আনিসুল হকের কাছে খোলা চিঠি

প্রবালাহমেদ
Published : 6 June 2012, 04:35 PM
Updated : 6 June 2012, 04:35 PM

প্রিয় আনিসুল হক,

আজকের প্রথম আলোতে (৫ জুন ২০১২) দুর্নীতি নিয়ে আপনার একটি লেখা ছাপা হয়েছে । এই লেখায় আপনি দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন – মানুষের কত টাকা লাগে ? মানুষ কেন দুর্নীতি করে ? এই প্রশ্ন দুটি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং আমি নিশ্চিত যে এই ধরনের প্রশ্ন আগেও তোলা হয়েছে । এই বিষয়ে আমার নিজস্ব কিছু ধারনা আছে । আমি নিতান্তই সামান্য মানুষ । আমার বিশ্লেষণ, সরল বিশ্লেষণ । তবু আপনার লেখার প্রেক্ষিতে আমার ধারনাগুলো উপস্থাপন করছি।

সাত আট বছর আগে, আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম তখন ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে অদ্ভুত এক ধরনের শ্রেনী বিন্যাস ছিল । একদম সহজ ভাষায় এই বিন্যাস ধনী ও গরীবের। আমার সহপাঠীদের একটি অংশ এসেছিলো বিত্তবান পরিবার থেকে। এরা ঢাকা শহরের স্থায়ী বাসিন্দা । ভার্সিটিতে আসত গাড়িতে চড়ে । হুটহাট করে ফাস্টফুডে চলে যেত, রাশি রাশি টাকা খরচ করত। হাতে থাকত দামী মোবাইল ফোন। বোঝা যেত, টাকা খরচের জন্য এদের হিসেব করতে হয় না।

এর বিপরীত চিত্রটি কিন্তু খুব বেদনাদায়ক। ছাত্রছাত্রীদের আরেকটি অংশটি আসত গ্রাম বা মফস্বল থেকে। এরা থাকত বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে। দুপুর বেলা হলের ক্যান্টিনে ছয় টাকা দিয়ে ডাল – ভাত খেত। মাসের খরচ জোগাড় করত টিউশনি করে । এমনকি কেউ কেউ টিউশানি করে বাড়িতে টাকা পাঠাত। মাসের শেষের দিকে গিয়ে এদের খাওয়ার পয়সাই থাকত না, বিলাসী জীবনের তো কোন প্রশ্নই ওঠে না।

আমার বিশ্বাস, আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এই চিত্রটির সাথে আপনি নিজেও পরিচিত এবং আশা করি আমার বক্তব্যের সাথে আপনি দ্বিমত পোষণ করবেন না।

এবার মূল প্রসঙ্গে আসা যাক । ছাত্র ছাত্রীদের এই দরিদ্র অংশটির একটি সাধারন স্বপ্ন থাকে -বিসিএস বা সরকারী চাকরী। এই সব দরিদ্র ছাত্র ছাত্রীরা জানে যে সৎ থাকলে বিত্ত বৈভবের যে সমৃদ্ধ জীবন, তা তাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবে। সৎ থাকলে তাদেরকে আজীবন হয় মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত হয়ে কাটিয়ে দিতে হবে। সৎ থেকে কোন বিলাসী জীবন ছুঁয়ে দেখার উপায় এদেশে নেই। হিসেবটা খুব সহজ – হয় চুরি করে বড়লোক হও অথবা দরিদ্র থাক। আশেপাশের ভোগ বিলাসের জীবন ফেলে রেখে চব্বিশ বছরের কোন যুবক দরিদ্র সন্ন্যাসীর জীবন যাপন করতে পারে না । চুরি করা অন্যায় এ কথা সে জানে। কিন্তু সে এও জানে যে ভাল থাকতে হলে, ঢাকা শহরে গাড়ি আর ফ্ল্যাট থাকতে হলে, ঘরে এসি লাগাতে হলে, দামী একটা ল্যাপটপ কিনতে হলে, ফাস্টফুডের দোকানে কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করতে হলে তাকে খারাপ হতে হবে।

বলার কিছু নেই । আমাদের দরিদ্র জনগোষ্ঠি সমাজের ধনীদের পাশাপাশি অবস্থান করে। ধনীদের সমৃদ্ধ, উন্নত জীবন এরা খুব কাছ থেকে দেখে। বোঝে যে এই বিলাসী জীবন তাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ধনীদের এই ঝলমলে জীবন ছুঁয়ে দেখতে হলে তাদেরকে খারাপ হতে হবে। আশেপাশে হাজারটা বিলাসী পণ্যের হাতছানি – দামী মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, পাজেরো গাড়ি, আলো ঝলমলে ফাস্টফুড শপ । সব কিছু তৈরী, প্রয়োজন শুধু টাকা । সুতরাং দুর্নীতি ছাড়া উপায় কি ? এই সমৃদ্ধ, বিলাসী জীবনের জন্য এক জন অনার্স পড়ুয়া তরুন যখন কাস্টমস অফিসার হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তখন আমরা তাকে কি বলে বাধা দেব ?

এই দরিদ্র ছাত্রছাত্রীরা জানে নৈতিকতার বুলি দিয়ে ঢাকা শহরে ফ্ল্যাটের মালিক হওয়া যায় না, পিজা হাটে গিয়ে হাজার টাকা বিল দেয়া যায় না। এই নৈতিকতা বছরের পর বছর তাদেরকে দারিদ্র্য ছাড়া যার কিছু দিতে পারেনি। নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন হচ্ছে পশুর জীবন। এই পশু জীবন থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় দুর্নীতি। সুতরাং হাতের কাছে কোটি কোটি টাকা রেখে সে কতদিন হাত গুটিয়ে বসে থাকবে।

আপনি একটু খোঁজ করলেই দেখতে পাবেন আমাদের উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারীদের বেশিরভাগই এসেছে কোন নিম্ন -মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে। বছরের পর পর দ্রারিদ্র্যের সাথে যুদ্ধ করার পর তারা পেয়েছে টাকার খনির সন্ধান। এই সুযোগ তারা হাতছাড়া করবে কেন ? আমাদের বেশির ভাগ রাজনৈতিক নেতাদের জন্যও ঐ একই কথাই প্রযোজ্য। আসলে আমাদের দেশের শতকরা আশি ভাগ মানুষের জন্যই এই কথা সত্যি। এরা জানে দারিদ্র্য একটি দুর্বিষহ ব্যাপার ।

আমার এই বক্তব্য কিছুটা একপেশে মনে হতে পারে। মনে হতে পারে আমি দুর্নীতিবাজদের পক্ষে সাফাই গাইবার চেষ্ট করছি । প্রকৃতপক্ষে, আমি এই সমস্যাটির গভীরে যাবার চেষ্টা করেছি এবং নিজের অভিজ্ঞতাকে এই সমস্যাটির সাথে মিলিয়ে দেখতে চেয়েছি।