প্রধান বিচারপতির কড়া কথা কাদের ভালো লাগবে না?

প্রবীর বিধান
Published : 6 March 2016, 07:06 PM
Updated : 6 March 2016, 07:06 PM

প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার কড়া কড়া কথা যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের অদক্ষ আইনজীবী ও তদন্ত কর্মকর্তা; তাদের বেশিরভাগের নিয়োগদাতা কামরুল ইসলাম; সরকারের নীতিনির্ধারক যারা বিচার বিভাগকে নিজেদের ইচ্ছামতো চালাতে চায়; উগ্রবাদী ওলামা লীগ এবং জামায়াতবিএনপির নেতাকর্মীদের ভালো লাগবে না।

সবচেয়ে গুরুতর অপরাধ করেছে প্রাক্তন বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিক ও শাহরিয়ার কবির, যারা প্রধান বিচারপতির সাথে শান্তি কমিটির সম্পৃক্ততা সম্পর্কে খন্ডিত ও বিকৃত বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে।

১০ই সেপ্টেম্বর ২০১৪: কি বলেছিলেন প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা?

যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামানের আপীল শুনানীর এক পর্যায়ে এটর্নী জেনারেল মাহবুবে আলম আসামীর আইনজীবীর যুক্তিগুলো উল্লেখ করছিলেন। আসামীপক্ষের প্রশ্ন ছিল কিভাবে মুক্তিযোদ্ধা হয়েও বদিউজ্জামান একজন শান্তি কমটির সদস্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। সেই সদস্যের নাম আহমেদ মেম্বার (বদিউজ্জামানের ভাইয়ের শ্বশুর)

বিচারপতি সিনহা তখন বলেনঃ "এমন হতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এমন একটা পরিস্থিতি ছিল যে একই বাড়িতে একজন আওয়ামীলীগ ও অন্য একজন পাকিস্তানের সমর্থক ছিল। আমি নিজেও শান্তি কমিটির সদস্য ছিলাম।"

এই বলে তিনি পাশের বিচারপতি আব্দুল ওয়াহাব মিয়ার দিকে তাকান। ঐ বিচারপতি তখন বলেনঃ "জীবন রক্ষা করতে।"

এটর্নী জেনারেল বলেনঃ "আমি ময়মনসিংহের একটি পরিবারকে চিনি যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল।"

প্রধান বিচারপতি বলেনঃ "আমি দিনের বেলায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সাথে থাকতাম, আর রাতে সেসব তথ্য মুক্তিযোদ্ধাদের দিতাম।"

তার সেই বক্তব্যের পর আজ যারা বড় বড় কথা বলছে তারা চুপ ছিল। হয়তো বড় একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল।

সম্প্রতি মীর কাশেমের আপীল মামলায় শুনানীর সময় প্রধান বিচারপতি এই মামলার আইনজীবী ও তদন্ত কর্মকর্তাদের দক্ষতাযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তার ক্ষোভের কারন ছিল কাশেমের বিরুদ্ধে দুইটি অভিযোগ প্রমান করতে না পারা এবং দুইটি অভিযোগের পক্ষে সাক্ষী যোগাড় করতে না পারা।

এর আগের প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেনও সাঈদীর মামলায় অদক্ষতার অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের আইনজীবী ও তদন্ত কর্মকর্তাদের সমালোচনা করেন। তাদের অবহেলার জন্য এবং প্রয়োজনীয় আলামত যোগাড়ে ব্যর্থতার জন্য সাঈদীর মৃত্যুদন্ড কমাতে বাধ্য হন আদালত।

নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই সাম্প্রদায়িক আক্রমন থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত রেষারেষির কবলে পড়েছেন এসকে সিনহা। প্রথমে তার বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে আওয়ামীলীগের হেফাজত শাখা বলে পরিচিত ওলামা লীগ। তারা কোন হিন্দুকে (আদিবাসী-মনিপুরী) প্রধান বিচারপতি হিসেবে দেখতে চায় না।

সরকারের কোন ব্যক্তি তখন তার পক্ষে কথা বলেনি। ওলামা লীগের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাও নেয়নি।

এক বছর আগে এই পদে আসীন হয়ে এস কে সিনহা দেশের বিভিন্ন জেলা সফরে গিয়ে বিচারক ও আইনজীবীদের নানা রকম নির্দেশনা দিয়েছেন এবং অনিয়মের বিরুদ্ধে সরাসরি কথা বলেছেন। কিছু বিষয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন।

গত বছরের মে মাসে এক আলোচনা সভা তিনি বলেন ঢাকা, সিলেট কারাগার এবং গাজীপুর নারী ও শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্রে নারীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। গাজীপুরে নারী ও শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্র পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি বলেন, গাজীপুরে অনেক যুবতী মেয়েকে ৫৪ ধারায় আটক রাখা হয়েছে। তাদের আদালতে উপস্থাপন করা হয় না। কারণ তাদের যৌন কাজে ব্যবহার করা হয়।

ধর্ষণের ঘটনায় সঠিক বিচারের জন্য তিনি নারী নেত্রীদের উপদেশ দেন তারা যেন এ সংক্রান্ত আইনটি পরিবর্তনের জন্য সরকারের উপর চাপ দেন, কেননা বর্তমান আইনে ভিক্টিমদের চরিত্র খারাপ দেখাতে পারলে আসামীর শাস্তি কমে যায় বা ছাড়া পেয়ে যেতে পারে।

গত ২রা মার্চ সিলেট সার্কিট হাউজে প্রধান বিচারপতির জন্য সংরক্ষিত কক্ষে আগুন লাগে। এ সময়ে তার সেই কক্ষেই থাকার কথা। কিন্তু ঢাকা থেকে যেতে দেরী হওয়ায় তিনি রক্ষা পান।

২৯শে ফেব্রুয়ারি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার তিলকপুরে প্রধান বিচারপতির গ্রামের বাড়ির পাশ থেকে একটি গ্যাস সিলিন্ডার পাওয়া যায় এবং ঘটনাস্থলে পাওয়া একটি মানিব্যাগে এলাকার বিভিন্ন সড়কের একটি স্কেচ ম্যাপ এবং কম্পিউটারে মুদ্রিত একটি কাগজে আল ফালাহ যুব সংঘের নাম পাওয়া গেছে।

১০ই জানুয়ারি তিনি বলেন, "এখন এক্সিকিউটিভ আমাদের কাছ থেকে সবগুলো ক্ষমতা কেড়ে নিতে চাচ্ছে।" এই চেষ্টা রুখতে আইনজীবীসহ বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানান প্রধান বিচারপতি। "অতীতে আমরা দেখেছি যখনই এ ধরনের কিছু হয়েছে আইনজীবীরা সোচ্চার হয়েছেন। এখন যদি বিচার বিভাগের প্রতি এক্সিকিউটিভ, আইনজীবী মহল, বিচারপ্রার্থী প্রত্যেকের আঘাত চলে আসে তাহলে বিচার বিভাগকে রক্ষা করবে কে?"

মাসদার হোসেন মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা হয়ে কাজ শুরু করে। এরপর সাত বছরের বেশি সময় পেরোলেও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আসেনি বলে গত বছর প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক মাসের মাথায় বলেছিলেন এসকে সিনহা।