চেক প্রতারণার রায় হয়, কিন্তু আসামি পাওয়া যায় না

প্রকাশ বিশ্বাসপ্রকাশ বিশ্বাস
Published : 30 Sept 2020, 09:43 AM
Updated : 30 Sept 2020, 09:43 AM

বিশেষ আইনে পরিচালিত চেক প্রতারণার মামলাগুলোর ক্ষেত্রে বিশেষ কারণ ছাড়া অধিকাংশ মামলারই রায় আসে আসামিদের বিরুদ্ধে। এ ধরনের মামলার সহজ ও সুনিদির্ষ্ট বিচার প্রক্রিয়ার  কারণে রায়ের আগে অথবা রায়ের সময় অথবা রায়ের পরে মামলার পরিণতি বুঝতে পেরে আসামি ও দণ্ডপ্রাপ্তদের অনেকেই   কমর্স্থল এবং  বাড়ির  ঠিকানা পরিবতর্ন করে পালিয়ে যান।

আর আসামিরা ধরা না পড়ায়  সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক ও বিভিন্ন প্রকার আর্থিক প্রতিষ্ঠান তুমুল ক্ষতির মুখে পড়ছে। মামলায় সাজার খবর জেনে পালিয়ে  যাওয়া এ  সব দণ্ডিতদের বিরুদ্ধে সরকারি পাওনা আদায় আইনে নিবার্হী হাকিম আদালতে মামলা করতেও পারছে না প্রতিষ্ঠানগুলো। কারণ অর্থ ও ব্যাংকের চেক সংক্রান্ত বিষয় হলেও নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যাক্টের এ মামলাগুলো ফৌজদারি প্রকৃতির; তাই এসব মামলার বিচার হয় দায়রা জজ আদালতে।

ভুক্তভোগী ও মামলা সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের সঙ্গে এ প্রসঙ্গে কথা উঠলে এসব জানার সুযোগ হল।

ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের সেরেস্তা থেকে পাওয়া এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী,  ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে নিগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যাক্টে  দায়ের করা বিচারাধীন মামলা সংখ্যা ৫০ হাজারের মত। আর এ বছর জানুয়ারি থেকে অগাস্ট পযর্ন্ত এই আদালতে সাত হাজারের উপর এ ধরনের  মামলা এসেছে।

সাধারণত ভোক্তা ঋণের বিপরীতে ঋণ গ্রহণকারীর বিরুদ্ধে এ ধরনের মামলা দায়ের করা হয়। চেক প্রত্যাখানের প্রতিক্রিয়ায় নেগাশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট আইনের মামলা চলে ব্যবসার ঋণ অথবা শিল্প ঋণের ক্ষেত্রেও। এসব দ্বিতীয় প্রকার ঋণে সম্পত্তি,  জমি , বাড়ি, ফ্ল্যাটের দলিল বন্ধক রাখা হয় ব্যাংকে বা অন্যান্য আথির্ক প্রতিষ্ঠানের কাছে। সে কারণে অর্থ ঋণ মামলায় ঋণ আদায়ে ঋণ গ্রহীতারা পালিয়ে গেলেও খুব বেশি সমস্যায় পড়তে হয় না ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে; আংশিক হলেও আদায় করা যায়।

এসব ঋণে মূল্যবান কোনো সম্পত্তি বা জমি বন্ধক বা জামানত রাখা হয় বলে খেলাপি ঋণ গ্রহীতার বিরুদ্ধে অর্থ ঋণ আদালতে মামলা করা যায়। মামলায় খেলাপি ঋণ গ্রহিতা  প্রতিদ্বন্দিতা না করলে বা তার বিরুদ্ধে একতরফা বা দোতরফা রায়  পেলে ঋণদাতা আথির্ক প্রতিষ্ঠান অর্থ জারি মামলা করে ঋণের বিপরীতে জমা দেওয়া বন্ধকি সম্পত্তি নিলামে তুলতে পারে। আর  তা থেকে পাওয়া অর্থ  পাওনা হিসাবে ব্যাংক প্রতিষ্ঠান আদায় করতে  সক্ষম হয়।

