উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থা: সাম্রাজ্যবাদ, ভারত ও তাঁবেদার শাসকশ্রেণীর স্বৈরশাসনেরই মূর্ত প্রকাশ

প্রগতির পরিব্রাজক দল-প্রপদ
Published : 25 Oct 2012, 03:57 PM
Updated : 25 Oct 2012, 03:57 PM

গত কয়েকদিনের ঘটনার দিকে চোখ রাখলে যে কেউ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভয়াবহ দুরবস্থার চিত্র স্পষ্ট হতে পারবেন। সম্প্রতি ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার ফি বৃদ্ধি প্রতিবাদে আন্দোলনরত ছাত্রদের উপর প্রশাসনের মদদে হামলা করেছে ছাত্রলীগ। অথচ এ ঘটনায় প্রশাসন আন্দোলনরত ছাত্র ফ্রন্টের ৯ নেতা-কর্মীকে এক সেমিস্টারেরর জন্য বহিঃষ্কারসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে। ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। ময়মনসিংহের ঘটনার প্রতিবাদ করতে গেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনের মদদে প্রগতিশীল ছাত্র জোটের নেতা-কর্মীদের বেধড়ক পিটিয়েছে পুলিশ। শিক্ষাঙ্গণে একদলীয় আধিপত্য বিস্তারের জন্য ছাত্রলীগ-শিবিরে সংঘাত ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সিলেট এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে আগুন দেয়ার ঘটনার পর রাজশাহীতে পুলিশের সামনেই ছাত্রলীগ কেডারদের পিস্তল উঁচিয়ে গুলি করার দৃশ্য সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। দিনাজপুর কলেজেও তারা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় ক্যাডারদের নিয়োগসহ নিয়োগ বাণিজ্যে আধিপত্য বিস্তারের জন্য ছাত্রলীগ একমাস ধরে শিক্ষাঙ্গণ অচল করে রেখেছে। এদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের আভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে শাটল ট্রেন বন্ধ রয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘাতের আশঙ্কা প্রকাশ করে গোয়েন্দা রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। এগুলো কোন আকস্মিক ঘটনা নয়; নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এদিকে ৩ অক্টোবর ২০১২ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছেন, তার সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ও স্বচ্ছতা নিশ্চত করতে উচ্চশিক্ষা কমিশন নামে একটি বিধিবদ্ধ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান গঠনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু এর ফল কি হবে? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসন আরো খর্বিত হবে। শিক্ষার বিষয়বস্তু ও মান নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গণতান্ত্রিক ক্ষমতা চলে যাবে আমলাতন্ত্রের হাতে। প্রধানমন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন রক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বনির্ভর হতেও নসিহত করেছেন। আমরা জানি, এসব ঘোষণা নতুন কিছু নয়। এটা মূলতঃ সাম্রাজ্যবাদী ও অগণতান্ত্রিক জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ ও ইউজিসির কৌশলপত্র বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতা মাত্র।

উচ্চশিক্ষার সাম্রাজ্যবাদী পুনর্গঠনের পাশাপাশি যখন শিক্ষাঙ্গণে অবাধ নৈরাজ্য চলছে, তখন এর বিরুদ্ধে ছাত্র-শিক্ষকদের প্রতিরোধও গড়ে উঠতে শুরু করেছে। সম্প্রতি বুয়েট ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্নীতি, শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা ইত্যাদি অভিযোগের প্রতিকারসহ উপাচার্যের পদত্যাগ দাবীতে আন্দোলন হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি বিক্রি করে দেয়াসহ দুর্নীতির অভিযোগে খুলনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছে। নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে। রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর উপর আরোপিত নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণ বিধির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছে শিক্ষার্থীরা। রাজশাহী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধেও একই ধরণের অভিযোগের আঙ্গুল উঠেছে। একই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসু নির্বাচন দেয়ার দাবী উঠছে।

গত দুই দশকে সাম্রাজ্যবাদী নীতি অনুসরণ করে বেতন-ফি বৃদ্ধি, ক্ষমতাসীন দলের ব্যক্তি ও সংগঠনের হত্যা-সন্ত্রাস, অগণতান্ত্রিক প্রক্টোরিয়াল বিধি সংশোধন, যৌন নিপীড়ন ইত্যাদির বিরুদ্ধে ছাত্র-সমাজ বারবার প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছে। এসব আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আরো পরিপক্ক হয়ে আজকের সংগ্রামগুলো দানা বাঁধতে শুরু করেছে।

