যে হার জয়ের চেয়েও বেশি আনন্দের

রাজু আহমেদ
Published : 21 March 2015, 08:02 AM
Updated : 21 March 2015, 08:02 AM

চলতি ক্রিকেট বিশ্বকাপ বাংলাদেশের জন্য কাব্যিক গৌরবময় ইতিহাস সৃষ্টির শুভক্ষণ হয়ে স্বাক্ষী থাকবে । নিকট ভবিষ্যতেই হয়ত বাংলাদেশ বিশ্ব ক্রিকেটে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট অর্জন করবে । ক্রিকেট মাঠে গড়াবে আরও কোটি কোটি বল । ব্যাট-বলের লড়াইয়ে বাংলার দামাল ছেলেরা নাস্তানাবুদ করবে বিশ্বের সকল দেশকে । হয়ত শুধু ক্রিকেটে মাঠে শ্রেষ্ঠত্বের কারণেই বিশ্ববাসী বাংলাদেশকে নতুন করে জানার আগ্রহ দেখাবে । দেশের ক্রিকেট ভবিষ্যত যতই উজ্জ্বল এবং সোনালী হোক না কেন তাতে কখনই ২০১৫ বিশ্বকাপের স্মৃতি মুছে যাবে না বরং এবারের সূখ স্মৃতি বাংলাদেশের ক্রিকেটর জন্য প্রেরণা জোগাবে অনন্তকাল । মাত্র কয়েক বছরের ক্রিকেটীয় অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশ প্রথমবারের মত ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আসরের কোয়াটার ফাইনালে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিল । বাংলাদেশ দল দেশ ছাড়ার আগে গোটা দেশবাসীকে যে স্বপ্নে দেখিয়ে গিয়েছেল তা তারা কানায় কানায় পূর্ণ করে দিয়েছে । গ্রুপ পর্বের প্রত্যেকটি ম্যাচেই দেশের দামাল ছেলেরা প্রত্যাশার চেয়ে অনেকগুন বেশি ভালো খেলেছে । ক্রিকেটের জন্মদাতা ইংল্যান্ডকে একপ্রকার উড়িয় দিয়েই বীর বেশে বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকার প্রতিনিধিত্বকারীরা অনায়াসে কোয়াটার ফাইনাল খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিল । গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে এবারের বিশ্বকাপের অন্যতম ফেভারিট ও সহ-আয়োজক নিউজিল্যান্ডকেও প্রায় ধরাশায়ী করেছিল । বাংলাদেশ থেকে কয়েক হাজার মাইল দুরত্বের অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে যখন বাংলার তরুণ তুর্কীরা প্রতিপক্ষকে ২২ গজের লড়াইয়ে নাকানী-চুবানী খাওয়াচ্ছিল তখন বাংলাদেশের প্রতি ইঞ্চিতে আনন্দের ঢেউ খেলছিল । আকাশে-বাতাসে যেন এ এক অন্যরকম আনন্দের বন্যা । মানুষের মধ্যে বিরাজমান সকল ভেদাভেদ ভূলে ঐক্যবদ্ধভাবে সবাই দেশের জন্য শুভ কামনা জানিয়েছে । কয়েক'শ গজ দীর্ঘ লাল সবুজের লাখ লাখ পতাকায় দেশের অলি-গলি ছেয়ে গিয়েছিল । এ যেন এক অচেনা বাংলাদেশ !

