সুফিবাদ এবং বাঙলায় এর প্রভাব

মশিউর রহমান মশু
Published : 4 April 2015, 07:28 AM
Updated : 4 April 2015, 07:28 AM

স্রষ্টা বা পরম সত্তা কে জানার বা বোঝার জন্য বিভিন্ন ধর্মে ভিন্ন ভিন্ন সাধনা আছে। ইসলাম ধর্মে যে সাধনা প্রচলিত এবং সর্বজন বিদিত তা সূফীবাদ। আরবি শব্দ 'সুফ' মানে 'উল'। আল-সুফিয়াহ বা সূফীবাদ শব্দটি দ্বারা ওলের তৈরি পোশাক পরিধান করাকে বুঝায় । সুফিরা তাদের বৈরাগ্যের নিদর্শনস্বরূপ ওলের বা পশমের কাপড় পড়তো বলেই সম্ভবত: এই নামে পরিচিত হয়েছেন। সম্ভবত: সর্বপ্রথম ইরাকের বুসরা নগরীতে যুদ্ধ বা দুনিয়া ত্যাগের প্রেরণা, প্রবল আল্লাহ-ভীতি ও দুনিয়াত্যাগের বাড়াবাড়ি, সার্বক্ষণিক যিকির, আযাবের আয়াত পাঠে বা শুনে অজ্ঞান হওয়া বা মৃত্যু বরণ করা ইত্যাদির মাধ্যমে সূফীবাদের যাত্রা শুরু হয়।
স্রষ্টা বা পরম সত্তার সাথে মিলনই সুফি সাধনার পরম লক্ষ্য। তার জন্য সাধক কে অনেক পথ পাড়ি দিতে হয়। ক্রমানুসারে তা তুলে ধরা হলো।

১. আত্মসমর্পনঃ সূফীবাদের মূল উদ্দেশ্য পরম সত্তার নিকট আত্নসমর্পন , তাই তাদের পীর বা গুরু -র নিকট আত্নসমর্পন করে তাদের শিক্ষা অনুযায়ী পথ চলতে হয়। পীর শব্দটি ফার্সি। আরবিতে বলা হয় মুর্শিদ। মুর্শিদ শব্দের অর্থ হলো পথপ্রদর্শক। যিনি আল্লাহর আদেশ-নিষেধ আল্লাহ তায়ালা যেভাবে চান সেভাবে পালন করার প্রশিক্ষণ দেন তার নাম মুর্শিদ বা পথপ্রদর্শক।

২. যিকিরঃ আল্লাহর নাম বা কোরআনের কোন আয়াত বার বার আবৃতির নাম জিকির। এ যিকির নীরবে বা উচ্চ স্বরে দু ভাবে হতে পারে, জিকিরের মাধ্যমে পরম সত্তার সাথে লীন হতে হয়।

৩. শামা বা সংগীত: আলাহর উদ্দেশ্যে প্রেমমূলক যে সংগীত যা আধ্যাত্মিক ভাব তন্ময়তা জাগিয়ে তোলে তাই শামা।

৪. ভাব তন্ময়তা বা হাল: সুফির এক ধরনের আধ্যাত্মিক মানসিক অবস্থা যা তার অন্তর দৃষ্টি লাভে সাহায্য করে।

৫. কৃতজ্ঞতা: সব সময় আল্লাহর প্রতি সুফি সাধকরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। প্রতিটি কাজের জন্য প্রতিটি ক্ষণের জন্য।

৬. ধৈর্য ধারণ বা আত্নসংযমঃ সুফি সাধকরা আত্মসংযমী হন। সকল বিপদে ধৈর্য ধারণ করেন এবং ধৈর্য ধারণের উপদেশ দেন।
৭. পবিত্রতা: সুফি সাধকরা দেহ এবং মন পবিত্র রাখেন কারণ অন্তরের পবিত্রতার উপর আল্লাহর জ্যোতি প্রতিবিম্ব হয়।

৮. ভক্তি বা প্রেম: সুফি সাধকরা ভয়ে নয় প্রেমে আল্লাহর দিদার লাভ করেন। আল্লাহর প্রেমে সাধক জাগতিক সবকিছু ত্যাগ করেন। ভয়ে নয় প্রেমের মধ্য দিয়ে আল্লাহর দিদার সূফীদের মূল লক্ষ্য।

৯. ফানা: আলাহর সংগে সম্মিলনের নঞর্থক দিক বলা হয় ফানা যার অর্থ তিরোধান বা ধ্বংস, জাগতিক বিষয়ের সকল চাওয়া পাওয়ার অবসান। এই স্তরে সাধকের নিজের কোন চাওয়া পাওয়া থাকে না। এই পর্যায়ে সাধক জীবন্ত মৃত হয়ে যায়। যেটাকে বলে মরার আগে মরা। আল্লাহর প্রেমের মরা।