কিন্তু ভোক্তা ঋণে যেহেতু কোনো স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি বন্ধক রাখা হয় না। সেহেতু  এ ধরনের ঋণের টাকা উদ্ধারে কোনো মূল্যবান কিছু নিলামে তুলে তা থেকে পাওনা  আদায় সম্ভব হয় না। সেক্ষেত্রে সরকারি পাওনা আদায় আইনের শরনাপন্ন হতে নিবার্হী হাকিম আদালতে আলাদা মামলা করতে হয়। তাতে করে ভোগান্তি বাড়ে ঋণদাতাদের।

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঋণ গ্রহীতারা তাদের প্রত্যাখাত হওয়া চেকের  মামলায় দণ্ডের রায় ঘোষণার আগে বা পরে পালিয়ে যান; ঠিকানাও পরিবতর্ন করেন। সঠিক বতর্মান ঠিকানা না পেলে তাদের বিরুদ্ধে সরকারি পাওনা আদায় আইনে আদালত থেকে নোটিশ পাঠানো যায় না।

ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসলি আবদুল্লাহ আবুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল এ নিয়ে।

তিনি বললেন,  "এসব মামলার দণ্ডিতদের গ্রেফতারে পুলিশ মনোযোগ দেয় না।"

সাজার মেয়াদ যাই হোক না কেন, দেশের আর্থিক কাঠামো সংশ্লিষ্ট এসব মামলায় দণ্ডিতদের 'পার পেয়ে যাওয়া' কোনো 'শুভ লক্ষণ নয়' বলে মন্তব্য করেন আইনজীবী আবদুল্লাহ আবু।

দেশের প্রথম সারির ব্যাংকগুলোর মধ্যে অন্যতম আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের অর্থায়নে পরিচালিত ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের এন আই অ্যাক্টের মামলার পলাতক বা আত্মগোপনকারী খেলাপি ঋণগ্রহীতার বিপরীতেও ব্যাংকের বড় অংকের পাওনা রয়েছে।

এদের মধ্যে অধিকাংশ সংখ্যক পলাতক খেলাপি ঋণগ্রহীতার বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনি ব্যাবস্থায় ঋণ আদায়ের জন্য অর্থঋণ আদালত এবং ফৌজদারী আদালতে অর্থ আদায়ের জন্য মামলা দায়ের করা হয়েছে।

তবে এ বছর  ও গত বছরের আসামিদের মধ্যে ৪২ জনের বিরুদ্ধে আদালতের রায় এবং সাজা পরোয়ানা জারি হওয়ার পরেও তাদের খুঁজে না পাওয়ার কারণে ওই সাজা পরোয়ানা এবং রায় কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।

ব্যাংক কর্তৃপক্ষের ভাষ্য ও এ বিষয়ে বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, এইসব সুযোগসন্ধানী ঋণখেলাপিদের অনেকেই যেমন দেশে গা ঢাকা দিয়ে আছে, আবার অনেকে ব্যাংকের পাওনা পরিশোধ না করেই দেশের বাইরে যেমন, ভারত, মালয়েশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, উত্তর এবং দক্ষিণ আমেরিকা এবং আফ্রিকায় আশ্রয় নিয়েছে।

ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতসহ দেশের অন্যান্য দায়রা জজ আদালতের গত পাঁচ বছরে  চট্টগ্রামের পাহারতলীর  মোহাম্মদী  ট্রেডাসের সত্ত্‌বাধিকারী মোহাম্মদ আসলামের কাছে ১৫ কোটি ৬৪ লাখ টাকা,  নরসিদীর  এস বি টেক্সটাইলের  মোহাম্মদ হাফিজুল ইসলামের বিরুদ্ধে  ১২ কোটি ৪৩ লাখ টাকা, চট্টগ্রামের দক্ষিণ খুলশীর এ এইচ চৌধুরি অ্যান্ড কোম্পানির মালিক  আনোয়ারুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে  ৫ কোটি ৮৫ লাখ টাকা,নারায়ণগঞ্জের মের্সাস ফাতিন টেক্টাইলের সত্ত্বাধিকারী শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে  ৫ কোটি ৮৮ লাখ টাকা, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের  এস কে ট্রেডার্সের শওকত ইকবালের কাছে ৯২ লাখ ৫০ হাজার টাকা , দিনাজপুরের বেন এক্স সোলারের মালিক  মো. রবিউল হক চৌরির বিরুদ্ধে  ৭০ লাখ টাকা, নরসিংদীর মাধবদীর মেসার্স  সানিয়া  ডেইরি অ্যান্ড পোলট্রি  ফার্মের  নাজমা আক্তারের বিরুদ্ধে ২২ লাখ ৩৯ হাজার টাকা, হবিগঞ্জ মাধবপুরের মেসার্স সজ্জার সালাউদ্দিন ভূইয়া এবং মেজবাহ উদ্দিন ভূইয়ার বিরুদ্ধে ১১ লাখ ৫০ হাজার টাকা , সিলেটের মেসার্স অ্যাবাকাস কম্পিউটারের আলী মো. বদরুদ্দোজা সপুর বিরুদ্ধে ১০ লাখ ৪৫ হাজার টাকা, কুমিল্লার আহমেদ মুনীর হোসেনের বিরুদ্ধে ১০ লাখ টাকা, ঢাকার মো. রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে ৭ লাখ ৯২ হাজার টাকা, ইসমাইল মো. সাদের বিরুদ্ধে ৭ লাখ টাকা, রংপুরের মেসার্স আদুরি এন্টারপ্রাইজের আদুরি রানী সিংয়ের বিরুদ্ধে ৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা, ঢাকার আনিসুজ্জামানের কাছে ৫ লাখ ৩৭ হাজার টাকা, খুলনার ফ্রেন্ডস ইলেকট্রো ওয়ার্ল্ডের বিরুদ্ধে ৫ লাখ ১৩ হাজার টাকা প্রতারণার রায় দিয়েছে।

এসব রায় অনুসরণ করে দেখা গেল, আসামির বিরুদ্ধে রয়েছে এক বছর সহ আইনে  বেঁধে দেওয়া বিভিন্ন মেয়াদের বিনাশ্রম কারাদণ্ডও।

এক ভুক্তভোগী ব্যাংকের জনসংযোগ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হলে তিনি বললেন, সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ বা ইমগ্রেশন কর্তৃপক্ষ পলাতক এসব দণ্ডিতদের  নাগাল পায়নি।

"দণ্ডিতরা ঠিকানা  পরিবতর্ন করায় আইন ও আদায়কারী  বিভাগ বাধ্য হয়েই  আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারস্থ হয়। কিন্তু  তাতে কোনো কাজ হচ্ছে না।"

সরকারি খাতের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ঢাকা জুরাইন শাখায় প্রতারণার অভিযোগে  ১১ দণ্ডিতের বিরুদ্ধে মোট  ২৩ লাখ ৬৮ হাজার নয়শ আটান্ন টাকার রায় হয়। এসব রায় হয় ২০১৭ সাল  থেকে ২০২০ সালের বিভিন্ন সময়ে ।

কৃষি ব্যাংকসহ ১৭টি আথির্ক প্রতিষ্ঠানের আইনজীবী মুহাম্মদ শফিকুর রহমানের সঙ্গে কথা হলে তিনিও পুলিশের ঢিমেতালে উদ্যোগের কারণে আসামিরা ধরা পড়ছে না বলে মন্তব্য করলেন।

আরো কয়েকটি ব্যাংকের বিভিন্ন পদে থাকা কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ হলে তারা বললেন, ব্যাংক আদালতের রায় এবং সাজা পরোয়ানা কার্যকর করে পাওনা আদায়ের জোর তদ্বির চালালেও আসামিরা পলাতক থাকায় তা সম্ভব হচ্ছে না।