কোয়াটার ফাইনালে পৌঁছেই বাংলাদেশের মানুষ প্রায় বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পেয়েছে । তরুণ দামালদের কাছে আর কি প্রত্যাশা করার আছে ? দেশের ক্রিকেটে ইতিহাসে এ যে মহান গৌরবের দিন । তবুও প্রাপ্তির সাথে মানুষের প্রত্যাশা হু হু করে বাড়ছিল । বাংলাদেশীদের সে প্রত্যাশ কোন অলীক কল্পনা ছিল না । মাঠের ১১ লড়াকুর সাথে ১৬ কোটি মানুষের অকুন্ঠ সমর্থন বিশ্বকাপের ট্রফির স্বাদও পাইয়ে দিতে পারত । কিন্তু তা হয়নি । প্রবাদ আছে যে 'জোর যার মুল্লুক তার' । কোয়টার ফাইনালে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ছিল প্রতিবেশি ভারত । ক্রিকেট খেলার বয়স বিচারে ভারতের কাছে বাংলাদেশের অবস্থান শিশুতুল্য হলেও মাঠে খেলার বিচারে বাংলাদেশ যে কেবল সমানে সমানে টক্কর দিত শুধু তাই নয় বরং ভারতকে তুলোধুনো করে ছেড়ে দেয়ার ক্ষমতা ও আত্মবিশ্বাস বাংলার ছেলেদের ছিল । ২০০৭ এর ওয়েষ্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের কাছে হেরে প্রথমপর্ব থেকে ভারতের বিদায়ের সে দিন হয়ত কোন কালেই ভারতবাসীসহ গোটা বিশ্ববাসী ভূলতে পারবে না । তবে এবারের আসরে গভীর ষড়যন্ত্র ও ঘৃণ্য চক্রান্তের কাছে বাংলাদেশকে পরাজিত হতে হয়েছে । ক্ষমতার যে এত নিকৃষ্ট প্রদর্শণী হতে পারে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ণ ক্রিকেট গ্রাউন্ডে তা ১৯ মার্চের বাংলাদেশ বনাম ভারতের মধ্যে অনুষ্ঠিত ম্যাচটি না দেখলে বিশ্বাসই হত না ।

বাংলাদেশকে মাঠের লড়াইয়ে হারানোর যোগ্যতা যে ভারতের ছিল না তা ভারত আগেভাগেই বুঝবে পেরেছিল । তাই কোয়াটার ফাইনালে বাংলাদেশকে পরাজিত করার জন্য চক্রান্তের শুরু হয়েছিল ম্যাচের পূর্ব-নির্ধারিত তারিখ পরিবর্তন করার মধ্য দিয়ে । যে ম্যাচটি ২১ মার্চ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল তা হঠাৎ করেই ১৯ মার্চ আয়োজন করা হল । ভারতীয় কর্তৃপক্ষের আদেশে ব্যাটিং সহায়ক উইকেট তৈরি করা হল । পরবর্তীতে বিশ্ববাসী এহেন ঘৃণ্য মানসিকতার কেবল মঞ্চায়ণের স্বাক্ষী হয়েছে । গোটা ম্যাচ জুড়েই ছিল বিতর্কের মহড়া । অবৈধভাবে বাংলাদেশকে পরাজিত করার নাটকটাই তারা দেখিয়েছে শুধু । ক্রিকেট দুই দলের ২২ জন খেলোয়ারের খেলা হলেও মাঠের দু'জন ও তৃতীয় আম্পায়ারের যে কোন ভূল সিদ্ধান্ত মূহুর্তেই ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিতে পারে । বিশ্বের সর্বাধিক সমালোচিত ইংল্যান্ডের ইয়ান গোল্ড ও পাকিস্তানের আলিম দার মাঠে দাঁড়িয়ে লেখা পরিচালনা করলেও তাদের প্রায় প্রতিটি সিদ্ধান্ত ছিল বিতর্কিত এবং অবশ্যই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে । প্রথমে ব্যাট করে যখন বাংলাদেশী বোলারদের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে ভারত প্রচন্ড চাপের মধ্যে ছিল তখন বাংলাদেশের বিপক্ষে আম্পায়ারদের কয়েকটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ম্যাচের ফলাফল পাল্টিয়ে দিয়েছে । কোয়াটার ফাইনালে রোহিত শর্মাকে আম্পায়াররা শুধু শতরান করতেই সাহায্য করেনি বরং বাংলাদেশকে অবৈধভাবে পরাজিত করার ভিত রচনা করে দিয়েছে । বাংলাদেশের গতিদানব রুবেলের করা ৩৯.৪ ওভারের যে বলটি রোহিতের হাঁটুর একটু উপর দিয়া যাচ্ছিল সেটাকে ক্যাচ ধরার পর আম্পায়ার উচ্চ নো-বল ডাকলেন । বিশ্বের শত কোটি মানুষ হাজার কোটি বার পুণঃপুণবার দেখে যে বলটাকে নিশ্চিতভাবে সঠিক ডেলিভারী বলে ঘোষণা করল, আম্পায়ার কয়েক সেকেন্ড না ভেবেই সে বলটাকেই নো-বল দিয়ে দিলেন । সুরেশ রায়ণা যে বলটিতে নিশ্চিত এলবিডাব্লিউ আউট হয়ে গেলেন সে বলটায় বোলার কর্তৃক আউটের আবেদন করার পরে মাঠের আম্পায়ার আউট তো দিলেনই না বরং যখন অধিনায়ক কর্তৃক রিভিউয়ের আবেদন জানানো হল তখন তৃতীয় আম্পায়ার মাত্র দু'বার অপূর্ণ রিভিউ দেখে মাঠের আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করলেন অথচ ভারতীয় টিভি নেটওয়ার্কের ধারা ভাষ্যকাররা এটাকে নিশ্চিত আউট বলেই বলেছিলেন । টিভি আম্পায়ারের দ্রুততা ও ব্যস্ততা দেখে মনে হচ্ছিল, তারা বাংলাদেশকে খুব তাড়াতাড়ি পরাজিত ঘোষণা করতে চান । মূলত রোহিত শর্মা ও সুরেশ রায়নাকে যদি সঠিক আউট দেয়া হত তবে ভারত ২০০ রান অতিক্রম করতে পারত কিনা তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ আছে ।

নাটকের এখানেই শেষ নয় । মূল নাটক মঞ্চায়ণ হয়েছে বাংলাদেশের ইনিংস শুরু হওয়ার পর । বিশ্বকাপ ক্রিকেট ইতিহাসে বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম শতরান হাঁকানো মাহমুদুল্লাহ রিয়াদই বাংলাদেশে ব্যাটিং শক্তির মূল স্তভ ও ভরসা । তিনি গত দুই ম্যাচে ( ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে) টানা শতরান করেছিলেন । তাকে যে বলটিতে আউট দেয়া হল তা একচোখ অন্ধরাও দেখেলে আঁৎকে উঠবে । মাহমুদুল্লাহর যে ক্যাচটি সীমানার দঁড়ির কাছে শেখর দাওয়ান লুফেছিল তা ছিল চরম বিতর্কিত । কেননা ক্যাচটি ধরার সময় শেখরের পা সীমানা দঁড়িতে স্পর্শ করেছিল । এ দৃশ্য তৃতীয় আম্পায়ার বারবার রিভিউ করে দেখার পরেও মাহমুদুল্লাহকে আউট দিয়ে দিলেন । নির্ভরযোগ্য এ ব্যাটসম্যানের আউট হওয়ার পরেই মূলত বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানদের মনোবল ভেঙ্গে যায় এবং ছন্দপতন শুরু হয় । মাহমুদুল্লাহকে ইচ্ছাকৃত আউট প্রদান দেখে বাংলাদেশী খেলোয়ারেরা বুঝে গিয়েছিল তারা যতই ভালো খেলুক আম্পায়ারেরাই তাদেরকে ক্রিজে থাকতে দিবে না । বিপক্ষ দলের ১১জন খেলোয়ারের সাথে যখন তিনজন আম্পায়ার যোগ হয় তখন প্রতিপক্ষের ১১জন যতই নির্ভূল খেলুক তাতে জয় আশা করা যায়না । ১৯ তারিখের ম্যাচে ভারত, আম্পায়ার তথা দলকানা আইসিসি বাংলাদেশের সাথে যে গাদ্দারী করেছে তা শতাব্দীর পর শতাব্দী কালো অক্ষরে লেখা থাকবে । অর্থ ও প্রভাবের জোড় খাটিয়ে ভারত হয়ত এবারের বিশ্বকাপের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করবে কিন্তু তাদের সে অর্জন কি আত্মতৃপ্তি দিতে সক্ষম ? অনৈতিক অর্জন তো আত্মতৃপ্তি দিতে পারে না । কোয়াটার ফাইনালে আম্পায়ার কর্তৃক ইচ্ছাকৃতভাবে বাংলাদেশকে হারানোর পর জনপ্রিয় ধারাভাষ্যকারদের মধ্যে পাকিস্তানের রমিজ রাজা ও শোয়েব আখতার, ইংল্যান্ডের নাসের হোসাইন, অষ্ট্রেলিয়ার শেন ওয়ার্নসহ অনেকেই আম্পায়ার ও আইসির তুমুল সমালোচনা করেছেন । এমনকি সর্বান্তকরণে ভারতীয় ভিভিএস লক্ষ্মণ, সৌরভ গাঙ্গুলীও আম্পায়দের সিদ্ধান্তকে বৈধ বলে মত দেননি । আইসিসির বর্তমান প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশের পরিকল্পনামন্ত্রী আহম মোস্তাফা কামাল আম্পায়দের সমালোচনা করেছেন । গোটা দেশব্যাপী বিতর্কিত আম্পায়ারদের শাস্তির দাবীতে মানবন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল চলছে । বিশ্বের প্রতিটি দেশে বসবাসরত বাংলা ভাষা-ভাষীরা আম্পায়ারদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়েছে ।

