ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে

প্রজাপতি২
Published : 4 July 2012, 07:54 AM
Updated : 4 July 2012, 07:54 AM

দাদুকে খুব মিস করি। ছোটবেলার স্মৃতিগুলো খুব করে আমাকে কাদায়। আমার ভালোভাবে মনে পড়ে, সন্ধ্যাবেলায় আমাদের বাড়ির বারান্দায় এসে দাদু বসতেন, একথা সেকথা বলতে বলতে কখন যেন তিনি হারিয়ে যেতেন মুক্তি যুদ্ধের গল্পে। আসলে সেগুলি ঠিক গল্প নয় বরং আমার দাদুর বাস্তব অভিজ্ঞতালব্দ ঘটনা। একটা ব্যাপার হলো আমার দাদু যে কথা দিয়েই আলোচনা শুরু করুকনা কেন সেখানে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ আসতোই। ছোটবেলায় বুঝতাম না মুক্তিযুদ্ধ কি জিনিস কি তার মহত্ত্ব, খুব বিরক্ত হতাম ধ্যাৎ দাদু শুধু মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে। পাকিস্তানি খানরা একে মেরেছে ওকে ধরেছে, আমাদের বঙ্গবন্ধু এই বলেছে আমরা এই করেছি ইত্যাদি এগুলি ছাড়া কি দাদু আর কোন গল্প জানেনা নাকি। কিন্তু এখন আমার মধ্যে যে অভাবোধ ও অপ্রাপ্তি সবচেয়ে বেশি কাজ করে সেটি হলো আমি বুঝতে শিখলাম ঠিকই কিন্তু তার আগেই আমার দাদু আমাকে ছেড়ে আকাশে চলে গেছে অথচ আমি আমার দাদুর কাছ থেকে আমার দেশের স্বাধীতার ইতিহাস শুনে রাখতে পারিনি। কিছুদিন আগে আমি আমার একজন খুব প্রিয় শিক্ষকের কাছে গিয়ে বললাম স্যার আমি ‌‌‌'বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ-১৯৭১ ' এ বিষয়টির উপর কিছু পড়াশুনা করতে চাই। একটা জিনিস লক্ষ করলাম স্যারের মুখে প্রথমে একটি ইতিবাচক আনন্দমাখা ছাপ ফুটে উঠেছিল কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটি হতাশার ছাপে লেপ্টে গেল। আমি বললাম স্যার বই পুস্তকের ব্যাপারে আপনি আমাকে সহযোগীতা করুন। তখন স্যার অত্যান্ত বিমর্ষভাবে বললেন, আমাদের স্বাধীণতা অনেক বড়, অনেক অত্যাচার, অভাব, অনেক অনেক কিছু জয় করে আমরা পেয়েছি এই স্বাধীনতা। তবে দুঃখের বিষয় হলো আমাদের দেশের সংকীর্ণ রাজনীতির সীমাহীন নোংরামি গিলে ফেলেছে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের পবিত্র ইতিহাস। স্যার বললেন, তুমি আমাকে কিছুদিন সময় দাও আমি কিছু মানসম্মত, নির্ভেজাল বই খুঁজে বের করি তোমার জন্য।

আজব আমাদের রাজনীতি, হতভাগ্য এ প্রজন্ম। আমরা নতুন প্রজন্ম প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে পারছিনা। ক্ষমতা বদলের সাথে সাথে বদল হয়ে আমাদের ইতিহাসেরও, এজন্য আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি কিন্তু বই পড়ে বা কারো কাছে তখনকার ঘটনা শুনেছি ভয় হয় আসলে সেগুলি সত্য নাকি বিকৃত। ভাবতে অবাক লাগে, লজ্জায় মাথা নুয়ে পড়ে যখন দেখি মহান স্বাধীনতা ঘোষক কে এ বিষয়টি নিয়েও রয়েছে চরম বিতর্ক। আজব জাতি আমরা, যে জাতি রক্তের স্রোতে ভাসিয়ে দিয়েছে শত্রুর দল, স্বাধীন করেছে এ দেশ সে জাতি ৪০ বছর পার করে এসেও স্বাধীনতার ঘোষক কে এ প্রশ্নের উত্তর ঠিক করতে পারল না। এখনো অনেক মুক্তিযোদ্ধা বেঁচে আছেন অথচ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কোন বই লেখার সময় তাদের কাছে শোনা হয়না ( খুব কম গবেষকই শুনে থাকেন ) লেখক বা গবেষক কোন একটা রাজনৈতিক দল কর্তৃক প্রভাবিত হয়ে সে দলের সাফাই গেয়ে শেষ করেন। ভাবুন তো কি শিখবে পরবর্তী প্রজন্ম। যে প্রজন্ম তার সঠিক ইতিহাস জানেনা সে জাতি হয় বিভ্রান্ত। আমাদের নোংরা রাজনীতি আর স্বার্থান্বেষী কিছু লেখক-গবেষকের কারনে বিকৃত হয়েছে ইতিহাস, বিভ্রান্ত হতে চলেছে পরবর্তী প্রজন্ম, দেশপ্রেম হতে চলেছে উপেক্ষিত। অতীতে যারা ইতিহাস বিকৃত করেছে বা আজ যারা এ নোংরামি করার অপচেষ্টায় লিপ্ত তাদেরকে বলি, ধ্বংস হোক তোদের জীবন, বিফল হোক তোদের কর্ম। পরবর্তী প্রজন্মের অভিশাপে শান্তি পাবেনা তোদের নারকীয় আত্মা। আমি জানতে চাই, (আমার মত সহস্র তরুণ এক কথায় নতুন প্রজন্ম) এ দেশটার ইতিহাস জানতে চাই। স্বাধীনতার গল্প শুনতে চাই। আজ আমার দাদু নেই, মুক্তিযোদ্ধারা অনেকেই বেচে আছেন। আমি তাদেরকে বলি 'তোমরা সবাই আমার দাদু। তোমরা রক্ত দিয়ে স্বাধীন করেছো এদেশ, এবার সে স্বাধীনতার পবিত্রতা রক্ষার্থে আরেকটা যুদ্ধ কর আমরা হব তোমাদের সৈনিক। আমি দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে বলতে পারি আজও অনেক মুক্তিযোদ্ধা বেঁচে আছেন, অনেক নমুনা আছে এখনই আমাদের ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য জোরালো পদক্ষেপ নেয়া উচিত। আমরা যদি আমাদের ইতিহাসটাকে নির্ভেজাল ও বিতর্কের উপরে রাখতে না পারি তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম আমাদেরকে ঘৃণা করবে, কখনো ক্ষমা করবেনা।