স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে কোভিড-১৯ ক্রস সংক্রমণ ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা

স ম মাহবুবুল আলম
Published : 23 Jan 2012, 02:26 PM
Updated : 2 July 2020, 04:40 PM

পয়লা মে ২০২০ পর্যন্ত সারাবিশ্বে কোভিড ১৯ আক্রান্ত হয়ে ১০০০ জনেরও বেশি স্বাস্থ্যকর্মী মৃত্যুবরণ করেছেন। এ তালিকা প্রতিদিনই দীর্ঘ হচ্ছে। এখন পর্যন্ত সারা বিশ্বে কমপক্ষে ৯০ হাজার স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন। বাংলাদেশে শুধু চিকিৎসক মৃত্যুবরণ করেছেন ৬৩ জন। কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মৃত্যু কি তবে অনিবার্য?

বিভিন্ন দেশে সেবাকেন্দ্রে সংক্রমণের উচ্চ হার দেখলে মনে হবে হাসপাতালগুলো হয়ে  উঠেছে ভাইরাসের আঁতুরঘর। স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে আক্রান্ত স্বাস্থ্যকর্মীর নিকট থেকে অন্য রোগী ও তার পরিবারের সদস্যরা আক্রান্ত হচ্ছে, তার সংস্পর্শে আসা কর্মীদের কোয়ারেন্টিনে রাখতে হচ্ছে। করোনাভাইরাসে উচ্চ সংক্রমণ হার স্বাস্থ্যসেবায় বিদ্যমান কর্মী সংকটকে আরো তীব্র করে তুলেছে। স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্রগুলোকে সুরক্ষা দেওয়া রোগী, পরিবার ও কমিউনিটির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্যানডেমিকের আতঙ্কের সময় রোগী ও জনগণের কাছে এক একটা হাসপাতাল এক একটা দুর্গ। 

আমরা অন্য দেশের কিছু অভিজ্ঞতার দিকে তাকাই। গবেষকরা দেখিয়েছেন হংকংয়ে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের ৬ সপ্তাহ পরেও কোন হাসপাতালে সংক্রমণের ঘটনা ঘটেনি। চীনের উহানের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়- প্রথম পর্যায়ে ১৩০০ স্বাস্থ্যকর্মী সংক্রমিত হয়ে চিকিৎসক, নার্স, শূন্য হয়ে পড়লে তারা ৪২ হাজার স্বাস্থ্যকর্মী অন্য প্রদেশ থেকে নিয়ে আসা হয়। দ্বিতীয় দফায় সংক্রমণের কোনো ঘটনা ঘটেনি। 

বিজ্ঞানীদের কাছে সম্পূর্ণ অজানা, অদৃশ্য এক জীবাণুর আক্রমণে দেশে দেশে ইতোমধ্যে অর্জিত অভিজ্ঞতার আলোকে সংক্রমণ প্রতিরোধে কিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করলে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে কোভিড ক্রস সংক্রমণ বহুলাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। এ লেখায় বাংলাদেশের হাসপাতালগুলির অবকাঠামো বিবেচনায় নিয়ে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের লিডার, ব্যবস্থাপক, চিকিৎসক, স্বাস্থ্যসেবা কর্মী, সহযোগীদের জন্য গ্রহণীয় পদক্ষেপগুলিকে প্রধান চারটি ভাগে শ্রেণিবিন্যাস করে উপস্থাপন করা হয়েছে।

    • করোনা ভাইরাসের সর্বজনীন উৎস শ্বাসতন্ত্র থেকে উৎপন্ন ড্রপলেট ছড়িয়ে পড়া রুখতে নাক ও মুখ ঢাকতে হবে (সবার জন্য মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে)।
    • হাসপাতালের  প্রবেশমুখে কোভিড সন্দেহযুক্ত রোগীকে চিহ্নিতকরণ ও বিচ্ছিন্ন করতে হবে।
    • যথাযথভাবে পরিবেশ জীবানুমুক্ত করতে হবে (ডিসইনফেকশন)।
    • স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীর (পিপিই) ব্যবহার ও ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধির অনুশীলন নিশ্চিত করতে হবে। 

