রক্তার্জিত স্বাধীনতার সম্মান যেন ভূলুন্ঠিত না হয়

রাজু আহমেদ
Published : 25 March 2015, 05:33 AM
Updated : 25 March 2015, 05:33 AM

স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের বয়স ৪৫ হতে চলছে । কোন কিছুর পূর্ণতা পেতে দীর্ঘ ৪৫ বছর কম সময় নয় । পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে হাজার চাঁদের সিগ্ধ আলোকচ্ছটা উপভোগ করার পরেও স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে যখন প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব কষতে চেষ্টা করি তখন খুব অস্বস্তি অনুভব করি । কোনভাবেই যেন মিলতে চায়না প্রত্যাশ্যার সাথে প্রাপ্তি । স্পষ্ট-অস্পষ্ট অনেক বৈষম্যই যেন প্রতীয়মান । এক বুক স্বপ্ন ধারণ করে জীবনকে বাজি রেখে যে বীর সৈনানীরা দেশকে স্বাধীন করেছিল তাদের একাংশ আজ বেঁচে নাই । যারা বেঁচে আছে তাদের অধিকাংশই স্বাধীনতার পুর্ণ অর্থ খুঁজে পাচ্ছে না । স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও অনেক ক্ষেত্রেই ব্যক্তি স্বাধীনতার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি । গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি সম্পূর্ণভাবে বিকশিত হয়নি । সীমাহীন সম্ভাবনা থাকার পরেও দেশটা এখনও প্রায় পরনির্ভরশীল । স্বাধীনতার পর দীর্ঘ সময় পার হলেও রাজনৈতিক হিংসা-প্রতিহিংসার কারণে উল্লেখযোগ্য স্থিতিশীলতা আসেনি । স্বাধীনতা অর্জণের জন্য যারা জীবনকে তুচ্ছ ভেবেছিল তারা আজ দেশের অবস্থা দেখে মূখ লুকিয়ে গুমরে গুমরে কাঁদে । ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থের কাছে বৃহৎ রাষ্ট্রীয় স্বার্থ বারবার বন্দী হয়েছে । স্বাধীনতার স্বাদ পূর্ণ আস্বাদনের সৌভাগ্য এখনো জাতি পূর্ণভাবে পায়নি । রাজনৈতিক মত পার্থক্যের কারণে দেশের স্বাধীনতাকেও বিভক্ত করার অপচেষ্টা চলছে বারংবার । দেশের স্বাধীনতাকে দলীয়করণের নগ্ন চাদরাবৃত করার চেষ্টাও কম হয়নি । পরাধীনতার চেয়ে মানুষ হাজার কোটি গুন ভালো আছে সত্যি কিন্তু স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্র কর্তৃক যে সুযোগ সুবিধা পাওয়া আবশ্যক তা এখনো অর্জিত হয়নি ।

