ফুলবাড়ি দিবস স্মরণিকা

প্রবীর বিধান
Published : 25 August 2012, 04:51 PM
Updated : 25 August 2012, 04:51 PM

এই লেখাটি আমার নিজের ব্লগে ছেপেছিলাম মার্চে। ২০০৬ সালের ২৬শে আগস্টের কথা মাথায় রেখে এটা বিডিব্লগে পোস্ট করলাম। (তথ্য-উপাত্ত বা বর্ননায় কোন ভুল-ভ্রান্তি থাকলে ধরিয়ে দেবেন প্লিজ)

অতি সাম্প্রতিককালে কয়লা উত্তোলন নিয়ে কিছু সরকারি উদ্যোগ ও পরিকল্পনা উদ্বিগ্ন হবার মতই। তারা চাইছে বড়পুকুরিয়াতে একটি "উন্মুক্ত পদ্ধতি"র খনি করতে।

ঘটনাটা খুব পরিচিত ঠেকছে; মানে এমনটিই আসলে হবার কথা ছিল। মানে বিএনপির মত বর্তমানের আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলের সরকারও উন্মুক্ত পদ্ধতিতে সায় দিবে। বিএনপি সায় দিয়েছিল এশিয়া এনার্জি ফুলবাড়িতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তুলুক, কিন্তু প্রতিবাদের মুখে ২০০৬ সালের ২৬শে আগস্ট ৩টি তাজা প্রাণের বিনিময়ে আর প্রায় ২০০ মানুষের আহত হবার মধ্য দিয়ে ৩০ তারিখে সরকার চুক্তি করে আন্দোলনকারীদের সাথে, বাধ্য হয় এই প্রকল্প বন্ধ করতে ও বাংলাদেশে উন্মুক্ত পদ্ধতি বাতিল করতে।

তার কয়েকদিন পর, ৪ঠা সেপ্টেম্বর তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা ফুলবাড়িতে এক নির্বাচনপূর্ব জনসভায় এসে বলেছিলেন ক্ষমতায় গেলে তিনি এইসব দাবি পূরণ করবেন।

অথচ ক্ষমতায় এসে তিনি সেগুলো বেমালুম ভুলে গেলেন! তার মানে কি সেগুলো উনি বলেননি! নাকি ভেবে-চিন্তে বলেননি!! হতে পারে নির্বাচনের কথা ভেবে বলেছিলেন।

নয়তো ২০১০ সালের এপ্রিলের ৭ তারিখে জ্বালানী মন্ত্রনালয়ের সভায় কি করে বললেন উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার ব্যাপারে চিন্তা করতে? যদিও তিনি ফুলবাড়ির কথা বলেননি, বলেছেন বড়পুকুরিয়া খনিকেই (বর্তমানে ভূ-গর্ভস্থ পদ্ধতিতে কাজ চলছে) রুপান্তর করে ফেলা যায় কিনা তার সম্ভাব্যতা যাচাই করতে।

উল্লেখ্য, এলাকা দুটি পাশাপাশি অবস্থিত।

তিনি বলেছেন আগে ক্ষতিপূরণ দিয়ে স্থানীয়দের জমি অধিগ্রহন করতে হবে ও পরিবেশের কথা মাথায় রাখতে হবে এবং এর নানা দিক নিয়ে কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করেছেন। কিন্তু উন্মুক্ত পদ্ধতিতেই করতে হবে, কেননা এতে করে অনেক বেশি কয়লা তোলা যায়। এখন বড়পুকুরিয়াতে শতকরা মাত্র ২০ ভাগ কয়লা তোলা সম্ভব, কিন্তু উন্মুক্ত পদ্ধতিতে ৯০ ভাগ তোলা যায়। সুতরাং তুলবোই যদি, তবে আর কম কেন?

সবকিছু পরিকল্পনামাফিকই হচ্ছে; বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের মার্চ ৫ তারিখের খবরে জানা গেল, বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড (বিসিএমসিএল) এখন কয়লা খনির উত্তরাংশে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করতে চায়। পেট্রোবাংলাকে ইতিমধ্যে এ বিষয়ে একটি প্রস্তাবও দিয়েছে খনিটির মূল অংশে বর্তমানে ভূ-গর্ভস্থ পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনরত পেট্রোবাংলার এই কোম্পানিটি।