আমাদের সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলো সংক্রমণ প্রতিরোধ ও সংক্রমণ চিকিৎসার জন্য যথাযথভাবে নির্মিত না হওয়ায় ও প্রয়োজনীয় সক্ষমতা না থাকায়  প্যানডেমিকের মত অভূতপূর্ব পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত নয়। এই পদক্ষেগুলোকে সফল করতে হলে তাৎক্ষণিকভাবে স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে স্পেস ও স্ট্রাকচারের সামান্য ইঞ্জিনিয়ারিং পরিবর্তন এনে ও রোগী ব্যবস্থাপনার পদ্ধতিতে  নতুন শৃংখলা প্রচলন করে পুরো হাসপাতালকে  দুটো পৃথক কোভিড এবং নন-কোভিড জোনে বিভক্ত করতে হবে যাতে দুই গ্রুপের রোগী ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সংস্পর্শে আসার সুযোগ সীমিত হয়। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে  ক্রস ইনফেকশন প্রতিরোধে সন্দেহযুক্ত কোভিড-১৯ রোগীদের দ্রুত চিহ্নিত করে বিচ্ছিন্ন করার মধ্যে মূল সাফল্য।

হাসপাতালের প্রবেশ মুখে কোভিড সন্দেহযুক্ত রোগীদের চিহ্নিত করার লক্ষ্যে যা করা লাগবে-

১. ট্রায়াজ স্টেশন : প্রত্যেক হাসপাতালে ইমারজেন্সি ও আউটডোরের প্রবেশ মুখে ট্রায়াজ স্টেশন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সঠিক পিপিই পরিহিত দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীরা থার্মাল স্ক্যানার ও স্ক্রিনিং প্রশ্নের  (কোভিড উপসর্গ, ভ্রমণ, পেশা, কন্ট্যাক্ট, কোন এলাকার, প্যারাসিটামল সেবন ইত্যাদি) মাধ্যমে কোভিড সন্দেহযুক্ত রোগীদের পৃথকীকরণ করবে। রোগী ও রোগীর সঙ্গীকে মাস্ক পরতে হবে। একজন মাত্র স্বজনকে অনুমতি দেওয়া যেতে পারে, তিনি উপসর্গমুক্ত হবেন। মাস্ক, পেপার টিস্যু, বিনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। হাত ধোয়া বা হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা থাকবে ট্রায়াজ স্টেশনে।

২. রেসপাইরেটরি ক্লিনিক: কোভিড-১৯ উপসর্গের রোগীদের দ্রুত চিহ্নিত করে পৃথক পথে নির্ধারিত রেসপাইরেটরি ক্লিনিকে (রেড জোন) নিয়ে  যেতে হবে। এ এলাকাটি নেগেটিভ প্রেশাররুম হওয়া বাঞ্ছনীয়। নেগেটিভ প্রেশার রুম না থাকলে ক্লোজ ডোর রুম অথবা পর্যাপ্ত বায়ু চলাচলের সুবিধাযুক্ত  স্থানে কমপক্ষে ৬ ফুট দুরত্ব বজায় রেখে রোগীদের বসার ব্যবস্থা করতে হবে। সীমিত সংখ্যক প্রবেশ ও বাইর গেইট দ্বারা লোক চলাচল নিয়ন্ত্রিত এই এলাকাটিতে হ্যান্ড ওয়াশ/ হ্যান্ড স্যানিটাইজার, টিস্যু ও বিনের পর্যাপ্ততা নিশ্চিত করতে হবে। যথাসময়ে আবর্জনা সরিয়ে ফেলে মেঝে ও অন্যান্য জায়গা নিয়মিত পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করতে হবে।  চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা সঠিক সুরক্ষা সামগ্রী পরিধান করে এবং অতিরিক্ত ফিজিক্যাল পার্টিশন তৈরি করে রোগীদের সাথে এক্সোপজার কমিয়ে ফেলবে।

তাৎক্ষণিক টেস্টিং সুবিধা না থাকায় সকল ভর্তিযোগ্য কোভিড সন্দেহযুক্ত রোগীদের দ্রুত স্বাস্থ্যকেন্দ্রের/হাসপাতালের কোভিড আইসোলেশন ওয়ার্ডে (রেড জোন) কোভিড রোগীদের জন্য নির্দিষ্ট পথ/লিফট ব্যবহার করে পাঠাতে হবে। ইমার্জেন্সি ট্রায়াজ থেকেও কোভিড সন্দেহযুক্ত রোগীদের কোভিড আইসোলেশন আইসিইউ বা কোভিড আইসোলেশন ওয়ার্ডে নিয়ে যেতে একক পথ/লিফট ব্যবহৃত হবে।