দুই দশক জুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সাম্রাজ্যবাদী পুনর্গঠন চলছে এবং ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র-শিক্ষকদের একচেটিয়া আধিপত্য-স্বেচ্ছাচারিতার যে সুকঠিন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে-সারবস্তুতে এ আন্দোলনগুলো তারই বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ইঙ্গিত বহন করছে। এ অবস্থায় বিপ্লবী রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর পক্ষে পরিস্থিতির মূল্যায়ন, আন্দোলনের কর্মসূচি ও কৌশল নির্ধারণের বিশেষ প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতন্ত্র নয়, তাঁবেদার শাসক শ্রেণীর একদলীয় স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে
সমাজের বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক কাঠামোর মধ্যে শিক্ষার লক্ষ্য হচ্ছে বিদ্যমান অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতির সেবা করা। শ্রেণী সমাজে যে শ্রেণী অর্থনীতির মালিক, তারাই রাষ্ট্র ও রাজনীতির মালিক হয়, তাদেরই সংস্কৃতি সমাজে আধিপত্য করে। সুতরাং, শ্রেণীবিভক্ত সমাজে শিক্ষা ব্যবস্থার অংশরূপে উচ্চশিক্ষাও শাসকশ্রেণীর বিদ্যমান অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতিকেই সেবা করে।

বাংলাদেশে মার্কিনসহ সাম্রাজ্যবাদ ও ভারত এবং তাদের তাঁবেদার শাসকশ্রেণী বিদ্যমান অর্থনীতির মালিক। তারাই রাষ্ট্র-রাজনীতির মালিক। সুতরাং বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থা এ শাসক শ্রেণী ও তাদের প্রভুদেরই সেবা করছে।

কেবল বিষয়বস্তুর দিক থেকেই নয়, শিক্ষার কাঠামো, পদ্ধতি, পরিচালনা সবদিক থেকেই শাসকশ্রেণীর চরিত্র ও আকাঙ্ক্ষা শিক্ষার ব্যবস্থায় প্রতিফলিত হয়। অন্যভাবে বললে, বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাই শিক্ষা ব্যবস্থাকে আকার দেয়।

বাংলাদেশে সাম্রাজ্যবাদ ও ভারত এবং তাদের দালাল বড় বুর্জোয়াদের স্বার্থকে সামনে রেখে সমাজ ও রাষ্ট্রের পুনর্গঠন চলমান। তার অংশ হিসাবে চলছে শিক্ষার সাম্রাজ্যবাদী পুনর্গঠন। কিন্তু এ পুনর্গঠন প্রতিক্রিয়াশীল সম্পর্ক ও পশ্চাদপদতার সাথে আপোষ করছে। এ আপোষের প্রতিফলন যেমন ঘটেছে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে তেমনি জাতীয় শিক্ষানীতিতে।
এদেশের বিদ্যমান শাসকশ্রেণীর রাজনৈতিক ব্যবস্থা হল ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরতান্ত্রিক। বর্তমান সংসদীয় স্বৈরতন্ত্রে প্রধানমন্ত্রীই সমস্ত স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতার আধার। তিনি সরকারের প্রধান নির্বাহী, সংসদের প্রধান নেতা এবং দলেরও প্রধান। তার হাতেই দলের নেতা, সংসদ নির্বাচনের প্রার্থী এমন কি গণ ও ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্ব নির্বাচনের একচেটিয়া ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছে। রাষ্ট্রের যে কোন কর্মচারি নিয়োগও দল ও নেতৃত্বের হাতে কেন্দ্রীভূত। যে কোন ব্যবসার সুযোগ অথবা অপরাধের দায়মুক্তি প্রদানের ক্ষমতাও তার হাতে রয়েছে। এ কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার কারণেই দল এবং দলের ঊর্ধ্বে নেতার প্রতিই দলীয় নেতা-কর্মী, সাংসদ, গণসংগঠনের নেতা, ব্যবসায়ী, রাষ্ট্রীয় কর্মচারি সকলের আনুগত্য নিবিষ্ট হয়। জনগণের প্রতি, সংশ্লিষ্ট সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের প্রতি তাদের কোন দায়বদ্ধতা থাকে না। বুর্জোয়া বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লেবাসে শাসকশ্রেণী 'এক নেত্রী, একদল, এক দেশ' নীতিই বাস্তবায়ন করছে। অপরদিকে, সংবিধানের ফ্যাসিকরণ, দমনমূলক আইন প্রণয়ন, পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করার পাশাপাশি আইন বহির্ভূতভাবে ক্রস-ফায়ার, হত্যা-গুম এবং দলীয় সন্ত্রাসীদের প্রকাশ্য সন্ত্রাস ইত্যাদির মাধ্যমে শাসকশ্রেণীর শাসন ফ্যাসিবাদী রূপ নিয়েছে।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আজ সবদিক থেকেই সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতের তাবেদার শাসক শ্রেণীর ফ্যসিস্ট ও দলীয় স্বৈরতান্ত্রিক রূপ নিয়েছে। এ ব্যবস্থা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার বিষয়বস্তু, পদ্ধতি, অর্থায়ন এবং প্রশাসনের ইত্যাদি মৌলিক ক্ষেত্রে কি আকার ধারণ করেছে তা খতিয়ে দেখলে আমরা আরও স্পষ্ট হব- বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান নৈরাজ্যিক পরিস্থিতি-এ ব্যবস্থারই ফলাফল মাত্র।

