ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা প্রশ্নে আমাদের জাতি-রাষ্ট্র

প্রজাপতি২
Published : 4 Feb 2013, 06:55 PM
Updated : 4 Feb 2013, 06:55 PM

পাকিস্তানের কাছ থেকে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে, বিশ্বের মানচিত্রে জায়গা করে নেয় নতুন একটি ভূ-খন্ড। বিভিন্ন জাতি সত্ত্বার সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্রের জাতীয়তাবাদী চেতনা ও পরিচিতির শিকড় ইতিহাসের গভীরে গ্রোথিত। তবে "যে উপলব্ধিবোধ,চেতনা কিংবা উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এ জাতিরাষ্ট্রটির জন্ম তা এখনও প্রবল আছে" একথা প্রশ্নবিদ্ধ। পিছন ফিরে তাকালে, যখন বাংলাদেশের জনগণের উপর উর্দুকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা দেখা গেছে তখন এ অঞ্চলের সুশীল সমাজ থেকে শুরু করে সাধারণ বাঙ্গালীরা একত্রিত হয়ে এমনকি জীবন দিয়ে তা প্রতিরোধ করেছে, কোন চেতনা থেকে এবং কেন? আবার ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে লাখো নারী ও পুরুষ যুদ্ধ করেছে, জীবন দিয়েছে এদেশকে স্বাধীন করার জন্য। কেন তারা যুদ্ধের জন্য নারী-পুরুষ আবাল বৃদ্ধ একত্রিত প্রয়াস চালিয়েছে? কোন চেতনা কিংবা কোন স্বপ্ন তাদেরকে ব্যক্তিক স্বার্থ উপেক্ষা করে প্রাণ উৎসর্গ করতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে? ভাষা, সংস্কৃতি জাতিসত্তা প্রশ্নে আমাদের জাতি-রাষ্ট্র বিষয়ক এ ধরনের আলোচনায় প্রথমেই চলে আসে জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গ।

প্রাথমিকভাবে জাতীয়তাবাদ হচ্ছে একটি রাজনৈতিক ভাবাদর্শ যা সম্পৃক্ত করে একটি দলের কঠোর পরিচিতিবোধকে, যাদের রয়েছে রাজনৈতিক শর্তাবলি দ্বারা নির্ধারিত রাজনৈতিক সত্তা। জাতির "আধুনিকতাবাদী" চিত্রে, জাতীয়তাবাদ হল তাই যা জাতীয় পরিচয় সৃষ্টি করে।১ কোন জনগোষ্ঠীর সদস্যরা নিজেদের রাজনৈতিক অধিকারের জন্য একটি বিশেষ জাতীয় পরিচয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে নিজেদের "আমরা" পরিচয় প্রকাশ করে যা ব্যক্তিক পরিসীমাকে ছাপিয়ে জতীয় পরিসীমা নির্দেশ করে। জাতি কি নিয়ে গঠিত হয় তা নিয়ে বিভিন্ন সংজ্ঞা আছে, তবে সংজ্ঞাগুলো জাতীয়তাবাদের কয়েকটি পৃথক পৃথক উপাদানের প্রতি দিকনির্দেশ করে। এটি একটি বিশ্বাস হতে পারে যে, একটি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব কোন একটি এথনিক, সাংস্কৃতিক বা identity group এর মাঝে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে বা একটি রাষ্ট্রের মধ্যকার বহু জাতীয়তা প্রান্তিক জনগণসহ সকলের জাতীয় পরিচয় প্রকাশ ও চর্চা করাকে ধারণ করতে হবে।২
একুশের চেতনা ও আমাদের জাতিরাষ্ট্র

জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রের ভূবনে বাংলাদেশের আবির্ভাব বিলম্বে। যোগদান তারিখের ক্রম অনুসারে জাতিসংঘের একশত পচিশটি সদস্যের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান একশ তেত্রিশতম। বাংলাদেশের পর যে রাষ্ট্রগুলি যোগ দিয়েছে তার সবকটিই জনসংখ্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশের চেয়ে ছোট। বাংলাদেশ জনসংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বে ৮ম।বিশ্বের প্রতি ৪৮ জনের মধ্যে একজন হচ্ছে বাংলাদেশী। নিশ্চিতভাবে বলা চলে বাংলাদেশ হচ্ছে নিজের অস্তিত্ব ঘোষণাকারী সর্বশেষ বৃহৎ জাতিভিত্তিক-রাষ্ট্র৩।

