কেমন আছ প্রাণের বাংলাদেশ?

রাজু আহমেদ
Published : 18 Feb 2015, 06:26 PM
Updated : 18 Feb 2015, 06:26 PM

অনেকটা নিরবে নিভৃতে কেটে যাচ্ছে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি । ফেব্রুয়ারি এলেই মাসব্যাপি বইমেলার আয়োজন ভাষার উৎসবকে আলাদা রং দেয় । উচ্ছ্বাস-উচ্ছলতায়এবংআবেগ-ভালোবাসায় মাতিয়ে রাখে প্রতিটি বাংলাদেশীর হৃদয় । দেশব্যাপী সরব হয় আনন্দঘণ উৎসবমুখর পরিবেশ। দেশের এমনকি দেশের বাইরের প্রতিটি বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে বইমেলা প্রাঙ্গনে ছুটে আসার প্রিয় লেখক, পাঠক কিংবা বন্ধু মহলের সাথে আড্ডায় ক্ষনকাল কাটানোর জন্য মনে অদম্যস্পৃহ ব্যাকুলতা জাগে । ভাষা উৎসবকে যেন পূর্ণতা দেয় বইমেলা । বাংলা ভাষায় প্রকাশিত লাখ লাখ নতুন বইয়ে মেলার প্রতিটি স্টল ভরে ওঠে । তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবারের বই মেলার চিত্র কিছুটা ভিন্ন । ঢাকা থেকে দূরবর্তী এলাকার বেশির ভাগ বইপ্রেমী এবারের মেলায় যেতে সাহস পাচ্ছে না । আর যাই হোক জীবনের সাথে তো অন্য কিছুর তুলনা চলে না । জীবনের নিরাপত্তার চেয়ে অন্য কিছুকে তো অগ্রাধিকার দেয়া যায় না । তবুও ঢাকা এবং আশপাশ এলাকার বই প্রেমী লাখ লাখ পাঠক ও দর্শণার্থীর ভীড়ে প্রতিদিন যেন বেইমেলা নতুনভাবে নিজেক সজ্জিত করে। বিশেষকরে শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনহওয়ায় (অবশ্য সাম্প্রতিককালে গোটা দেশ এ দুদিন দেশ হরতালমুক্তথাকে ও শিথিলভাবে অবরোধপালিত হয়) শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সের মানুষ বই কেনা, লেখকের সাথে কিছু সময় কাটানো কিংবা শুধু বইয়ের মোড়ক দেখা এবং নতুন বইয়ের গন্ধ শুঁকতে মেলায় চলে আসে । লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতি দেখলে মন আনন্দে ভরে যায় । ভাবতেই ভালো লাগে, এমন অনিশ্চয়তার মধ্যেও অগণন বইপ্রেমী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জ্ঞানের রাজ্যে ঘুরতে আসে।

আমাদের সীমান্তবর্তী ভারতের কলকাতাতেও বিশাল পরিসরে বই মেলার আয়োজন হয় তবে সেখানে বছরের প্রায় পুরো সময় জুড়ে জনপ্রিয় ও নতুন লেখকদের বই প্রকাশিত হয় কিন্তু আমাদের দেশের নিয়মটা দিন দিন বদলাতে শুরু হয়েছে । এখানকার লেখকরা যেমন বই মেলাকে প্রধান্য দিয়ে বই লেখেন তেমনি প্রকাশকরাও বই মেলাকে কেন্দ্রকরে বই প্রকাশ করে । তাইতো দেশে প্রতি বছর লাখ লাখ নতুন বই প্রকাশিত হলেও দেশের প্রকাশনা সে অর্থে এখনো শিল্পে রূপ নেয়নি । লেখক এবং প্রকাশকদের বই মেলাকে প্রধান্য দেয়ার অবশ্য কয়েক ধরণের কারণও আছে । 'বই পড়া' নামক প্রবন্ধে লেখক বলেছেন, 'বই পড়ে কেউ দেউলিয়া হয়না' ।

