ভাষার প্রতি চাই নিখাদ ভালোবাসা

রাজু আহমেদ
Published : 19 Feb 2015, 08:52 PM
Updated : 19 Feb 2015, 08:52 PM

বছর ঘুরে আমাদের দ্বারে উপস্থিত হয়েছে ফাল্গুন মাস । বসন্ত ঋতুর প্রথমমাসটি শুধু প্রাকৃতিক রুপ বৈচিত্র্যের জন্যই শ্রেষ্ঠ নয় বরং এ মাসের সাথেজড়িয়ে আছে বাঙালী ও বাংলা ভাষার অসীম গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস । ফাল্গুন তথাফেব্রুয়ারী ভাষার প্রতি ভালবাসা প্রকাশের মাস । মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলারস্বীকৃতি আদায়ের মাস । মাতৃভাষা রক্ষার মাস । মায়ের মুখের ভাষার অম্লানতারক্ষার লড়াইয়ে জীবন উৎসর্গকারীদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করার মাস ।ফেব্রুয়ারী এলেই আমরা বলি, 'একুশ আমার অহংকার' । বাংলায় হাসি, বাংলায়কাঁদি, বাংলায় করি গান…….। এজন্যই বাঙালী জাতি ইতিহাসের পাতায় পেয়েছেস্বতন্ত্র সম্মানের স্থান । কেননা বিশ্বের মধ্যে বাঙালীই একমাত্র জাতি যারামাতৃভাষা রক্ষার দাবীতে জীবন উৎসর্গ করেছে । রাজপথে ঢেলেছে বুকের তাজারক্ত । বাঙালীর এ বীরত্বপূর্ণ ত্যাগের প্রতি সম্মান জানাতে বিশ্ববাসীওকার্পন্য করেনি । ২১ ফেব্রুয়ারী পেয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসেরস্বীকৃতি । মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গোটা বিশ্বব্যাপী ২১ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয় । বাংলাদেশেরমানুষের কাছে ২১ ফেব্রুয়ারী তথা ৮ ফাল্গুন মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলনেরচুড়ান্ত দিন হলেও এ আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্টপাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হওয়ার পর ।ব্রিটিশদের শাসন-শোষণমুক্ত হয়ে ভারত এবং পাকিস্তান আলাদা রাষ্ট্র হিসেবেপ্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর থেকেই মূলত এ আন্দোলনের সূচনা হয় । পূর্ব পাকিস্তানএবং পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষা ভিন্ন হওয়ায় ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট থেকে দুইপাকিস্তানের মধ্যে দ্বন্ধের সূচনা হয় । পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মাতৃভাষাছিল বাংলা, যা দুই পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৬% মানুষের মাতৃভাষা ।অপরদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা ছিল উর্দু । যা দু'ইপাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার মাত্র ২৪% । সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে উপেক্ষা করেপশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানীদের উপর রাষ্ট্র ভাষাহিসাবে উর্দুকে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল । কিন্তু বাঙালী তা মানবে কেন ? সেইথেকে শুরু হল মাতৃভাষার স্বীকৃতি আদায়ের লড়াই । যা প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবেশুরু হয়েছিল ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে । তৎকালীন সময় পূর্ব পাকিস্তানীদের 'তমুদ্দুন মজলিস' নামে একটি সাংস্কৃতিক সংঘ ছিল । তারা পাকিস্তানেররাষ্ট্রভাষা কি হবে, 'উর্দু নাকি বাংলা' ? নামে একখানা পুস্তিকা প্রকাশ করে। সে পুস্তিকায় প্রথম পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে ঘোষণা করারদাবি করা হয় । উল্লেখ্য যে, তৎকালীন সময়ে সরকারী