বিশিষ্টজনের মধ্যস্থতায় চলমান সংকট দূর হওয়া উচিত

রাজু আহমেদ
Published : 16 Feb 2015, 05:42 AM
Updated : 16 Feb 2015, 05:42 AM

স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে যতগুলো সংকটের জন্ম হয়েছে তার মধ্যে বর্তমানে চলমান রাজনৈতিক সংকট অন্যতম মারাত্মক ও ভয়াবহ । সময়ের তালে পাল্লা দিয়ে সংকটের তীব্রতা দিন দিন গাঢ় হচ্ছে । দিন যত এগুচ্ছে মানুষের প্রতি মানুষের আন্তরিকতা ও সহিষ্ণুতা লোপ পেয়ে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে । কিছু আধুনিক সরঞ্জাম ব্যবহৃত হচ্ছে রাজনীতির চর্চায়ও । শাসক দল আইনত বৈধভাবেই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এবং তাদের বিরোধীদলকে দমন-পীড়নে যেমনিভাবে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করছে তেমনি সন্ত্রাসী এবং সরকার বিরোধীপক্ষও ক্ষমতাশীনদের প্রতি অনস্থা প্রকাশ এবং হুমকি স্বরূপ এমন কিছু নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করছে । প্রযুক্তি সব সময় মানুষের কল্যান করে না । বর্তমানে দেশের বিভিন্ন অঙ্গনে সরকার পক্ষ যেভাবে প্রযুক্তিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার পাঁয়তার চালাচ্ছে ভিন্নমতকে দমনে তেমনি বিরোধীপক্ষও হাত গুটিয়ে বসে নাই । যার ফলাফলে, অগণিত মানুষের প্রাণনাশ, লাখ লাখ কোটি টাকার সম্পদ যেভাবে নষ্ট হচ্ছে তেমনি ভবিষ্যতে কোন অশুভ শক্তি রাষ্ট্রের গভীরে ভিত্তিমূল প্রথিত করার সমূহ সুযোগ পেতে যাচ্ছে বলেই সূধী জনের অনেকই অনুমান করছেন । দেশের বৈধ রাজনৈতিক দলগুলো ছাড়া যারাই শক্তিশালী হোক না কেন তা রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য যেমন হুমকি স্বরূপ তেমনি দেশের সকল মানুষের কাছেও অনাকাঙ্খিত । তবে রাজনৈতিক দলগুলো যদি পরস্পরের সাথে রাজনৈতিক অঙ্গনে সহাবস্থান ও সমঝোতার মাধ্যমে দেশ ও দেশের মানুষকে পরিচালিত করতে ব্যর্থ হয় এবং অশুভ কোন শক্তি রাজনৈতিক দলগুলোর স্থান দখল করতে সামর্থ লাভ করে তবে এ দূর্ঘটনার দায়ভারের পুরো অংশ রাজনৈতিক দলগুলোকেই নিতে হবে । রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক মতাদর্শের দূরত্ব ও সম্পূর্ণ বিপরীতমূখী অবস্থান এবং দেশের সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে স্বার্থ আদায়ের প্রচেষ্টা, অশুভ শক্তির জন্য তাদের কাজকে সহজ সুযোগে রূপ দেবে । গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ কোন রাজনৈতিক দল কর্তৃক সরকার গঠন এবং জনসাধরণকে শাসন ব্যতিরেকে অন্যকোন দল বা গোষ্ঠী যদি শাসনক্ষমতায় আরোহনের সুযোগ পায় তবে তা দেশের মানুষের জন্য জগদ্দল পাথর হবে । যদিও ইতোপূর্বে শাসকদলের স্বেচ্ছাচারিতা কিংবা রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পর বিরোধী অবস্থানের কারণে এমন জগদ্দল পাথর জনগণের কাঁধে বহুবার চেপেছিল এবং রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মীদেরকেই এর জন্য বেশি খেসারত দিতে হয়েছিল তবুও পূনরায় তেমন সম্ভাবনা উঁকি দেওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে । চলমান রাজনৈতিক সংকট যদি সমাধান না হয় তবে অনাকাঙ্খিত কিছুর স্বাক্ষী দেশবাসীকে হলেও হতে পারে । যে ইস্যুকে কেন্দ্র করে সরকার এবং তাদের বিরোধীপক্ষ দীর্ঘ মাসব্যাপী আন্দোলনে আছে তার সমাধান ঠিক কোন পথে হবে তা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকেই । যদিও দেশের ভিতরে এবং বাইরের একটি পক্ষ সমস্যা সমাধানে সরকারকে পরামর্শ এবং চাপ দিচ্ছে কিন্তু সরকার তা এড়িয়ে চলতে চাইছে । ক্ষমতাশীনদল বিরোধীপক্ষের দাবী কতদিন এড়িয়ে চলতে পারবে তা নিশ্চিত নয় এজন্য যে, যারা সরকারের সরাসরি বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে দাবী আদায়ের চেষ্টা করছে তারা একেবারে জনবিচ্ছিন্ন কোন শক্তি নয় বরং শাসক দলের প্রায় সমপরিমাণ জনসমর্থন নিয়েই তারা আন্দোলনে নেমেছে । এছাড়াও তারা তাদের আন্দোলনের পক্ষে বিশ্বের বেশ কয়েকটি শক্তিধর রাষ্ট্রের সমভাবাপন্ন মনোভাবের সহায়তা লাভের সমর্থণ পেয়েছেন । যদিও এদেশের বিজ্ঞজন এবং দেশপ্রেমী মহল কখনো চাইবে না, আমাদের দেশের কোন ব্যাপারেই বিদেশী কোন নাগরিক কিংবা সংঘঠন অথবা রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করুক । আমাদের দেশ পরিচালনার নীতিমালা কি হবে তা অন্য কেউ বাহিরে বসে নির্ধারণ করে দেবে তা আকাঙ্খিত নয় তবুও যখন দেশের রাজনৈতিক দলগুলো এবং এর কর্তাব্যক্তিরা একে অপরের ছায়া মাড়াতেও অনিচ্ছুক তখন কোন পক্ষ যদি কর্তৃত্ব করার সুযোগ পায় তখন তারা আসবেই এবং সাধারণ মানুষও উপায়ান্তর না দেখে মনে প্রাণে চাইবে যে কোন ভাবেই সমস্যার সমাধান হোক ।

