্যেকেরই নিকট আত্মীয় সৌদি আরবে নিহত হয়েছেন। কারো বাবা, কারো ভাই, কারো চাচা। আমি এতো দ্রুত সেখানে পৌঁছেছি শুনে তারা বিস্মিত হলেন। কারণ এই পর্যন্ত আসতে কারো তিন মাস, কারো ছয় মাস পর্যন্ত সময় লেগেছে। দূর্ঘটনায় মৃত মানুষদের ক্ষেত্রে কখনো কখনো এক বছরও লেগে যায়। কারণ সেগুলো প্রপার ইনভেস্টিগেশন শেষ না হলে, লাশ হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয় না। কোম্পানি মরদেহ পরিবহনের খরচ না দিলে, ব্যক্তিগত খরচে আনতে হয় এবং তার খরচও কম নয়, কখনো কখনো সাত থেকে আট লক্ষ টাকা প্রয়োজন হয়। ফলে অনেকেই এই সমস্ত লাশের আশা ছেড়ে দেন।

আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে পড়েছি। বিপদে ধৈর্য্যধারণ করার একটা সহজাত ক্ষমতাও আমার রয়েছে। কিন্তু সব শুনে মনে হতে লাগলো, এই পড়ন্ত বিকেলে গুলশানের ব্যস্ত রাস্তায় হাত পা ছড়িয়ে কিছুক্ষণ কেঁদে নিই। যে লাশ চারদিনের মাথায় আসার কথা ছিল, আজ পঞ্চমতম দিনে এসে মনে হচ্ছে একটুও এগুতে পারিনি। পৃথিবীর কাছে কেন মানুষের চেয়ে কাগজপত্র, বৈধতা ইত্যাদি বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ কে জানে?

দ্বিতীয় পথটি বাদ দিতে হলো। ২৮ দিন অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। আমাদের তরফ থেকে আব্বার জন্য এটা আমাদের শেষ কাজ। এই পৃথিবীর সাথে তাঁর সম্পর্ক শেষ হয়েছে। অচেনা ভূবনের দিকে তাঁর যাত্রাটি যতো দ্রুত সম্ভব করা যায়, আমাদের উচিত সেই চেষ্টা করা। পরদিন গেলাম ঢাকাস্ত প্রবাসী কল্যাণ ভবনে। বিএমইটির এক কর্মকর্তার সাথে পূর্বেই একটা কাজের সূত্র ধরে পরিচয় ছিল। তাঁর রেফারেন্সে প্রবাসী কল্যাণ অফিসের এক কর্মকর্তার সাথে সহজেই দেখা করা গেল। তিনি জানালেন, সৌদি কনস্যুলেটে যে আবেদন করতে হবে, তার একটা নির্দিষ্ট ফরম আছে। যে এলাকায় থাকি সে এলাকার পৌরসভা থেকে একটা ওয়ারিশ নামা তৈরি করে আবেদনের সাথে জমা দিতে হবে। তবে পুরো কাজটি শুরু হবে জেলা অফিস থেকে। যশোর অফিস থেকে কাগজ আসবে ঢাকায়। সেখান থেকে সৌদিআরব। কতদিন সময় লাগবে বলা যায় না। তবে আমার যেহেতু রেফারেন্স আছে, তারা দ্রুত চেষ্টা করবেন। অগত্যা আবার যশোর যেতে হলো। বাকি কাজটি শেষ হতে আরো দু'দিন সময় লাগলো। আমাদের এখনকার কাজ শেষ। এখন শুধু অপেক্ষা করার পালা।

অপেক্ষার সময়টি ছিল সুদীর্ঘ ও করুণ। জানা যেত দুদিন পরেই আব্বাকে আমরা পেয়ে যাব। কিন্তু সে দুদিন পার হলে আবার নতুন তারিখ। মরদেহ পরিবহনের জন্য ফ্লাইট সিডিউল পাওয়া যায় না। আমার আব্বা কঠোর পরিশ্রমী ছিলেন। শুনেছি একারণে কোম্পানির মালিক তাঁকে পছন্দ করতেন। মালিকের বিশেষ নির্দেশে কোম্পানিই তাঁর সমস্ত চিকিৎসা খরচ, ফ্রিজিং খরচ, ঢাকা এয়ারপোর্ট পর্যন্ত পরিবহন খরচ বহন করেছিল। তবু কোম্পানি ক্লিয়ারেন্স পেতেই অনেকটা সময় বেরিয়ে গেল। একদিন কোম্পানি থেকে আমাদের ফোনও করেছিল। কিন্তু গান্ডুরা আরবী ছাড়া আর কিছু বলতেও পারে না, বোঝেও না। ফলে কেন তারা ফোন করেছিল, তা অজানাই থেকে গেল।