একটি জাতিরাষ্ট্র গঠনের পেছনে অবশ্যম্ভাবী শর্ত হলো জাতীয়তাবাদী চেতনাবোধ কিংবা পরিচয়।ভাষা, সংস্কৃতি এবং ধর্ম এক্ষেত্রে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সংস্কৃতি সৃষ্টির মধ্য দিয়ে মানুষ নিজেকেই সৃষ্টি করে চলে নিরন্তর। এই সৃজনযজ্ঞে মানুষ শুধু আমিই সৃষ্ট করে না, সৃষ্টি করে আমরাও, সৃষ্টি করে পরিবার-কৌম-সমাজ-জাতির আদলে নিজেদের সামষ্টিক পরিচয়ের বহুবিধ রূপ।এই যুথবদ্ধ সৃজন যজ্ঞের মধ্যদিয়ে ব্যক্তি মানুষের নামের সাথে জুড়ে যায় আরো অনেকগুলি পরিচয়। ক্ষমতার ইতিহাস এই সৃজন যজ্ঞের নিয়ন্তা হয়ে উঠবার পরে এই ইতিহাসের সবচেয়ে পরিশীলিত অর্জন হিসেবে আধুনিক জাতিরাষ্ট্র আবির্ভূত হয়। আধুনিক ব্যক্তি মানুষের অনিবার্য আইনি-পরিচয় হয়ে দাঁড়ায় তার জাতিরাষ্ট্রের পরিচয়, বৈশ্বিক ক্ষমতা বিন্যাসেরও মৌলিক একক হয়ে দাঁড়ায় জাতিরাষ্ট্র। ব্যক্তি-পরিচয়ের পাশাপাশি এই রাজনৈতিক পরিচয়ের চর্চা বা এই দুই পরিচয়ের সম্পর্কটির চর্চা আধুনিক মানুষের আমোঘ নিয়তি হয়ে দাঁড়ায়। পৃথিবীর তাবৎ জাতিরাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক সীমার ভেতরে এবং বাইরে এই পরিচয় চর্চার ইতিহাস এক নয়। কিন্তু তারপরও বলা যায় মূখ্যত সাংস্কৃতিক সমস্বত্ত্বতার ধারণা এবং ক্ষমতার আর্থ-রাজনৈতিক বিন্যাস এই দুইয়ের দ্বান্দিক ছকেই বিন্যাস্ত হয় মানুষের এই পরিচয়টি।৪

এখন প্রশ্ন হলো বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট গঠনের পিছনে কোন জাতীয়তাবাদী চেতনাবোধ কাজ করেছে? এ বিষয়টি পরিস্কার করার জন্য আমাদেরকে পিছন ফিরে যেতে হবে। ভারত-পাকিস্তান বিভাজন লগ্নে যে অদূরদর্শী/প্রভাবিত ব্রিটিশ নীতি কাজ করেছিল তার চরম মূল্য দিতে হয়েছে এ অঞ্চলের (বাংলাদেশ) মানুষদেরকে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্টতার দোহায় দিয়ে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয় বাংলাদেশকে। চরম ইসলামী জাতীয়তাবাদী চেতনা থেকেই, এবং একটি বৃহৎ মুসলিম জাতিরাষ্ট্রের লক্ষ্যেই হয়ত পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্টী এ অঞ্চলের বাঙ্গালীদের ভাষা ও সংস্কৃতিক পরিচয়ের উপর চাপিয়ে দিয়েছিল উর্দুকে। অথচ এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর মধ্যে ধর্মীয় ভিন্নতা থাকলেও ভাষা এবং সংস্কৃতিতে ছিল অকৃত্রিম মিল যে কারণে পাকিস্তানের এই সিদ্ধান্ত বাঙ্গালীর জাতীয়তাবাদী চেতনায় নির্মমভাবে আঘাত করে।আর তখন থেকেই এ অঞ্চলের বাঙ্গালীরা একটি স্বাধীন ধর্মনিরপেক্ষ জাতিরাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিল যে স্বপ্ন বাস্তবায়নে কোন ধর্মীয়-জাতিগত সীমানা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি বরং ভাষাতাত্ত্বিক ঐক্যই সবকিছুর মূলে কাজ করেছে।

