মা কেন বৃদ্ধাশ্রমে?

রাজিব রাজ
Published : 5 Sept 2015, 03:29 AM
Updated : 5 Sept 2015, 03:29 AM

রাত ১টা পেরিয়ে ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে ছুটে চলেছে, ট্যাবে গান চালিয়ে কানে হেডফোন সমেত গান শুনতে শুনতে ফেসবুকিং করছি। জীবনমুখী গান আমাকে প্রায়সই খুব কাছে টানে। তারই বদৌলতে হয়তো শুনছিলাম নচিকেতার গাওয়া বৃদ্ধাশ্রম গানটি। ঠিক তখনই নয়নে ধরা দিলো ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয় থেকে অনার্স-মাষ্টার্স করা এক বৃদ্ধা এখন বৃদ্ধাশ্রমে। নিউজটি পড়তে পড়তে নয়নের বারি যেন আর সংবরণ করতে পারছিলাম না!! যদিও ইদানীং খবরের পাতা মেললেই এই রকম দু-একটি ঘটনার পদচারণা পাওয়া যেন এক নিত্য-নৈমত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তবুও নিউজটি আমার হৃদয়ে এতটাই দাগ কেটে যাচ্ছে যে, বেড থেকে লাফিয়ে উঠে সুইচ চেপে লাইট অন্ করে ফ্যানের রেগ্যুলেটর মধ্যগতির করে দিয়ে সোজা-সাপ্টাভাবে ডেস্কে বসে পড়লাম। উদ্দেশ্য, জন্মদাত্রী মাকে নিয়ে আজ কিছু লিখবো।

যেই ভাবা সেই কাজ, কাঁপা কাঁপা হাতে লিখছি আর ভাবছি- লেখাটি আগামীকাল (শুক্রবার) ব্লগে পোষ্ট করবো। যদিও আমার লেখনীর পরিধি খুবই স্বল্প, এক্কেবারে নতুন ধাচের। বিডি নিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকমের ব্লগে লেখা শুরু করেছি মাত্র ১মাস যাবৎ। ইতিমধ্যে সেখানে আমার ৩টি লেখা প্রকাশিত হয়েছে, এটি প্রকাশিত হলে তা হবে চতুর্থবারের মত। যাই হোক এবার আসা যাক মূল উদ্দেশ্যে-

ছাত্র জীবনে বাবাকে হারিয়েছি, মা'ই এখন পৃথিবীতে আমার একমাত্র অবলম্বন। কর্মের তাগিদে স্বভাবতই আমাকে থাকতে হচ্ছে মায়ের চাইতে দূরে যান্ত্রিকতায় ঘেরা রাজধানী ঢাকাতে। প্রায় প্রতিরাতেই নিঃস্বঙ্গতায় ভুগি, মা কাছে নেই বলে! প্রতিক্ষণ উপলব্ধি করি মায়ের সেই হাসিমাখা সুমধুর চাহনিখানা! মিস করি সন্তানের জন্য মায়ের সার্বক্ষণিক খেয়াল করা মুহূর্তগুলো! ছেলে বড় হয়েছি – তা কি হয়েছে, মায়ের চাইতে তার সন্তানতো আর কখনো বড় হতে পারেনা।

সুযোগ পেলেই ছুটে চলি মাকে কাছে পাবার আবেগাপ্লুত প্রত্যাশায়, নিঃস্বঙগতায় সঙ্গী করে নেবার নেশায়। করি বেসরকারী চাকুরী, তাই ছুটির পরিমাণ খুবই কম! তারপরও মনটা সর্বদাই আনচান করে মাকে প্রাণভরে দেখব বলে, মায়ের প্রিয় খাবারটি নিয়ে মাকে খাওয়াব বলে, মায়ের সেই সুমধুর ডাকটি শুনবো বলে।

মাঝে-মধ্যে খুব কচিৎ ছাড়া প্রায় প্রতিদিনই আমার ফোনে কথা বলতে হয় মায়ের সঙ্গে, নতুবা সারাদিনের কর্ম ব্যস্ততার মাঝেও কোথায় যেন একটা অপূর্ণতা বোধ করি। মাও আমার নিশ্চয়ই পথ চেয়ে থাকেন যে, কখন খোকা ফোন করবে? জানতে চাইবে, বাবা কেমন আছিস, কি করছিস, শরীরটা ভালোতো, খেয়েছিস কিনা, আরো কত্তো কি অসাধারণ সব খেয়াল!