১০. বাকা: ইহা শেষ স্তর ফানার শেষ বাকার শুরু ,আল্লার সাথে সম্মিলন অর্জনের সদর্থক দিকটি হল বাকা। বাকার অর্থ আল্লাহর স্বরূপে, গুণে প্রতিষ্ঠা লাভ। বাকাকে বলা হয় আল্লাহর মধ্যে অবস্থান, এ পর্যায়ে সাধক আল্লাহর চেতনার সাথে অন্তর্লীন হয়ে যায়। এ অবস্থায় সাধকের সকল ইচ্ছা আল্লাহর ইচ্ছা হয়ে যায়, তার কর্ম হয়ে যায় আল্লাহর কর্ম।

সুফিবাদ বলে, নিজেকে চিনো বা জানো। নিজের মধ্যেই আল্লাহ বিরাজ মান। আধ্যাত্মিক সাধনার দ্বারা নিজের অন্তর দৃষ্টিকে উন্নত করতে পারলে হৃদয়ের আয়নায় আল্লাহর মহিমা প্রতিফলিত হবে।

সুফীদের রয়েছে বিভিন্ন তরীকা। স্থান ও কাল অনুযায়ী অসংখ্য সুফী তরীকা আত্মপ্রকাশ করেছে। তার মধ্যে কয়েকটি তরীকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

১. গাউছুল আজম বড় পীর হযরত আবদুল কাদির জিলানী (রঃ) প্রতিষ্ঠিত কাদেরিয়া তরিকা,

২. সুলতানুল হিন্দ হযরত খাজা মু'ঈনুদ্দীন চিশতি (রঃ) প্রতিষ্ঠিত চিশতিয়া তরিকা

৩. গাউছুল আজম হযরত আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী প্রতিষ্ঠিত কাদেরিয়া মাইজভান্ডারীয়া তরিকা,

৪. হযরত খাজা বাহাউদ্দিন নকশবন্দী (রঃ) প্রতিষ্ঠিত নকশবন্দিয়া তরিকা এবং

৫. হযরত শেখ আহমদ মুজাদ্দিদ-ই-আলফে ছানী সারহিন্দী (রঃ) প্রতিষ্ঠিত মুজাদ্দিদিয়া তরিকা।

এই পাঁচটি তরীকার নামই আমাদের দেশের সুফীদের মুখে ব্যাপকভাবে উচ্চারণ করতে শুনা যায়। এছাড়া অনেক উপ-তরীকা দেখতে পাওয়া যায় যেমন, সুহ্‌রাওয়ার্দিয়া, মাদারীয়া, আহমদিয়া ও কলন্দরিয়া নামে আরও কয়েকটি তরিকার উদ্ভব ঘটে।

আমাদের বাংলাদেশে ইসলামের প্রচার এবং প্রসার ঘটে সেন রাজবংশের পতনের মধ্যদিয়ে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির (১২০৩ খ্রিঃ) বাংলা জয়ের পর পর । ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির বঙ্গ বিজয়ের পর ইরান-ইরাক-তুরস্ক ও আফগানিস্তান থেকে অনেক সুফি দরবেশ, পীর-আউলিয়া ধর্ম প্রচারের জন্য বাঙলায় আসেন।

আমরা বাঙালি মুসলমানরা (৫৭০খ্রি:+৪০= ৬১0 খ্রিঃ) ইসলামের জন্মের প্রায় ৬০০ বৎসর পরে মূলত: সুফি সাধকদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ইসলামের রূপ সৌন্দর্যে অবগাহন করেছিলাম। তার মধ্যে উল্লেখ যোগ্য সূফী দরবেশ বা অলি আউলিয়ারা হলেন- শাহ জালাল (রঃ), শাহ সুলতান (রঃ) শাহ মুখদম (রাঃ) শাহ আলী (রঃ) খানজাহান আলী (রঃ) ইত্যাদি। তার আগে আমরা কেউ হিন্দু, কেউ বৌদ্ধ বা কেউ অন্য কোন ধর্মের অনুসারী ছিলাম। তাই আমাদের ভারতবর্ষে তথা বাংলায় ইসলাম ধর্ম সাধনায় সুফি সাধকদের প্রভাব আজও বিদ্যমান।

যাদের হাত ধরে ইসলাম বাঙলায় এসেছিল, সেই সকল অলি-আউলিয়ারা বাঙলায় ইসলামী আইন, প্রথা এবং উৎসব প্রবর্তন করলেও বাঙলার নিজস্ব আচার-আচরণ, রীতি-নীতি এবং প্রথা অস্বীকার করেননি। বরং যে সকল প্রথা বা আচার আচরণের মধ্যে যত টুকু একত্ববাদের সাথে সাংঘর্ষিক ছিল ততো টুকুই শুধু বাতিল করছেন। তাই অনেক প্রথা বা আচার রীতি-নীতি একই সাথে বাঙালী মুসলমান, হিন্দু ও অন্যরা পালন করেন নিজেদের মত করে। যেমন জ্ঞানের প্রতীক আগুনকে সন্মান করে প্রজ্বলন বা ফানুস ওড়ানো। বিভিন্ন পালা-পার্বণ ও নবান্নের উৎসব পালন। বিয়েতে নিজ নিজ ধর্মের নিয়ম অনুসারে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা পালনের আগে ও পরে বাঙালি রীতির নানা প্রথা বা আচার মানা ইত্যাদি।

-মশিউর রহমান