লাল ফিতায় আটকে থাকা খসড়া কয়লা নীতিতেও এমন একটি প্রস্তাব ছিল।

তার ২দিন আগে জানা গেল, বড়পুকুরিয়া খনিতে ১৬ই মার্চ থেকে এখন থেকে দ্বিতীয় স্তরের কয়লা উত্তোলন করা হবে নতুন পদ্ধতিতে। আর এতে উৎপাদনের গতি বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হবে বলে আশা করছেন বিসিএমসিএল কর্তৃপক্ষ।

এখন আর এশিয়া নাম শোনা না গেলেও, ফুলবাড়ি কয়লা খনি প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে জিসিএম রিসোর্সেস। এশিয়া এনার্জির পরিবর্তিত নাম জিসিএম। কয়লার অনুসন্ধান ও খনি উন্নয়ন করার জন্য এশিয়া এনার্জি এবং বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে চুক্তি সম্পাদিত রয়েছে।

এ সংক্রান্ত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো ফেব্রুয়ারির ২৮ তারিখে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা ফুলবাড়িতে উন্মুক্ত কয়লা খনির পরিকল্পনায় আশংকা প্রকাশ করেন। এই প্রকল্প শুরু না করতে তারা সরকারকে অনুরোধ জানায়। তাদের মতে এই প্রকল্প চালু হলে ফুলবাড়ি এলাকার প্রায় ৫০,০০০ থেকে ১,৩০,০০০ মানুষকে স্থানান্তর করতে হবে–মোট প্রায় ২,২০,০০০ মানুষের জীবন-জীবিকা-বাসস্থান পরিবর্তনে বাধ্য করবে। সেচপ্রকল্প, কুয়া ও নদীর পানি ক্রমশ শুকিয়ে যাওয়ার কারনে কৃষি ব্যবস্থা ধ্বংস হবে। ৩৬ বছর ধরে প্রায় ৬,০০০ হেক্টর জমিতে প্রায় ৫৭ কোটি ২০ লক্ষ টন কয়লা উত্তোলন করার কারনে প্রায় ১২,০০০ হেক্টর কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এছাড়া প্রায় ১,০০০ মাছের খামার আর ৫০,০০০ ফলের গাছ ধ্বংস হবে।

যদিও জিসিএম'এর দাবি খনির মেয়াদকালে (৩৫ বছরের বেশি) প্রায় ৪০,০০০ ব্যক্তিকে (যার বেশিরভাগ প্রথম দশ বছরে) স্থানান্তরের প্রয়োজন হবে। কিন্তু এই মেয়াদকাল (মাইন লাইফ) এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশী বিনিয়োগ ও প্রকল্প সময়কালে বাংলাদেশের ৭ বিলিয়ন ডলারের বেশী রাজস্ব ও অন্যান্য আয় হবে।আর সেটাকেই আমাদের সরকার গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করছে।

এদিকে ২২শে ফেব্রুয়ারি লন্ডন মাইনিং নেটওয়ার্ক ও ইন্টারন্যাশনাল একাউন্টেবিলিটি প্রোজেক্ট এর প্রতিবেদনেও (যা ইউকে পার্লামেন্টের একটি প্রকাশনাতে ছাপা হয়েছে ২২শে ফেব্রুয়ারি) প্রস্তাবিত ফুলবাড়ি প্রকল্পকে উদ্দেগের সাথে দেখা হয়েছে, বিশেষ করে খননকারী প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশের মত একটি দরিদ্র দেশ নানা ধরনের আর্থিক মওকুফ করে জিসিএমকে যেভাবে লাভবান করে দিচ্ছে সেটা নিয়ে। তাছাড়া ১০০ ভাগ রপ্তানীর সুবিধা, মানব-বসতি ও পরিবেশের মারাত্মক কুপ্রভাব নিয়েও সেই প্রতবেদন বিস্তারিত আলোচনা করেছে।

এশিয়া এনার্জি ছাড়াও ভারতের টাটা গ্রুপও বড়পুকুরিয়া ও ফুলবাড়ি থেকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল ২০০৫ সালে।

সম্প্রতি এক মাসের ব্যবধানে কয়লা উত্তোলন নিয়ে দুরকম মন্তব্য করে একটা ধোঁইয়াশা তৈরি করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। ১৪ই জানুয়ারি ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশনে এক অনুষ্ঠানে তিনি বললেন আমাদের যেসব কয়লা খনি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় অবস্থিত, সেখান থেকে কয়লা উত্তোলনে তার সরকারের কোন পরিকল্পনা নেই। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য তিনি তা রেখে যেতে চান। সবাই বাহবা দিল তার সেই বাক্যে। কিন্তু ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখে সংসদে বললেন অন্য কথা—বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য নাকি কয়লা তুলতে হবে! এই খাতের ২০১০ সালের মহাপরিকল্পনা অনুযায়ি ১১,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কয়লা দিয়ে উৎপাদন করতে হবে।

