ঈদের অর্থনীতি

ড. আবুল বাসার
Published : 24 Sept 2015, 05:56 AM
Updated : 24 Sept 2015, 05:56 AM

ঈদ বাংলাদেশে এখন আর কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়। শত বছরের চর্চায় তা অন্যতম সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। বাঙালি প্রদানের ক্ষেত্রে যেমন উদার, গ্রহণের বেলায় তেমনি নিঃশর্ত। যেসব আনুষ্ঠিকতায় ঈদ-উৎসব পালিত হয়, তা আমাদের দৈনন্দিন ও অর্থনৈতিক জীবনে বেশ ভালো প্রভাব ফেলে। শহরবাসীর মধ্যে ঈদের সময় গ্রামের বাড়ি যাবার প্রচণ্ড তাড়না কাজ করে। অন্য সময় যাই হোক না কেন, ঈদের সময় বাড়ি যেতেই হবে এবং তা হাজারো পথিকের ভিড়ে থমকে যাওয়া পথের যন্ত্রণা সয়ে হলেও। আপনজনের নৈকট্যের আবেদন যে ওজনে পথের কষ্টের চেয়ে বেশি তা ঈদের সময় স্পষ্ট হয়ে উঠে। এ সময় আবার বেড়ে যায় আমাদের ভোগের পরিমাণ, তার প্রভাব পড়ে বাজার ও অর্থনীতির উপর।

বাংলাদেশের লোকসংখ্যা প্রায় ১৬০ মিলিয়ন। এর প্রায় ৩০ শতাংশ শহরে বাস করে। ঈদে এই শহুরে জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ গ্রামে চলে যায়। ঠিক কত শতাংশ মানুষ এ সময় শহর ত্যাগ করে, তার উপর গবেষণালব্ধ তথ্য নেই। কেন যে বিষয়টা বাংলাদেশের গবেষকদের কাছে এখনও কদর পাচ্ছে না, তা বোধগম্য নয়। ঈদের সময় আমাদের যাতায়াত খাতে যে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়, তা হ্রাস করার জন্য হলেও ঠিক কত সংখ্যক মানুষ শহর ছেড়ে যায় সে বিষয়ে কিছু তথ্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে থাকলে সেটা খুব উপকারে আসত।

তবে বিভিন্ন মিডিয়ার রিপোর্ট অনুযায়ী প্রায় ৭০ শতাংশ শহুরে মানুষ ঈদের সময় বাড়ি যায়। এ সংখ্যা হয়তো-বা অনুমানভিত্তিক, কিন্ত একে ভুল ভাবার মতো বিকল্প তথ্যও আমাদের কাছে নেই। আবার উল্লেখ্য সংখ্যাটি যে খুব অস্বাভাবিক রকমের কম বা বেশি তেমনটিও নয়। অনুমিত এ সংখ্যার ভিত্তিতে যা দাঁড়ায় তা হল, ঈদের সময় প্রায় ৩৪ মিলিয়ন বা ৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে যায়। বিশ্বের অনেক দেশের মোট জনসংখ্যা এর চেয়ে অনেক কম। যে মালয়েশিয়ার উন্নয়ন নিয়ে আমাদের এত আগ্রহ, সেই দেশের মোট লোকসংখ্যা ২ কোটি ৮০ লাখের মতো।

ঈদের প্রাক্কালে পরিবহন খাতে জনদুর্ভোগ কত কম বা বেশি হবে, তা নির্ভর করে তিনটি বিষয়ের উপর। প্রথমটি হল, কতটা জন-চাপ ঐ সময়ে তৈরি হয়। এ সম্বন্ধে একটি ধারণা ইতোমধ্যে দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিষয় হল, পরিবহন খাতের সক্ষমতা ও ব্যবস্থাপনা। উৎসবকালীন জন-চাপ সামাল দেওয়ার মতো পরিবহন খাতের উদ্বৃত্ত সক্ষমতা পৃথিবীর কোনো দেশে নেই। বড়দিনের প্রাক্কালে আমেরিকাতেও হাইওয়েগুলোতে মাইলের পর মাইল গাড়ির ভিড় তৈরি হয়। এভাবে সামনের গাড়ির একদম বাম্পার ঘেঁষে ধীরগতিতে গাড়ি চালানোর বিষয়টি Tailgating বলে আখ্যা দেয় সে দেশের মিডিয়া।

ঈদের প্রাক্কালে মালয়েশিয়াতেও কত লম্বা গাড়ির লাইন তৈরি হয়, সেটির প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান মালয়েশিয়া-ফেরত যে কোনো বাংলাদেশি শ্রমিকের কাছ থেকে সহজেই পাওয়া যায়। সুতরাং শুধুমাত্র যোগাযোগ খাতের সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে যে উৎসব-পার্বনকালীন যানজট দূর করা যায় না, উন্নত বিশ্ব তার বড় প্রমাণ।

