'আমার সোনার বাংলা' কবিতাটি ১৯০৫ সালের ৭ই আগস্ট-এ প্রথম প্রকাশ ঘটে। আজ ৭ই আগস্ট এই কবিতার জন্মদিন। ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চে সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে পল্টন ময়দানে "আমার সোনার বাংলা" কবিতাটি বাঙালি জাতির সঙ্গীত হিসেবে ঘোষনা করা হয়। ১৭ই এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে এই গান প্রথম বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গাওয়া হয়। ১৯৭২ সালে সদ্য গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার রাষ্ট্রীয় জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে এই সঙ্গীতের প্রথম দশ চরণ নির্বাচন করেন। ২০১৪ সালে এই জাতীয় সঙ্গীত লাখো কন্ঠে গাওয়ার কারনে গিনেস বুক ওব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস-এ স্থান পায়। বাঙালি জাতির হাজার বছরের স্বপ্নের ও সপথের প্রকাশ ঘটেছে এই সঙ্গীতের মাধ্যমে।
এই সঙ্গীত বাঙালির মনে দেশের জন্য আত্মউৎসর্গ করার চেতনা তৈরী করেছিল। যেমন এই গানটির একটি লাইন এখানে উদাহরন স্বরুপ বলা যেতে পারে… "ওমা, তোর চরণেতে দিলেম এই মাথা পেতে–/ দেগোতোর পায়েরধূলা, সে যে আমার মাথার মানিক হবে।".. .. এই সঙ্গীতের চেতনায় চেতনায়িত হয়ে যুগে যুগে গর্জে উঠেছে রজনিকান্ত, দিজেন্দ্রলাল, ক্ষুদিরাম বোস, সুভাস বোস, বাঘাজতিন, বেগম রোকেয়া, রাজা রাম মোহন রায়, নজরুল, প্রীতিলতা, সূর্যসেন, ভূপেন, ভাসানী, সরোয়ার্দি, মুজিব, ফজলুল হক, সত্যজিত, ইলামিত্র, ওসমানি, জিয়া, সাইকসিরাজ, আব্দুল্লাহ আবু সাঈদ প্রভৃতিজনের মত কোটি বাঙালি। এদেরেও আগে একই ধরনের সপথ নিয়ে বাংলার মানুষের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলন, তিতুমীর, ফয়েজী, ঈশ্বরচন্দ্র, বঙ্কিম, দ্বীন বন্ধু মিত্র সহ অনেক দেশপ্রেমিক।
এই সঙ্গীত বুকে গেঁথে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি ৭১-এ গর্জে উঠেছিল (১১ হাজার রাজাকার বাদে)। ৩০ লক্ষ্য বীর বাঙালি প্রাণ দিয়েছেন। কোটি বাঙালি র্নিযাতন বরণ করে নিয়েছিল। দু'লক্ষ্য মা-বোনের কান্না এই সঙ্গীতের সুরে লুকিয়ে আছে। বীর বাঙালির উক্ত উৎসর্গের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি হাজার বছরের উপহার, সার্বভৌম একটি স্বাধীন দেশ- "বাংলাদেশ"।
ভালবাসার চেতনা বাঙালি বুকে লালিত হয়ে আসছে হাজার বছর ধরে। এই সঙ্গীতের মাধ্যমে ১৯০৫ সালে সেই ভালবাসার প্রকাশ ঘটে বাঙালির কণ্ঠে। সেই থেকে কন্ঠে কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে বাঙালি শপথ করে আসচ্ছে। দেশ মাতৃকার জন্য বাঙালি নিজের সকল ধন উৎসর্গ করার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে এই সঙ্গীতের মূর্ছনায়। ফলে বাঙালি নিজের প্রিয় প্রাণ বিসর্জন দিতে দ্বিধা বোধ করেনি। সেই প্রস্তুতির সুর বেজে উঠেছিল গানের চরনে। যেমন, ওমা, গরিবের ধন যা আছে তাই দিব চরণ তলে" । দেশকে ভালবাসতে হলে বা দেশের জন্য কিছু ত্যাগ স্বীকার করতে হলে অনেক ধনদৌলতের প্রয়োজন হয় না। যার যা আছে তাই নিয়েই দেশকে ভালবাসা যায়। তাইতো ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন " তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তত থাকো…"।