আবার একটা ভুল-বোঝাবুঝি। এত দ্রুত মত পরিবর্তনের কারনও তিনি জাতিকে পরিষ্কার করে বলেননি।

আসলে কেউই বলছেনা যে, এশিয়া এনার্জি কাজটা অনেকদূর এগিয়ে নিয়েছিল। এখন সেটা বাতিল করলে কেমন দেখা যায়! অনেক টাকা গচ্চা যাবে কোম্পানীটির, সাথে এদেশের যেসব বিশেষজ্ঞ এখনও কাজ করেন বা যুক্ত আছেন এই প্রতিষ্ঠানের সাথে তাদের কি হবে? তাছাড়া আমেরিকার একটা চাপ তো আছেই। জিসিএম'এর ৬০ভাগ মালিকানা তো আমেরিকারই।

উইকিলিকসের প্রচারিত তারবার্তায় জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী ২০০৯ সালে ঢাকায় আমেরিকার রাষ্ট্রদূতের সাথে এক আলোচনায় বলেছিলেন যে সংসদীয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ফুলবাড়িতে জিসিএম-কে কয়লা খননের অনুমতি দেবার ব্যবস্থা করা হবে।

কিন্তু ২০১০ সালের গ্যসিফিকেশন বিষয়ক এক সেমিনারে এলাহী বলেন পরিবেশ-বান্ধব পদ্ধতিতেই কয়লা তোলা হবে। সেক্ষেত্রে কোল বেড মিথেন ও আন্ডারগ্রাউন্ড কোল গ্যাসিফিকেশন পদ্ধতি কাজে লাগানো হবে। তবে তা জামালগঞ্জে ব্যবহার করা হবে। তার মতে, বড়পুকুরিয়াতে কিন্তু উন্মুক্তই ভালো হবে।

বাংলাদেশে এ পর্যন্ত পাঁচটি কয়লা খনি আবিষ্কৃত হয়েছে যার মজুদ প্রায় ৩৩০ কোটি টন। খনি পাঁচটি হলো- দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া, ফুলবাড়ী, দীঘিপাড়া জয়পুরহাটের জামালগঞ্জ এবং রংপুরের খালসপীর। এর মধ্যে বড়পুকুরিয়ায় ৩৯ কোটি টন। এই কয়লার মান ভারত, ইন্দোনেশিয়া বা অস্ট্রেলিয়ার তুলনায় প্রশ্নাতীত।

অন্যদিকে, ফুলবাড়িতে কয়লা আছে প্রায় ৫৭ কোটি টন যার গুনগত মান খুবই উন্নত। এগুলো বিটুমিনাস জাতীয় কয়লা (উচ্চ তাপমান সম্পন্ন, অল্প ছাই ও অল্প সালফার যুক্ত)।

ফুলবাড়ি প্রকল্পকে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক ভেবে ও কয়লা রপ্তানী সহজ করতে সরকার মংলা বন্দরকে ব্যবহারোপযোগী করছে, সুন্দরবনের মাঝামাঝি এলাকায় আকরাম পয়েন্টে একটি বহির্নোঙ্গর তৈরির চিন্তা করছে। তাছাড়া মংলা বন্দর পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারন করা হচ্ছে। অথচ এদেশে এখনো কয়লা নীতিই চূড়ান্ত হয়নি।

বর্তমানে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি (১,০৫০ হেক্টর) থেকে ভূ-গর্ভস্থ পদ্ধতিতে দৈনিক প্রায় ৩,০০০ টন কয়লা উত্তোলন হচ্ছে। যার প্রায় ৮০ ভাগ ব্যবহৃত হচ্ছে সেখানকার তাপভিত্তিক ২৫০ মেগাওয়াট (বর্তমানে প্রায় ১২৫ মেগাওয়াট) ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রে। বাকিটা লোহা ও কাঁচের কারখানা, ইটভাটায় ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু ভারতের কয়লা দামে সস্তা হওয়ায় বাংলাদেশ প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ কয়লা আমদানী করে নানা শিল্পে ব্যবহারের জন্য।