স্মৃতি ও ইতিহাস বিজড়িত মার্চের দিনগুলো অতিবাহিত হচ্ছে । এখন থেকে ৪৫ বছর পূর্বে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রত্যেকটি দিন ছিল বাংলাদেশীদের স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হওয়ার প্রারম্ভের চরম উত্তেজনাকর দিন ।পহেলা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত প্রতিটি রাতে মানুষ স্বাধীনতা আন্দোলনের অংশগ্রহনের স্বপ্ন দেখে ঘুমাতে যেত এবং ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে সে স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার নির্দেশের অপেক্ষায় থাকত ।মূলত বাংলাদেশীদের হৃদয়ে স্বাধীনতার বীজ ১৯৭১ সালেই প্রথম রোপিত হয়নি । এ জাতি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল ১৯৪৭ সালের আগষ্টে পাকিস্তান সৃষ্টির সূচনা লগ্ন থেকেই । বৃটিশদের শোষণ মুক্ত হয়ে বাংলাদেশীরা (তৎকালীন পরিচয় পূর্ব পাকিস্তানী নাগরিক) যখন খোলা বাতাসে বুক ফুলিয়ে চলতে শুরু করবে বলে ভেবেছিল তখনই পশ্চিম পাকিস্তানীদের পক্ষ থেকে একের পর এক আঘাত আসতে শুরু করে । পূর্ব পাকিস্তানীদেরকে ন্যূণতম নাগরিক অধিকার টুকু দিতেও তারা নারাজ ছিল । বৃটিশদের বিরুদ্ধে ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তানীদের সাথে সম্মিলিত আন্দোলন করে ক্লান্ত পূর্ব পাকিস্তান যখন ভেবেছিল তারা একটু বিশ্রামের সুযোগ পেল ঠিক সেই মূহুর্তেই পশ্চিম পাকিস্তানীদের পক্ষ থেকে নির্লজ্জ আঘাত পেয়ে এ বঙ্গের মানুষ হতবাক হয়েছিল । তাইতো আর বিশ্রাম করা হয়নি । রাজ্যের ক্লান্তি নিয়েই আবারও নতুন করে নতুন পরাধীনতা থেকে স্বাধীনতা অর্জণের ছক অঙ্কনের পরিকল্পনা সাজাতে হয়েছিল । আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৪৮ সালে শুরু হওয়া ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েইবাংলাদেশীরা স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছিল,পশ্চিম পাকিস্তানের পশু সূলভ আচরণকারী মানুষগুলোর সাথে বেশিদিন স্থায়ী হওয়া যাবে না ।বৃটিশদের শোষণেরকবল থেকে পূর্ব পাকিস্তানীরা মুক্তি পেয়ে যখন ঘর গোছাতে ব্যস্ত তখনি আবার সে নড়বড়ে ঘরে হানা দেয় পশ্চিম পাকিস্তানীরা ।একের পর এক অনৈতিক যুক্তি খাড়া করে পূর্ব পাকিস্তানীদের উপর নির্মম নির্যাতন চালাতে শুরু করে।১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত প্রায় প্রতি বছর একটির পর একটি খোড়া যুক্তি দাঁড় করিয়ে তারা বাংলাদেশীদের অধিকার হরণ করে নেয় । মানুষের সহ্যের সীমার বাঁধ যখন ভেঙ্গে যায় তখন বাধ্য হয়ে যেমন প্রতিবাদ করতে শুরু করে তেমনি বাংলাদেশীরাও পশ্চিম পাকিস্তানীদের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে মুখ বন্ধ রাখতে পারেনি । অনেক সহ্যের পরীক্ষা দিয়েঅবশেষে দুই পাকিস্তান জন্মের মাত্র ২৩ বছরের মাথায় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ শুরু হয় বাঙালীর স্বাধীনাত সংগ্রামের মূল সংগ্রাম এবং ঐ দিনই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয় ।

আমরা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক । বিশ্ব মানচিত্রে আমাদের স্বতন্ত্র স্থায়ী আবাসভূমি রয়েছে । স্বতন্ত্র ইতিহাস, ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে গোটা বিশ্ব বাংলাদেশকে নতুনভাবে চিনেছে । যে স্বাধীনতা আমাদেরকে উন্নত সম্মানজনক স্থানে আসীন করেছে সে স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস এক সুদীর্ঘ ইতিহাস । যা বর্ণিত হয় বীরত্বগাঁথা বাক্যের গাঁথুনিতে । তবে এই সম্মান অর্জন করতে ত্যাগও কম করতে হয়নি । আমাদের এ স্বাধীনাত ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থ্যাৎ মাত্র নয় মাসে অর্জিত হলেও এ নয় মাসকে পেতে সহ্য করতে হয়েছে দীর্ঘ ২৩ বছরের বিভৎস হিংস্রতা ও আঘাত।শুধু স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ৩০ লাখ শহীদের তরতাজা প্রাণ এবং ২ লাখ মা-বোনের অভ্রু-সম্ভ্রম উৎসর্গ করতে হয়েছিল ।সকল কিছুর পরেও দীর্ঘ ২৩ বছরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আন্দোলন ও ত্যাগের ফল-ই হল আমাদের মহান স্বাধীনতা ।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস জানতে হলে প্রথমেই জানতে হবে পরাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস । বাংলাদেশের স্বাধীনতার পটভূমির খুবই মর্মান্তিক এবং দীর্ঘ ।১৯৪৭ সালে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহের দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত এবং পাকিস্তান নামক দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয় ।সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু অধ্যুষিত এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র ধর্মাবলম্বীদের সমন্বয়ে গঠিত হয় একক ভারত । অন্যদিকে মুসলিম অধ্যুষিত পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে দুই হাজার মাইল দূরত্বে অবস্থিত পূর্ব পাকিস্তানীদের ইসলাম ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে পশ্চিম পাকিস্তানীদেরকেও এক করে দেওয়া হয় ।তৎকালীন সময়ের বিখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা সংযোগহীনদু'ভূখন্ডকে প্রকৃত রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে না চাইলেও ভারত এবং পাকিস্তানের শীর্ষ নেতাদের পরামর্শে বৃটিশরা এভাবেই দুই রাষ্ট্রেকে ভাগ করে দিয়ে যায় ।ভৌগলিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে সম্পূর্ণ বিপরীতমূখীদুটি অংশের মানুষের মধ্যে মিল ছিল কেবল ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতায়।দুই পাকিস্তানের মধ্যে অজস্র বৈষম্য থাকলে মূলবৈষম্য ছিল অর্থের বরাদ্ধে ।পাকিস্তানের জাতীয় বাজেটের সিংহভাগ পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বরাদ্ধ থাকত ।দুই পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের। এ সকল শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানীদের সাথে বিমাতা সূলভ আচরণ করত। ফলশ্রুতিতে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ পশ্চিম পাকিস্তান সম্পর্কে হতাশ হয় এবং এ বঙ্গের মানুষের মনেপুরনো ক্ষোভ নতুন করে দানা বাঁধতে শুরু করে ।দুই পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৪ শতাংশ মানুষের মূখের ভাষা ছিল বাংলা অপরদিকে মাত্র ৬.০৭ শতাংশ মানুষের ভাষা ছিল উর্দু ।কিন্তু পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষাভাষী মানুষের অধিকার হরণ করে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করে ।পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী বিশেষ করে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ'র অন্যায় সিদ্ধান্তকে মেনে না নিয়ে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় ।পূর্ব পাকিস্তানীদের স্বতঃস্ফুর্ত প্রতিবাদের জোয়ার দেখে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী দিশেহারা হয়ে পড়ে এবং ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী ঢাকাসহ এর আশ পাশের এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে ।মাতৃভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার রক্ষার দাবীতে আন্দোলনরতপূর্ব পাকিস্তানের অনড় ছাত্র সমাজ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলে পাকিস্তানের পুলিশ মিছিলরত ছাত্রদের উপর গুলি ও লাঠি চার্জ করে।এতে সালাম,বরকত,রফিকসহ কয়েকজ ছাত্র-জনতা ঘটনা স্থলেই মারা যায় ।দেশব্যাপী এ খবর ছড়িয়ে পড়লে দেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে ।পরে অবস্থা বেগতিক দেখে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানীদের দাবী মেনে নেয় এবং ১৯৫৬ সালে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভাষা আন্দোলনের সফলতা মাইলফলক হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে ।

পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি চূড়ান্ত নাটকীয়তার মুখোমূখি হয় ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে যখন পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী মুসলিম লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে ।দলটি পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭ টি আসনে জয়লাভ করে এবং ৩১৩ আসন বিশিষ্ট জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়,যা আওয়ামী মুসলিম লীগকে এককভাবে সরকার গঠনের অধিকার দেয়। কিন্তু জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি এ নির্বাচনে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রাপ্ত দল হলেও তিনি শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করার বিরোধীতা করে । জুলফিকার আলী পাকিস্তানের দুই প্রদেশে দুইজন প্রধানমন্ত্রী রাখার প্রস্তাব করেন ।যা পূর্বপাকিস্তানীদের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ দুই দলের নেতা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে সঙ্গে নিয়ে দেশের ভাগ্য নির্ধারনে ঢাকায় রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হয় ।এ বৈঠকে কোন ফলপ্রসু সিদ্ধান্ত না হওয়ায় শেখ মুজিবর রহমান সারা দেশে ধর্মঘটের ডাক দেন ।দেশের পরবর্তী ভাগ্য নির্ধারণ এবং দেশবাসীকে দিকনের্দশনা প্রদানপূর্বক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) ১৯ মিনিটের এক ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন ।এই ভাষণে তিনি বাঙালী জাতিকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হতে পরোক্ষ নির্দেশ দেন এবং ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের পূর্বেই তার দাবী মেনে নেয়ার জন্য পাকিস্তানের নীতি নির্ধারকদের কঠোর হুঁশিয়ারী প্রদানপূর্বক আল্টিমেটাম দেন।

