শিশুদের শাস্তি বন্ধের জন্য সরকারি প্রজ্ঞাপন প্রয়োজন

কাজী মাহমুদুর রহমান
Published : 22 Dec 2015, 06:38 PM
Updated : 22 Dec 2015, 06:38 PM

পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায় আমাদের শিশুরা কোনো না কোনোভাবে নির্যাতিত হচ্ছে। কোনো শিশুকে হয়তো হত্যা করা হয়েছে, আবার কোনো শিশুকে হয়তো জিম্মি করে অর্থ আদায় করা হয়েছে। মেয়ে শিশুরাতো অহরহ নির্যাতিত হচ্ছে। এসব নির্যাতনের অধিকাংশ পত্রিকার পাতায় আসে না। নির্যাতন শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিপর্যয় ঘটায়।

সাধারণত প্রচণ্ডতা, হিংস্রতা, সহিংসতা, হিংস্র আচরণ, ধর্ষণ, শারীরিক আঘাত, মানসিক ক্ষতি, যৌন হয়রানি, মৌখিক অপমান, ক্ষতবিহীন শারীরিক আঘাত, ভয় প্রদর্শন, হুমকি, প্রতারণা প্রভৃতিকে নির্যাতন বলে আখ্যায়িত করা হয়। আধুনিক মনোবিজ্ঞানিদের মতে, নির্যাতন যে কোনো ধরনের ক্রিয়া যা একজন বা একদল করলে অপরজন বা অপরদলের শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি হয়।যে কোনো প্রকার নির্যাতন শারীরিক ও মানসিক কষ্ট, অস্বস্তি বা বিরক্তি উৎপাদন করে।
নানা ধরনের নির্যাতনের মধ্যে শিশু নির্যাতন সবচেয়ে প্রকট ও দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতিকর। আমাদের চারপাশে এখনও শিশুদের উপর নানা প্রকার নির্যাতন নানাভাবে প্রচলিত । কোনো কোনো সমাজ মনে করে শিশুদের জন্ম হয়েছে বাবা-মায়ের দ্বারা । অতএব তারা তাদের শিশুদের নির্যাতন করবে এটাই স্বাভাবিক। শিক্ষার্থী শিশুসহ কর্মজীবী শিশুরা নানাভাবে নির্যাতিত হয়। শিক্ষার্থী শিশুদের লেখাপড়া শেখানোর অজুহাতে বাবা-মা, শিক্ষকরা মিলে চড়-থাপ্পড়, কিল-ঘুষি, নিলডাউন, কানে ধরা, কানে ধরে উঠবস, কানমলা,অপমান করা, ইট নিয়ে মাঠে দৌড়ানো, রোদের দিকে তাকিয়ে থাকা, না বুঝে মুখস্ত করতে বলা, বেতানো, চুলটানা, হাতের তালুতে বেত দিয়ে মারা, পেন্সিল দিয়ে আঙ্গুল পেষা, ধমক দেওয়া প্রভৃতি প্রকার শাষণ বা শাস্তি নামক নির্যাতন করেন।

বাংলাদেশের অধিকাংশ পিতামাতা ও শিক্ষকরা শেখানোর ক্ষেত্রে শিশুদের অহরহ শারীরিক ও মানসিক শাস্তি দিয়ে থাকেন। যদিও অধিকাংশ শাস্তির ঘটনা দৈনিক খবরে আসে না। শিশুদের ভর্তি করানোর সময় আমাদের দেশের পিতামাতারা শিক্ষকদের খোলাখুলিভাবে বলেন, শিক্ষক শিশুকে শেখানোর সময় ইচ্ছেমত পেটাতে পারেন । পেটাতে পেটাতে শিশুর চামড়া তুলে ফেলতে পারেন। শুধু হাড় অভিভাবককে দিলেই হবে। ফলে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের শেখানোর মনোবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির চেয়ে মারপিট অর্থাৎ শাস্তির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠে। এদিকে যে শিশুটি শিখতে এসে নানা ধরনের শাস্তি পেল তার মানসিক অবস্থার খবর কেউ রাখে না। শুধু তাই নয়, শিশুরা স্কুলে শিখতে আসে সমাজে মানুষের মত মানুষ হয়ে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য। কিন্তু শাস্তির ফলে সেই শিশুটি হয়ে উঠে অসামাজিক, অসুস্থ। আর এর কারণ, অবিভাবক ও শিক্ষকদের অমানুষিক নির্যাতন।