২০০৫ সাল থেকে এ খনিতে কয়লা উত্তোলন শুরুর পর বিগত ছয় বছরে ৪২ লাখ টন কয়লা উত্তোলন করা হয়েছে। এশিয়া এনার্জির অনুমান অনুযায়ি তারা ফুলবাড়ি থেকে বছরে ১.৫ কোটি টন কয়লা উত্তোলন করতে পারবে।

এদিকে আবার বড়পুকুরিয়ায় ১৬ মার্চ থেকে নতুন পদ্ধতিতে (লংওয়াল টপ কোল কেভিং) দ্বিতীয় স্তরের কয়লা উত্তোলন শুরু হলে প্রায় দ্বিগুন উৎপাদন হবে। তার ব্যবহার কি হবে সরকার তা নিশ্চিত না করায় এখন পর্যন্ত বোঝা যাচ্ছে কয়লা রপ্তানীর ইচ্ছাটাই তার প্রবল।

খনির শ্রমিক-কর্মচারিদের অভিযোগ ভূ-গর্ভস্থ পদ্ধতিকে অসফল প্রমান করার জন্য এই খনিটি সঠিকভাবে রক্ষনাবেক্ষন করা হয়নি। যার ফলে এখান থেকে সফলভাবে অনেক কয়লা উত্তোলন করা সম্ভব হয়নি। উন্মুক্ত খনি বিরোধীরা মনে করেন এর ফলে সরকারের পক্ষে উন্মুক্ত পদ্ধতির পক্ষে কথা বলা সহজ হবে।

এই খনির কারনে ভূমিধ্বস হয়েছে, হচ্ছে, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষ। গত কয়েক বছর বিসিএমসিএল কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময় সামান্য কিছু ক্ষতিপূরণ দিলেও তা যথার্থ ছিলনা। অনেকের বাড়ি ধ্বসে গেছে বা কৃষিজমি দেবে গেছে, বিশাল এলাকা পানিতে ডুবে আছে সারা বছর। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসীকে স্থায়ী ক্ষতিপূরণ দেওয়াসহ খনি এলাকার ৬২৭ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য ২০১০ সালের নভেম্বরে একটি ১৯০ দশমিক ৫৩ কোটি টাকার বরাদ্দ অনুমোদন করে একনেক। এর আওতায় গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত ১২০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে ক্ষতিগ্রস্তদের।

এখন পর্যন্ত জানা গেছে সরকার প্রায় ১,৩৫০ মেগাওয়াটের ৪টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র (নিজস্ব কয়লা) নির্মানের জন্য কাজ করছে। তাছাড়া, বাগেরহাটে সুন্দরবনের পাশে, কক্সবাজারে ও চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ৩টি প্রতিটি প্রায় ১,৩০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার (আমদানীকৃত কয়লা) বাস্তবায়নাধীন আছে।

সবসময়েই এই বিষয়ে একটা খাপছাড়া ভাব লক্ষ করা যায়। নইলে এই অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি কেন এত বছরেও সমাধান হয়নি? সরকারের যদি উন্মুক্ত বা অন্য কোন পদ্ধতির প্রতি ঝোঁক থাকে যে তারা সেটা করেই ছাড়বেন তবে সে ধরনের প্রস্তুতি কই? অর্থ্যাৎ পরিবেশ বাঁচানোর পরিকল্পনা, পূন্ররবাসন, কয়লার ব্যবহার বৃদ্ধি এবং সর্বোপরি একটি স্বদেশী কয়লা নীতির অভাব এই প্রাক্ররতিক সম্পদ আহরনে নানা প্রতবন্ধকতার সৃষ্টি করছে।

সমস্যাটির শুরু ২০১০ সালে শেখ হাসিনার সেই বক্তব্যের পরেই বোধকরি শুরু হয়। কেননা তার দুই মাস পর আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয় শেখ সেলিম সংসদে বললেন উন্মুক্ত পদ্ধতিতেই কয়লা তুলতে হবে। মানুষের দরকারটা আগে, পরিবেশের ক্ষতি তেমন কিছুনা। ক্ষতি যা হবার একটি এলাকায় হবে, সারা দেশে তো আর হবে না! বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে কয়লা লাগবেই।

সে বছরেই নভেম্বরে জ্বালানী বিষয়ক সংসদীয় কমিটি বললো উন্মুক্ত পদ্ধতি কাজে লাগানো যেতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে যথাযথ পানি ব্যবস্থাপনা এবং মানুষ ও পরিবেশের কথা ভাবতে হবে।