৩. পৃথককৃত নন-কোভিড রোগীদের আলাদা পথে ক্লিন/গ্রিন জোনে চিকিৎসার জন্য দ্রুত স্থানান্তর করতে হবে। নন-কোভিড জোনে অন্যান্য চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনার সময়ে সংক্রমণ প্রতিরোধের সকল স্ট্যান্ডার্ড নির্দেশনা কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে। দ্রুততম সময়ে রোগীর সেবা কার্যক্রম সম্পন্ন করার দক্ষতা বৃদ্ধি ও অনুসরণ করতে হবে।

৪. হাসপাতালের কোভিড ওয়ার্ড (রেড জোন)- এর ব্যবস্থাপনা: এই ওয়ার্ডের অবস্থান ইমাজের্ন্সি ও রেসপাইরেটরি ক্লিনিক থেকে নিকটবর্তী হওয়া প্রয়োজন। হাসপাতালের অন্যান্য এলাকা থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন থাকবে। নিশ্চিত কোভিড রোগীদের  থেকে সন্দেহযুক্ত কোভিড রোগীদের আলাদা জোনে চিকিৎসা দিতে হবে। সংক্রমণ প্রতিরোধে এয়ারবোর্ন ইনফেকশন আইসোলেশন রুম প্রয়োজন (AIIR) । AIIR রুম না থাকলে মুক্ত বায়ু চলাচল ব্যবস্থা সম্পন্ন আইসোলেশন রুমের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। রোগীকে এখানে সরাসরি বেড প্রদানের পর অন্যত্র চলাচল করবে না। ওয়ার্ডের মধ্যে একটা চিহ্নিত ক্লিন এলাকা থাকবে যেখানে পিপিই ডোনিং রুম থাকবে এবং রোগীর সেবা কার্যক্রম যতদূর সম্ভব এই এলাকা থেকে করতে হবে। প্রতিটি রোগীর চিকিৎসা উপকরণ যেমন থার্মোমিটার, ব্লাড প্রেশার কাফ, স্টেথোস্কোপ, গ্লুকোমিটার প্রতিটি রোগীর জন্য নির্দিষ্ট থাকতে হবে অথবা একাধিক জনের জন্য ব্যবহার করতে হলে সঠিকভাবে ডিজইনফেকট করে নিতে হবে। বহনযোগ্য রেডিওলজিক্যাল যন্ত্র ব্যবহার করে রোগীর চলাচল সীমিত করতে হবে। রোগীকে যদি হাসপাতালের অন্যত্র (পরীক্ষা বা অন্য প্রয়োজনে) নিতে হয় তাহলে অ্যাপয়েনমেন্ট, সতর্কতা, আনুসঙ্গিক সংক্রমণ সম্ভবনা নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয় বিস্তারিত ব্যবস্থা নিয়ে পাঠাতে হবে।  কোভিড ওয়ার্ডে ডেডিকেটেড চিকিৎসক, নার্স, ক্লিনারদের ক্ষুদ্র টিম ১০/১৪ দিন অন্তর রোটেশন ডিউটি করবে। 

প্রতিদিন ডিউটির পূর্বে পরিষ্কার স্ক্র্যাব পরিধানের ব্যবস্থা থাকবে। স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের সঠিক পিপিই ও সঠিকভাবে পরিধান নিশ্চিত করতে হবে। ওয়ার্ডের বাইরে দরজার নিকট ডোফিং রুম থাকবে।