কর্মজীবী শিশুদের মধ্যে যারা গৃহে কাজ করে তারা তুলনামূলকভাবে বেশি নির্যাতিত হয়। অধিকাংশ গৃহকত্র্রীরা মনে করে কাজের শিশুদের জন্ম হয়েছে তাদের সেবা করার জন্য । অনেক গৃহকত্র্রী ওইসব শিশুদের মানব বলে গণ্য করে না। তাদের আচরণ দেখে মনে হবে কাজের শিশুরা অন্যকোনো প্রজাতির প্রাণী। কাজের শিশুদের অযথা বকাবকি, সামান্য ভুলে মার খাওয়া, স্যাঁতসেঁতে স্থানে ঘুমানো, মশারি ছাড়া ঘুমানো, পচাবাসি খাওয়া, না খেতে পাওয়া প্রভৃতি ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়। কাজের মেয়ে শিশুরা এগুলোর পাশাপাশি বাড়তি যৌন নির্যাতনে আক্রান্ত হয়। শিশুদের উপর নানা প্রকার নির্যাতনগুলোকে আলোচনা করতে কয়েকটি প্রকারভেদে বিভক্ত করতে হয়। যেমন: শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন, সামাজিক নির্যাতন ও যৌন নির্যাতন। শারীরিক নির্যাতন হলো শিশুর শরীরে আঘাত করা বা ক্ষত সৃষ্টি করা। যেমন- মারপিট, পোড়ানো, ঝাকানো, শ্বাসরুদ্ধ করা, বিষ প্রয়োগ করা, আগুনে পোড়ানো প্রভৃতি। মানসিক নির্যাতন হলো যে নির্যাতন শিশুর মনে প্রভাব ফেলে । শিশুর মনে স্বল্পস্থায়ী বা দীর্ঘস্থায়ী কষ্ট জাগরণ করে এরূপ নির্যাতনই হলো মানসিক নির্যাতন। এদিক থেকে বিবেচনা করলে নির্যাতনে মানসিক প্রভাব রয়েছে।

শিক্ষার্থী শিশুদের শেখানোর ক্ষেত্রে শিক্ষকরা সাধারণত শারীরিক ও মানসিক দুই ধরনের শাস্তি ব্যবহার করেন। শারীরিক শাস্তির মধ্যে অধিকাংশ শাস্তিতে শিশুরা মানসিকভাবে কষ্ট পায়। আবার শুধু মানসিকভাবে কষ্ট পায় এমন কতগুলো শাস্তিও শিক্ষকরা অহরহ শিশুদের দিয়ে থাকেন। যেমন, বকা দেওয়া, অপছন্দ করা, মনোযোগ না দেওয়া, লজ্জা দেওয়া, সমালোচনা করা, এড়িয়ে চলা, অপমান করা, না বুঝে মুখস্ত করতে দেওয়া, তুলনা করা, কানে ধরে দাঁড়িয়ে রাখা প্রভৃতি। কর্মজীবী শিশুরা অধিকাংশ সময় নানা ধরনের অপমানের শিকার হয়।