এই কমিটি পরবর্তীতে প্লেজার ট্রিপে জার্মানি ঘুরে এসে বললো এই পদ্ধতির কোন সমস্যা নেই। রাজী পেট্রোবাংলা প্রধান, এবং এশিয়া এনার্জি'র প্রতিনিধিরা।

এমনকি স্থানীয় সাংসদ মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার গতবছর এক সভায় বলেন পরিবেশের কথা ভেবে তো আর কয়লা নীতি ফেলে রাখা যায় না। সেখানে উপস্থিত অর্থমন্ত্রী বললেন যেহেতু কয়লা তুলতে সময় লাগে, সেহেতু এখুনি সরকারকে এই নীতি তৈরি করতে চাপ দিতে হবে। রাজশাহীর এমপি শাহরিয়ার আলম বলেন সরকারের উচিৎ বড়পুকুরিয়া ও ফুলবাড়িতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার জন্য অর্থ বরাদ্দ দেয়া। মহাজোট সরকারের কয়েকজন সংসদ সদস্য অবশ্য উন্মুক্ত পদ্ধতির বিরোধিতা করেছেন সংসদে।

আর তেল, গ্যস-কমিটি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন ও কয়লা রপ্তানির বিরোধীতা করছে সেই শুরু থেকে যখন এশিয়া এনার্জি এই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইপত্র জমা দেয় ২০০৫ সালে। অস্ট্রেলিয়ার বিএইচপি বিলিটনের সাথে করা ১৯৯৪ সালের অনুসন্ধান চুক্তিটি এশিয়া এনার্জি কিনে ১৯৯৮ সালে সরকারের সাথে চুক্তি করে। কোম্পানিটির হিসাবমতে, খনির মেয়াদকালে প্রায় ৫,৯৩৩ হেক্টর জমির প্রয়োজন হবে। তবে খননের জন্য প্রকল্পভুক্ত জমির এক তৃতীয়াংশ ব্যবহৃত হবে এবং তা হবে পর্যায়ক্রমে।

প্রকল্পটি বিতর্কিত হওয়ায় সরকারের এ নিয়ে উদ্যোগ চোখে পড়ার মত না হলেও কার্যক্রম চলছে আড়ালে। কেননা জিসিএম স্বভাবতই যে কোন উপায়ে তাদের বিনিয়োগকৃত অর্থ তুলে নিতে চাইবে, আর তাই সরকারের বিশেষ মহল নানা উপায়ে ছল-চাতুরি করে একটা উন্মুক্ত কয়লা খনি ওদের বাগিয়ে দিতে চাইবে।

কয়লা নীতি

ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ফেসিলিটেশন সেন্টার (আইআইএফসি) ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে প্রথম কয়লা নীতি প্রকাশ করে উন্মুক্ত কয়লা খনির পক্ষে মত দিয়ে। বিএনপি আমলে সেই নীতির ৪টি সংস্করন তৈরি করলেও ১টিও বাস্তবায়ন করতে পারেনি। পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এই নীতির ৬ষ্ঠ ও ৭ম সংস্ক্রন প্রকাশ করে ২০০৭ সালের মার্চ ও জুনে।

সাবেক বুয়েট ভিসি আব্দুল মতিন পাটোয়ারির কমিটি ২০০৮ সালের জানুয়ারি মাসে খসড়া কয়লা নীতির অষ্টম সংস্করণ বের করেন; কিন্তু প্রতিবাদের মুখে তা সিলগালা করা হয়। নতুন সরকার ক্ষমতায় এসে উদ্যোগ নেয়।

২০১০ সালের এপ্রিলে ১ম কমিটি হয় জ্বলানী সচিব মোঃ মেজবাহউদ্দিন-এর নেতৃত্বে যা অক্টোবরে মতামতের জন্য ইন্টারনেটে দেয়, পরবর্তীতে তা চূড়ান্ত হয়। ১৫ সদস্যের পরেরটি কমিটি হয় ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে। ৪ মাসের মধ্যে অর্থনৈতিক ও পানি ব্যবস্থাপনার বিষয়ে মতামত দেবার কথা।

এখন পর্যন্ত কোন কমিটিই ভূ-গর্ভস্থ ও উন্মুক্ত পদ্ধতির বাইরে কিছু ভাবতে পারছেনা।

তবে মজার ব্যাপার হলো যারা ফুলবাড়ি এলাকা জনমানবশূন্য করে এশিয়া এনার্জিকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে প্রচুর পরিমাণে কয়লা উত্তোলন করতে অনুমোদন দেবার ক্ষেত্রে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ একই রকম আচরন দেখাচ্ছে।