৫. কোভিড রোগীদের জন্য নির্ধারিত  আইসিইউ (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র): আইসিইউ স্টাফরা অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করে। ইতিমধ্যে দেশের তিনটি প্রধান হাসপাতালের আইসিইউ প্রধান করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। নিবিড় পবিচর্যা কেন্দ্রে AII কক্ষ প্রয়োজন। প্রত্যেক স্বাস্থ্যকর্মীকে সর্বোচ্চ সুরক্ষা নিতে হবে। অ্যারোসল জেনারেটিং প্রসিডিউরের সময় পার্টিশন তৈরি করা যেতে পারে। সরাসরি শ্বাসনালীর নীচে না তাকিয়ে ভিডিও ক্যামেরার সাহায্য নিতে পারে। রোগীর সংখ্যার সাথে আনুপাতিক হারে আইসিইউ স্টাফ না বাড়ালে মৃত্যুহার বাড়বে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পৃথক কোভিড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়ত সাঠিক ছিল কিন্তু দ্রুত বৃহৎ এবং স্বয়ং সম্পূর্ণ হাসপাতাল তৈরি করে জনগণের আস্থা অর্জন করা প্রয়োজন ছিল, পারেনি। অন্যদিকে, যেখানে হাসপাতাল আছে রোগী সেখানেই যাবে তাদের গায়ে সিল থাকেনা কোভিড বলে। লকডাউনের শুরুর দিনগুলোতে কোভিড সন্দেহযুক্ত বা অন্য ক্রনিক/ইমার্জেন্সি রোগী কোভিড সন্দেহে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে করুণ মানবিক হাহাকার সৃষ্টি হয়েছে। দেরিতে হলেও নির্দেশ এসেছে প্রত্যেক হাসপাতালে কোভিড ও নন কোভিড ইউনিট থাকতে হবে।

৬. হাসপাতাল আসার পূর্বেই ট্রায়াজ: নতুন টেকনোলজি ব্যবহার করে হাসপাতালে রোগীর আগমন কমানো এবং ভিড় কমানো ও লাইন এড়ানোর জন্য অনলাইন রেজিস্ট্রেশন, টেলিমেডিসিন, অ্যাপয়েন্টমেন্ট, বিলিং, বাড়ি থেকে কাজের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

৭. পরিবেশ জীবাণুমুক্তকরণ (ডিসইনফেকশন): সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের অন্যতম ভিত্তি হলো ঘন ঘন স্পর্শ করা পৃষ্ঠতল (সারফেস) ও বস্তুসমূহ যেমন ডোর নবস ও হ্যান্ডেল, লাইট সুইচ, কাউন্টার টপস, চেয়ার আর্ম, বেড রেইল, এসকেলেটর রেলিং, এলিভেটর বাটন ইত্যাদি পুনঃ পুনঃ জীবাণুমুক্ত করা (ডিসইনফেকট করা)। সন্দেহযুক্ত বা নিশ্চিত কোভিড রোগীর সংস্পর্শে আসা বস্তু ও পরিবেশ তাৎক্ষণিকভাবে জীবানুমুক্ত করতে হবে। দিনের শেষে  এবং রোগী ডিসচার্জ হলে সম্পূর্ণ ও বর্ধিত ক্লিনিং ও ডিসইনফেকট করতে হবে। ফ্লোর, সিলিং, ওয়াল, পর্দা সঠিক নিয়মে পরিচ্ছন্ন ও ডিসইনফেকট করতে হবে। টয়লেট ও অনান্য স্যানিটারি ব্যবস্থা সতর্কতার সাথে পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করতে হবে।

ক্লিনিং স্টাফদের সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তারা সঠিক পিপিই পরিধান করবে- ফ্লুইড রেজিসটেন্ট গাউন, হেভি ডিউটি গ্লাভস, মেডিক্যাল মাস্ক, আই প্রটেকশন, বুট অথবা ক্লোজড ওয়ার্ক সু। হাত ধোয়া সহ অনান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবে। মুখ, নাক, চোখে হাত দেয়া থেকে বিরত থাকবে। উপযুক্ত জীবাণুনাশক ও সঠিক অনুপাত, ব্লিচিং, সাবান, ডিটারজেন্ট ও পানি ব্যবহার করবে। এ সময়ে মানসম্মত জীবাণুনাশক প্রাপ্তির দিকে সতর্ক দৃষ্টি দিতে হবে। ক্লিনিং ইকুইপমেন্টগুলো কাজ শেষে পরিষ্কার করে বাখতে হবে। পরিবেশ পরিষ্কার রাখা ডিজইনফেকশনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। 

এয়ার কন্ডিশনিং এবং ভেন্টিলেশন সিস্টেমকে পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে।

৮. স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী: যারা রোগী দেখায় সরাসরি যুক্ত তাদেরকে এন ৯৫ মাস্ক পরিধান করতে হবে। এন ৯৫  মাস্ক বা সমমানের বা  উচ্চ মানের মাস্কের  মান ও সরবরাহ নিশ্চিত করা এ মুহূর্তের অগ্রাধিকার। এ্যারোসল জেনারেটিং প্রসিডিউরে, আইসিইউতে, ইমার্জেন্সিতে, কোভিড ওয়ার্ডে কর্মরতদের সর্বোচ্চ প্রটেকশন নিতে হবে। মাস্ক ছাড়া অনান্য প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্টগুলো মধ্যে আছে আই প্রটেকশন গগলস, আই সিল্ড, গ্লাভস, গাউন (ফ্লুইড রেসিসটেন্ট), অ্যাপ্রোন, হেড গিয়ার, সু কভার। কাজের প্রকৃতি অনুযায়ী সঠিক পিপিই পরিধান করতে হবে। সতর্ক থাকতে হবে মাস্ক পরিহিত চোখের নিচের এবং গ্লাভস পরিহিত কব্জির ফাঁক গলে জীবাণু ছড়িয়ে না যায়। ফিট টেস্টেড এন ৯৫ মাস্ক সহ পিপিই প্রত্যেক ব্যবহারকারীর মাপমত, আরামপ্রদ হতে হবে। সংক্রমিত গ্লাভস নিজের, অন্য রোগীদের ও পরিবেশে রোগ ছড়ানোর কারণ। সুতরাং পরিবেশ থেকে, নিজের শরীরের অন্যান্য অংশে স্পর্শ থেকে গ্লাভস পরা হাত সংযত রাখতে হবে এবং নির্দিষ্ট কাজ শেষে পরিত্যাগ করতে হবে। চুরি রোধে পিপিই ইনভেনটরির উপর কড়া নজর রাখতে হবে। সুরক্ষা সামগ্রীর মজুদ ও ব্যবহারের তথ্যের সার্বক্ষণিক আপডেইট প্রস্তুত থাকতে হবে। সম্পদ ও সরবরাহের সীমাবদ্ধতার কারণে পিপিই পুনরায় বা দীর্ঘ সময় ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে। বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভিত্তিতে আমাদের টেকনিক্যাল কমিটির সুপারিশের মাধ্যমে এ বিষয়ে স্থানীয় বাস্তবতার নিরিখে স্বচ্ছ সিদ্ধান্ত দিতে হবে। সেক্ষেত্রে পিপিই ব্যবহারে যত্নের সঠিক পদ্ধতি অবহিত করতে হবে। পুনরায় ব্যবহারের জন্য প্রদানকৃত পিপিইগুলো যথাযথভাবে পরিষ্কার, জীবাণুমুক্ত এবং সঠিক অবস্থায় আছে কি না তা নিরীক্ষা করে ব্যবহার করতে দিতে হবে।

পিপিই পরিধানের (ডোনিং) ধাপগুলি যথাক্রমে চুলের কভার, ফিট টেস্টেড এন ৯৫ মাস্ক, ফ্লুইড প্রতিরোধক গাউন, দুই স্তরের গ্লাভস, গগলস, ফেইস সিল্ড ও সু কভার। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এক্সোপজারের পরে পিপিই খোলার  (ডোফিং) ধাপগুলো যেভাবে অনুসরণ করা উচিত: হাত ধোয়া, ফেইস সিল্ড ও গগলস খোলা, ফ্লুইড প্রতিরোধক গাউন অপসারণ, বাইরের গ্লাভস খোলা, সু কভার খোলা, ভিতরের গ্লাভস খোলা, হাত ধোয়া,  এন ৯৫ মাস্ক খোলা ও চুলের কভার খোলা। প্রত্যেকটি ধাপ সঠিকভাবে পালিত হচ্ছে কিনা তা তত্ত্বাবধায়নে রাখতে হবে। ব্যবহৃত পিপিই হাসপাতালের ওয়েস্ট ডিসপোজাল চেইনের যথাস্থানে পরিত্যাগ করতে হবে। 

স্বাস্থ্যকর্মীদের কোভিড বা সংক্রামক রোগ থেকে সুরক্ষা প্রদানে প্রয়োজন অনেকগুলি পদক্ষেপের সমন্বিত ব্যবস্থা যার একটি পিপিইর ব্যবহার। প্রথমে আসে ট্রেনিং ও প্রশাসনিক কন্ট্রোল, ইনজিনিয়ারিং কন্ট্রোল, নিরাপদ ওয়ার্ক প্রাকটিস কন্ট্রোল এবং সর্বশেষে পিপিইর ব্যবহার।