বাংলাদেশের যোগাযোগ খাত বেশ অনুন্নত। এ খাতের সক্ষমতা বৃদ্ধি সময়-সাপেক্ষ ব্যাপার। সুতরাং ঈদের সময় জনদুর্ভোগ কমানোর একমাত্র উপায় হল, পরিবহন খাতের ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন। আমেরিকা বা মালয়েশিয়ায় যানজটের সময় জনদুর্ভোগ কম হয়; কারণ তাদের যোগাযোগ খাতের ব্যবস্থাপনা অনেক উন্নত। যানজটে সেখানে গাড়ি থেমে যায় না, আস্তে চলে, কিন্ত চলে। আর আমাদের এখানে চলে না, থেমে যায়। এখানেই তফাৎ। তাছাড়া উন্নত বিশ্বে নিয়ম ভেঙে গাড়ি চালানোর জন্য যানজট লাগে না বা তীব্রতর হয় না। সেখানে হাইওয়েগুলিতে মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে না, যা আমাদের পাঁজরে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। উৎসব-পার্বনের সহোদর হিসেবে যানজট লাগবেই, কিন্ত সেটা যেন জনদুর্ভোগে পরিণত না হয় সে দিকেই নজর দিতে হবে বেশি। কেউ যদি বলে ঈদের সময় বাংলাদেশের মূল সড়কগুলিতে যানজট হবে না, সেটি ভুল বলা হবে। তবে জনদুর্ভোগ কমানোর আশাবাদও ভুল নয়, সেটি সম্ভব।

আসলে বাংলাদেশে যোগাযোগ খাতের উৎসবকালীন ব্যবস্থাপনা নিয়ে খুব একটা চিন্তা-ভাবনা করা হয় বলে মনে হয় না। যা করা হয় তা হল, খুব ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ঈদের আগে বাস, ট্রেন ও লঞ্চের অগ্রিম টিকেট বিক্রির কার্যক্রম। যখন চাহিদার চেয়ে যোগান কম হয় তখন, অর্থনীতির সুত্র অনুযায়ী. 'আগে আসলে, আগে পাবেন' নীতি বলবৎ করা হয়। এতে কিন্ত মূল সমস্যার সমাধান হয়ে যায় না। বরং সেখানেও আরেক অব্যবস্থাপনার শিকার হয়ে অন্য ধরনের জনদুর্ভোগে পড়েন টিকেট-ক্রেতা। পথের সমস্যাটির পথেই সমাধান করতে হবে, সেটিকে টিকেট কাউন্টারে সমাধান করা যাবে না। পথে নিরাপত্তা ও স্বস্তি নিশ্চিত করতে পারলে, মানুষ পথের দেরি মেনে নিয়ে হুড়োহুড়ি থেকে বিরত থাকবে, যেটা উন্নত বিশ্বে দেখা যায়।

ঈদের সময় আমাদের সামগ্রিক ভোগের পরিমাণ বেড়ে যায়। এই বর্ধিত ভোগের প্রকরণ অনেক। এক সময় ছিল যখন ঈদ ঘিরে মানুষের কেনাকাটা ভোগ্যপণ্য, যেমন উন্নতমানের খাবার-দাবার ও পোশাক-আশাকেই সীমাবদ্ধ থাকত। পরিবর্তনের হাওয়া সেখানেও লেগেছে। এখন প্রতি বছর ঈদ সামনে রেখে অথবা ঈদের পরে প্রচুর মানুষ দেশের ভিতরে কিংবা বাইরে বেড়াতে যায়। কোনো একটি দেশে মানুষের আয়-উপার্জন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোগের এই কাঠামোগত পরিবর্তন খুব স্বাভাবিক ঘটনা।

এ পরিবর্তন বাংলাদেশের পর্যটন খাতের বিকাশের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা হিসেবে কাজ করবে। অবশ্য বাংলাদেশে পর্যটন খাতের বিকাশের ক্ষেত্রে চাহিদা অপ্রতুল তা নয় বরং যোগানেরই সংকট। ঈদের সময় এ সংকট আরও বেশি অনুভূত হয়। আর এ কারণেই অনেক দেশীয় পর্যটক তখন বিদেশে বেড়াতে যান। অর্থনৈতিক পরিভাষায় তখন সেবা খাতে বাংলাদেশের আমদানি অনেক বেড়ে যায়। তার একটা প্রভাব তো আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের উপর পড়ে।

