পথের টুকিটাকি

জেসমিন হোসেন
Published : 5 June 2017, 03:05 AM
Updated : 5 June 2017, 03:05 AM

অনেকদিন পর রোদ ঝলমলে শনিবার পেয়ে মন একেবারে চনমন করে উঠলো। শীতের দেশের এ অনেক বড় পাওয়া। নাহ এমন একটা দিন তো ঘরে বসে কাটানোর উপায় নেই। উইকেন্ড এ একটু ভালো আবহাওয়া পেলে রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা মোটামুটি দ্বিগুন হয়। তারপরেও বেরিয়ে পড়লাম- যাই একটু প্রকৃতির কাছাকাছি ঘুরে আসি। বাসা থেকে ১০ মিনিটের পথ মাত্র গিয়েছি অমনি এক সহকর্মীর (যিনি আবার প্রতিবেশীও হন) ফোন। বনজঙ্গলে ঘুরতে যাচ্ছি শুনে সেও আগ্রহ প্রকাশ করলো যাত্রাসঙ্গী হতে। যেহেতু বেশি দূর যাইনি গাড়ি ঘুরিয়ে তাকে বাসা থেকে তুলে নিবো বলে কথা দিলাম।

পথের গোল চত্বর ঘুরতে না ঘুরতেই গাড়ির লম্বা লাইন দেখতে পেলাম। সর্বনাশ, বিশাল ট্রাফিক জমে গিয়েছে। কিন্তু এখন তো আর গাড়ি ঘুরানোর জো নেই। শুধু সামনেই যাওয়া যাবে। এই পথে তো জ্যাম বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না, বড়জোড় ১০ মিনিট। সহকর্মীকে ফোন করে জানালাম একটু দেরি হবে। ২০ মিনিট গেলো, ১ ঘন্টা পার হলো, কোনো গাড়িই তো এক চুলও নড়ছে না। পাশের লেন দিয়েও তো কোনো গাড়ি যাচ্ছে না। লোকজন পথে নেমে পায়চারি করছে। নাহ এতো স্বাভাবিক কোনো ট্রাফিক জ্যাম না। কোনো এক্সিডেন্ট নাকি? তাহলেই সেরেছে! মনে হচ্ছে পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আরো ঘন্টা খানেক পরে বিরক্ত হয়ে আমিও রাস্তায় নামলাম, তথ্য সংগ্রহের আশায়। কেউ কিছু বলতে পারছে না। সামনে পিছনে যতদূর দেখা যায় গাড়ির লম্বা লাইন। অনেকেই বাচ্চা নিয়ে ভ্রমণ করছে। তারাও গাড়ির বাইরে। অবশ্য এই গরমে গাড়ির ভিতর বসে থাকার চেয়ে বাইরে দাঁড়ানোই ভালো। রাস্তার দুপাশে বেশ গাছপালা আছে।

বিরক্তিতে আমার ভ্রু কুঞ্চন বোধ হয় সর্বোচ্চ সীমায় অবস্থান করছে। আশ্চৰ্য সবাই বেশ শান্ত। তেমন কোনো অস্থিরতা চোখে পড়ছে না। বেশি বয়স্কদের মধ্যে অবশ্য কিঞ্চিৎ বিরক্তি দেখা যাচ্ছে। দু একজনের মোবাইল ফোনের কথোপকথন কানে এলো- নির্ধারিত দাওয়াত বাতিল করছেন বা বর্তমান অবস্থা জানাচ্ছেন পরিবার পরিজনকে। কোনো বাজে কথা বা গালিগালাজ কানে এলো না, কিন্তু আমার ভেতর অসহিষ্ণুতা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। ঘন্টা তিনেক পার করেছি এমন সময় দেখতে পেলাম দু-তিনটা কিশোর বয়সী ছেলে পানির জগ আর গ্লাস হাতে গাড়ির পাশ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