দেশের মধ্যে কি এমন কোন নিরপেক্ষ ব্যক্তি নাই যারা চলমান সমস্যা নিরসনের জন্য দু'পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতার ক্ষমতা রাখে ? অবশ্যই আছে । কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোই তাদেরকে ভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে দলীয় তকমা দেয়ার চেষ্টা করছে । বিশ্বের ইতিহাসের সর্বত্রই ক্ষমতাশীন দলগুলোর একটু দাম্ভিকতা থাকে এবং তারা বিভিন্ন ক্ষমতার প্রয়োগে টিকে থাকতে চায় । কেননা ক্ষমতা এমন এক সম্মোহনী শক্তি যা কখনো কখনো ন্যায় বিচারককেও ন্যায়-নীতির প্রশ্নে অন্ধ সাজাতে পারে । তদ্রুপ বিরোধীপক্ষও ক্ষমতা লাভের জন্য গণতান্ত্রিক পন্থাকে উপেক্ষা করে সহিংসতা চালাতে পারে । ক্রিকেট বিশ্বে যেমন পাকিস্তানকে নিয়ে কোন ভবিষ্যতবাণী করা চলে না তদ্রুপ বর্তমান দেশের রাজনৈতিক অবস্থা । বিএনপির ডাকা হরতাল, অবরোধে দেশের বিভিন্ন স্থানে পেট্রোল বোমা হামলায় নিহত হয়েছে প্রায় অর্ধশত । আহতের সংখ্যাও সহস্রাধিক । আন্দোলন যেহেতু বিএনপির কাজেই সকল সহিংসতার দায়ভারও স্বাভাবিকভাবেই তাদের কিন্তু মাঝে মাঝে মিডিয়ায় কিছু বিস্ময়কর সংবাদ উঠে আসে । দেশের কয়েকটি স্থানে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ কর্মীরা পেট্রোলবোমাসহ আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর কাছে গ্রেফতার হয়েছে ! দেশের সাধারণ ও নিরপেক্ষ মানুষও এ সংবাদ শুনে খেই হারিয়ে ফেলে, কেননা ভেবে পায় না তারা কোন পক্ষে দাঁড়াবে ? বর্তমানে সরকার পক্ষের কতিপয় প্রভাবশালী মন্ত্রী মিডিয়াকেই ক্ষমতাশীনদের প্রধান শত্রু বলে আখ্যা দিয়েছেন । তাদের ব্যাখ্যায় কিছুটা বিস্ময় প্রকাশ পায় কেননা দেশে যে মিডিয়াগুলো চালু আছে তার একটিও কি বিএনপির পক্ষে কিংবা সরকারের বিপক্ষে কোন মিথ্যা তথ্য কিংবা সংবাদ প্রকাশ-প্রচারের ক্ষমতা রাখে ?