হ্যান্ডহাইজিন-জীবাণুযুক্ত সারফেস হাত দিয়ে স্পর্শ করার পর তা চোখ, নাক, মুখের মাধ্যমে সংক্রমিত হতে পারে। স্বাস্থকর্মীর মাধ্যমে এক রোগী থেকে আরেক রোগীতে জীবাণু সংক্রমিত হয়। তাই কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড নিয়মিত সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধোয়া বা অ্যালকোহলভিত্তিক হ্যান্ড সানিটাইজার ব্যবহার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বাস্থকর্মীদের হাত ধোয়ার বিশেষ মুহূর্তগুলি- রোগী পরীক্ষার আগে ও পরে, কোনো ক্লিন প্রসিডিউর করার আগে, কোনো বডি ফ্লুইডের সংস্পর্শে এলে, রোগীর চারিদিকের জিনিসপত্র স্পর্শ করলে, পিপিই পরা ও খোলার আগে। স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে পর্যাপ্ত হাত ধোয়া সামগ্রী বা হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা রাখতে হবে।

স্বাস্থ্যসেবা কর্মী ব্যবস্থাপনা

১. প্রত্যেক স্বাস্থ্যসেবা কর্মী প্রতিদিন কোভিড উপসর্গ মনিটরিং করবে এবং উপসর্গ থাকলে কাজে যোগ না দিয়ে স্টাফ ক্লিনিক/সুপারভাইজারের কাছে রিপোর্ট করবে।

২. প্রবেশ পথে প্রত্যেক স্টাফকেই থার্মাল স্ক্যানারে স্ক্রিনিং করে প্রবেশ করানো হবে। 

৩. সবধরনের প্লাটফর্ম ব্যবহার করে (প্রাতিষ্ঠানিক ইমেইল, গ্রুপ মেসেজ, পোস্টার, ভিডিও কনফারেন্সিং ইত্যাদি) স্টাফদের মধ্যে পরিবর্তনশীল তথ্য, পরিস্থিতির নিয়মিত আপডেইট-সরকারি ও প্রাতিষ্ঠানিক, কর্ম পরিকল্পনা, কর্ম পদ্ধতির উন্নতি, নির্দেশনা ইত্যাদি দ্রুত অবগত করতে হবে 

৪. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রশিক্ষণ। পিপিই ডোনিং ও ডোফিং, সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কৌশল, কোভিড সংক্রমণ, প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ সর্ম্পকে জ্ঞান, চেকলিস্ট তৈরি, দক্ষতা বৃদ্ধি ইত্যাদি। প্রশিক্ষণ সিমুলেশন ব্যবহার করা যেতে পারে। পুনঃ প্রশিক্ষণ সুযোগ তৈরি করতে হবে।

৫. ডিউটি রোস্টার এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে যাতে খুবই সীমিত থাকে সেবা কর্মীদের কোভিড রোগীদের সাথে এক্সপোজার।

৬. স্বাস্থ্যকর্মীদের পারিবারিক বাসস্থান স্বাস্থ্য উপযোগী কিনা এবং সংশ্লিষ্ট কর্মী সেখানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে অনুশীলন করছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ এবং নিশ্চিত করতে হবে। উচ্চ কমিউনিটি সংক্রমণের সময় তাদের কমিউনিটি থেকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি।

৭. এ সময়ে স্বাস্থ্যসেবাকর্মীরা একাধিক প্রতিষ্ঠানে সেবা দেওয়া থেকে বিরত থাকবে।

৮. সেবা কর্মীদের মনোবল বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিশেষ খাদ্য, ড্রিংকস, লন্ড্রি সার্ভিস ইত্যাদির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সিনিয়র লিডারদের কাছ থেকে উৎসাহ প্রদানকারী মেইল, মিডিয়া কভারেজ, প্রকাশনা, ফ্রন্টলাইনদের সাহসী গল্পকে সামনে আনতে হবে।

৯. কোভিড আক্রান্ত স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের দ্রুত চিহ্নিতকরণ ও নিজেদের প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। 

১০. দ্রুত কনটাক্ট ট্রেসিং এর ব্যবস্থা করে প্রয়োজনীয় কোয়ারেন্টিন, পরীক্ষা এবং বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভিত্তিতে ডিউটিতে প্রত্যাবর্তনের শৃংখলা আনতে হবে। প্রতিটি সংক্রমণের কারণ খুঁজে বের করে দুর্বলতা দূর করতে হবে।