সারা দেশ যখন ক্ষোভে উত্তাল,তখন ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে শেখ মুজিবের সাথে সরকার গঠন ও ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আলোচনা শুরু করে ।কিন্তু একই সাথে সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা চালানোর পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহন করতে থাকে। বেলুচিস্তানের কসাই হিসেবে পরিচিত জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর হিসেবে ঢাকায় প্রেরণ করা হয়।কিন্তু বাঙালী বিচারপতিরা তাকে শপথ বাক্য পাঠ করাতে অস্বীকৃতি জানায়। ইতোমধ্যেই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে গোপনে ঢাকায় সৈন্য পাঠানো শুরু হয়। ১০ থেকে ১৩ মার্চের মধ্যে পাকিস্তান এয়ারলাইন্স তাদের সব আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বাতিল করে পূর্ব পাকিস্তানে জরুরী ভিত্তিতে 'সরকারী যাত্রী' পরিবহণ করতে শুরু করে ।কথিত সরকারী যাত্রীর প্রায় সবাই ছিল সাদা পোশাকে পাকিস্তানের সামারিক বাহিনীর সদস্য।এমভি সোয়াতনামে গোলাবারুদ ও অস্ত্রসস্ত্র বোঝাই একটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করে ।এতসব আয়োজনের মধ্যে মুজিব-ইয়াহিয়ার আনুষ্ঠানিক বৈঠক চললেও তা সফল হয় নি । মূলত ইয়াহিয়া খান লোক দেখানোর উদ্দেশ্যেই ঢাকা সফর করেছিলেন । সমাধানের কোন মানসিকতা তার মধ্যে ছিল না।পশ্চিম পাকিস্তানীদের পক্ষ থেকে বেজে ওঠে নিরীহ বাংলাদেশী হত্যার দামামা।২৫ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীকে বাঙ্গালী নিধনযজ্ঞের সবুজ সংকেত দিয়ে গোপনে সন্ধ্যায় পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যায়।২৫ মার্চ রাতে 'অপারেশন সার্চ লাইট' নামে পশ্চিম পাকিস্তানীরা যে পরিকল্পনা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল পরবর্তীতে তা এশিয়া টাইমসে প্রকাশ করা হয় ।সেখানে বলা হয়, 'সামরিক বাহিনীর বড় বড় অফিসারদের নিয়ে বৈঠকে ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করে, তিরিশ লক্ষ বাঙ্গালিকে হত্যা কর,তখন দেখবে তারা আমাদের হাত চেটে খাবে।সে পরিকল্পনা মাফিক ২৫ মার্চের কালো রাতে পাকিস্তানী আর্মি অপারেশন সার্চলাইট শুরুকরে,যার উদ্দেশ্য ছিল রাতের আঁধারেই বাংলাদেশীদের হত্যা করা।এর অংশ হিসেবে সামরিক বাহিনীতে কর্মরত বাংলাদেশী সদস্যদের নিরস্ত্র করে হত্যা,ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী সমাজ নিধন এবং সারা বাংলাদেশে নির্বিচারে সাধারণ মানুষ হত্যা করাহয়।এ হত্যাকান্ডের সংবাদ যাতে বর্হিবিশ্বে না পৌঁছতে পারে সেজন্য ২৫ মার্চের আগেই বিদেশী সাংবাদিকদের ঢাকা ত্যাগে বাধ্য করা হয় ।তবে সাংবাদিক সাইমন ড্রিং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকায় অবস্থান করেন এবং ওয়াশিংটন পোষ্টের মাধ্যমে সারা পৃথিবীকে এই গণহত্যার খবর জানিয়ে দেন।উল্লেখ যে, ২৫ মার্চ রাতেই শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয় এবং তাকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় ।

এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ মার্চ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসার মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন ।ঘোষণাটি ছিল ইংরেজীতে।যার বঙ্গানুবাদ হল, 'আমি, মেজর জিয়া,বাংলাদেশ লিবারেশন আর্মির প্রাদেশিক কমান্ডার-ইন চিফ,শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করছি। আমি আরও ঘোষণা করছি যে,আমরা শেখ মুজিবুর রহমানের অধীনে একটি সার্বভৌম ও আইনসিদ্ধ সরকার গঠন করেছি, যা আইন ও সংবিধান অনুযায়ী কর্মকান্ড চালিয়ে যেতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের সরকার জোট-নিরপেক্ষ নীতি মেনে চলতে বদ্ধপরিকর……' ।১৯৭১ সালে ২৬ মার্চের এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মাটিতে রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা ঘটে যা দীর্ঘ নয় মাস স্থায়ী হয় ।১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয় কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহাকুমা (বর্তমান জেলা) বৈদ্যনাথতলার অন্তর্গত ভবেরপাড়া (বর্তমান মুজিবনগর) গ্রামে ।এ অস্থায়ী সরকার ব্যবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে তাকে রাষ্ট্রপতি করে সরকার গঠন করা হয় ।তবে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানন্ত্রীর দায়িত্ব অর্পিত হয় তাজউদ্দীন আহমেদ এর উপর ।এ সরকারে অধীনেই বাংলাদেশকে ১১ টি সেক্টরে ভাগ করে যুদ্ধ পরিচালনা করা হয়।আক্রমন-পাল্টা আক্রমনের মধ্যে ধীরে ধীরে পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনী দূর্বল হয় এবং ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী বাহিনীর চুড়ান্ত পরাজয়ের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হয় ।জন্ম হয় স্বাধীন বাংলাদেশের ।

