একজন ‘অসাধারন’ মানুষের মৃত্যু, শয়তানের জয়

প্রবীর বিধান
Published : 16 Feb 2013, 04:52 AM
Updated : 16 Feb 2013, 04:52 AM

শিবিরের ফেসবুক পেজ-ব্লগার ও কর্মী বাহিনী উল্লাস করছে গতরাত থেকে শাহবাগের একটা উইকেট পড়েছে এই বলে। বাঁশেরকেল্লার ফ্যানসংখ্যা ৪দিনে ২০০০০ পৌঁছায় দেখে ফ্যানদের সাথে এডমিনও ধেই ধেই করে নাচে। জামায়াতের ওয়েবসাইট অবশ্য এই খবরটি দিলোই না।

সবাই শিবিরের দিকে আঙ্গুল তুলবে এটাই স্বাভাবিক, আর হয়েছেও তাই। সহমর্মী ব্লগার অমি রহমান পিয়ালকে দেখলাম খুঁজে-খুঁজে বের করলেন ব্লগার-স্থপতি আহমেদ রাজীব হায়দার শোভন গত কয়েকদিনে কি করছিলেন, কি লিখছিলেন আর সোনার বাংলা ব্লগে তাকে নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটির কথা ফাঁস করে দিলেন ফেসবুকে।

রাজীব যে কারো লক্ষ্য হতে পারেন তা তিনি জানতেন, কারন তার পথ মসৃন ছিলনা। তিনি আরাম-আয়েশ, আত্মচিন্তায় মগ্ন থাকতেন না, আশেপাশে ঘটে যাওয়া অনাচারে মাথা নুইয়ে রাখতেন না, আবার অবহেলায় এড়িয়ে যেতেন না। সমাজ-রাষ্ট্রের অসংগতিগুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতেন।

জন্মগতভাবে মুসলিম শিক্ষিত পরিবারের সন্তান রাজীব একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন, তিনি ছিলেন কৌতূহলী আর হয়তো আইনস্টাইনের সেই উক্তিটি তার মাথায় সবসময় খেলতোঃ "কখনো প্রশ্ন করা থামাবেনা।" ওয়ার্ডপ্রেসে তার ব্লগ দেখলাম, গত বছরের আগস্টের পর আর কিছু লিখেননি সেখানে। নিয়মিত লিখতেন আমারব্লগ ও অন্যান্য ব্লগে।

এখন পর্যন্ত বেশিরভাগ মানুষের ধারনা, ইসলাম ধর্মের নানা অসংগতি নিয়ে প্রশ্ন তোলায় জামায়াত-শিবিরের উগ্রমুসলমানদের লক্ষ্যে পরিণত হন তিনি। তাছাড়া শাহবাগ আন্দোলনের সাথে জড়িত থাকায় শিবিরের রক্তপিপাসা ছিল আরো বেশি। মাসখানেক আগে এরকম আরেকজন তথাকথিত নাস্তিক আসিফ মহিউদ্দীনকে রাস্তায় থামিয়েীলোপাথাড়ি কোপায় দুষ্কৃতিকারীরা, যাদের পরিচয় সেই একই চক্র ছাড়া আর কেউ নয়।

আমার জানামতে জামায়াত-শিবির আর আমিনীর ইসলামী ঐক্যজোট ছাড়া আর কেউ কোন ব্যক্তির ধর্মপালন-আচরন নিয়ে কথা বলে না বা ফতোয়া দেয় না। বিশেষ করে এসব দলের ধর্ম-বিশেষজ্ঞরা কোন উপলক্ষ্য পেলেই একটা ওয়াজ বা মিলাদে গিয়ে ধর্মের নানা বিষয়ে ব্যাখ্যা দেয়। সাধারন মানুষ নিজেরা ভালো করে কোরান-শরীফ ও হাদিস না পড়ে এসব রাজনৈতিক ধর্মীয় গুরুদের বক্তব্য হুবুহু মানার চেষ্টা করে। ধর্মের ডাক এমনই যে, মানুষ সরল বিশ্বাসে এগিয়ে যায়। আর সেই সুযোগটাই নেয় উগ্রপন্থী জামায়াত-শিবির। নিজেদের দলে টানতে ও এদের ব্যবহার করে বিপক্ষ দলকে বিপদে ফেলার তাগিদেই নতুন কর্মীদের ব্রেনওয়াশ করা হয়। ফলে কিছুদিন এসব ধর্মীয় গুরুদের আশেপাশে থেকে, তাদের কথা শুনে এদের জীবনের মানেটাই পালটে যায় ক্রমশ।

বিএনপির সহায়তায় রাজনৈতিকভাবে জামায়াত শক্তিশালী অবস্থানে থাকায় এর নেতা ও শিবিরের কর্মীদের বুকের পাটা বেড়ে গেছে কয়েক হাত। তার উপর আবার জামায়াতী প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশ-অনুদান, বিদেশী অর্থসাহায্য (আইএসআই, সৌদিআরব, আমেরিকা) আর দলের নেতা-কর্মীদের নিয়মিত চাঁদার টাকায় গত কয়েক দশকে বেশ ভালোই প্রস্তুতি নিয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী এই চক্র।

পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ায় জামায়াতের বুকও ভেঙ্গে গেছে, আর তাই পাকিস্তানের বিরোধীতা করা মুক্তিযোদ্ধা-বুদ্ধিজীবীদের খুঁজে-খুঁজে মেরেছে '৭১-এ; আর তার পরবর্তী সময়ে ভাড়াটে লোক/প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে রাজনৈতিক খুন ও অস্থিরতার একটা আবহ তৈরি করেছে এই দেশে যেন তাদের এদেশে থেকে যাওয়াটা পাকাপোক্ত হয়।

আবার যারা বিচারের ব্যবস্থা করবে সেই পুলিশ-বিচারক আর আইনজীবীদের মধ্যেও নিজেদের লোক বসিয়ে নিয়েছে গত ৪০বছরে। তাদের প্রভাব আছে সেনাবাহিনীতে, এমনকি বিশেষ পুলসিহ বাহিনী র‍্যাবেও। গোয়েন্দাদের মধ্যে গুপ্তচর ও ভাড়ায় খাটা কর্মকর্তা থাকায় আগেভাগেই সরকারের পদক্ষেপের অনেক খবর পেয়ে যাচ্ছে জামায়াত-শিবির। আর এভাবে টাকা ঢালার কারনে অনেক ঘটনাই জামায়াত ঘটিয়ে চলেছে নির্বিঘ্নে, প্রতিনিয়ত। কারন সরকারি বাহিনী, নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও প্রধানমন্ত্রীর নিজের অবস্থান যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে হলেও এবং তিনি সম্প্রতি শাহবাগের আন্দোলনের সাথে সহমত জানালেও যুদ্ধাপরাধের মামলায় ধীরগতি এবং দ্বিতীয় সারির আইনজীবী ও তদন্ত কর্মকর্তার নিয়োগ, অপ্রতুল সুযোগ-সুবিধা, লোকবলের অভাব ইত্যাদি দেখে ধারনা হয় সরকারের মতি-গতি বেশি সুবিধার না। মনে হয়, তারা জামায়াতকে নিয়ে নির্বাচনকেন্দ্রীক কিছু একটা করতে যাচ্ছে।

বহিষ্কৃত জামায়াত সদস্য বাচু রাজাকারের ফাঁসির রায়ের পর একই ধরনের ও আরো গুরুতর অপরাধ করেও যখন জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের ফাঁসি হলোনা, তখন সেই সন্দেহ আরো তীব্র হয়।

ফেব্রুয়ারির ৫তারিখে রায় ঘোষনার পরমুহুর্ত থেকে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায় আদালতপাড়া থেকে পাড়ার চায়ের দোকান পর্যন্ত, তৈরি হয় গুজব, ফাঁস হয় নানা তথ্য — কিন্তু কোনটাই তথপ্রমানসহ কেউ হাজির করতে পারেনি। শুধু কথাই বলে গেছেন বন্ধু বা সহকর্মীদের সাথে। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী পর্যন্ত তার অখুশি মনোভাব জানালেন।

কিন্তু সেই সময় ঢাকার জনগনের মধ্যে কারো কারো উত্তেজনা তুঙ্গে উঠে যায়। তারা মানববন্ধন ডাকেন শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনে। তাদের দাবি রাজাকারের ফাঁসি।

সেদিন ও তারপরদিন জামায়াতের হরতাল ছিল যা পালন করতে গিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছিল জামায়াত-শিবির। শাহবাগের উত্তাল তরঙ্গের কারনে রাস্তাঘাটে গাড়ি চলেছে বেশি আবার সহিংসতার ঘটনাটাও ঘটেছে অনেক। পরদিনই শাহবাগের প্রেরণা ছড়িয়ে যায় দেশের আরো কিছু এলাকায়। তারপর থেকে চলছেই, চলবে। এগারদিন পার হলো