পাঠক বই পড়তে চাইলে তো লেখককে নতুন নতুন বই লিখতে হবে এবং প্রকাশকে সে বই পাঠকের হাতে পৌঁছানোর জন্য বাজারজাত করার প্রক্রিয়া করতে হবে কিন্তু দূর্ভাগ্যের হলেও সত্য, বই পড়ে কাউকে দেউলিয়া না হতে হলেও বই প্রকাশ করে অনেক প্রকশনা সংস্থাকে দেউলিয়া হতে হয়েছে । যে জন্য বেশিরভাগ প্রকাশক ঝুঁকি নিয়ে বই প্রকাশ করতে চান না এবং লেখকদের অধিকাংশের নিজ খরচে বই প্রকাশের আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় অনেকের লেখক জীবন কেবল পান্ডুলিপিতেই সীমাবদ্ধ থেকে যায় । আবার কখনো কখনো লেখক ও প্রকাশক অধিক মুনাফা লাভের আকাঙ্খায় শুধু বই মেলা ছাড়া বই প্রকাশ করেন না । তবুও দেশে অনেক পাঠক আছে কিন্তু বইয়ের ক্রেতা কম থাকায় ব্যবসায়িক ঝুঁকি নিয়ে প্রকাশকরা বই প্রকাশ করতে চান না।সেই সাথে এ বছর বই মেলার মাসে টানা অবরোধ ও হরতাল থাকায় হয়ত এ বছর বই মেলায় এর তেমন প্রভাব ফেলবে না কিন্তু আগামী বছর প্রকাশকরা বই প্রকাশে কতটা উৎসাহী থাকবেন সেটা ভাবনার বিষয় । লেখকরা হয়ত জীবনের পরমানন্দ আস্বাদনের জন্যই বই লেখেন কিন্তু প্রকাশকদের তো বই প্রকাশের পেশা দ্বারা জীবন ও জীবিকা অর্জন করতে হয়। চলমান হরতাল ও অবরোধে প্রকাশকদের পেটে লাথি পড়লে সে ধাক্কা সামলে পূনরায় সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আবার কতটা ঝুঁকি নিয়ে বই প্রকাশের মানসিকতায় থাকবেন সেটা সময় বলে দিবে । সরকারের পক্ষ থেকে মেলাস্থানের নিরাপত্তা শতভাগ নিশ্চিত করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে কিন্তু পাঠক, ক্রেতা ও দর্শণার্থীদেরকে তো অন্তত মেলাস্থল পর‌্যন্ত নিরাপদে পৌঁছতে হবে । দর্শণার্থী কিংবা পাঠকের কথা না হয় বাদ দিলাম কিন্তু দেশের এমন অনেক স্বণামধণ্য লেখকের নাম জানি যাদের একাধিক বইএ বছরের বই মেলায় প্রকাশ হলেও শুধু নিরাপত্তাহীনতার কারণে মেলার মাসের অর্ধেকর বেশি সময় কেটে গেলেও তারা মেলায় আসতে সাহস করেননি । অথচ কোন লেখকের বই মেলায় আসলে সে মেলায় না এসে পারে না । দিনের বেলায় শত ব্যস্ততার মধ্যে হয়ত মেলার কথা স্মরণ নাও হতে পারে কিন্তু নতুন বইয়ের গন্ধ এবং পাঠকের সাথে আড্ডা দিতে না পারলে প্রকৃত কোন লেখকের রাতে ঘুম আসার কথা নয় ।

মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়ের পর দীর্ঘ ৬৩ বছর পার হতে চলল । রক্তের বিনিময়ে অর্জিত মায়ের মুখের ভাষা বাংলা আজ পৃথিবীতে স্বতন্ত্র মর‌্যাদায়সম্মানের স্থান পেয়েছে । মাতৃভাষা হিসেবে বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তর জনগোষ্ঠী তাদের প্রধান ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে ব্যবহার করছে । বিশ্বের সকল দেশের সকল জাতি জেনেছে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করতে বাঙালী জাতি দীর্ঘ সংগ্রাম করেছে ও অসংখ্য মানুষের প্রাণ এবং এক সাগর রক্তের বিনিময়ে মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ছেড়েছে । আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনোস্ক বাঙালী জাতির মহীয়সী অর্জনকে বিশ্বের সকল মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে '৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারীকে দিয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি । সুতরাং ২১ ফেব্রুয়ারীকে এখন আর বাংলাদেশীদের নিজস্ব সম্পদ বলে দাবি করার যৌক্তিকতা নাই বরং বাংলাদেশী হিসেবে এ ভূমির প্রতিটি নাগরিকের অত্যন্ত গর্বের যে, মাতৃভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের ইতিহাস এবং মাতৃভাষার প্রতি আলাদা সম্মানবোধ সৃষ্টিতে বাঙালীর অকৃত্রিম ত্যাগের স্বীকতি স্বরূপ বিশ্ববাসী প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারী শ্রদ্ধার সাথে অবনত মস্তিষ্কেআন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করে। এর চেয়ে সম্মানের প্রাপ্তি আর কি হতে পারে ? ২১ ফেব্রুয়ারীকে ঘিরে বিশ্বাবাসী শুধু বাঙালীদের মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার অংশটুকুই জানে কিন্তুপরবর্তীকালে এর প্রাপ্তি দ্বারা সূচিত বৃহৎ অর্জনের কথা তাদের অঘোচরেই রয়ে গেছে । ২১ ফেব্রুয়ারী শুধু মাতৃভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠার দিন নয় বরং পূর্ব পাকিস্তানীদের পক্ষে সর্বপ্রথম দাবী আন্দোলনের শিক্ষা এবং সাফল্য অর্জনের দিনও বটে । যে সফলতা পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে কন্ঠস্বর উঁচু রেখে দাবি আদায়ের সোপান রচনা করেছিল । গণঅভ্যূত্থান কিংবা '৭১ এ স্বাধীনতা অর্জন '৫২ এর সাফল্যের ধারাবাহিকতার ফল মাত্র ।