সাম্রাজ্যবাদীদের ষড়যন্ত্রে বাংলাদেশের অর্জনকে দীর্ঘ করা গেল না । তবে বাংলাদেশকে যেভাবে ইচ্ছাকৃতভাবে হারানো হয়েছে তাতে বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের সম্মান কমেনি বরং হাজার গুন বেড়েছে । এদেশের মানুষ সর্বদা ক্রিকেট উম্মাদনায় ভোগে । দেশের জয়ে যেমন আনন্দ উল্লাসে মাতে তেমনি পরাজয়েও কেঁদে বুক ভাসায় । কখনো কখনো বিজিত খেলোয়ারদেরকে নিয়ে কটুক্তিও করে । কিন্তু এই প্রথম বাংলাদেশ হেরে যাওয়ার পরেও দেশের মানুষ তাদেরকে বুক ভরে দোয়া করছে এবং শুভ কামনা জানাচ্ছে । হাসি মূখে তাদেরকে বরণ করার জন্য বরণঢালা সাজাচ্ছে । ভারতের সাথে পরাজয়ের পর স্বাভাবিকভাবে যে কষ্ট অনুভূত হয় তার স্থলে আনন্দের ফোয়ার ছুটছে । কেননা বাংলাদেশ তো মাঠের খেলায় হারেনি বরং চক্রান্ত করে হারানো হয়েছে । এমন কিছু হার আছে যা জয়ের চেয়েও বেশি আনন্দ দেয় । বাংলাদেশও তেমনি একটি হারের মুখোমুখি হয়েছিল কোয়াটার ফাইনালে । ভালো মানুষরুপী মানুষের মুখোশের অন্তরালে যে কত কদাকার মানসিকতা লুকিয়ে থাকতে পারে তা আরও একবার প্রকাশিত হল । অনৈতিকভাবে হারানোয় এ প্রেরণা আমাদের জন্য শক্তি হবে । ভবিষ্যতে আমাদের দেশের ক্রিকেটে তারুণ্যের যে শক্তির বিস্ফোরণ ঘটবে তাতে অন্যায় পুড়ে ছাড়খার হয়ে যাবে । আমাদের দেশটাই হবে ভবিষ্যত ক্রিকেট দুনিয়ার সুপার পাওয়ার । বিদায় বেলায় আবারও বলে যাই, আমরা হারিনি, আমাদেরকে হারনো হয়েছে । ১৯ তারিখের ম্যাচে ক্রিকেট হেরে গেছে, নৈতিকতা ও বিবেককে আরও একবার বিক্রি করা হয়েছে । আমাদের দুর্বলতার এ শোক একদিন শক্তিতে পরিণত করবই । সেদিন কোন রথী-মহারথী বাংলার তরুণদের জয়ে বাধা হতে পারবে না ।

রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ।

Facebook.com/raju69mathbaria/