কিন্তু কোন ভাষার কি এই জাতিরাষ্ট্র গঠন করার ক্ষমতা আছে? আমাদের জাতিসত্তা নিয়ে বাঙ্গালী/বাংলাদেশী জাতীয় রাজনৈতিক দলজাত কূট-কথকতার ধোঁয়া সরাতে পারলে ভাষার প্রশ্নটিই আমাদের জাতিগত পরিচয় নির্মাণের প্রথম রাজনৈতিক সংগ্রামের ক্ষেত্র হিসেবে নির্ণিত হয়।একারণেই এখনও 'একুশ' আমদের জাতিসত্তাগত পরিচয়ের সবচেয়ে বড় প্রতীক, একুশের চেতনা আমদের জাতিত্ববোধের আদি সোপান হিসেবে চিহ্নিত। সেই বিচারে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আবির্ভাব একটি ভাষা কি করে একটি জাতিরাষ্ট্র গঠন করে সেই প্রশ্নের সামনে নিয়ে এসেছিল রাষ্ট্রচিন্তুকদের, আমাদের জাতিরাষ্ট্রটি গঠনের ক্ষেত্রে বাংলা ভাষায় কেন্দ্রীয় উপাদান হিসেবে ভূমিকা পালন করাটা আধুনিক রাষ্ট্রের ইতিহাসে অভিনব ঘটনাই বটে।৫

বাঙালি জাতির সবচাইতে গর্বের, সবচাইতে অহংকারের অধ্যায়টির নাম হচ্ছে ভাষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলন কোন বিচ্ছিন্ন বিদ্রোহ বা কোন আটপৌরে আন্দোলন ছিল না, একটা ভাষাভিত্তিক জাতিসত্ত্বার অসাধারণ এক উত্থান ছিল এই ভাষা আন্দোলন। তাই ভাষা আন্দোলন অনেক বেশি গর্বের, অনেক বেশি মর্যাদাপূর্ণ পৃথিবীর প্রতিটি বাঙলা ভাষাভাষীর কাছে।৬ পৃথিবীতে এই পর্যন্ত যতগুলো জাতিরাষ্ট্র দেখা গিয়েছে, ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্রের দার্শনিক ভিত্তি সব সময়ই অন্যান্য সকল জাতিরাষ্ট্রের চাইতে উন্নত বলে দার্শনিক সমাজে স্বীকৃত। ভাষা মানুষের এক ধরনের আত্মিক বন্ধন তৈরি করে, যেই বন্ধন অন্য যেকোন ধরনের বন্ধন থেকে শক্তিশালী। মানুষ ধীরে ধীরে বুঝতে শিখেছে, নানা ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে শিখেছে যে ধর্ম কখনও একটা রাষ্ট্রের ভিত্তি হতে পারে না, রাষ্ট্রকে একত্র রাখতে পারে না। ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার; রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিক, তা সে যেই ধর্মেরই হোক না কেন, রাষ্ট্রে সে সমান সুবিধা ভোগ করবে। একটা জাতিকে একত্র রাখার জন্য চাই অভিন্ন জাতীয়তাবোধ, যা একমাত্র ভাষাই দিতে পারে। একক সংস্কৃতি, একক জাতিগত চেতনাই মানুষকে একত্র করতে পারে, ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারে।দেশকে নিজের ভাবা, রাষ্ট্রকে আপন ভাবাটা প্রতিটা নাগরিকের মনস্তত্বে গভীর প্রভাব ফেলে। এই আপন ভাবাটা কোন চাপিয়ে দেয়া তত্ত্বের কাছে নত হয় না, স্বতস্ফূর্তভাবেই বের হয়। আর এই মনস্তত্ব গঠনে যুগে যুগে ভাষাভিত্তিক জাতিসত্তাই প্রমাণ করেছে নিজেদের স্থায়িত্ব, নিজেদের শক্ত ভিত্তি।৭