স্বাধীন বাংলাদেশ ও বাংলাদেশীর ব্যক্তি স্বাধীনতা অর্জনের ৪৪ তম বার্ষিকি পার করেছি । এতদিন কেবল জানতে চেয়েছি, কেমন আছি আমরা ? ভাষা আন্দোলন এবং স্বাধীনতার দীর্ঘ পথ পারি দিয়ে আজ জানতে ইচ্ছা করছে, বাংলাদেশ তুমি কেমন আছ ? নিশ্চয়ই ভালো ! দেশের বৃহৎ দু'টো রাজনৈতিক দলের দ্বন্ধে টানা অবরোধ ও সপ্তাহে প্রায় পাঁচ দিন হরতালের স্বাদ পেয়ে তুমি ভালো না থেকে পার ! তুমি ভালো থাকলেও এদেশের মানুষ ভালো নাই । যারামুখে কৃত্রিম হাসি এঁকে ভালো থাকার অভিনয় করছে তারা ভেতরে ভেতরে আরোবেশি পুড়ছে যদি তারা দেশপ্রেমিক হয়ে থাকে । যে দেশের কৃষক, সাধারণ মানুষ ভালো নাই সে দেশের অন্যরা ভালো আছে তা বলি কোন ভরসায় । যতই বলো ভালো আছি, নিশ্চিত জানি বাংলাদেশ তুমিও ভালো নাই । তোমার বুকের সমস্যা নিয়ে বিশ্বের তাবৎ রাষ্ট্রগুলো আলোচনা করছে, বেঠকে বসছে, হুমকি দিচ্ছে-এরপরেও তুমি ভালো থাকতে পার ? শুনছি তোমার ভবিষ্যত নির্ধারণ করতে বিদেশীদেরপ্রতিনিধি আসবে কিন্তু নিজেরাই তো সমস্যার সমাধান করতে পারতাম । আমাদের স্বার্থলোভী মানসিকতায় তোমার উপর দিয়ে অনেক ধকল যাবে তবুও উপায় কি ? আমরা তো আমাদের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত । তুমি কি ভূলে গেছ ?'৫২ সালে তুমি স্বাধীন ছিলে না কিন্তু তোমার বুকেঅবস্থান করে মানুষ কোন ভাষায় কথা বলবে তা নির্ধারণ করতে কারো চোখ রাঙানি কিংবা কারো হস্তক্ষেপের পরোয়া করিনি । আমাদের ভাগ্য আমরাই নির্ধারণ করেছিলাম । '৭১ এর ইতিহাস তো আরো বহুল আলোচিত । আমরা স্বাধীন হয়েছি আমাদের শক্তিকেপুঁজি করে। বিশ্বের বর্তমান সুপার পাওয়ার আমেরিকা সেদিন আমাদেরস্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল কিন্তু দমে যাইনি বরং স্বাধীনতার মন্ত্রেই এগিয়ে ছিলাম এবং সাফল্যও পেয়েছি । অনেকের অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্থান দিতে হয়েছে । সেই বাংলাদেশের তবে এখন কেন এমন অবস্থা ! এমন পরিনতি ! জানুয়ারির ৬ তারিখ থেকে টানা অবরোধ চলছে । থেমে থেমে হরতাল তো আছেই । প্রায় শ'সংখ্যক মানুষের জীবনহানীও হয়েছে শুধু স্বার্থান্বেষী মহলের ঘৃন্য রাজনীতি চর্চার খেসারত স্বরূপ । রাজনৈতিক সংকটের সমাধান একদিন হবেই কিন্তু সাধারণ নিরাপরাধ মানুষের জীবনের মূল্য দিতে কেউ এগিয়ে আসবে না । স্বজন হারানোদের বুক ফাটা কষ্টের বেদনা রাজনীতিকদের মুখে কিছুদিন শোভা পাবে হয়ত কিন্তু পাশে দাঁড়িয়ে সত্যিকারের সহোযোগীতার হাত কেউ বাড়াবে না, বাড়ায়নি কোনদিন । যে দেশের শিক্ষার্থীরা নির্বিঘ্নে পরীক্ষা ও ক্লাসে অংশগ্রহন করতে পারে না, মজুর তার মজুরী বিক্রি করে দিনযাপন করতে পারে না, পেশাজীবিরা জীবনের নিশ্চয়তা নিয়ে অফিস কিংবা কর্মস্থলে যাত্রা করতে পারে না- সে দেশের মানুষ ভালো নাই কিংবা ভালো থাকতেও পারে না । আর যে দেশের মানুষ ভালো নাই সে দেশ ভালো আছে এ প্রশ্ন করাও আহম্মকি বহি অন্য কিছু নয় কিন্তু উপায় কি ? কারো বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেলে তো জীবন থেকে পালাতেও হতে পারে তার চেয়ে আশ্রস্থলের কাছেই সুখ-দুঃখ, মনের ব্যথা-বেদনার কথা বলে কিছুটা হাল্কা হওয়াএবং নিজেকে প্রবোধ দেয়ার চেষ্টা করাই উত্তম এবং আপাতত পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াহীন ।

রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ।
raju69mathbaria@gmail.com