কাজকর্ম ছাড়াও সকলডাকটিকেট, পোষ্ট কার্ড এবং রেলের টিকেটে কেবলমাত্র উর্দু এবং ইংরেজী লেখাহত । পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বাঙালি সংস্কৃতিকে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতিএবং বাংলা ভাষাকে হিন্দুয়ানী ভাষা হিসেবে অভিহিত করে এটাকে প্রত্যাখ্যানকরেছিল । সেজন্য তারা পুর্ব পাকিস্তানী সংস্কৃতিকে 'পাকিস্তানীকরণ' যেটিউর্দু এবং তাদের ভাষায় ইসলামিক করার চেষ্টা চালাতে থাকে । তমুদ্দুন মজলিশেরতৎকালীন সময়ের সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানেরঅধ্যাপক আবুল কাশেম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হওয়া উচিত, সে ব্যাপারে একটি সভা আহ্বান করেন । সে সভায় বাংলাকেরাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে পাকিস্তান সরকারের কাছে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায়আন্দোলন করে দাবি আদায়ের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ।এরপর ১৯৪৭ সালের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানের তৎকালীনশিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের উদ্যোগে পশ্চিম পাকিস্তানে আয়োজিত 'পাকিস্তানএডুকেশনাল কনফারেন্স' এ পূর্ব পাকিস্তান হতে আগত প্রতিনিধিরা উর্দুকেপাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেবাংলাকেও সম-অধিকার প্রদানের দাবি জানান । পরবর্তীতে ৭ নভেম্বর পুর্বপাকিস্তানের সাহিত্য সংসদের সভায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপণকরা হয় । পরবর্তীকালে ১৭ নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হিসাবেবাংলাকে প্রতিষ্ঠার দাবিতে লক্ষাধিক মানুষের গণস্বাক্ষর সম্বলিত স্মারকলিপিপ্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিনের কাছে পেশ করা হয় । ১৯৪৭ সালেরডিসেম্বরে শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের উদ্যোগের বিরুদ্ধে ঢাকায় তমুদ্দুনমজলিশের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবেশ এবং মিছিল হয় । ৮ ডিসেম্বরএকটি সমাবেশ হতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী জানানো হয় । ডিসেম্বরেরশেষের দিকে 'রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ' গঠন করা হয় । ১৯৪৮ সালের ২৫ফেব্রুয়ারী কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত বাঙালী, গণপরিষদের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথদত্ত প্রথমবারেরমত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে একটি বিল আনেন । মজলুমজননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী্ এ বিলের পক্ষে অবস্থান করে সমর্থনজানালেও মুসলিমলীগের অন্যান্য সদস্যরা এ বিলের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েবিরোধিতা করে । পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত সদস্য খাজা নাজিম উদ্দিনছিল এই বিরোধিতার শীর্ষে । তার সমর্থনে বিলটিকে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতিকেপাকিস্তানের সংস্কৃতিতে অনুপ্রবেশের চেষ্টা আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রীলিয়াকত আলী খান এর তীব্র বিরোধিতা করেন এবং বিলটিকে বাতিল করা হয় ।ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তাতে দমে না গিয়ে তিনবার বিভিন্ন সংশোধনীসহ বিলটি পূনরায়উত্থাপন করেন । কিন্তু প্রতিবারই তা একই ভাগ্যবরণ করে । ১৯৪৮ সালের ৪-৭মার্চ পর‌্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির শীর্ষমূখদের নিয়ে 'স্টুডেন্টস এ্যাকশন কমিটি' গঠন করা হয় । এই কমিটি প্রথম বাংলাকেরাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলনের পূর্নাঙ্গ রুপরেখা প্রনয়নকরে । সে ধারাবাহিকতায় ১১ মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার দাবিতেধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয় । একই তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে এক বিরাট সমাবেশের আয়োজন করা হয় । এই সমাবেশ শেষে বেরহওয়ার পথে সরকারের পেটোয়া পুলিশ বাহিনী শামসুল হক, কাজী গোলাম মাহবুব, শেখমুজিবুর রহমান, শওকত আলী এবং অলি আহাদসহ বেশ কয়েকজন ছাত্র ও রাজনৈতিকনেতাকে গ্রেফতার করে । ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর পূর্বপাকিস্তান সফরের প্রক্কালে বিস্ফোরণম্মূখ পরিস্থিতি মোকাবেলায় খাজা নাজিমউদ্দিন স্টুডেন্টস এ্যাকশন কমিটির সাথে বৈঠকে বসেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষাহিসাবে প্রতিষ্ঠার একটি অঙ্গিকারনামা সই করেন । পরবর্তীকালে জিন্নাহ এইঅঙ্গিকারনামা বাতিল করে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করারঘোষণা দেন । যে ঘোষনার মাধ্যমে ২৪% মানুষের দাবী রক্ষা করতে গিয়ে উপক্ষিতহয় ৫৬% মানুষের যৌক্তিক দাবী ।১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এর পূর্বপাকিস্তানে আগমন উপলক্ষে আয়োজিত এক সমাবেশে জিন্নাহ স্পষ্ট ঘোষণা করেন 'উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা' । সমাবেশে উপস্থিতছাত্র-জনতার একাংশ সাথে সাথে প্রতিবাদ জানালেও জিন্নাহ সে প্রতিবাদের প্রতিভ্রুক্ষেপ না করে তার বক্তৃতা অব্যাহত রাখেন । একই বছরের ২৪ মার্চ ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সমাবর্তনে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ 'স্টুডেন্টস রোল ইন নেশন বিল্ডিং' শিরোনামে একটি ভাষণ প্রদান করেন । সেখানেতিনি ক্যাটাগরিক্যালী বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা প্রতিষ্ঠার দাবী নাকচকরে দিয়ে বলেন, 'The state language therefore, must obviously be Urdu, a language that has been nurtured by a hundred million Muslims of this sub-continent. A language understood throughout the length and breadth of Pakistan and above all. A language which more than any other provincial language, embodies the best that is in Islamic culture and Muslim tradition and is nearest to the language used in other Islamic countries'. জিন্নাহর এই বক্তব্য সমাবর্তন স্থলে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টিকরে এবং ছাত্ররা দাঁড়িয়ে 'no' 'no' বলে প্রতিবাদ করেন । জিন্নাহর এই বাংলাবিরোধী স্পষ্ট অবস্থানের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলন আরো বেশিগ্রহনযোগ্যতা লাভ করে এবং আন্দোলন ঢাকার বাইরে ছড়িয়ে পরে ।