ফ্রুটিকা কতোটা পিওর?

প্রবীর বিধান
Published : 30 Oct 2015, 06:27 AM
Updated : 30 Oct 2015, 06:27 AM

বড় বড় ব্যবসায়িদের অনেক সুবিধা বাংলাদেশে। যেমন তাদের কুকর্মের খবর টিভিপত্রিকায় আসেনা; আর আসলেও ফলাও করে প্রচার হয় না। কেননা এদের দেয়া বিজ্ঞাপনের টাকায় অনেক টিভিপত্রিকা অফিসে বেতন হয়। এমনি একটি প্রতিষ্ঠান আকিজ বেভারেজ।

আপনি কি জানেন এদের ফ্রুটিকা ম্যাংগো জুসের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করা হয়েছে? আপনি কি জানেন তাদের দাবি: 'ফ্রুটিকা ম্যাঙ্গো জুস, বাংলাদেশের একমাত্র প্রিজারভেটিভ বিহীন জুস। যা তৈরি হয় জার্মানের অ্যাফেক্টিবল পদ্ধতিতে। যা শত ভাগ নিরাপদ। একটু বেশিই পিওর!' মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে?

আপনি কি জানেন কুকর্ম ধরা পরে যাওয়ায় আকিজ কোম্পানি সায়েন্স ল্যাবরেটরির (বিসিএসআইআর) বিজ্ঞানিদের ঘুষ দিয়ে আদালতে ভুয়া প্রতিবেদন দাখিল করেছিল?

আকিজের 'ফ্রুটিকা ম্যাঙ্গো জুস'র একটি বিজ্ঞাপনে এক মাছ বিক্রেতা একজন স্মার্ট ক্রেতার কাছে ফরমালিন মিশ্রিত মাছকে ভালো বলে দাবি করছেন। ক্রেতা বিক্রেতাকে একটি ফ্রুটিকার বোতল দেন। এরপর বিক্রেতার সব জারিজুরি ফাঁস হয়ে যায়।

২৭ অক্টোবর বিশুদ্ধ খাদ্য আদালতের বিচারক স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মাহবুব সোবহানী ক্ষতিকর ফ্রুটিকা জুস উৎপাদন, সরবরাহ ও ১০০ ভাগ পিওর ঘোষণা দিয়ে প্রতারণার অভিযোগে আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজের দুই কর্তা শেখ বশিরউদ্দীন এবং শেখ জামিলকে ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা এবং বিক্রেতা মোহাম্মদ আজিজুল হক সর্দারকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেন

পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ি, টেলিভিশনে এই বিজ্ঞাপন দেখে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক) মোহাম্মদ কামরুল হাসান বিষয়টি ডিসিসি দক্ষিণের স্বাস্থ্য বিভাগকে অবহিত করেন। স্বাস্থ্য বিভাগ 'ফ্রুটিকা ম্যাঙ্গো জুস' কেমিক্যাল পরীক্ষার জন্য ঢাকার নিরাপদ খাদ্য আদালতের কাছে অনুমোদন চায়।

আদালতের আদেশের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা কামরুল হাসান নিউমার্কেটের ৪ নম্বর গেট এলাকার সৈকত ফাস্ট ফুড (৭৭ নম্বর দোকান) থেকে ফ্রুটিকার বোতল কিনে সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করতে দেন।

পরীক্ষার প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১০০ ভাগ প্রিজারভেটিভ বিহীন ঘোষণা দেওয়া হলেও ফ্রুটিকায় মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর মারাত্মক ৬১ ভাগ সোডিয়াম বেনজোনাইট ও ৬৪ ভাগ সালফার ডি অক্সাইড রয়েছে। এই দুই রাসয়নিকের একত্রে ব্যবহারে মানবদেহে ভয়ঙ্কর ক্যান্সার সংক্রমতি হতে পারে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

কেমিক্যাল পরীক্ষার এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ফ্রুটিকার বিক্রেতা মোহাম্মদ আজিজুল হক সর্দার ও উৎপাদনকারী এবং সরবরাহকারী আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজের শেখ বশিরউদ্দীন ও শেখ জামিল উদ্দীনকে আসামি করে মামলা করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগ।

২০১৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর দায়ের হওয়া এ মামলায় ঢাকার নিরাপদ খাদ্য আদালতে করা নিরাপদ খাদ্য আদেশ ১৯৫৯ (সংশোধিত ২০০৫) এর ৬ () ধারায় আসামিদের বিরুদ্ধে খাদ্যপণ্যে বিষাক্ত রাসয়নিক ব্যবহার, ১৮ () ধারায় ভূয়া লেভেল ব্যবহার ও ১৯ () ধারায় গণমাধ্যমে ভুল তথ্য সম্বলিত বিজ্ঞাপন প্রচারের মাধ্যমে প্রতারণার অভিযোগ আনা হয়।

