শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন ও প্রসঙ্গ কথা

আবদুল কাইয়ুম
Published : 14 Sept 2012, 04:07 PM
Updated : 14 Sept 2012, 04:07 PM

পৃথিবীর সব উন্নত দেশের আজকের পর্যায়ে আসার পিছনে শিক্ষাই প্রথম ও প্রধান ভুমিকা রেখেছে। কোন দেশে একটি গ্রহণযোগ্য ও সার্থক শিক্ষা কাঠামো না থাকলে শিক্ষাকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব নয়। ১৯৭১ পরবর্তী বাংলাদেশে একটি সর্বসম্মত ও সার্বজনীন শিক্ষা কাঠামো গড়ে তোলার জন্য ডঃ কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন(১৯৭২) হতে শুরু করে সর্বশেষ অধ্যাপক কবির চৌধুরি শিক্ষা কমিশন(২০১১) পর্যন্ত ৭ টি শিক্ষা কমিশন একটি সর্বসম্মত ও গ্রহণযোগ্য কার্যকরী শিক্ষা নীতি প্রনয়নের জন্য কাজ করেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এই যে , এই সব শিক্ষানীতি শিক্ষাক্ষেত্রে তেমন কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারেনি। প্রতিটি সরকারই শিক্ষা কমিশন এর সুপারিশকে পাশ কাটিয়ে গোলেমেলে ধরনের শিক্ষানীতি সবার উপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন।
প্রতিটি সুপারিশে প্রাথমিক শিক্ষার প্রসারের ব্যাপারে অনেক সুপারিশই থাকে। সরকার মাঝে মাঝে তা বাস্তবায়নেরও সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু দৃশ্যপট আর বদলায় না। শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের প্রথম দিকে অনেক আলোচনা শোনা গেলেও কিছুদিন পর সেটার কথা কারই মনে পড়ে না। প্রতিটি শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কিছু ব্যাপার সবাই পাশ কাটিয়ে যায়। যারই কারনে অনেক বিজ্ঞানসম্মত ও উঁচুমানের শিক্ষানীতি বার বার মুখ থুবড়ে পড়েছে। যদি এইভাবে চলতেই থাকে তবে বরাবরের মত এইবারের শিক্ষানীতির ক্ষেত্রেও কথাটা সত্যি প্রতীয়মান হবে।
আমাদের দেশের প্রতিটি শিক্ষানীতিতেই দেশের প্রাথমিক শিখার ব্যাপারে অনেক বুলিই থাকে। সবার জন্য বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা, শিক্ষাদান পদ্ধতির সংস্কারসহ বিভিন্ন নতুন নতুন পাঠ্যসূচির প্রনয়ন সংকান্ত সুপারিশ ও নির্দেশনা ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু যে ব্যাপারটা নিয়ে সবাই উদাসীন সেটা হচ্ছে, যাদের দ্বারা এই সব সুপারিশ বাস্তবায়িত হবে তাঁদের নিয়ে না ভাবা।
প্রাথমিক, উচ্চ মাধ্যমিক কিংবা উচ্চশিক্ষা প্রতিটি ক্ষেত্রে সবার আগে প্রয়োজন যোগ্যতাসম্পন্ন, আন্তরিক, মেধাবী শিক্ষকমণ্ডলী। যদি কোন শিক্ষক শিক্ষকতাকে ব্রত হিসেবে নিতে না পারেন তবে শিক্ষাদান পদ্ধতির যত আধুনিকায়নই হোক না কেন তা পরিপূর্ণ ও ফলপ্রসু হবে না। আর যে কোন শিক্ষক যদি তার কাজের যথাযথ প্রতিদান না পান তবে তার পক্ষে আন্তরিক থাকা প্রায় অসম্ভব। আমাদের দেশে মুখে যদিও বলা হয় শিক্ষকতা একটা মহান পেশা, এর সাথে অনেক সম্মান জড়িত কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এত ছেলের মাঝে শতকরা কত জন এই পেশায় আসতে চাইবেন?
