মা দিবস ও আমার নীরবতা

পার্থ তালুকদার
Published : 15 May 2017, 03:39 AM
Updated : 15 May 2017, 03:39 AM

সূর্য যখন সারা দিনের ক্লান্তি শেষে পশ্চিম আকাশে ডুব দিবে তার কিছু আগেই মামার বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে রওয়ানা দিতাম আমরা। আমাদের বাড়ি থেকে মামার বাড়ির দূরত্ব প্রায় দু' কিলোমিটার। সব সময়ই সাথে থাকতেন আমার মা। মায়ের কনিষ্ঠা ধরে সবুজ মেঠোপথে হাঁটা সাত-আট বছরের আমি যেন মায়ের চিরচেনা এই পথের পথ প্রদর্শক। রাস্তার দু'পাশে সবুজ মাঠে ছড়ানো গরুর দলকে দেখিয়ে মা কে বলতাম- এই গরুগুলো যদি আমার হতো মা! মা বলতেন- বাবা, এই রকম বলিস না। পরিশ্রম না করে কিছু চাওয়া ভালো নয় বাবা। আমি বলতাম- কী বলো মা! আমি এত্ত সব গরুর মালিক হবো, সকালে গরুকে তাজা ঘাস খাওয়াবো, প্রচুর দুধ দিবে, আর তুমি কিনা বলছো তা ভালো নয়! মা হাসতেন, আর বলতেন ধর্মকথা, সৎ পথে চলার কথা। আমি তা নিরবে শুনেই যেতাম।

মাঝে মাঝে এমন হতো- মাকে ফেলে দৌঁড়ে কোন ঝোঁপের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে আনন্দ পেতাম আমি। মায়ের মুখ তখন মেঘবরণ ধারণ করত। আবার দৌঁড়ে যখন বেড়িয়ে আসতাম, তখন মা জড়িয়ে বুকে তুলে নিতেন। আর আস্তে করে বলতেন- এমন করিস কেন বাবা?

তখন বর্ষাকাল। আমাদের সেই ছোট্ট নৌকায় মামার বাড়ি যাচ্ছি। চারদিকে পানির থৈ থৈ। পানির মধ্যথেকে উঁকি দেওয়া রঙিন শাপলা ফুল দুদিকে সরিয়ে আমাদের নৌকাটা এঁকেবেঁকে যাচ্ছে। আমি আর শাপলা ফুলের লোভ সামলাতে পারিনি। মায়ের কোল থেকে হুট করে সরে গিয়ে যখন শাপলা ফুল তুলতে যাব ঠিক তখনই আমার পানিতে পড়ে যাওয়ার মত অবস্থা। তখন, মা আমার রাগ সামলাতে পারেননি। আমাকে রাগে-ক্ষোভে কয়েকটি আঘাত করে বসলেন। তারপর মায়ের কী কান্না। তাঁর চোখের পানি আর আমার চোখের পানি সব একই সাথে মিশে একাকার হয়ে গেল।
তারপর আস্তে করে বললেন- এমন করিসনে বাবা!

এভাবে কিছু মাস, কিছু বছর প্রিয় মায়ের সান্নিধ্যে থেকে কখন জানি পঞ্চম শ্রেণী পাস করলাম। এবার বাড়ি ছাড়ার পালা। কারণ ভগবানের স্নেহের পরশ আমাদের ঐ পল্লীগ্রামে লাগেনি। বাড়ি থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে হাই স্কুলের অবস্থান। পায়ে হেঁটে যাওয়া-আসায় অতিক্রম করতে হবে প্রায় ছয় মাইল দূরত্ব। তাই বাবার দুরদর্শিতা, মায়ের পায়ের ধূলো আর চোখের নোনা জল সঙ্গে নিয়ে দিদির বাড়িতে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তির উদ্দেশ্যে বাড়ি ছাড়লাম আমি।

তারপর, আরও কয়েকটি বছর কেটে গেল এভাবে। ছুটিতে বাড়ি গিয়ে মায়ের সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য সবসময় উদগ্রীব হয়ে থাকতাম। বাড়ি গিয়ে হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করলাম আমার স্বল্প শিক্ষিত মা মনযোগ সহকারে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার বড় বড় বই পাঠ করছেন। তাঁর একাগ্রতা ও মেধার সমন্বয়ে রপ্ত করলেন এই চিকিৎসা পদ্ধতি। গ্রামের গরীব-অসহায় রোগীদের সেবা করতেন তাঁর কোমল হৃদয় দিয়ে। এভাবে পার্শবর্তী গ্রাম থেকেও রোগীরা আসতে থাকল। মায়ের এসব কীর্তি দেখে আমি খুবই মুগ্ধ হতাম।

একদিন বাড়ি গিয়ে দেখি অনেক মহিলা এক সাথে জড়ো হয়ে আছেন। মা আমার উনাদের কিছু বলছেন আর সবাই মুগ্ধ হয়ে মায়ের কথা শুনছেন। যখন মাকে বললাম- কী ব্যাপার মা? মা বললেন- সবাই মিলে আমরা মহিলা 'গীতাসংঘ' গঠন করব। আমাদের কাজ হবে ধর্মকথা প্রচার করা, সমাজে নীতিকথা প্রচার করা। আমি অনেক সমস্যার কথা তুলে ধরতেই মা বললেন- দেখ বাবা, কিছু সমস্যা তো থাকবেই। তবে আমার বিশ্বাস আমি সবাইকে এক রাখতে পারবই।

স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটিতে যখন বাড়ি যেতাম তখন জমানো সব মনের কথা আমি মাকে বলতাম, মা ও বলতেন। মা একদিন বললেন- তুই এখন থেকে হোমিওপ্যাথিক প্র্যাকটিস করিস তো। আমি আকাশ থেকে পড়লাম। একটু অবহেলার সুরে বললাম- আমি! বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়ে আমি হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক হব? মা বললেন- দেখ বাবা, কোন কাজকেই এভাবে ছোট ভাবা উচিত নয়, জীবনে কোন একদিন হয়তো এই ছোট কাজটাই তোর কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ধরা দিবে। আমি হাসতাম আর বলতাম- ঠিক আছে মা, আমি চেষ্টা করবো।

একদিন লাজুক সুরে মা আমাকে বললেন- পার্থ, আমি না কয়েকটা গান লিখেছি। কয়েকটা অনুষ্ঠানে এই গানগুলো গেয়েছিও আমি। আমি অবাক হয়ে বললাম- কী বল মা! তুমি গান লিখেছো? হ্যাঁ রে, তুই এক কাজ করিস তো বাবা, আমি যখন আরো কিছু গান লিখব তখন সবগুলো গান কম্পিউটারে লিখে আমাকে দিবি। আমি বললাম- ঠিক আছে মা, তুমি আরো কিছু গান লিখে ফেল।

ছুটি কাটিয়ে যখন বাড়ি ছাড়তাম তখন বিদায় বেলায় ঘর থেকে বের হয়ে আমার পিছু পিছু অনেক দূর চলে আসতেন মা। আমি বলতাম- মা, এবার তুমি যাও। মা তাঁর শাড়ীর আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে মুছে বলতেন- তুই যা বাবা, আমি আছি এখানে। আমি আর পেছন ফিরে তাকাতাম না, কেন জানি বুকের ভেতরটা ভেঙ্গে যেত। তখন অনুভব করতাম মায়ের এক মায়াবী ছায়া আমার পিছু পিছু হেঁটে আসছে।

ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে চাকরিতে যোগদানের আগ পর্যন্ত জীবনের এই গুরুত্বপুর্ণ সময়টুকু প্রায় মায়ের আদরের স্পর্শ ছাড়াই কাটিয়েছি আমি। তাই মনের মধ্যে একটা লালিত স্বপ্ন ছিল চাকরিতে যোগদান করেই মায়ের সংস্পর্শে থেকে হারানো সময়ের আদরটুকু পুষিয়ে নিব। মাকে যখন এই স্বপ্নের কথা বললাম, মা বললেন- এটা কিভাবে সম্ভব বাবা! আমার চিকিৎসা, আমার সংগঠন, প্রিয় মহিলাদের সঙ্গ ফেলে আমার শহর জীবন ভালো লাগবে? তখন নিজেকে আমার খুব নিঃস্ব মনে হত। তবে আমি আমার লালিত স্বপ্নকে হারাতে চাইতাম না। একদিনতো মা বলেই ফেললেন- তোকে লেখাপড়া করিয়ে কি হবে, তুই তো আর চাকরি পেয়ে আমার কাছে থাকবি না।

শেষ পর্যন্ত আমার সুস্বপ্নটা পূরণ হয়নি। মা আর আমার কাছে আসেননি। অনেক দূরে চলে গেছেন, অনেক দূরে। আমার চাকরি পাওয়ার দুইমাস পর 'মা' দিবসের ঠিক আগের দিন মা চলে গেছেন আমাকে ফেলে। তাই সবার কাছে মা দিবসটা যখন উচ্ছল আর আনন্দের, আমার কাছে তখন তা সুনসান নিরবতায় আচ্ছন্ন। আমার এতদিনের রঙিন স্বপ্ন কেন জানি এক নিমিষেই ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। আমার স্বপ্ন কেন অঙ্কুরদমেই ভেঙ্গে গেল, এর সঠিক উত্তর আমি এখনও পাইনি। জানি, পাবো না কোন দিন। মা হারানো এক ছোট বোন আমাকে বলল- 'দাদা, ইদানিং কেন জানি মায়ের কথা মনে পড়ে না। তবে  কাউকে যখন তার মায়ের সাথে দেখি তখন কেন জানি খুব হিংসা হয়।' হ্যাঁ, এই নিষ্ঠুর সত্যটা ইদানিং আমার মনের মাঝেও বাসা বেঁধেছে।

এখন আর আগের মতো গ্রামে যাওয়া হয়না। আগে গ্রামে যাওয়ার জন্য মন কাঁদতো আর এখন গ্রামে গেলে ফিরে আসার জন্য মন কাঁদে। কারণ গ্রামে মায়ের প্রতিটা স্মৃতিচিহ্ন আমাকে কাঁদায়, আমি আবেগতাড়িত হই। আমি আমার মাকে নিরবে খুঁজি গ্রামের মহিলাদের মাঝে, নদীর ঘাটে, ঠাকুর ঘরে প্রার্থনায় আর তাঁর তিলেতিলে গড়া ফার্মেসীতে। মায়ের গড়া সেই সংগঠন এখনও সাম্যের বাণী পৌঁছে দিচ্ছে মানুষের মনের মাঝে কিন্তু আমার মা নেই। বাড়ি থেকে বিদায়ের সময় এখনও অনেক মহিলা আমাকে বিদায় জানান তবে মায়ের সেই অশ্রুভেজা মুখখানি এখনও নিরবে খুঁজে বেড়াই। তখন মায়ের দেখা না পেয়ে মনেমনে বলি- ও তোতা পাখিরে শেকল খুলে উড়িয়ে দিব, আমার মাকে যদি এনে দাও, আমার মাকে যদি এনে দাও।