সৃষ্টির মাঝেই অটুট থাকবে তার জীবন বীক্ষণ

মশিউর রহমান মশু
Published : 24 Sept 2016, 09:00 AM
Updated : 24 Sept 2016, 09:00 AM

যিনি শব্দের পর শব্দ গেঁথে তৈরি করেছেন শব্দ সৌধ; যার রূপ- কাঠামো দিয়েছেন কখনও কবিতায়, কখনও উপন্যাসে, কখনও গল্পে, কখনও নাটকে, কখনও শিশু সাহিত্যে, কখনও কলাম-প্রবন্ধে। এক কথায় বাংলা সাহিত্যের সকল মাধ্যমে যিনি সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। যার লেখায় বাঙ্গালির স্তবক গাঁথা। যার লেখায় মুক্ত মননশীলতা। যার লেখায় প্রেম ও মানবতার উদাত্ত আহবান। যার লেখায় ঈগলের দৃষ্টি দর্শন, সিংহের মত সাহস সঞ্চয় এবং জননীর মত মমতাময় ও প্রেমিকার মত প্রেম-স্পর্শ। যিনি কবিতায় সব্যসাচী, সাধারণ্যে লেখক এবং আমার কাছে একজন তারুণ্যের প্রতীক, একই সাথে একজন ফ্যাশন সচেতন বাঙ্গালি কবি। তিনি সৈয়দ শামসুল হক।

সৈয়দ সামসুল হক ১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রাম জেলার ধরলা নদীর তীরে পৈতৃক-গৃহে জন্মগ্রহণ করেন। সৈয়দ শামসুল হকের প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালে ফজলে লোহানী সম্পাদিত ''অগত্যা'' পত্রিকায়। সেখানে "উদয়াস্ত" নামে তাঁর একটি গল্প ছাপা হয়।

সৈয়দ শামসুল হকের পিতার ইচ্ছা ছিলো তাকে তিনি ডাক্তারি পড়াবেন। পিতার এরকম ইচ্ছা তিনি মানতে পারেনি। ১৯৫১ সালে বম্বে পালিয়ে যান। সেখানে তিনি বছর খানেকের বেশি এক সিনেমা প্রডাকশন হাউসে সহকারী হিসেবে কাজ করেন। এরপর ১৯৫২ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন। নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী পড়াশুনায় মনোনিবেশ করেন এবং তৎকালীন জগন্নাথ কলেজে মানবিক শাখায় ভর্তি হন। কলেজ পাসের পর ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু স্নাতক পাসের আগেই ১৯৫৬ সালে পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখে বেরিয়ে আসেন। এর কিছুদিন পর তাঁর প্রথম উপন্যাস ''দেয়ালের দেশ'' প্রকাশিত হয় । (সুত্রঃ উইকিপিডিয়া)

যে কোন লেখক ভিন্ন ভিন্ন পাঠকের কাছে ভিন্ন ভিন্ন আবেগ ও ভালোবাসার সঞ্চালন করে তাদের মনে যায়গা করে নেন। তেমনি আমার মনে সৈয়দ শামসুল হক মূলত কবিতা ও কবিতা ও ব্যক্তিগত জীবনাচরণের কারণেই স্থান পেয়েছেন। তার যে কবিতা আমার এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে সেটি , "আমার পরিচয়" কবিতাটি,

আমি জন্মেছি বাংলায়
আমি বাংলায় কথা বলি।
আমি বাংলার আলপথ দিয়ে, হাজার বছর চলি।
চলি পলিমাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে।
তেরশত নদী শুধায় আমাকে, কোথা থেকে তুমি এলে ?
আমি তো এসেছি চর্যাপদের অক্ষরগুলো থেকে
আমি তো এসেছি সওদাগরের ডিঙার বহর থেকে।
আমি তো এসেছি কৈবর্তের বিদ্রোহী গ্রাম থেকে
আমি তো এসেছি পালযুগ নামে চিত্রকলার থেকে।
এসেছি বাঙালি পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার থেকে
…………………………..

সৈয়দ সামসুল হক এমনতর লেখক যিনি প্রতিটি লেখায়- অবশ্যই পাঠ্য ও সমকালীন হিসাব মাথায় রাখতেন। তিনি কবিতা গল্প উপন্যাস নাটক ইত্যাদির প্রতিটি সৃষ্টিতেই তরুণ লেখকদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন এবং প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীও ছিলেন। যিনি বিশ্বাস করতেন লেখকের রাজনীতি হচ্ছে সমাজ, জীবন এবং ইতিহাসের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা। তিনি অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও বাঙ্গালি সমাজ, জীবন এবং ইতিহাসের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছেন। এই বিশ্বস্ততার জন্যই তিনি মহান বাঙ্গালি কবি ও লেখক হিসাবে আমার মনের গহীনে সু-সমন্বিত স্থান পেয়েছেন। আমি তাকে ভালোবাসি এবং ভালবাসবো।

বর্তমানে যিনি দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যানসারের সাথে যুদ্ধ করছেন। যিনি একটু একটু করে ক্ষয়ে যাচ্ছেন, মিলিয়ে যাচ্ছেন। যিনি আর আমাদের মাঝে ফিরবেন না! তলিয়েই যাবেন, হারিয়েই যাবেন মহাকালের গর্ভে। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম এক কাণ্ডারি'র চোখের সামনে একটু একটু করে ক্ষয়ে যাওয়া, একটু একটু করে চলে যাওয়া, একটু একটু করে হারানোর বেদনা সবচেয়ে বেশি পীড়া দায়ক। তবে আশার সঞ্চার এই যে তার সান্নিধ্য আমরা পাবো তার অনবদ্য সৃষ্টিগুলির মাঝে। সৃষ্টির মাঝেই অটুট থাকবে তার জীবন বীক্ষণ।