এরপর দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছরব্যাপী চলতে থাকেআন্দোলন । বাংলাকে যে কোন মূল্যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠাকরতেই হবে । এ উদ্দেশ্যেকে সামনে রেখে গঠিত হতে থাকে একের পর এক কমিটি, সংগঠন । বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার দাবীতে আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করেনমাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, মাওলানা আকরাম খাঁ, তৎকালীন ডাকসুর ভিপিগোলাম আজম, শেখ মুজিবুর রহমান, ভাষাপন্ডিত ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহসহ আরোঅনেকে । পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও বাঙালী ছাত্র-জনতাআন্দোলনকে আরও বেগবান করে । পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র ছড়িয়ে পরেআন্দোলনের দ্বীপশিখা । অবশেষে নিকটবর্তী হয় চুড়ান্ত লড়াইয়ের দিন ।বাঙালীদের আন্দোলনে প্রথম সাফল্য পাওয়ার দিন । আন্দোলন করতে গিয়ে প্রথমজীবন উৎসর্গ করার দিন । ন্যায্য অধিকার আদায়ের দিন । শুরু হয় দুর্বারআন্দোলন । ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারী মাওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে পূর্বপাকিস্তনের সকল রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংঘঠনের একটি সম্মেলনঅনুষ্ঠিত হয় । এই সম্মেলন থেকে কাজী গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করে 'সর্বদলীয়রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ' গঠন করা হয় । সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রামপরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারী সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করে ।৪ঠা ফেব্রুয়ারী ছাত্রদের ডাকে ঢাকা শহরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেস্বতঃস্ফুর্ত ধর্মঘট পালিত হয় । ছাত্ররা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণারদাবীতে তৎকালীনসময়ের সবচেয়ে বড় মিছিল নিয়ে রাজপথ প্রদক্ষিণ করে । ১৮ফেব্রুয়ারী পাকিস্তান সরকার ২১ ফেব্রুয়ারীতে ডাকা সাধারণ ধর্মঘটেরপরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তৎসংলগ্ন এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে এবংসভাসমাবেশ নিষিদ্ধি করে ।পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ১৪৪ ধারা জারির পরিপ্রেক্ষিতে সর্বদলীয়রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এর উদ্যোগে ২০ ফেব্রুয়ারী আবুল হাশিমেরসভাপতিত্বে গুরুত্বপূর্ণ সভা অনুষ্ঠিত হয় । সভায় উপস্থিত সদস্যগণ ১৪৪ ধারাভঙ্গ করার ব্যাপারে নেতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন । কেননা সভার একটি বড়অংশ ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ব্যাপারে মত দিলেও অনেকেই এতে সহিংসতার আশঙ্কায়বিপক্ষে মত দেন । ২১ ফেব্রুয়ারী সকাল ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেশিয়ামমাঠের পাশে, ঢাকা মেডিকেল কলেজের (তখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত)গেটের পাশে ছাত্র-ছাত্রীদের জমায়েত শুরু হয় । সকাল ১১টায় কাজী গোলামমাহবুব, অলি আহাদ, আব্দুল মতিন, গাজীউল হক প্রমূখের উপস্থিতিতেছাত্র-ছাত্রীদের সমাবেশ শুরু হয় । সমাবেশে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ব্যাপারে ছাত্রনেতৃবৃন্দ এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয় । আওয়ামীমুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক সভায় উপস্থিত হয়ে ছাত্রদের ১৪৪ ধারানা ভাঙ্গার ব্যাপারে যুক্তি উপস্থান করেন । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরউপাচার‌্য ড. এস এম হোসেইন এর নেতৃত্বে কয়েকজন শিক্ষক সমাবেশ স্থলে আসেনএবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার জন্য ছাত্র-জনতাকে অনুরোধ করেন । বেলা ১২টা থেকেবিকাল ৩টা পর‌্যন্ত উপস্থিত ছাত্রনেতাদের মধ্যে আব্দুল মতিন এবং গাজীউল হক১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে মত দিলেও সমাবেশ থেকে নেতৃবৃন্দ এ ব্যাপারেসুনির্দিষ্ট কোন দিক-নির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হন । এ অবস্থায় উপস্থিতছাত্র-জনতা স্বতঃস্ফুর্তভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত করে মিছিল নিয়েপূর্ব বাংলা আইন পরিষদের (বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলেরঅন্তর্গত) দিকে যাবার উদ্যোগ নেয় । এ সময় পুলিশ লাঠিচার্জ ও গুলি বর্ষণশুরু করে । গুলিতে ঘটনাস্থলেই আবুল বরকত (ঢাবি এর রাষ্ট্র বিজ্ঞানেরমাষ্টার্সের ছাত্র) রফিক উদ্দীন এবং আব্দুল জব্বার নামের তিন তরুন মৃত্যুবরণ করেন । পরে হাসপাতালে আব্দুস সালাম (যিনি সচিবালয়ে কর্মরত ছিলেন)মত্যুবরণ করেন । অহিউল্লাহ নামের ৯ বছরের একটি শিশুও পুলিশের গুলিতে মারাযায় । পুলিশের সাথে ছাত্রদের ৩ ঘন্টাব্যাপী সংঘর্ষ চলতে থাকে কিন্তু পুলিশগুলিবর্ষন করেও ছাত্রদের স্থানচ্যূত করতে ব্যর্থ হয় । বিকাল ৪টায় ছাত্রদেরউপর গুলিবর্ষণের কথা ঢাকার সর্বত্র ছড়িয়ে পরলে হাজার হাজার সাধারণ জনতাঢাকা মেডিকেলের সামনে জড়ো হতে থাকে । গুলি বর্ষণের সংবাদ আইন পরিষদে পৌঁছলেধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার ৬ জন আইন পরিষদের সদস্য আইনপরিষদের সভা মুলতবী করে ঢাকা মেডিকেলে আহত ছাত্রদের দেখতে যাবার জন্যমূখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীনকে অনুরোধ করেন । সরকারী দলের সদস্য আব্দুর রশীদতর্কাবাগীশও এই প্রস্তাবের পক্ষে উচ্চকন্ঠী হন । কিন্তু নুরুল আমীন সকলদাবী উপেক্ষা করে আইন পরিষদের অধিবেশন চালাবার নির্দেশ দেন । এ অন্যায়েরপ্রতিবাদে পূর্ব বাংলার সদস্যরা পরিষদ থেকে ওয়াক আউট করেন ।২২ ফেব্রুয়ারী সকাল থেকেই হাজার হাজার ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় জড়োহতে থাকে । উপস্থিত ছাত্র-জনতা ২১ ফেব্রুয়ারী নিহতদের স্মরণে কার্জন হলএলাকায় একটি জানাজা নামাজ আদায় করে এবং একটি শোক মিছিল বের করে ।শান্তিপূর্ণ মিছিলের উপর পুলিশ পূনরায় গুলি চালালে শফিউর রহমানসহ ৪জনঘটনাস্থলে মৃত্যুবরণ করেন । উত্তেজিত জনতা রথখোলায় অবস্থিত সরকার পক্ষীয়পত্রিকা 'দি মর্নিং নিউজ' এর অফিসে আগুন ধরিয়ে দেয় । নুরুল আমিন পুলিশেরপাশাপাশি আর্মি নামিয়ে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভকে নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা করে ।পুলিশ ও আর্মির বাধা উপেক্ষা করে ছাত্র-জনতা ভিক্টোরিয়া পার্ক (বর্তমানেবাহদুরশাহ পার্ক) এ একত্রিত হয় এবং সেখানে অলি আহাদ, আব্দুল মতিন ও কাজীগোলাম মাহবুব বক্তব্য রাখেন । উপায়ন্তর না দেখে নুরুল আমীন তড়িঘড়ি করে আইনপরিষদে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার একটি প্রস্তাব আনেন এবংপ্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে পাশ হয় ।