স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস শোকের ইতিহাস,হারানোর ইতিহাস এবং অর্জনের ইতিহাস ।ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত,দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম এবং ৭ কোটি মানুষের উপর চলা অমানুষিক নির্যাতনের বিনিময়ে আমরা যে স্বাধীন বাংলাদেশ পেলাম সে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আজ হুমকির মূখে ।রাজনৈতিক অস্থিরতায় দেশটি অর্থনৈতিকভাবে দিনে দিনে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে । হরতাল ও অবরোধের কারণে দেশের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড প্রায় ভেঙ্গে পড়েছে । রাজনৈতিক আন্দোলনের কারণে শিক্ষার্থীরা নিয়মিত ক্লাসে যোগদান করে শিক্ষা গ্রহন করতে না পারায় জাতির মেরুদন্ডও নড়বড়ে বটে । দেশব্যাপী মানুষ হত্যার মহোৎসব চলছে । বিরোধীমত দমনের উর্বর ভূমি হিসেবে বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই বিশ্ববাসীর কাছে সমালোচিত হয়েছে । দু'টো বৃহৎ রাজনৈতিক দলের ক্ষমতার দ্বন্ধে সাধারণ মানুষ নিত্যদিন পিষ্ট হচ্ছে । মানুষের জীবনের ন্যূণতম নিরাপত্তা নাই । ৪৫ বছর আগে বর্বর পাকিস্তানী গোষ্ঠীর দ্বারা যেভাবে মানুষকে প্রাণ দিতে হত আজও প্রায় সেভাবেই নিয়মিত মানুষকে প্রাণ দিতে হচ্ছে। এই কি প্রকৃত স্বাধীনতার চিত্র? একটি স্বাধীন দেশ কি এভাবে চলতে পারে ? অন্যদিকে দেশের আভ্যন্তরীণ নানামূখী চক্রান্ত এবং বিদেশী কিছু রাষ্ট্রের সূদুঢ় প্রসারী ষড়যন্ত্রের শিকাড় হয়ে দেশের স্বাধীনতা,বাঙালী জাতীয়তা বোধ আজপ্রায় বিলীন হতে বসেছে ।বর্হিবিশ্বের দেশগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে যতটুকু হুমকি হয়েছে তার চেয়ে দেশের আভ্যন্তরীণ চক্রান্তকারীরা দেশের স্বাধীনতা বিকিয়ে দিতেআধার জল খেয়ে লেগেছে।রাজনৈতিক দলগুলোর তাদের দলীয় স্বার্থের মোহে এমনভাবে অন্ধ হয়েছে যাতে ন্যায়-অন্যায় কিংবা দায়িত্ব-কর্তব্যও ভূলতে বসেছে । তাদের কারণে যে সোনার দেশটি পশ্চাৎমূখী যাত্রা করেছে সে দিকে তাদের বিন্দুমাত্র খেয়াল নাই । ক্ষমতার লোভ যেন তাদের স্বাভাবিক হুঁশ কেড়ে নিয়েছে । সময় এসেছে স্বাধীনতাকে তার সঠিক রূপ ফিরিয়ে দেয়ার । দেশের স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৫ বর্ষের পূর্বক্ষণে দাঁড়িয়ে সকলের সিদ্ধান্তে আসা উচিত, দেশবাসী কি রক্তার্জিত স্বাধীনতাকে ভূলণ্ঠিত হতে দিবে নাকি রক্ষা করবে ? সামান্যতম দেশপ্রেম যাদের মধ্যে আছে তারা সম্ভবত প্রয়াত গীতিকার গোবিন্দ হালদারের মতই বলবেন,

'মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি,

মোরা একটি মূখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি

যে মাটির চির মমতা আমার অঙ্গে মাখা…….' ।

দেশপ্রেমিক মনের এ আকুতি যেন সকলে প্রাণের আকুতি হয় এবং এ লক্ষ্যকে সামনে রেখেই যেন আমরা আমাদের ভবিষ্যত জীবন গড়তে পারি ।দেশের স্বাধীনতাকে সবকিছুর উর্ধ্বে স্থান দেওয়ার মানসিকতা আমাদের সবার মধ্যে তৈরি হোক-এই প্রত্যাশায় ।

রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট।

facebook.com/raju69mathbaria/