দেশের কিছু বিশিষ্টজন (যদিও তাদেরকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ বলা চলে না তবুও তারা দলকানা নন) উদ্যোগী হয়ে রাষ্ট্রপতি, সরকার প্রধান ও যার নির্দেশে আন্দোলন চলছে তাদের নিকটে চলমান সমস্যার সমাধানকল্পে এগিয়ে আসার জন্য চিঠি দিয়েছেন । ক্ষমতাশীনদের পক্ষ থেকে তাদেরকে পাল্টা শর্ত দিয়ে তাদের আহ্বানকে উপেক্ষা করা হয়েছে এবং কেউ কেউ এ উদ্যোগ নিযে হাস্যরসও করেছেন । বিএনপির পক্ষ থেকে এ বিষয় কোন বিবৃতি আসা না আসা সমান, কেননা তাদের পক্ষ থেকে আলোচনার দাবীকে কেন্দ্র করেই আন্দোলন চলছে । সরকার এবং তাদের বিরোধীপক্ষের বর্তমান অবস্থান দেখে মনে হচ্ছে, দেশের সমস্যা দেশের মানুষের দ্বারা সমাধান বোধহয় সম্ভব হচ্ছে না অথচ নিজেদের সমস্যার সমাধানে নিজেদেরকেই এগিয়ে আসা উচিত ছিল । পাকিস্তানের প্রভূত্ব মানবো না বলেই '৭১ এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমাদের পূর্বসূরীরা স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল । ছিনিয়ে আনা সে স্বাধীনতা যুগ যুগ ধরেই আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার । অথচ স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আমাদের গর্বের স্থানে বারবার কুঠারাঘাত করা হয়েছে । বিদেশী ষড়যন্ত্র ও স্বৈরশাসন বারংবার আমাদের স্বাধনীতার মর‌্যাদাকে কলুষিত করেছে । তবুও আমাদের শিক্ষা হয়নি । আবারও বোধহয় পা বাড়াচ্ছি অজানার পথে । সরকার যদি সংলাপে বসে তাতে সরকার তার দাবী কিংবা সংবিধান থেকে বিচ্যুত হয়ে যাবে এমন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না । বিভিন্ন সংস্থার জরিপ অনুযায়ী, জন্মলগ্ন থেকেই আওয়ামীলীগের পক্ষে যেমন ৪০ শতাংশ জনগণের সমর্থণ রয়েছে তেমনি বিএনপির পক্ষেও ৩৫ শতাংশ জনগণের সরাসরি সমর্থন রয়েছে । জোট হিসেবে বাকী ২৫ শতাংশের সিংহভাগও ধীরে ধীরে একদিকে ঝুঁকছে অথচ এটা ঝোঁকার কথা ছিল না কিন্তু কিছু সিদ্ধান্তের কারণে মানুষের মনে ক্ষোভ সৃষ্টি হচ্ছে । গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রাণ জনমত অথচ তাই যদি উপেক্ষিত হয় তবে গণতন্ত্রের মর‌্যাদা কোথায় থাকে ?