বাঙালীর ভাষা আন্দোলনের স্বীকৃতি স্বরূপ ইউনোস্ক ২১ ফেব্রুয়ারীকে দিয়েছেআন্তর্জাতিকতার স্বীকৃতি । ২১ ফেব্রুয়ারীকে ঘোষনা করেছে আন্তর্জাতিকমাতৃভাষা দিবস । এত ত্যাগের বিনিময়ে আমরা যে ভাষা পেলাম, দেশব্যাপী চলছে সেভাষাকে অপমান, তুচ্ছ-তাচ্ছি্ল্যের প্রতিযোগীতা । বাংলা ভাষার সবেচেয়ে বেশিমরর‌্য্যাদাহানী হচ্ছে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে । টিভিতে দেখলাম, একটিইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ডজনখানেক ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে বাংলা বার মাসের নামজিজ্ঞাসা করা হল । দূর্ভাগ্যের হলেও সত্য যে, এদের মধ্য থেকে একজনওসঠিকভাবে বার মাসের নাম বলতে পারে নি এমনকি ধারাবাহিকভাবে ৩ মাসের নামও নয় ।এক ছাত্রতো বলেই বসল গ্রীষ্ম, বসন্ত ….. ! এরকম কিছু দেখলে বাঙালীহিসাবে অবাক না হয়ে উপায় কি ? বিশ্বায়নের যুগে ইংরেজী শেখা আমাদের জন্যখুবই জরুরী তবে সেটা কি বাংলাকে বাদ দিয়ে ? আজ-কাল কথিত আধুনিক শ্রেণীরবাবা-মাকে প্রায়ই গর্ব করে বলতে শোনা যায়, তাদের তিন বছরের শিশুও হিন্দিবলতে পারে । অথচ একবারও অনুশোচনা করে বলতে শোনা যায় না যে, তাদের সন্তানেরাবাংলা বলতে পারে না । যে বাংলার জন্য ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর‌্যন্ত আন্দোলনহল, সেই '৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী বাংলায় কোন মাসের কত তারিখ ছিল সেটা আমরাঅনেকেই জানি না । আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য ২১ ফেব্রুয়ারীযেমনিভাবে মুখস্ত থাকার কথা ঠিক বাংলা ভাষার জন্য ৮ই ফাল্গুনকে ধারন করাউচিত ছিল । ছাত্র-ছাত্রীদের বাংলা লেখার অবস্থা দেখলে মনেই হবে না এই জাতীরপূর্ব পূরুষেরা বাংলার মর‌্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে জীবন উৎসর্গ করেছিল ।বর্তমান সমাজে এমন এক শ্রেণীর লোকের আগমন ঘটেছে যারা ফেব্রুয়ারী এলেই, বাংলা বর্ণমালা লেখা টি-শার্ট পরিধান করে, ফেব্রুয়ারীর বইমেলা এবং ২১ফেব্রুয়ারী নিয়ে ব্যাপকভাবে আবেগ আপ্লুত থাকে । অলিতে-গলিতে, হাটে-বাজারেটুল ফেলে টাকা উত্তোলণ করে । ২১ ফেব্রুয়ারীর রাতে পাড়ার তরুনীদের শখের ফুলবাগান থেকে ফুল চুরি করে । বছরের বাকী ১১মাস হিন্দি সিরিয়াল এবং মুভিতেইদৃষ্টি ও কর্ণকে আবদ্ধ রাখে । সহজ কিছু হিন্দি ডায়লগ মুখস্ত করে যত্র-তত্রতা উচ্চারণ করে সে-কি উল্লাস । এদের উল্লাস দেখে ডারউইনের সৃষ্টিতত্ত্বেরকথা স্মরণ হয় । এ শ্রেণীর লোকদের দেখে কেন জানি প্রশ্ন জাগে, আসলেই কিমানুষ বানর থেকে সৃষ্টি ? সমাজে আরেক শ্রেণীর লোক আছে যারা কোন বাক্যউচ্চারণ করলেই তার শুরুতে অথবা শেষে একটা হিন্দি অথবা ইংরেজী শব্দ ব্যবহারকরবেই । এতে তাদের সম্মান কতটুকু বৃদ্ধি পায় তা কেবল তারাই ভালো জানে । তবেআধুনিক জমানায় নাকি এগুলো না করলে চলে না !সমাজের কথিত বুদ্বিজীবিদের মত চরিত্রকে না বদলিয়ে বাংলাকে হৃদয়ে ধারণ করতেশিখি । বাইরে বাইরে বাংলার প্রতি অসম প্রেম এবং অন্দরমহলে হিন্দির চর্চাত্যাগ করি। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী দেশের বীর সন্তানেরা যে উদ্দেশ্যকেসামনে রেখে বুকের তাজা রক্ত উৎসর্গ করে বাংলাকে দিয়েছিল সম্মানের স্থানেআসীন হওয়ার ক্ষমতা তা হৃদয়ে লালন করি । বাংলাভাষা যেন সেই সম্মানের স্থানেথাকতে পারে, সে ধরনের পরিকল্পনা, উদ্যোগ নিয়ে সামনে আগানো প্রতিটি বাংলাভাষা-ভাষীর জন্য বড় দায়িত্ব । হিন্দি কিংবা ইংরেজী শেখা অবশ্যই দরকার তবেবাংলাকে বর্জন করে নয় । বাংলাভাষায় দক্ষতা অর্জন করার পরে যদি অন্য কোনভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে পারি, বাঙালী হিসেবে সেটাই হবে গৌরবের ।

রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ।