চাকুরি ক্ষেত্রে কোটার অত্যাচার নিয়ে দু’টি কথা

আবদুল কাইয়ুম
Published : 8 Sept 2012, 02:42 AM
Updated : 8 Sept 2012, 02:42 AM

স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে শিক্ষার প্রসার খুব দ্রুতগতিতে না হলেও ভালই হয়েছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের দেশে উচ্চ শিক্ষিত শিক্ষার্থীর পরিমান বেড়েই চলেছে। তার সাথে সাথে বেড়েছে চাকুরি প্রার্থীর পরিমাণ। দেশে বিদ্যমান চাকুরী বাজারে সবচেয়ে দামী ও আকাঙ্ক্ষিত চাকুরি অবশ্যই বিসিএস । অধিকাংশ উচ্চশিক্ষিত শিক্ষার্থীই মনে প্রানে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার সপ্ন বুকে লালন করে। যদিও সরকারি চাকুরী বাজারে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার প্রক্রিয়াটা বন্ধুর হলেও কিছুটা স্বচ্ছ বলা চলে। তারপরও বলতে হয় বিসিএস ক্যাডার হওয়ার পথে যোগ্য ও মেধাবী শিক্ষার্থীরা নানাভাবেই বঞ্চনার শিকার। এই ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রভাব ও লবিং ছাড়াও যে প্রতিবন্ধকতা সামনে আসে তা অবশ্যই ''কোটা'' নামক অত্যাচার। পিএসসি (সরকারি কর্ম কমিশন) ঘোষিত সর্বশেষ বিসিএস (৩৩ তম ) বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী ৫৮২ টি সাধারন, ২৯০৫ টি প্রফেশনাল এবং সাধারন শিক্ষায় ৭১৯ টি সহ সর্বমোট ৪২০৬ টি পদের জন্য আবেদনপত্র আহবান করা হয়। এর মধ্যে ২৩৫৫ টি পদ শুধুমাত্র কোটার জন্যই বরাদ্দ রাখা হয়েছে যা মোট পদের ৫৬ শতাংশ। এই ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি –নাতনিদের জন্য ৩০%, নারীদের জন্য ১০%, পিছিয়ে থাকা জেলাসমূহের জন্য ১০%, উপজাতিদের জন্য ৫% এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য ১% পদ সংরক্ষিত রাখা হয়েছে।

এই বরাদ্দ করা কোটার মধ্যে অন্যান্য কোটার বিপক্ষে আপত্তি না থাকলেও মুক্তিযোদ্ধা ও উপজাতি কোটার হার ও গ্রহণযোগ্যতার বিপক্ষে সাধারন আবেদনকারীদের একটা বিরূপ মনোভাব থাকা অবশ্যই অমূলক হবে না।

উপজাতি কোটার ক্ষেত্রে একটা কথা অবশ্যই মানতে হয় যে,একই শিক্ষা কাঠামোতে শিক্ষা লাভ করার পরও অন্যান্য চাকুরীর মত বিসিএস এর ক্ষেত্রেও শুধুমাত্র উপজাতীয় শিক্ষার্থীদের একতরফা সুযোগ দেয়া কি অবিচার নয়? কেননা শিক্ষাক্ষেত্রের বিভিন্ন পর্যায়ে উপজাতীয় শিক্ষার্থীরা যেখানে কোটা সুবিধা নিয়ে পড়াশোনার সুযোগ পায় সেখানে অ- উপজাতীয় বাঙ্গালী ছাত্ররা নিজের যোগ্যতা ছাড়া পড়াশোনার সুযোগ হতে বঞ্চিত। এই বৈষম্যের ফলে অবস্থা এমনও দাঁড়ায় যে, একই স্কুল ,কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে নিজের উপজাতি সহপাঠীর চেয়ে ভাল ফলাফল করেও কোন বাঙ্গালী শিক্ষার্থী যেখানে নিজের যোগ্যতায় বিসিএস এ নিচের দিকের পদ পায় সেখানে উপজাতীয় বন্ধু ও সহপাঠী শুধুমাত্র কোটা সুবিধা নিয়ে বিসিএস এর লোভনীয় ক্যাডার লাভ করে। একই অবস্থা মুক্তিযোদ্ধা কোটার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য তো বটেই বরং সেখানে এই অবস্থা আরও ভয়াবহ। যেখানে সারাদেশে সকল শিক্ষার্থীদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এর পরিমান ৫% ও নয় সেখানে তাঁদের জন্য ৩০% কোটার সংরক্ষণ বাতুলতাই বটে। এরই ফলস্বরূপ আমরা প্রতিবছরই দেখি যে, উপজাতি কোটার মত এই কোটারও অধিকাংশ পদই খালি থাকে। পোঁদের অপর বিষফোঁড়ার মত এই কোটায় আবার লেজও লাগান হয়েছে। সরকার মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের ছাড়িয়ে তাঁদের নাতি-পুতিকেও এই কোটার সুবিধাভোগী ঘোষণা করেছেন। এই অবস্থায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের হতাশা বেড়ে যাওয়া দোষের কিছু না।

এটা বলাতে অনেকে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে প্রশ্ন তুললেও আমি অবাক হব না। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ অবশ্যই আছে এবং থাকবে। তাঁদেরঅসামান্য ত্যাগের জন্যই আমরা স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকার স্বাদ পাচ্ছি। সরকার তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সামান্য একটা সুবিধাই না হয় দিচ্ছে। সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কিছুই থাকার নয় । তারপরও বাধ্য হয়ে বলতে হয়, এই সুবিধা কি অন্যভাবে দেয়া যেত না? সামান্য একটা কোটা সুবিধা দিয়ে তাঁদের ছোট না করে তাঁদের জীবন যাত্রার মান উন্নয়নের কথাও তো ভাবা যেত। আর কিছু না হোক তাঁদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ এর কথাই ভাবা যাক। সরকার যেখানে গাঁটের পয়সা খরচ করে সেনাবাহিনীর জন্য এত এত ক্যাডেট কলেজ এর ব্যাবস্থা করতে পারে সেখানে শুধুমাত্র মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য প্রতি জেলায় বিশেষায়িত স্কুল, কলেজ পরিচালনা করা অবশ্যই খুব কষ্টসাধ্য হবে না। সেখানে সরবচ্ছ মানের শিক্ষা লাভের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা তাঁদের পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করতে পারে। তারপরও মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য কিছু পরিমান কোটা (হতে পারে তা ১০%) রাখলেও আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা নিশ্চয় খারাপভাবে নেব না। কিন্তু এভাবে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে যে মুক্তিযোদ্ধাদের ছোট করা হচ্ছে তা কি আমাদের মান্যবররা বুঝতে পারেন না!

আমাদের ক্ষমতাসীনরা একটু চাইলেই পারেন সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি লাঘব করতে। যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে কোটার কারনে সৃষ্ট বৈষম্য দূর করা হলে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি জানানো শ্রদ্ধা যেমন প্রতিষ্ঠা পাবে তেমনি অনেক যোগ্য শিক্ষার্থীও নিজের আজন্ম লালিত সপ্ন পূরণের সুযোগ পাবে। এবং কোটার ভারে শূন্য থাকা পদগুলো পূরন হবে যোগ্য ও দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা বেড়ে যাওয়া নাগরিক দ্বারা। সবচেয়ে বড় কথা , দেশের সরকারি কাঠামো কোটার ভারে নুয়ে না থেকে একটু সোজা হয়ে দাঁড়ানোর অবকাশ পাবে।