শিক্ষার বিষয়বস্তু ও পদ্ধতি
প্রকৃতি বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাসের মত বিষয়গুলোর জাতীয় বিকাশের জন্য অপরিহার্য হলেও ইউজিসির উচ্চশিক্ষার কৌশলপত্রে এসব বিষয় উপেক্ষিত হয়েছে। এতে বাজারের প্রয়োজন মেটানোর উপযোগী শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ডেভেলপমেন্ট ইকনমিকস, পপুলেশন সাইয়েন্স, পিস এন্ড কনফ্লিক্ট, আমেরিকান স্টাডিজ ইত্যাদি যেসব নতুন বিভাগ খোলা হচ্ছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে যে গবেষণা হয়ে থাকে বা শিক্ষকরা তাদের পরামর্শক প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেসব বিষয়ে গবেষণা করেন-তাও সা¤্রাাজ্যবাদ ও তাঁবেদার শাসকশ্রেণীর নিত্য প্রয়োজনকেই সেবা করছে। বাজারের খোরাক যোগাবার জন্যই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সান্ধ্যকালীন কোর্সগুলোও চালু করা হয়েছে। অন্যদিকে, আরবি, সংস্কৃত, ইসলামের ইতিহাসসহ বিভাগপূর্ব সামন্তবাদী ও সাম্প্রদায়িক চেতনাজাত পশ্চাদপদ বিষয়বস্তুগুলো আজও সযতেœ লালিত হচ্ছে। খোলা হয়েছে ঊর্দু বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, আরবি বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রেও সেক্যুলার ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি উপেক্ষিত হচ্ছে। জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ নিশ্চিত করেছে ভারতীয় শাসকশ্রেণী ও তার তাঁবেদারদের উপযোগী নৈতিক শিক্ষা। নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগে ভারতীয় হাই কমিশন প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে।
শিক্ষাপদ্ধতিতে সমাজ ও জনবিমূখতা, উৎপাদন ও প্রয়োগ বিচ্ছিন্ন মুখস্তপনা ও তত্ত্বের কচকচি প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ও শিক্ষা শেষে কাজের সাথে কোন সামঞ্জস্য নেই।

অর্থায়ন
ইতিহাসে বিশ্ববিদ্যালয় বিপ্লব হিসাবে পরিচিত ১৯১৮-২১ সাল পর্যন্ত ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে সংঘটিত গণতান্ত্রিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার যে আন্দোলন, তাতে শিক্ষার্থীরা টিউশন ফি মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবী হাজির করেছিল। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে রাষ্ট্রের সকল নাগরিকদের জন্য একাডেমিক যোগ্যতার ভিত্তিতে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ অবাধ করার স্বার্থেই এ দাবী তোলা হয়েছিল। যার লক্ষ্য ছিল ধনী ও অভিজাত শ্রেণীর একাধিপত্য থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে মুক্ত করা। একটি গণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা।

এদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও সুলভ ও সমান শিক্ষার সুযোগের দাবী উঠেছে বারবার। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষার সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী পুনর্গঠনের কারণে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ তরান্বিত হয়েছে। একারণেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমোদন, নতুন স্থাপিত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চ হারে টিউশন ফি নির্ধারণ ও রাষ্ট্রীয় মঞ্জুরি প্রদান না করা, পুরনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ধাপে ধাপে বেতন-ফি বৃদ্ধি, সান্ধ্যকালীন বাণিজ্যিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা, স্বনির্ভর হওয়ার নামে সাম্রাজ্যবাদী বিভিন্ন সংস্থা, এনজিও, বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের অনুদান নির্ভরতা সৃষ্টি ইত্যাদি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী বিরাষ্ট্রীয়করণ ও বাজার নীতি কার্যকর করার ফলে উচ্চশিক্ষা সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সেবায় সম্পূর্ণ নিয়োজিত হয়ে পড়ছে। উপেক্ষিত হচ্ছে জাতীয় স্বার্থ। অন্যদিকে শিক্ষা পণ্যে পরিণত হওয়ায় উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে একাডেমিক যোগ্যতার স্থান দখল করেছে অর্থনৈতিক সক্ষমতা। এভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে সমানাধিকারের নীতি সম্পূর্ণ বর্জিত হয়েছে। নব্বই-এর পরেও বাৎসরিক টিউশন ফি ছিল মাত্র কয়েক শত টাকা। সেখানে আজ বছরে হাজার হাজার-লক্ষ লক্ষ টাকার শিক্ষা খরচের দায় চেপেছে শিক্ষার্থীদের কাঁধে। এতে শ্রমিক-কৃষকের সন্তানদের জন্য উচ্চশিক্ষা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে মধ্যবিত্ত অভিভাবককে তার সারা জীবনের সম্বল তুলে দিতে হচ্ছে শিক্ষা ব্যবসায়ীদের হাতে।

প্রশাসন
বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর আনুকূল্যে নির্বাচন ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হচ্ছে। উপাচার্য তাই একাডেমির প্রতি নয়, অনুগত থাকছেন প্রধানমন্ত্রীর বরাবর। তিনি নিজেই স্বৈরাচারের ক্ষুদ্র সংস্করণ হয়ে উঠছেন। একারণেই দেখা যায়, তীব্র আন্দোলনের মুখেও উপাচার্যরা প্রধানমন্ত্রীর ইশারা ছাড়া পদত্যাগ করেন না। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারপন্থী শিক্ষক ও ছাত্র সংগঠনের স্বৈরতন্ত্র কায়েমে নেতৃত্ব দিচ্ছেন উপাচার্য । শুধু ভিসি নন প্রো-ভিসি ও ট্রেজারাদেরও প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেন। সরকারি মন্ত্রীত্ব, রাষ্ট্রদূত, ব্যাংক-প্রধান ইত্যাদি নানা সুযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী বিতরণ করছেন। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় মিলছে সাম্রাজ্যবাদী গবেষণা ও কনসাল্টেন্সির সুযোগ। এভাবে শিক্ষকদের একাংশের দলবাজ হিসাবে অধঃপতন ঘটছে। শিক্ষকদের এ শক্তিশালী দলীয়চক্রটি শিক্ষক নিয়োগে, প্রশাসনের পদ ও সুযোগ-সুবিধা বণ্টনে কড়াকড়ি দলীয় মানদ- বজায় রাখেন। ফলে ব্যাপক শিক্ষকদেরও দলীয়করণ ঘটেছে। সিনেট, সিন্ডিকেট, শিক্ষক সমিতি সব কিছুই সর্বগ্রাসী দলীয়করণে পতিত হয়েছে। একারণেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য শরীফ এনামুল হক জনপ্রিয় আন্দোলনের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হলেও কয়েকদিন পর উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনে সিনেটে সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছেন। এতে কেবল দলতন্ত্র গড়ে উঠছে তা নয়, একাডেমিক যোগ্যতা বিচারের বালাই না থাকায় তার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে-একাডেমিক মানের অবনতিতে। দলবাজ একাডেমিশিয়ানদের কল্যাণে শিক্ষার মানের কি অবস্থা দাঁড়িয়েছে তা গবেষণা ও প্রকাশনার দুরাবস্থার দিকে তাকালেও বোধগম্য হবে। আর এর সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরতন্ত্রের কেবল দলীয়রূপই নয়, প্রশাসনিক রূপও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শিক্ষার সাম্রাজ্যবাদী পুনর্গঠনের লক্ষ্যে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এবং ইউজিসির ২০ বছর মেয়াদী উচ্চশিক্ষার কৌশলত্রে উচ্চশিক্ষার মান নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রতিষ্ঠা, অনাবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, শিক্ষাঙ্গণে রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ, ছাত্র সংখ্যা সীমিতকরণ ইত্যাদি সিদ্ধান্ত রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি নির্ধারণী সংস্থায় এনজিও কর্তা, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবসায়ী এবং বড় ব্যবসায়ীদের যুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। ফখরুদ্দিনের সামরিক বাহিনী সমর্থিত সরকারের আমল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পুলিশি খবরদারি বৃদ্ধি পেয়েছে। এসময় থেকে ছাত্র আচরণ বিধি প্রণয়ন, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে সিসি ক্যামেরা ব্যবহার করে শাস্তি প্রদান, প্রশাসনের মদদে হামলা এবং শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা করা, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে নিষেধাজ্ঞা, খবরদারি ও সুযোগ-সুবিধা হ্রাস ইত্যাদির মাধ্যমে ছাত্রদের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো খর্ব করার প্রয়াস চালানো হচ্ছে। ১৯৯০ সালের পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-সংসদ নির্বাচন বন্ধ রয়েছে। ফলে সিনেটেও ছাত্র প্রতিনিধি নেই। '৭৩-এর আদেশ অনুযায়ি সিন্ডিকেটে ছাত্রদের প্রতিনিধিত্বের সুযোগ নেই। অথচ সিন্ডিকেট ও সিনেটে সরকারি আমলা, রাজনীতিকদের অংশগ্রহণের সুযোগ রাখা হয়েছে, যা নীতিনির্ধারণী সংস্থাগুলোতে সরকারি আধিপত্যকে নিরঙ্কুশ করে তুলেছে। বর্তমান পরিস্থিতি এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক স্বায়ত্তশাসনের উপর সরকারের খবরদারি করার সুযোগ বৃদ্ধি, বিরাজনীতিকীকরণ, শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমন ইত্যাদির মাধ্যমে একাডেমিক-প্রশাসনিক ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

এদেশে শাসকশ্রেণীর ছাত্র সংগঠনের নেতারাও নির্বাচিত হন দলীয় প্রধানের দ্বারা। সরকার দলের এ নেতারা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বৈরতন্ত্র কায়েম করেন। আবার তাদের আনুকূল্য প্রাপ্ত নেতারা হলে হলে স্বৈরাচারি ব্যবস্থা কায়েম করেন। ১৯৯০ সালের আগে যে শিক্ষাঙ্গণে যেটুকু গণতান্ত্রিক চর্চার সুযোগ ছিল। নব্বইউত্তর তা ক্রমশ সংকুচিত হয়ে নিঃশেষিত হয়ে গেছে। হলে কোন ছাত্রের বা গণতান্ত্রিক সংগঠনের এমন কি শাসকশ্রেণীর বিরোধী দলগুলোরও বাক স্বাধীনতা, মত প্রচার ও সংগঠন করার স্বাধীনতা নেই। ছাত্রদের মধ্যযুগীয় কায়দায় সরকার দলের সংগঠন করতে বাধ্য করা হয়। গেস্টরুমগুলোতে একটি সমান্তরাল প্রশাসন সৃষ্টি করেছে সরকার দলের ছাত্ররা। এটাকে টর্চার সেল বললেও ভুল হবে না। এখান থেকে হলের আসন বণ্টন নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সরকার দলের প্রতি আনুগত্য না দেখিয়ে হলে থাকাও অসম্ভব করে তোলা হয়েছে। নবীন ছাত্রদের জোর করে তাদের ঠেঙ্গারে বাহিনীতে যুক্ত করছে। দিচ্ছে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ। সরকারি ছাত্র সংগঠনের এ আধিপত্য বজায় থাকার সাথে যোগ রয়েছে টেন্ডার ও চাঁদাবাজি, চাকুরি ও ব্যবসা প্রাপ্তির যোগ। তবে তাদের অন্তঃকোন্দল ও ত্রাস শিক্ষার পরিবেশকে করে তুলেছে বিষাক্ত। আধিপত্য বজায় রাখার স্বার্থে দলীয় শিক্ষক ও ছাত্র-সংগঠনের পারস্পরিক পৃষ্ঠপোষকতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ স্বৈরাতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সার্বিক ব্যবস্থায় পরিণত করেছে।

সার কথায়, বিশ্ববিদ্যালয় আজ সাম্রাজ্যবাদ, ভারত ও তাদের তাঁবেদার শাসকশ্রেণীর স্বৈরশাসনেরই মূর্ত এক প্রকাশ।