আমাদের জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রতিক নৃশংসতা
একুশের চেতনা থেকে, একাত্তরের যুদ্ধের মধ্যদিয়ে যে জাতিরাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল, চল্লিশ পার করে আজ টগবগে যৌবনে এসে কি সেই রাষ্ট্রটি সেই চেতনাবোধকে টিকিয়ে রাখতে পেরেছে।জাতীয়তাবাদ নিরাপত্তা দেয় এবং এক ধরনের আবেগ তৈরী করে। রূপক হিসেবে দেখলে বলা যায় জাতি একটি বিরাট পরিবার যেখানে ব্যক্তিক আবেগকে জাতীয় আবেগে পরিণত করা হয়।৮ আর এমন বিশ্বাস ছিল বাঙ্গালীর জাতীয়তাবাদী চেতনার মধ্যেও কিন্তু বাস্তবে কী ঘটেছে? বস্তুত অগ্রসরমান কোন মানবিক রাষ্ট্রের জন্ম হয়নি একুশের গর্ভ থেকে।গণমানুষের প্রতিবাদী কন্ঠে ধ্বনিত ইতিহাসের আকাঙ্খা অবিশ্রুত থেকে গিয়েছিল আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে। একুশের চেতনার এই মানবিক অনুধাবনের প্রস্তুতি বা সামর্থ্য কোনটিই ছিলনা আমাদের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির৯।একুশের চেতনায় একাত্তরে যে স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে তার পরবর্তী জাতীয় রাজনীতি সেই চেতনার আমেজ মোটেও সমুন্নত রাখতে পারেনি। উপনিবেশিক আধুনিক রাষ্ট্রের সাথে দেশজ সমাজ প্রক্রিয়ার সংমিশ্রণে যে 'উদ্ভট' চেহারার কথা কার্ল মার্কস লিখেছিলেন ভারত ইতিহাস প্রশ্নে, আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্রটিও তার প্রতিরূপ হয়ে গিয়ে আর দশটি উত্তর-উপনিবেশিত দেশের ঐতিহাসিক রাজনৈতিক পরিণতি বরণ করে নিল।১০

জাতীয়তাবোধের চরম অবক্ষয় গ্রাস করেছে স্বাধীণতা উত্তর জাতীয় রাজনীতিকে যার ফলে বৈশ্বিক জগতে আমাদের ভাবমূর্তি আজও স্পষ্ট হয়ে উঠেনি। যে ভাষার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে একটি রাষ্ট্র গঠিত হলো, সে রাষ্ট্রেই কিনা আজ চৈতন্য সৃষ্টিকারী সে ভাষা অদ্ভূদ পরিস্থিতির সম্মুখিন। সমাজের, আচরণের প্রতিটি মৌল পর্যায়ে আজ ভাষা দুষিত। আমাদের সংবিধান, আইন-কানুন, এবং সবধরনের চিন্তা ভাবনায় পশ্চিমা দাতাদের তাবেদারিত্ব প্রতিয়মান। তবে এ বিষয়ে আলোচনা দীর্ঘ করা আমার লক্ষ না, আমি ভাষার বিকৃতির বিষয়টি এনেছি যাতে এর মাধ্যমে ভাষাতাত্ত্বিক জাতীয়তাবাদী চেতনার অবক্ষয়ের বিষয়টি সহজে স্পষ্ট করা যায়্। বাংলাদেশ নাম জাতিরাষ্ট্রে জন্মলগ্নে সবশ্রেণীর মানুষের অবদান ও অংশগ্রহণ ছিল স্পষ্ট। কিন্তু জাতীয়তাবাদী চৈতন্য লোপ পাওয়ার কারনে আজ সহিংশতা ঘটে চলেছে অবিরত, যা, কখনও একটি অসাম্প্রদায়িক, ভাষাতাত্তিক জাতি-রাষ্ট্রের স্বপ্রের মধ্যে সুপ্ত ছিলনা। সাম্প্রতিক কয়েকটি নৃশংসত পর্যাবেক্ষণ করলেই ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা প্রশ্নে আমাদের জাতিরাষ্ট্রের (এবং জাতীয় রাজনীতির) অবস্থান ও ভূমিকা রক্তিম রাঙ্গা সুর্যালোকের ন্যায় সত্য ও স্পষ্ট হয়ে ধরা দিবে।