আমি নিজে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ০১ বৎসরকাল কাজ করেছি। তারই অভিজ্ঞতা দিয়ে আমি বলতে পারি, একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক কতখানি কষ্ট করেন তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে। আমাদের দেশে প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১ম-৫ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানো হয়। তার মধ্যে আবার আছে একটি শিশু শ্রেণী। প্রতি শ্রেণীতে যদি গড়ে ৭০ জন করে ধরি তবে বিদ্যালয়ের মোট ছাত্র সংখ্যা হবে প্রায় ৪২০ জন। কিন্তু এই বিশাল পরিমান বাচ্চাকে সামলানোর দায়িত্ব ন্যাস্ত থাকে ৩-৪ জন শিক্ষকের উপর ( আমাদের দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো মান অনুযায়ী তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত এবং এগুলো মান অনুযায়ী শিক্ষক পেয়ে থাকে)। এই কয়েকজন শিক্ষকের পক্ষে এই সংখ্যক ছাত্রকে সামলানো আসলেই কঠিন। এর বাইরেও সবসময় শিক্ষকদের নানা সরকারী কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। ভোটার তালিকা , আদমশুমারি থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারী কাজে তাঁদের সবসময়ই কাজে লাগানো হয়। কেউ চাইলে কোন বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখে আসতে পারেন, কি অবস্থার মধ্যে একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ক্লাস নেন। এত খাটুনির পরও সরকার দেশের একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকের পিছনে প্রতি মাসে সর্বসাকুল্যে ৮০০০ টাকারও কম ব্যায় করে থাকে। আর প্রধান শিক্ষকের ক্ষেত্রে এই অংক বেড়ে দাঁড়ায় সর্বোচ্চ ৯০০০ টাকা। কোন গুরুত্বপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত থাকা একজন ব্যাক্তির পক্ষে বর্তমান বাজারে এই টাকায় দিন যাপন করা সম্ভব কিনা তা পাঠকরাই বিবেচনা করবেন। আর যদি সম্ভবপর না হয় তবে সেই শিক্ষকের পক্ষে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করা কি আদৌ সম্ভব?
একটা সময় ছিল যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য চাকুরীতে ঢোকার ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল ছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ে প্রতিটি বিদ্যালয়ের শিক্ষকই কমপক্ষে বিএ পাশ। একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক যে যোগ্যতা নিয়ে চাকুরীতে যোগদান করেন সেই একই যোগ্যতা নিয়ে সরকারী চাকুরীতে যোগদান করা অনেক সরকারী কর্মচারীর বেতন তুলনামুলক ভাবে বেশি। সরকার সম্প্রতি পুলিশ বিভাগে কর্মরত পরিদর্শক ও উপ- পরিদর্শক পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের কাজের কথা বিবেচনা করে তাঁদের পদমর্যাদা এক ধাপ করে উন্নিত করলেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কথা বেমালুম ভুলে গেলেন। কিন্তু এটা তো সত্য যে এই দুই বিভাগে কর্মরত ব্যাক্তিগন একই শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন।
বিশ্বের প্রতিটি দেশেই যেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গুরুত্বসহকারে মূল্যায়ন করা হয় সেখানে আমাদের দেশই কেবল ব্যতিক্রম। কিন্তু প্রতিটি শিশুর মানসিক বিকাশের দরজা খুলে যায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। কিন্তু আমরা যদি তাঁদের পরিপূর্ণ বিকাশের প্রধান কুশীলব শিক্ষকদের কথা না ভাবি তবে কি কোন মন্ত্রই কাজ করবে?
আমাদের দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অনেক মেধাবী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র -ছাত্রীশিক্ষক হিসেবে যোগদান করলেও শুধুমাত্র বঞ্চনার শিকার হয়েই তাঁরা পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। কেননা শুধু সম্মান দিয়ে কারও পেটই চলে না। আর সম্মানই বা কোথায়! আজকাল তো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সব ক্ষেত্রেই ছোট করে দেখা হয়। হোক তা সামাজিক কিংবা অর্থনৈতিক। তাই এই ব্যাপারটা নিয়েও ভাবার সময় এসেছে। যে গাছের ছায়ায় আমরা দাঁড়াবো সেই গাছটাতো আগে বাঁচাতে হবে। যদি গাছই না বাঁচে তবে আর গাছের ছায়া কোথায়?