দেশের কোন মানুষ দেশের সমস্যা সমাধানের জন্য বিদেশীদের হস্তক্ষেপ কামনা করে না । কারণ বিদেশীদের হস্তক্ষেপে অনেকগুলো নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে । দেশের ভাবমূর্তি বর্হিবিশ্বে ক্ষুণ্ন হবে এবং আমাদের দেশের ওপর তাদের এক ধরণের প্রভূত্ব সৃষ্টি হবে । স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে এটা কাম্য নয় । জঙ্গি কিংবা ভিন্ন ইস্যু দাঁড় করাতে গিয়ে যেন দেশটা পশ্চিমাদের কাছে আতঙ্কের নগরিতে পরিণত এবং পাকিস্তান কিংবা আফগানিস্তানের মত পরিণতও না হয় । সামান্য একটু স্বার্থত্যাগ করলে অস্তিত্ববিলীন হয়না বরং সাধারণ মানুষের কাছে সম্মান বাড়ে । সত্যিকারার্থেই দেশের মানুষ স্বাভাবিক পাবে নিঃশ্বাস নিতে, চলাচল করতে ভূলে গেছে । শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিতে পারছে না, ব্যবসায়ী ব্যবসা করতে পারছে না কিংবা শ্রমিক শ্রম বিক্রি করার সুযোগ পাচ্ছে না । দিনমজুরের পরিবারের সদস্যদের না খেয়ে মরার উপক্রম । হাসপাতালগুলোতে দ্বগ্ধ ও আহত মানুষের আহাজারি, সর্বত্র স্বজন হারানোদের চিৎকার-এভাবে আর কত দিন ? সমাধান হওয়া জরুরী । দেশের ৯০ ভাগ মানুষ মনে করে, সংলাপেই সমাধান হবে । তৎপরবর্তীতে সরকারের পক্ষে কিংবা আন্দোলনকারীদের পক্ষে সিদ্ধান্ত আসবে এবং দু'দলের সে সিদ্ধান্ত মেনে নেয়ার মানসিকতা তৈরি করা উচিত । বর্হিবিশ্বের হস্তক্ষেপ কিংবা কোন অশুভ শক্তি যেন আমাদের স্বাধীনতা কিংবা গণতন্ত্রকে কলঙ্কিত করার সুযোগ না পায় । দেশের বিতর্কের উর্ধ্বের বিষয়গুলোকে বিতর্কমুক্ত রেখে একটি সমাধানে চেষ্টা করা সময়ের দাবী । দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা যে পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছেন তাতে সমর্থন ও সহায়তা করা দু'পক্ষেরই উচিত । শুক্র ও শনিবার ব্যতীত হরতাল এবং টানা অবরোধ চলছে মাসাবধিকাল জুড়ে । এভাবে কি কোন স্বাধীন দেশ চলতে পারে ? এভাবে চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতি, ব্যবসা, শিক্ষাখাত টিকবে ? সকল রাজনৈতিক দলের উচিত, জনসাধারণে কল্যানে রাজনীতির চর্চার মানসিকতা তৈরি করা । ব্যক্তি কিংবা দলীয় স্বার্থে রাজনৈতিক কর্মকান্ডকে পুঞ্জীবুঁত করতে চাইলে তার গচ্চা দিতে হবে, অতীতেও তেমনটাই হয়েছিল ।

রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ।

raju69mathbaria@gmail.com