বিশ্বজিৎ হত্যা একটি মাত্র ঘটনা। কিন্তু বিচ্ছিন্ন বলা যাবে কি? বিশ্বজিৎ হত্যার কোন রাজনৈতিক সমীকরণ যে সক্রিয় ছিল, তা কিন্তু কেউ বলছেন না বা বলতে চাচ্ছেন না। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের হামলায় হতাহত হওয়াটা এক জিনিস। কিন্তু বিশ্বজিৎ তো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ছিল না। তিনি যে কোন দলের সদস্য ছিলেন আজ পর্যন্ত কোন খবরে তা জানানো হয়নি। তিনি জামায়াতের সমর্থক ছিলেন না। তিনি তো অছাত্র একজন দর্জির সহযোগী ছিল। পুরান ঢাকা অর্থাৎ যেখানে তিনি খুন হন সেটি মূলত সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকা। রাজনৈতিক বিশ্লেষণের দৃষ্টি দিয়ে দেখলে, বিশ্বজিৎ হত্যার রাজনৈতিক সমীকরণটির কেন্দ্রবিন্দুই ছিল একটি সংখ্যালঘু লাশের প্রয়োজনীয়তা। যেহেতু ৯ ডিসেম্বর সড়ক অবরোধ ডেকেছে জামায়াত সমর্থিত বিএনপি। সুতরাং ওদের হাতে একজন অরাজনৈতিক সংখ্যালঘুর মৃত্যু দেখাতে পারলে বিএনপি-জামায়াতকে রাজনৈতিকভাবে ঘায়েল করার একটি সহায়ক উপাদান পাওয়া যাবে, এই সমীকরণ থেকেই হয়েছিল এই হত্যা।১১ আবার অন্যভাবে ভাবলে আওয়ামীলীগ সমর্থকদের হাতে একজন সংখ্যালঘুর মৃত্যু ঘটাতে পারলে ষোলআনা ফায়দা তুলতে পারবে বি এন পি-জামায়াত।বেচারা বিশ্বজিৎ এই হিসাব-নিকাশের শিকার হলো মাত্র। এ কথার সত্যতা মেলে গত ২৬ তারিখে প্রকাশিত The Daily Star এর একটি খবরে। সেখানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ সভাপতি এফ এম শরিফুল ইসলামের একটি উদ্ধৃতি ছাপা হয়। 'I actually told them (the activists) to stop Bishwajit and beat him a little. But they lost their sense of proportion.' He admitted asking the BCL followers to 'teach the Shibir man a lesson.' Pointing at Biswajit, who was a Hindu by religion. There was hardly aû possibilitz of his involvement with an Islamist organisation like Islami Chaatra Shibir, the student wing of Jamaat-e-Islam.

'আমি হিন্দু, আমাকে মেরো না' এই আকুতির মাধ্যমে মূলত অবচেতনভাবে বিশ্বজিৎ জানান দিতে চেয়েছিলেন, তিনি অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের নাগরিক, ভাষাতাত্তিক জাতীয়তাবাদ তাঁর মধ্যে প্রবল এবং কিংবা তিনি অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বলীয়ান রাজনীতির সমর্থক। অথচ এই জানানোর পরও উপর্যুপরি চাপাতির ঘায়ে, লোহার রডের আঘাতে তাকে প্রাণ দিতে হলো। যার বীভৎস দৃশ্যের ভিডিও ফুটেজ দেখে দেশ-বিদেশবাসী স্তম্ভিত। খুনিরা এলাকায় রাজনৈতিকভাবেও পরিচিত। তারা চাঁদাবাজি সন্ত্রাসী হলেও এদের রাজনৈতিক পরিচিতি ছিল। যে কারণে বিশ্বজিৎ আমি হিন্দু বলে বারবার আকুতি জানিয়েছে।কিন্তু এই হিন্দু হওয়াটাই যে বিশ্বজিতের দরকার ছিল। সেই হিসাবটা সে বুঝতে পারেনি। এভাবেই বৃহত্তর নোংরা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ও জাতিসত্তার চৈতন্যকে উপেক্ষার হিসাব-নিকাশের শিকার হয়ে তাকে মরতে হলো।

বিশ্বজিৎ মরেছে। কিন্তু এই হত্যার রাজনৈতিক ফায়দা ঘরে তুলে নিতে পারেনি সন্ত্রাসীরা। মিডিয়ার কারণে রাজনীতির হিসাব-নিকাশে তালগোল পাকিয়ে বুমেরাং হয়ে গেল হত্যা পরবর্তী সময়ে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে পরিবেশমন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন দলের মুখপাত্রদের অসংলগ্ন মন্তব্যেও প্রকৃত সত্য ঢেকে রাখা গেল না। 'ঠাকুর ঘরে কেরে, আমি কলা খাই না' জাতীয় কথাবার্তায় বিশ্বজিৎ হত্যার দায়ীরা আজ দেশবাসীর কাছে সন্দেহাতীতভাবে চিহ্নিত।১২ কিন্তু বিশ্বজিৎ এর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে লাভ অথবা ক্ষতি কী হয়েছে? তবে অন্তত একটি বিষয় আগের তুলনায় আরও স্পষ্ট হয়েছে সেটা হলো জাতীয়তাবাদী চেতনা চরম অবক্ষয় ঘটেছে।সুতরাং স্বাধীনতার ৪১ বছর পরেও আমাদের অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক ধারায় বা অসাম্প্রদায়িক বডি পলিটিকে (ইড়ফু ঢ়ড়ষরঃরপ) রাজনৈতিক ফায়দা লাভের জন্য যদি সাম্প্রদায়িক হিসাব-নিকাশের দরকার হয়, তাহলে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী, ভাষাতাত্ত্বিক জাতীয়তাবাদী চেতনায় আমরা কতখানি বিজয়ী হয়েছি এ প্রশ্ন অবশ্যই করা যায়?১৩ উত্তরটা সম্প্রতি রামুর ধ্বংসলীলা ও বিশ্বজিৎ হত্যার মধ্যেই পাওয়া যায়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে বিশ্বজিৎ এর জায়গায় যদি একজন জামায়াত সমর্থক থাকতো তবে কি তাকে মারা উচিত হতো? বিষয়টি একটু তলিয়ে দেখা দরকার। কে এই জামায়াত? '৪৭ পূর্ব এবং '৪৭ পরবর্তী এদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা এখানে না টেনে শুধু মুক্তিযুদ্ধের সবার জানা এদের ভূমিকা নিয়ে সেই সময়কার বিদেশি পত্র-পত্রিকা কী লিখেছে সে সম্পর্কে কিছু বলা যেতে পারে। ১৯৭১ সালের ২ জুন 'লন্ডন টাইমস' লিখেছে, 'ছাত্ররা তাদের বিছানায় মারা গেছে, নারী ও শিশু তাদের ঘরে জীবন্ত অগি্নদগ্ধ হয়েছে।' ৩ মার্চ ডেইলি টেলিগ্রাফ লিখেছে, একজন বৃদ্ধ যখন সিদ্ধান্ত নিলেন সান্ধ্য আইনের চেয়ে শুক্রবারের নামাজ অধিক গুরুত্ববহ, তখন তিনি মসজিদের দিকে পথচলা আরম্ভ করলেন। আর কিছু দূর যেতে না যেতেই বৃদ্ধকে গুলি করে হত্যা করা হলো। ২৭ মে টেলিগ্রাফ লিখেছে, আলবদর বাহিনী দিয়ে হালুয়াঘাটে যুবকদের একত্রিত করে পাকিস্তানি সৈন্যরা জানায় যে, আহত পাকিস্তানি সৈনিকদের জন্য রক্তের প্রয়োজন। রক্ত দেয়ার জন্য যুবকদের শুয়ে পড়ার পরামর্শ দেয়া হলো। আর যুবকরা যখন শুয়ে পড়ল তখন তাদের শরীরে সুই ঢুকিয়ে রক্ত নেয়া আরম্ভ করল। ছেলেগুলো রক্তশূন্য হয়ে মরে যাওয়া পর্যন্ত সুই তুলে নেয়া হলো না। ১৯৭১ সালের ২ আগস্ট নিউইয়র্ক ম্যাগাজিন লিখেছে ৫৬৩ জন বাঙালি যুবতীকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে রাখা হয়েছে। পাকিস্তানি সৈন্যরা পর্যায়ক্রমে এসব যুবতীর সঙ্গে যৌনাচারে লিপ্ত হয়। অধিকাংশ যুবতী বর্তমানে গর্ভবতী।ইতিহাসের এসব জলন্ত সাক্ষ যথার্থই প্রমাণ করে অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ ও মুক্তিযুদ্ধের চরম দুশমনদেরকে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগীতা করেছে জামায়াত। আর সেই জন্যই জামায়াত অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী জনগণের শত্রু। এই চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের অত্যাচারের প্রতিশোধের নেশাই হয়ত অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী জনগণকে ক্ষিপ্র করে তোলে। "নির্মম নিষ্ঠুর পাকি বাহিনীকে সহযোগিতা করতে যারা পাপবোধ করেনি বরং ইসলাম রক্ষার জেহাদ বলে ধর্মীয় লেবাস পরানোর চেষ্টা করেছে, তাদের মতো নরপশুদের বিচার না করাও আরেকটি পাপ। বিচার এড়িয়ে যাওয়া হবে আমাদের আরেকটি পাপ।"১৪ এ ধরনের বিশ্বাসও এক ধরনের সহিংসতার ইঙ্গিত দেয়।