মামলার পর সায়েন্স ল্যাবে তদবির চালায় আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ। তারা সেখান থেকে দেওয়া আগের প্রতিবেদন স্থগিত করে নতুন রিপোর্ট নিয়ে আদালতে জমা দেয়।

ডিসিসি দক্ষিণের স্বাস্থ্য বিভাগ বিষয়টি আদালতে চ্যালেঞ্জ করলে চলতি বছরের ১৬ আগস্ট বিসিএসআইআর'এর প্রিন্সিপ্যাল বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রাক্তন গবেষণা সমন্বয়কারী মনজুর মোর্শেদ লিখিত আবেদনের মাধ্যমে আদালতে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করে আগের রিপোর্ট বহাল করেন এবং দ্বিতীয় রিপোর্ট বাতিল ঘোষণা করেন।

এছাড়াও আদালত তার রায়ে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর ফ্রুটিকা ম্যাঙ্গো ফ্রুট জুস বা পিওর ফ্রুটিকা জুস বিজ্ঞাপন যাতে ভবিষ্যতে প্রচারিত না হতে পারে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে তথ্য মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেন।

# এর আগে ২২শে এপ্রিল পরিবেশ ও জলজ জীববৈচিত্রের ক্ষতি করায় ধামরাই উপজেলার কুষ্ণপুরা এলাকার আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের একটি কারখানাকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। ওই কারখানায় আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজের কোমল পানীয় মোজো, ক্লেমন, লেমু, এনার্জি ড্রিংকস স্পিড, জুস ফ্রুটিকা, পাস্তরিত তরল দুধ ফার্ম ফ্রেশ ও ঘি তৈরি করা হয়।

পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা গত ১৩ এপ্রিল ওই কারখানা পরিদর্শন করে দেখতে পান, কারখানার অপরিশোধিত তরল বর্জ্য পাশের জলাশয়ে ফেলা হচ্ছে।

আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কোম্পানির সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে শুনানির জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের সদর দপ্তরে তলব করা হয়। শুনানি শেষে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট) আলমগীর হোসেন আকিজ কর্তৃপক্ষকে ৫ লাখ টাকা জরিমানা করেন।

যশোরের ব্যবসায়ী শেখ আকিজ উদ্দিন গত শতকের পঞ্চাশের দশকে বিড়ি দিয়ে ব্যবসা শুরু করলেও পরে বিভিন্ন খাতে কাজ শুরু করেন। বর্তমানে আকিজ গ্রুপের অধীনে দেড় ডজন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আকিজের ছেলেরাই এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা দেখেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাবে বর্তমানে আকিজ পরিবারের নিট সম্পদের পরিমাণ ৭০০ কোটি টাকা বলে গণমাধ্যমের খবর। শেখ আকিজ উদ্দিনের দ্বিতীয় সন্তান শেখ আফিল উদ্দিন যশোর১ আসনে ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ।

এর আগে যশোরে আকিজ গ্রুপের চামড়া প্রক্রিয়াকরণ কারখানা এসএএফ ইন্ডাস্ট্রিজকেও পরিবেশ দূষণের দায়ে ৭০ লাখ টাকা জরিমানা করেছিল পরিবেশ অধিদপ্তর।

এসব খবর চাপা পড়ে যায় চটকদার অন্যান্য রংঢংএর আড়ালে।

# এবারের রোজার ঈদে মাছরাঙা টেলিভিশনে রিয়েলিটি শো 'আল কুরআনের আলো'র স্পনসর ছিল ফ্রুটিকা।

# তারও আগে ২০১২ সালের ১৪ই জুলাই হোটেল সোনারগাঁওএ বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ফ্রুটিকা দেশের এক নম্বর জুস নির্বাচিত হয়! একই সাথে ফ্রুটিকা দেশের দ্বিতীয় শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ডও নির্বাচিত হয়!!

নেইলসেন বাংলাদেশ লিমিটেড কর্তৃক ভোক্তা পর্যায়ে পরিচালিত দেশব্যাপী এক গবেষণার ভিত্তিতে ব্র্যান্ডফোরাম এই ঘোষণা প্রদান করে।

ফ্রুটিকা দেশের এক নম্বর জুস নির্বাচিত হওয়ার পেছনে "কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ আকিজউদ্দীনের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে" বলে উল্লেখ করে কোম্পানির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, "ফ্রুটিকার মানের ব্যাপারে শুরু থেকে কোন ধরনের আপোষ করা হয়নি। আর এরই ফলশ্রুতিতে ফ্রুটিকা দেশের এক নম্বর জুসে পরিণত হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে।" আকিজ গ্রুপের সর্বস্তরের কর্মকর্তা কর্মচারীদের সমন্বিত কর্মদক্ষতা, নিরলস পরিশ্রম, মেধা এবং সততা ফ্রুটিকা জুসকে দেশের এক নম্বর জুসে পরিণত করেছে বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে!!!