তথ্য প্রযুক্তির যুগে বন্ধু মহলকে ফোন কলে স্মরণ না করলেও আমার কোন সমস্যা হয়না, কিন্তু মাকে যে আমার ফোন করতেই হবে, কেননা মা যে আমার ওসব চ্যাটিং-ফ্যাটিং বোঝেননা বা বুঝলেও হয়তো চেষ্টা করেননা।

ঘড়ির কাঁটা ১ঘন্টা পেরিয়ে গেছে, এতরাতে মাকে ভেবে ভেবে যে আমি এত্তোসব লিখছি, তা মা আমার এতক্ষণে টের পেয়ে গেছেন নিশ্চয়ই। কেননা, সন্তানের কোন কিছুইতো মায়ের কাছে অজানা থাকেনা, সৃষ্টিকর্তার অপার মহিমায় সন্তানের ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ, সুস্থ্যতা-অসুস্থ্যতা আপনা-আপনি মায়ের মনে জানান দেয়। তাতে কি, কাল ঠিক ঠিক মাকে সব বলে দেব, কেননা মা যে আমার একমাত্র অবলম্বন – আমার ভুবন জুড়ে মা'ই যে আমার সকল স্বপ্ন-সাধনা।

মাঝে মাঝে গলা শুকিয়ে আসছে, থেকে থেকে ডেস্কে ঢেকে রাখা আধা লিটারের জলভর্তি মগখানায় চুমুক দিয়ে গলা ভিজিয়ে নিচ্ছি। ভেবে হতবাক হচ্ছি, কি করে কোন সন্তান তার মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে দিব্যি হাসি মুখে দিন কাটিয়ে দিতে পারে!!! যে মা সন্তানের হাসিমুখ না দেখলে বিচলিত হয়ে যেতেন, আর আজ সে মা কেন বৃদ্ধাশ্রমে??? এদের কি মানুষের কাতারে বিবেচনা করা যায়, নাকি এরা পশুর চেয়েও অধম, তা আপনারা পাঠকরাই বলুন। যে মা ১০মাস ১০দিন ওরশে ধারণ করে স্ব-যতনে সন্তানকে লালন-পালন করে বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করিয়ে বড় করেছেন, আজ সে মাকে কি করে পর করে দেয়া যায়!!! বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসা যায়!!! কতটা পাষন্ড হৃদয়ের হলে এমন অমানবিকতার চর্চা করা সম্ভব, তার সংঙ্গা আমার জানা নেই।

যে মায়ের বদৌলতে এই সুন্দর পৃথিবীর আলো দেখার সৌভাগ্য আমরা লাভ করেছি, সেই মায়ের প্রতি আর কখনো কোন সন্তান যেন অবহেলার আঙ্গুল দেখাতে না পারে, সেটাই হোক আমার-আপনার আজকের অঙ্গীকার।

শৈশব, কৈশর পেরিয়ে আজ যুবক হয়েছি, একদিন বৃদ্ধও হব। একসময় চলেও যেতে হবে সেই না ফেরার দেশে। রেখে যেতে হবে সব টাকা-পয়সা, বাড়ী-গাড়ী, অর্থ-সম্পদ। তাহলে কেন এত অহংকার, কিসের এত দাম্ভীকতা??? একবার ভেবে দেখুন, এমন অবহেলার চিত্র যে বৃদ্ধাবস্থায় আমার বেলায়ও ঘটতে পারে।

তাহলে আসুন, আজ হতে আমরা সকলে মিলে একসাথে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই, শপথ করি ও প্রতিরোধ গড়ে তুলি, ভবিষ্যতে আর কোন সন্তান যেন তার মায়ের দিকে বাঁকা চোখে তাঁকাতে না পারে, মাতৃস্নেহের অবমাননা করতে না পারে, মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাতে না পারে। সকল মায়ের শেষ আশ্রয়স্থল হোক প্রশান্তিময়, দুশ্চিন্তাহীন ও ঝামেলামুক্ত, যেখানে মায়ের মতন করে আমরাও মাকে খেয়াল করতে পারবো।