বিভিন্ন সূত্রের তথ্যানুযায়ী প্রতি ঈদের সময় প্রায় ২ লাখ দেশীয় পর্যটক বিভিন্ন দেশে বেড়াতে যায়। এরা যদি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে মাথাপিছু ১,০০০ হাজার মার্কিন ডলারও নিয়ে যায়, তাহলে এর মোট অংক দাঁড়ায় ২০০ মিলিয়ন ডলার, যা বছরে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ শুধু দুই ঈদের সময় আমাদের পর্যটন খাতে আমদানির অংক প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার। বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন নিয়ে আমাদের যে ঠোকাঠুকি লেগেছিল তার অংক ছিল ১.২ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎআমাদের তিন বছরের ঈদকালীন পর্যটন-আমদানির সমান।

বিশ্ব ঘুরে দেখা মানুষের সহজাত স্বভাব বা আকাঙ্ক্ষা। সুতরাং স্বচ্ছলতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের মানুষ বিদেশে যাবেই। আর গত দুদশকে দেশের মানুষের আয়-উপার্জন যে বেড়েছে সেটা 'বলিলে অহংকার হইতে পারে কিন্ত মিথ্যাবাদ হয় না'। কিন্ত সেই অহংকারের সঙ্গে মিল রেখে মধ্যবিত্তের জন্য মানসম্পন্ন পর্যটন খাত গড়ে উঠেনি। সড়কপথের দুর্ভোগ এড়িয়ে আকাশপথে কক্সবাজারে গিয়ে একটি মোটামুটি মানের হোটেলে থাকলে যে খরচ পড়ে, তা বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে ব্যাংককে বেড়াতে যাওয়ার খরচের প্রায় কাছাকাছি।

এত সুন্দর প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন পর্যটকদের কাছে আকর্ষণ হিসেবে কেন মালয়েশিয়ার লংকাভীর সমকক্ষ হয়ে ওঠেনি, তা নিয়ে না ভাবলে বাংলাদেশ থেকে ঈদের সময় বিদেশগামী পর্যটকের সংখ্যা ২ লাখ থেকে বেড়ে ৩ লাখে দাঁড়াবে, ৩ লাখ থেকে বেড়ে ৪ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। আর আমাদের ভূখণ্ডের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অঞ্চল পার্বত্য চট্টগ্রামে তো তেমন কোনো পর্যটন কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি। যা-ও কিছু হয়েছে সে সব আবার সাধারণ জনগণের জন্য অবাধ, উন্মুক্ত নয়।

হ্রদ, পাহাড়, সবুজ আর সাংস্কৃতিক ও জীবনপ্রণালীর ভিন্নতার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের আছে পর্যটনের এক অপার সম্ভাবনা। এ সম্ভাবনা কাজে লাগানোর জন্য শুধু কর্পোরেট সেক্টরের দিকে তাকিয়ে না থেকে সরকারের উচিত সেখানে কটেজ-ভিত্তিক পর্যটন সুবিধা গড়ে তোলার দিকে নজর দেওয়া। বিদেশে যা Bed and Breakfast নামে পরিচিত, পার্বত্য চট্টগ্রামে এ ধরনের পরিবার-কেন্দ্রিক পর্যটন সুবিধা গড়ে তুলতে সহায়তা করা দরকার। এ কাজে সেখানকার আদিবাসীদের সম্পৃক্ত করলে সবচেয়ে ভালো হবে। কে না চাইবে, বিশাল হ্রদের মাঝখানের কিংবা ধারের সবুজ পাহাড়ের নির্মল বিশুদ্ধতায় আদিবাসীদের নির্ভয় আতিথেয়তায় নির্ভার মনে দুটো দিন কাটিয়ে আসতে?

বর্তমানে সেখানে যে পরিবেশ বিরাজ করছে, তাতে অবশ্য এই প্রস্তাবনা অভিলাষী মনের অবাস্তব আকাঙ্ক্ষা মনে হতে পারে। কিন্ত এক জায়গা থেকে তো সীমিত আকারে হলেও শুরু করতে হবে। যখন এর অর্থনৈতিক সুফল ওখানকার বাসিন্দাদের কাছে প্রতিভাত হয়ে উঠবে, কাজটি তখন আর এত কঠিন মনে হবে না। অর্থনীতি সবচেয়ে বড় নীতি, যা পাল্টে দিতে পারে অনেক কিছু।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে এগুচ্ছে। আর এই এগোনোর গতিতে পাল্টে যাচ্ছে ভোগ ও চাহিদার চরিত্র। মানুষ এখন দল বেঁধে মধ্যরাতে রেস্টুরেন্টে গিয়ে সেহরি খায়, পিৎজার দোকানে গিয়ে ইফতার করে, অনলাইনে কোরবানির গরু কিনে আর কোরবানির পর বা আগের দিন দল বেঁধে দেশে-বিদেশে বেড়াতে যায়। আমাদের অভ্যন্তরীন যোগান ব্যবস্থা যত তাড়াতাড়ি পরিবর্তনটি সুযোগ হিসেবে কাজে লাগানোর জন্য নিজেদের তৈরি করতে পারবে, উন্নয়নের চাকা তত গতি পাবে।