অন্যদিকে, সম্প্রতিক সময়ের আরেকটি নৃশংসতা ঘটেছে রামুতে। রামুর ঘটনাটি বাংলাদেশের মানুষের চেতনাবোধের জায়গাকে অন্যভাবে প্রশ্নের সম্মূখীন করেছে। এ ঘটনাটি ইসলামী জাতীয়তাবাদী ধারণা থেকেও বিশ্লেষণের দাবি রাখে।আমাদের জাতীয়তাবাদী পরিচয় কী?এ নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে নোংরামীর কোন ঘাটতি নেই। এমনকি বঙ্গবন্ধ থেকেও এমন উদাহরণ দেয়া যায়। তিনি পাহাড়িদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন "তোরা সব বাঙালি হয়ে যা' ঠিক যেভাবে পাকিস্তানি শাসকশ্রেণী বলেছিল পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে উদর্ু১৫। এগুলি মূলত এমন কিছু সহিংসতার আগাম বার্তা দেয় যেগুলিকে খোদ জাতীয়তাবাদই ধারণ করে রাখে যুগ যুগ ধরে।

যাহোক রামুর বিষয়টি বিশ্বজিৎ এর প্রেক্ষাপটের নয়। আমাদের জাতি-রাষ্ট্রের মূলে ভাষাতাত্ত্বিক জাতীয়তাবাদ থাকলেও এখনো আমাদের দেশের নিম্নবগীয় ও সাধারণ মুসলমানগেণর (ধর্মীয় রাজনীতির শিকার) মধ্যে ইসলামি জাতীয়তাবোধ কাজ করে,আর তা্রই ফশ্রুতিতে রামুর ঘটনা ঘটেছে (ঘটনাটি অন্যভাবেও ব্যাখ্যা করা যেতে পারে)। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বে ইসলাম বিদ্বেষী কিছু ঘটনা বিশেষতঃ মায়ানমারের সংখ্যলঘু মুসলিম রোহিঙ্গাদের উপর যে নৃশংসতা চালানো হযেছে তা ব্যপকভাব বাংলাদেশের মুসলিমদের ইসলামী জাতীয়তাবাদী চেতনায় কুঠারাঘাত করেছে। ঠিক এমনই সময় রামুর বৌদ্ধপল্লির একটি ছেলের ফেসবুকে ইসলামের অবমাননাকর ছবির ঘটনার মধ্য দিয়ে মুসলমানদের ক্ষোভ ফুঁসলে উঠে যার চরম শিকার হয় বৌদ্দপল্লি অথচ তারাও স্বপ্ন দেখেছিল, অবদান রেখেছিল এদেশের স্বাধীনতায় এবং এদেশটি তাদেরও।একটি সম্প্রদায়ের উপর এমন দলীয় হামলার করণ হিসেবে কি ফেসবুকের ঐ ঘটনাই যথার্থ ছিল নাকি এর পিছনে ইসলামী জাতীয়তাবাদী চেতনা কাজ করেছিল কিংবা ভাষা তাত্ত্বিক জাতীয়তাবাদী চেতনা বিরুদ্ধে একটি সুপ্ত ষড়যন্ত্র ক্রিয়াশীল ভুমিকা রেখেছিল।যাহোক,ভাষাতা্ত্ত্বিক জাতীয়তাবাদের সেই ঐতিহাসিক চেতনাবোধ এখানে কাজে আসেনি আর সে বিপর্যয়ের কারনেই এ নৃশংসতা চলেছে যাতে রাষ্ট্রেরও প্রত্যক্ষ মদদ কাজ করেছে। পত্রিকা মারফতে জানা যায় যে ঐ ঘটনা ঘটেছে প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের চোখের সামনে।