'বিদেশে পলাতক' আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতের রায় কার্যকর করার জন্য ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষকেও পত্র মারফত অনুরোধ করা হয়েছে  ভুক্তভোগী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে। অন্যান্য পলাতকদের বিষয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তিও দেওয়া হয়েছে এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সাথে নিয়মিত যোগাযোগও রক্ষা করা হচ্ছে।

ব্যাংকের কর্মকর্তাদের অনেকেই বললেন, পলাতক খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের বিষয়ে কোনো তথ্য, গ্রেফতার ও সন্ধানে পুলিশ বিভাগের সঙ্গে যোগোযোগ করেও কোন সুরাহা পাচ্ছেন না তারা।

পলাতকদের ধরতে না পারা নিয়ে সবারকে পুলিশকে দায়ী করার কথা জানালে ঢাকার ইমিগ্রেশন বিভাগের পুলিশ  কমর্কতা মুশফিকুর রহমান বলেন,  "আমি এ বিভাগে নতুন। এটা আমাদের মালিবাগ পুলিশের বিশেষ শাখা সংশ্লিষ্টরা বলতে পারবেন।"

আমার পেশাগত কাজের কারণে ঢাকার মহানগর পুলিশ কমিশনার কার্যালয়ের একজন নারী কর্মকর্তার কাছেও এই প্রশ্ন  রাখার সুযোগ করে নিয়েছিলাম।

তিনি বলেন,  "আসামিদের ঠিকানার সংশ্লিষ্ট থানায় সাজা পরোয়ানা পাঠানো হলে অবশ্যই পুলিশ উদ্যোগ নেয়। এসব বিষয়ে অবহেলা করি না।"

তবে এর উল্টো কথাই বলছিলেন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে  নিয়মিত আইনজীবী মো. শাহীনুল ইসলাম রিজভী।

তিনি বলেন, "এনআই অ্যাক্টোর মামলায় ইতোমধ্যে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের  পক্ষে ঋণ খোলাপিদের বিরুদ্ধে নালিশি চেকে বর্ণিত চেকের মামলায় পলাতক আসামির সাজা পরোয়ানা সংশ্লিষ্ট থানায় পৌঁছানোর পরও আসামিদের গ্রেফতার করা সম্ভব পর হচ্ছে না।"

এ নিয়ে নিজের  অভিজ্ঞতা  'তিক্ত' বলেও জানালেন এই আইনজীবী।

শাহীনুল ইসলাম রিজভী বলেন,   "আদালতের কর্মচারীরা বলেন,  সাজা পরোয়ানা পাঠিয়ে দিয়েছি। থানা থেকে বলে পাই নাই। দুই তরফের অবহেলায়  অর্থকড়ি-উপঢৗকনের লোভে এগুলোর কোনো হদিস মেলে না।

"বছরের পর বছর সাজা  পরোয়ানা চাপা পড়ে থাকে। পলাতকরা তাদের গুহা থেকে বেরিয়ে এসে নতুন ভাবে অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে আবারো ঋণ নিয়ে একই দুষ্টচক্রের জন্ম দেয়।"

পুলিশি তৎপরতায় কমতির কথা উঠে এল সোনালী ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংকের আইন পরামর্শক কৃষ্ণপদ ভৌমিকের সঙ্গে আলাপের সময়ও।

তিনি বলেন, "আমাদের পুলিশ বিভাগের সময়ের স্বল্পতা বলুন আর অবহেলা বলুন … তাছাড়া অনেক সময় পুলিশ কর্মকর্তাদের উপহার বা রাহা খরচ দিতে ব্যথর্তায় এসব পরায়ানা টেবিলের ড্রয়ারে পড়ে থাকে।  আবার অনেক  সময় রাজনৈতিক পরিচয়েও পুলিশের  অভিযান থেকে পার পেয়ে যান অনেকে।"

তবে তার কাছ থেকে জানা গেল, দণ্ডিতদের মধ্যে অধিকাংশেই বাংলাদেশ ব্যাংকের কালো তালিকাভূক্ত হয়ে যান বলে এরপর তারা আর কোনো ব্যাংক থেকে ‍ঋণ নেওয়ার সুযোগ পান না।