রবীন্দ্রনাথ ১৯০৫ সালের ৭ই আগস্টে বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্নকে এই সঙ্গীতে নিয়ে এসেছিলেন। শেখ মুজিব ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চে সেই সঙ্গীতের চেতনাকে ভাষনে প্রকাশ ঘটান। বীর বাঙালি এই সঙ্গীতকে হৃদয়ে ছন্দময় করে এনে দিয়েছেল একটি স্বাধীন দেশ। এ থেকেএটাই প্রমানিত হয় এই সঙ্গীত অত্যন্ত শক্তিশালী যা একটা দেশের হাজার বছরের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার জন্য উৎসাহ যুগিয়েছিল। আজ ৭ই আগস্ট এই সঙ্গীতের জন্মদিন। আসুন সকলে মিলে আমরা এই শুভ জন্মদিনে দেশের ক্ষতময় ইতিহাসকে স্মরণ করি। যারা কন্ঠে এই শক্তিশালী সঙ্গীতকে ধারন করে দেশের জন্য আত্ম উৎসর্গ করেছেন তাদের স্মরণ করি। পৃথিবীর আর একটি দেশ পাওয়া যাবেনা যেখানে এই ধরনের একটি শক্তিশালী সঙ্গীত আছে। তাই জাতীয় সঙ্গীত-এর জন্মদিন হিসেবে ৭ই আগস্ট প্রতি বছর বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর সকল দেশ যেন স্মরণ করে তার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
সেই দিক বিবেচনা করে, বাংলাদেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রায়, আজ এই মহান দিনে সকল বাঙালিসহ সরকারের কাছে প্রস্তাব করছি, ৭ই আগস্ট যেন আন্তর্জাতিক জাতীয় সংগীত দিবস করা হয়।
– কামার/৭ই আগস্ট ২০১৪/ ঢাকা।
কবিতাটি এখানে তুলে ধরা হল –
আমার সোনার বাংলা
-রবীন্দ্রনাথঠাকুর
আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি॥
ওমা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
মরি হায়, হায় রে–
ওমা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি॥
কী শোভা, কী ছায়াগো, কী স্নেহ, কী মায়াগো–
কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে।
মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো,
মরি হায়, হায় রে–
মা, তোর বদন খানি মলিন হলে, ওমা, আমি নয়ন জলে ভাসি॥
তোমার এই খেলা ঘরে শিশুকাল কাটিলেরে,
তোমারি ধুলা মাটি অঙ্গে মাখি ধন্য জীবন মানি।
তুই দিন ফুরালে সন্ধ্যা কালে কী দীপ জ্বালিস ঘরে,
মরি হায়, হায় রে–
তখন খেলা ধুলা সকল ফেলে, ওমা, তোমার কোলে ছুটে আসি॥
ধেনু-চরা তোমার মাঠে, পারে যাবার খেয়া ঘাটে,
সারাদিন পাখি-ডাকা ছায়ায়-ঢাকা তোমার পল্লী বাটে,
তোমার ধানে-ভরা আঙিনাতে জীবনের দিন কাটে,
মরি হায়, হায় রে–
ওমা, আমার যে ভাই তারা সবাই, ওমা, তোমার রাখাল তোমার চাষি॥
ওমা, তোর চরণেতে দিলেম এই মাথাপেতে–
দেগো তোর পায়ের ধূলা, সে যে আমার মাথার মানিক হবে।
ওমা, গরিবের ধন যা আছে তাই দিব চরণ তলে,
মরি হায়, হায় রে–
আমি পরের ঘরে কিনবনা আর, মা, তোর ভূষণ বলে গলার ফাঁসি॥