আব্বার মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার একঘন্টা পর থেকেই তাঁকে ফিরিয়ে আনার কাজ শুরু করেছিলাম। এই কাজে অনেক মানুষের অকৃত্রিম ও সহানুভূতিপূর্ণ সহযোগিতা পেয়েছি। তবু মরদেহ পেতে ৩৯ দিন লেগে গেল। আমি আর আমার বড় ভাই হযরত শাহজালাল ইন্টারন্যাশনাল এয়াপোর্টের হ্যাঙারগেট থেকে রিসিভ করলাম। এই ৩৯দিন আমার পরিবারের কোন সদস্য রাতে ঘুমাতে পারেন নি। এ পর্যায়ে মা বলেছিলেন, মৃতের আত্মা কষ্ট পাচ্ছে। তোরা ঐখানে দাফন করার ব্যবস্থা কর। মায়ের এই নির্দেশ পালন করার অবস্থাও ছিল না। কারণ সমস্ত কাগজপত্রে আমরা তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনার ইচ্ছার কথা জানিয়েছি। সেই ইচ্ছাকে বাতিল করার প্রক্রিয়া সম্পর্কেও আমাদের কোন ধারণা ছিল না।

আমার আব্বা তাঁর জীবনের শেষ ১১ বছর ধরে দেশের জন্য রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন। বিনিময়ে দেশ তাঁকে তাঁর মরদেহ বাড়িতে আনার খরচ বাবদ এয়ারপোর্টে ৩০০০০ টাকা প্রদান করেছিল। সাড়ে তিন লক্ষ টাকার একটা অনুদান আমরা পেয়েছিলাম, যা প্রদান করতে সরকারের ২ বছর সময় লেগেছে। আর সৌদি আরবে আব্বার যে সামান্য টাকা পয়সা ছিল, জেদ্দার বাংলাদেশ কনস্যুলেটের মাধ্যমে তা আড়াই বছর পর পেয়েছি।

প্রবাসে ১ কোটিরও বেশি বাংলাদেশি রয়েছেন। পুরো প্রক্রিয়ার সময় আমি শুধু ভেবেছি, যারা দালালের মাধ্যমে বিদেশে যান, চোরাই পথে বিদেশে যান তাদের কি দূরাবস্থাই না হয়। ভেবেছি ঐ সমস্ত মানুষের কথা, অন্যের সাহায্য ছাড়া যাদের একটা সাধারণ ফরম পূরণ করার ক্ষমতাও নেই, তারা কিভাবে এতো জটিল প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাবেন? প্রয়োজনীয় মুহূর্তে সঠিক দিক নির্দেশনাই বা কে দেবেন? ভেবেছি ঐ সমস্ত মানুষের কথা, যাদের আত্মীয়ের মরদেহ ৬ মাস, ১ বছর এক ভীনদেশে আত্মীয় পরিজনহীন অবস্থায় ফ্রিজে পড়ে আছে। তারা অপেক্ষা করছে, কখন দুই দেশের সরকারি প্রক্রিয়াগুলো শেষ হবে।

তৌকির আহমেদ তাঁর চলচ্চিত্রে এই গভীর বেদনার জায়গাটুকু নিয়ে কাজ করেছেন। একজন ভুক্তভোগী হিসেবে আমি আমার তরফ থেকে ও এককোটি প্রবাসী বাঙালির তরফ থেকে তাঁকে অসীম কৃতজ্ঞতা জানাই।

অনেক মানুষকে দেখলাম, চলচ্চিত্রটি প্রশংসা করলেও এর টেকনিক্যাল নির্মাণ নিয়ে চিন্তিত। সত্যজিৎ রায় তাঁর এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, 'সমালোচনা বলতে সামান্য কয়েকটা ব্যতিক্রম বাদে যেটা থাকে, তার প্রায় অর্ধেক হলো '‌ভুলের' তালিকা, আর বাকিটা হল-কোন কোন বিশেষ দৃশ্য বা শট বা শট-এর ডিটেইল উল্লেখ করে তার 'অন্তর্নিহিত নিগূঢ় অর্থ' উদঘাটনের প্রয়াস।' তাঁর মতে অধিকাংশেরই এই যৌথশিল্প সম্পর্কে কোন ধারণা নেই। 'চিত্রনাট্য সুষ্ঠু' অথচ 'সংলাপ দূর্বল' বা 'পরিচালনায় মুনশিয়ানা আছে' অথচ 'সম্পাদকের কাজ ক্রুটিপূর্ণ' ইত্যাদিও খুব পরস্পর বিরোধী আলাপ। নিজের অভিজ্ঞতায় তিনি দেখেছেন, 'দর্শক সাধারণত যে ধরনের ভুলের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন, তার সঙ্গে শিল্পরসের কোন সম্পকর্ই নেই।'

'অজ্ঞাতনামা' তার বক্তব্যের দিক দিয়ে ভীষণ শক্তিশালী ছবি। এমন অজানা এক অধ্যায়কে সে মানুষের সামনে হাজির করেছে, তা খুবই মর্মস্পর্শী। বাকি সমস্ত কিছু তুচ্ছ। এর বাইরে বলা চলে, অনেক অনেকদিন পর বাংলাদেশ তার চলচ্চিত্রে সম্পূর্ণ নিজের গল্পটা বলতে সক্ষম হলো। তৌকির আহমেদকে অভিনন্দন। অজ্ঞাতনামার পুরো ইউনিটকে অভিনন্দন।