সামাজিক নির্যাতন হলো, সামাজিকভাবে শিশুকে কষ্ট দেওয়া বা আঘাত করা। এগুলো সাধারণত শিশুর স্কুল, খেলার মাঠ, বাজার-ঘাট থেকে আসে। অনেকে অপরিচিত শিশুদেরকে অবজ্ঞা করে। হোটেলে যে সব শিশু কাজ করে অনেকে তাদের নাম না ধরে ডেকে বিভিন্ন প্রকার বানানো নামে ডাকে। এটাও শিশুর জন্য অপমানকর বা লজ্জাকর।

অধিকাংশ শিশুই কোনো না কোনো ভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। বিশেষ করে মেয়ে শিশুরা খুব কাছের আত্দীয়স্বজন, চাচাতো-মামাতো ভাইবোন, পারিবারিক বন্ধু বা বিশ্বস্ত ব্যক্তি দ্বারা যৌন নির্যাতনে আক্রান্ত হয়। গবেষণায় দেখা যায়, ছেলে শিশুরাও যৌন নির্যাতিত হয়। বিশেষ করে হোস্টেলে শিক্ষার্থীরা বিকৃত রুচির শিক্ষক দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। কখনো কখনো মহিলা বা অবিবাহিত মেয়েদের দ্বারাও ছেলেরা যৌন নির্যাতনে আক্রান্ত হয়। প্রত্যেক ধরনের নির্যাতনেই ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। শারীরিক নির্যাতনের ফলে তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘস্থায়ী নানা ধরনের ক্ষতি হয়। ছোট শিশুকে ঝাকানো, মাথায় থাপ্পড় মারা, চাটি মারা, চাপড় মারা বা চুল টানার ফলে তার মস্তিষ্কের ক্ষতি হয়। যেহেতু মস্তিষ্ক আমাদের সর্বপ্রকার কাজ করার নিয়ন্ত্রক সেহেতু ওইসব নির্যাতনের ফলে শিশুর সব চিন্তা, আবেগ ও আচরণে সমস্যা দেখা দেয়। মস্তিষ্কে আঘাতের ফলে শিশু পরবর্তী জীবনে চোখে কম দেখে, কানে কম শোনে, আবেগজনিত সমস্যায় ভোগে। আগুনে পোড়ানোর ফলে শিশুর শরীর স্থায়ীভাবে কদাকার আকার ধারণ করে। কখনো কখনো বিকাশ জনিত সমস্যা হতে পারে।

যাই হোক, সম্প্রতি বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), আইন ও সালিস কেন্দ (আসক), বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ , ব্রাক হিউম্যান রাইটস ও লিগ্যাল সার্ভিসেস এবং নিজেরা করি প্রভৃতি এনজিওর-এর যৌথ উদ্যোগে শিক্ষার্থীদের অমানবিক শাস্তি দেওয়ার বেশ কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করে দায়ের করা রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট একটি রুল জারি করেন। আদালতের আদেশে বলা হয় 'শিক্ষার্থীদের শাস্তি দিয়েছেন এমন শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না আগামী ১০ দিনের মধ্যে তা জানাতে চেয়েছেন। এ ছাড়া সরকারের যে সব প্রতিষ্ঠান এসব শাস্তি রোধের দায়িত্বে নিয়োজিত, তাদের নিষ্ক্রিয়তাকেও কেন বে-আইনি ঘোষণা করা হবে না তাও জানতে চেয়েছেন আদালত…। শাস্তি বন্ধের জন্য ১৯৯৬ সাল থেকে বিভিন্ন পত্রিকাতে লিখালিখি ও সচেতনতামুলক কর্মশালা  করার ফলে বহু অভিভাবকের সাথে মতবিনিময় হয় । অধিকাংশ অভিভাবক মনে করেন শাস্তি নিসিদ্ধ বা বন্ধের জন্য সরকারের একটি প্রজ্ঞাপন থাকা প্রয়োজন।

কাজী মাহমুদুর রহমান

এডুকেশনিস্ট, সাইকোথেরাপিস্ট

স্বেচ্ছাসেবকসাইকথেরাপি সার্ভিসেস