সরকারি নানা উদ্যোগ

কয়লা নিয়ে সরকারের উৎসাহ চোখে পড়ার মত। বিদ্যুৎ মহাপরিকল্পনা অনুযায়ি ২০৩০ সালের মধ্যে প্রায় ২০,০০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ হতে হবে, আর তাই সরকার গতবছর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানী লিমিটেড সৃষ্টি করে। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুত উৎপাদন কমাতে কয়লার দিকে নজর সবার, এছাড়া খরচ অনেক কম হওয়ায় (৩-৪ টাকা) গ্যাস, (৫-৬ টাকা), ফার্নেস অয়েল (৭-৮ টাকা) আর ডিজেলের (১২-১৪ টাকা) উপর নির্ভরতা কমানো উচিৎ।

সরকারের ইচ্ছা ৩বছরে ৭,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত কয়লা দিয়ে উৎপাদন করার। ১০টি কেন্দ্র তৈরি হবে। এর মধ্যে মাত্র একটি (বড়পুকুরিয়ায়) নিজস্ব কয়লা ব্যবহার করবে। আর ২০২০ সালের মধ্যে আমদানী করা কয়লা দিয়ে ৯,৮০০ মেগাওয়াট ও দেশি কয়লা দিয়ে ৭,৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করা হবে।

দেশে বর্তমানে বিদ্যুত ঘাটতির পরিমান প্রায় ২০০০ মেগাওয়াট। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে ২০১৬ সালের মধ্যে ১৫,০০০ মেগাওয়াট উৎপাদন করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে। ২০১২ সালের পর আর লোডশেডিং থাকবেনা বলেন অর্থমন্ত্রী, জ্বলানী উপদেষ্টাও সে কথা বলেন। যদিও কয়েকদিন আগে অর্থমন্ত্রী মুহিত বলেন ২০১৪ সালের পর আর বিদ্যুত বিভ্রাট থাকবেনা।

তবে গত ৩বছরে সরকার দ্রুত নতুন বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন করে প্রায় ৩,০০০ মেগাওয়াট যোগ করে সাফল্য দেখিয়েছে। কিন্তু পুরনো কেন্দ্রগুলো মেরামত না করায় আজকাল চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে মানুষকে। যদিও এসব নতুন যোগ হওয়াগুলোর মধ্যে প্রায় ১,২০০ মেগাওয়াট ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলভিত্তিক হবার কারনে বেশি খরচের মুখে পড়েছে সরকার। ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলভিত্তিক এসব কেন্দ্র চালাতে গিয়ে আমদানী বেড়ে যায় বিপুল পরিমানে। যার ফলশ্রুতিতে বৈদেশিক মুদ্রার তহবিলে টান পড়ে, ত্বরান্বিত হয় মুদ্রাস্ফীতি। ভর্তুকি সাথে সাথে বেড়ে যাওয়ায় সরকার তেল, গ্যাস ও বিদ্যতের দাম বাড়ায় এবং সে প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে।

এমতাবস্থায়, সরকারের উচিৎ একটি বস্তুনিষ্ঠ-সর্বজনগ্রাহ্য কয়লা নীতি প্রস্তুত করে সে অনুযায়ী পরিবেশবান্ধব উপায়ে কয়লা উত্তোলন, সঠিক ব্যবহার, বাজারজাতকরণ, আমদানী-রপ্তানী ইত্যাদি বিষয়ে সুরাহা করা। তার আগেই যদি সরকারের নানা পর্যায়ের লোকেরা একের পর এক জনবিচ্ছিন্ন পদক্ষেপ নিতে থাকে বা পরিকল্পনা করে তবে তা ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য কোনমতেই সুখকর হবেনা। তাছাড়া সম্প্রতি আমাদের প্রধানমন্ত্রী বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে ও অন্যান্য ফোরামে যেভাবে উন্নয়নশীল-দরিদ্র দেশগুলোর পক্ষে কথা বলেছেন, পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষণাবেক্ষনের উপরে জোর দিয়েছেন তাতে করে তার সরকারের উচিৎ হবেনা প্রশ্ন উঠতে পারে এমন কোন কয়লা খনি বা কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করার পরিকল্পনা করা।