হাইওয়ের  পাশে নামকরা একটা কফিশপ আছে। তাও যেখানে আটকা পড়েছি সেখান থেকে ১০-১৫ মিনিটের হাঁটা পথ। তারাই ভলান্টিয়ার পাঠিয়েছে পথে আটকা পড়া লোকজনের পানির ব্যবস্থা করতে। বিনে পয়সায়, এও সম্ভব! আর এই ভলান্টিয়ার গুলোকে তো কমপক্ষে এক মাইল হাটতে হবে। যদিও পানির বোতল সাথে আছে তাও এগিয়ে গেলাম এক গ্লাস পানি খাবো বলে। উদ্দেশ্য, দেখি ওরা যদি কিছু বলতে পারে। জিজ্ঞেস করতে জানালো ওরা তেমন কিছু জানে না, পুলিশ পথ আটকে দিয়েছে – এটুকুই।

কিছুক্ষণ পর পাশের লেইন দিয়ে পুলিশের গাড়ি খুব ধীর গতিতে পার হচ্ছিলো, টহল দেয়ার মতো করে। তারাও আটকে পড়া যাত্রীদের জিজ্ঞেস করছিলো সব কিছু ঠিক ঠাক আছে কিনা। পুলিশের কাছ থেকেই জানা গেলো নিকটস্থ এক ছোট ওভারব্রিজে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন নিচে ঝাঁপ দিবেন বলে। জানামাত্রই পুলিশ এসে দুপাশের সকল যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। কোনোভাবেই মহিলাকে ব্রিজ থেকে নামানো যাচ্ছে না। পুলিশ আর অ্যাম্বুলেন্স চারপাশ ঘিরে রেখেছে। এখন তারা চেষ্টা করছে বিকল্প পথের ব্যবস্থা করতে যাতে আটকে পড়া গাড়িগুলো যেতে পারে। এ ঘটনা শুনে তো রাগে আমার মাথা ঝিমঝিম করা শুরু করলো।

তাজ্জব ব্যাপার, এরাতো কোনো রাগ দেখাচ্ছে না, বাজে কথা বলছে না। অনেকের অস্থির পায়চারি দেখে বুঝা যাচ্ছে আস্তে আস্তে তারাও বিরক্ত হচ্ছে। সারা সপ্তাহ হাড় ভাঙ্গা খাটুনির পর উইকেন্ডটাও রাস্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, এটাতো কোনো আনন্দের বিষয় না। কেউ কেউ হয়তো প্লেনও মিস করবে কে জানে। অবাক করা বিষয় হচ্ছে জনগণ ক্ষেপে গিয়ে কোনো ভাংচুর করছে না। আরে বাবা! যে মহিলা এতক্ষণ ধরে ব্রিজে দাঁড়িয়ে আছে মরবে বলে, তার যে মরার ইচ্ছে নেই এ তো বুঝাই যাচ্ছে। তার জন্য এতগুলা মানুষের ভোগান্তি করার কি মানে? সবার জীবনের দাম দিলে কি চলে? কই আমাদের দেশে তো ক্ষমতাবানরা ছাড়া সাধারণ মানুষের জীবনের কোনো মূল্য নেই। যত্তসব! আর ওই যে ভলান্টিয়াররা পানি নিয়ে ঘুরছে এ নিশ্চয় মার্কেটিং এর ফন্দি। হোক না বিনামূল্যে পানি, আসলে ফাঁকতালে ব্যবসার প্রচারণা আর কি!

কিন্তু যে শিশু কিশোররা দেখলো যে রাস্তায় ওদের মতোই অল্প বয়সীরা গরমে পানি নিয়ে ঘুরছে আর অপরিচিত যাত্রীদের সাহায্য করছে, নিজের অজান্তেই ওরা কী শিক্ষা বা মেসেজ পেলো? চার অক্ষরের একটা শব্দ বোধহয়- 'মানবতা'। আর ওদের মা-বাবারাও যে খিস্তি খেউর ছাড়াই এতক্ষণ অপেক্ষা করছে এর নাম সম্ভবত 'ধৈর্য'। এমনিভাবেই কি একটি জাতি মানবিক হয়ে গড়ে উঠে?

আমি ভাই অতকিছু বুঝি না। পাঁচ ঘন্টা বেহুদা রাস্তায় বসে থেকে ব্রম্ম তালু জ্বলে যাচ্ছে- হাজার হোক মাথা গরম জাতি বলে আমাদের একটা ইজ্জত আছে!