১১. কোভিড আক্রান্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের পরিবারের প্রতি প্রাতিষ্ঠানিক সহমর্মিতা ও সহযোগিতা দিতে হবে।

১২. বাড়তি লোকবল নিয়োগ করতে হবে।

১৩. আক্রান্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের বেতন সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা দূর করতে হবে।

১৪. বয়স্ক চিকিৎসক ও কোমরবিডিটি যাদের আছে তাদেরকে ফ্রন্টলাইন থেকে সরিয়ে নিতে হবে।

স্বাস্থ্যসেবাকর্মীরা প্রণোদনা প্যাকেজের বিষয়ে আগ্রহী নয় তারা আতঙ্কিত তাদের পরিবার ও নিজের জীবনের জন্য। 'চিকিৎসা মহৎ পেশা' এই বুলি বা হাইকোর্টের রায়ে ফৌজদারী অপরাধের ভীতি সংকট সমাধানে কোনো ভূমিকা রাখবে না। এটা জনগণ ও চিকিৎসককে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। 

মহামান্য হাইকোর্টের রায়ের (সরকারের আপিলে স্থগিত) পর পরই চিকিৎসক নিহত হওয়ার ঘটনায় এখন হাইকোর্টের উপর দায় বর্তায় কীভাবে চিকিৎসকরা কর্মস্থলে নিরাপদ থাকবে সেই আদেশ প্রদানের। দীর্ঘদিনের বঞ্চনা, নীতিনির্ধারকদের অদূরদর্শিতায় স্বাস্থ্য অবকাঠামো আজ জীর্ণ, শীর্ণকায়। এই কাঠামোর কাছে জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও প্রাপ্তির যে ফারাক তার ক্রোধ সম্মুখে থাকা ডাক্তারকে বীরের মর্যাদা না দিয়ে ভিলেনে রূপান্তরিত করে। যেসব রাষ্ট্র করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বিস্ময়কর সাফল্য দেখিয়েছে তা শুধু অগ্রিম প্রস্তুতি গ্রহণ ও তাৎক্ষণিক বাস্তবোচিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য নয়। এই সাফল্য শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষাকে সামনে রেখে তাদের কয়েক যুগের চেষ্টায় গড়ে তোলা গণমুখী স্বাস্থ্য অবকাঠামোর ফসল।

লিডারশিপ ও আইপিসি (ইনফেকশন প্রিভেনশন কন্ট্রোল) টিম 

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও শুরুর কথা স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রের কোর লিডারশিপ ও ইনফেকশন কন্ট্রোল টিমের ভূমিকা। স্বচ্ছ এবং সুচিন্তিত মতামত ও পরিকল্পনা প্রতিষ্ঠানে আস্থা ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। এমন একটা শক্তিশালী, উন্মুক্ত কমান্ড সেন্টার প্রতিষ্ঠা করতে হবে যেখানে সবাই প্রশ্ন করতে পারে।

হাসপাতালের একক পদক্ষেপে স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের মৃত্যুর মিছিল থামানো যাবে না। হাসপাতাল কমিউনিটি থেকে বিচ্ছিন্ন কোনও দ্বীপ নয়। তাই কমিউনিটিতে সংক্রমণের উচ্চ স্রোতকে থামাতে হবে। আমাদেরকে একটা সহজলভ্য, দ্রুত ও নির্ভরযোগ্য টেস্ট পদ্ধতি সংযোগ করতে হবে। প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা, দুর্বলতা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। প্যানডেমিক মোকাবিলায় বিপুল সম্পদের প্রয়োজন হয়। প্রয়োজন হয় অগ্রিম প্রস্তুতির। মার্চের শুরুতেই আমাদের পাবলিক ও প্রাইভেট সেক্টরের হাসপাতালগুলি কলাপস করে যায় প্যানডেমিকের রোগীর সংখ্যাধিক্যে নয় বা সম্পদের স্বল্পতায় নয়, প্যানিকে। তাই বিদ্যমান সম্পদের মধ্যে তাকে বৃদ্ধি করে, নতুনদের প্রশিক্ষিত করে, অনুপ্রাণিত করে শতাব্দীর ক্রান্তিকালের এক ভয়াল মহামারীর চালেঞ্জ কীভাবে  মোকাবিলা করতে হয় সেই দক্ষতা ও সক্ষমতার শক্তির স্ফূরণই বড় প্রশ্ন।