সাম্প্রতিক সময়ের আরেকটি হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে তাজরীন ফ্যাশান নামক গার্মেন্টসে।একই জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ জনগোষ্ঠীর এক দলকে রাষ্ট্র আরেকদলের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিচ্ছে তাজরিন ফ্যাশানের ঘটনা তার জলন্ত উদাহরণ।সাধারণ শ্রমিক পুড়ে ছাঁই হয়ে যাচ্ছে, নরমাংসের ছাঁই-চর্বি পানিতে ভাসছে তারপরও রাষ্ট্র জড়িতদেরকে বিচারের মুখোমুখি করছেনা। মালিকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র এখন পর্যন্ত কোন পদক্ষেপ নেয়নি। তাজরিন ফ্যশানসে ঘটে যাওয়া অগ্নিকান্ডে ১২৪ জন শ্রমিক প্রাণ হারায়। এটি কোন দুর্ঘটনা ছিলনা বরং একটি হত্যাযজ্ঞ, কেননা এ গার্মেন্টসে নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা ছিলনা বললেই চলে যা তাদের ওয়েবসাইটের (যদিও তারা পরে ওয়েব সাইট বন্ধ করে দিয়েছে) তথ্য থেকেও জানা গেছে।বি জি এম ই এবং রাষ্ট্রীয় ছত্রছায়ায় তারা বারবার ধরা ছোয়ার বাইরে থেকেছে।১৫

এখন প্রশ্ন হলো কোথায় আমাদের সেই একুশের চেতনা, জাতীয়তাবোধ যা এদেশের সব জনগোষ্ঠীকে নিয়ে একটি অসাম্প্রদায়িক বৃহৎ জাতিরাষ্ট্র গঠনে ক্রীয়াশীল ভূমিকা রেখেছিল।সেই চেতনা থেকেই হয়ত মিডিয়া বারবার এই ধরনের ঘটনাগুলিকে মানুষের সামনে আনছে কিন্তু তাতে রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ চোখে পড়ছেনা বরং অনেক ক্ষেত্রে মিডিয়ার গলা চেপে ধরার প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। সংখ্যালঘু, প্রান্তিুক কিংবা নিম্নবর্গীয় জনগণ রাষ্ট্রের কোন ধরণের ভূমিকা প্রত্যক্ষ করছে? মুলত রাষ্ট্র বারবার সংখ্যাগরিষ্ট, প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক দলের স্বার্থসিদ্ধিমূলক ভূমিকায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আর একথাও স্পষ্ট যে জাতীয়তাবাদ সবসময় স্বপ্নপুরণ করতে পারেনা বরং তার পরিবর্তে কিছু নৃশংসতাকে ধারণ করে।

বইপত্রঃ

Britannica ready refuence encyclopedia, Volume 7, Eneyeloedia Britanmica (India) Pvt. Ltd., New Delhi and Impulse Marketing, New Delhi, 2005, p 74

২Smith, Anthony D – page 72
৩Lvb, AvKei Avwj, evsjv‡`‡ki mËvi A‡š^lv (Abyev`: fuyBqv Avwgbyj Bmjvg), evsjv GKv‡Wwg, XvKv, 2004, c„-1

৪আহমেদ বখতিয়ার, ভাষা, সংস্কৃতিক ও জাতিসত্ত্বা প্রশ্নে আমাদের জাতিরাষ্ট্র, পৃ-২
৫আহমেদ বখতিয়ার, ভাষা, সংস্কৃতিক ও জাতিসত্ত্বা প্রশ্নে আমাদের জাতিরাষ্ট্র, পৃ-৩
৬বদরুদ্দীন ওমর, পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন এবং তৎকালীন রাজনীতি।
৭পুর্বোক্ত
৮ Britannica ready refuence encyclopedia, Volume 7, Eneyeloedia Britanmica (India) Pvt. Ltd., New Delhi and Impulse
৯আহমেদ বখতিয়ার, ভাষা, সংস্কৃতিক ও জাতিসত্ত্বা প্রশ্নে আমাদের জাতিরাষ্ট্র, পৃ-২
১০পুর্বোক্ত
১১হারাধন গাঙ্গুলী, ঢাকানিউজ24ডটকম/এসডি.
১২পুর্বোক্ত
১৩পুর্বোক্ত
১৪পুর্বোক্ত
১৫কয়েকটি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকীয় বিশ্লেষণ