ঘুমাও বিবেক!

রাজু আহমেদ
Published : 17 June 2015, 06:40 AM
Updated : 17 June 2015, 06:40 AM

অনেকদিন পর প্রিয় জন্মস্থানে কয়েকটি দিন কাটানোর সুযোগ পেয়েছিলাম । সবুজ ছায়া-ঘেরা নিবিড় গ্রামটিতে শান্তির ছোঁয়া যেন একেবারেই অনুপস্থিত । চিরচেনা গ্রামটিকে বর্তমান অবস্থার সাথে কিছুতেই মেলাতে পারিনি। গ্রামে অবস্থানকালীন সময়ে বরাবরের মত বেশিরভাগ সময় কেটেছে বয়সের ভারে কুঁজো হওয়া মানুষগুলোর সাথে । তাদের মূখে চিরচেনা হাসির উপস্থিতি দেখিনি । আমাকে পেলে তারা যেমন হৃদয়ের সকল কথা উজাড় করে বলে আমিও মন্ত্রমুগ্ধের মত তাদের কথা শোনার জন্য ব্যাকুল থাকি । কুশালাদি বিনিময়ের পর তারা আমাকে প্রথম যে প্রশ্নটি করে সেটি শুনতে শুনতে আমি এখন আর প্রশ্নের অপেক্ষা না করেই উত্তর দিতে শুরু করি । তাদের প্রশ্নটি হল, দেশের পরিস্থিতি কি ? তাদের কাছে ছুটে যাই আমার কথা শোনানোর জন্য নয় বরং তাদের কথা শুনতে । তাদের সন্তান-সন্ততির কথা জিজ্ঞাসা করলেই বুক ফেঁটে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস । দারিদ্র্যের কষাঘাতে একদিনে যেমন তারা তাদের সন্তানদের শিক্ষাসহ মৌলিক অধিকার পূরণে সম্পূর্ণ সক্ষম হয়নি তেমনি মাদকের ভয়াবহ ছোঁবল উঠতি তরুণদেরকে ঘিরে ফেলেছে । মাদকের বিস্তার রোধে প্রশাসনের ভূমিকা জানতে চাইলে এর উত্তরে তাদের দীর্ঘশ্বাস আরও দীর্ঘ । স্থানীয় চৌকিদারকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে তিনি আমতা আমতা করে নিজের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কার কথা বলে উপজেলা প্রশাসনের অবস্থানও বোঝাতে চেষ্টা করলেন ।

মাদকসেবীদের দৌরাত্ম্যে সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সম্মান ভূলুন্ঠিত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে । গ্রামে মাদক বলতে এখন পর‌্যন্ত কেবল গাঁজার সয়লাব হয়েছে । বিড়ি-সিগারেটের চেয়েও গাঁজা সহজলভ্য বস্তুতে পরিণত হয়েছে । যে তরুণগুলোর বই হাতে স্কুল কলেজের বারান্দায় কাটানোর কথা তারা বিড়ি-সিগারেটের পূর্বেই গাঁজার কল্কি মূখে তুলছে । গাঁজা সেবীদের মধ্যেও আবার গুরু-শিষ্যের ভাব । শুনলাম, এরা একজন আরেকজনকে অকথ্য ভাষায় গালি-গালাজ করেও আবার ক্ষণিক পরে একে-অপরের গলায় হাত দিয়ে হাটে । দেশের বিভিন্ন যায়গায় স্থানীয় পর‌্যায় রাজনীতিতে তেমন বড় ধরণের বিরোধ দেখা না গেলেও আমাদের অঞ্চলে স্থানীয় পর‌্যায় থেকেই বিভিন্ন বৃহৎ দলের রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে সাপে-নেউলে সম্পর্ক । অথচ গাঁজা সেবনের ক্ষেত্রে কারো মধ্যে কোন দলীয় মতপার্থক্য লক্ষ্য করা যায়না । দেখে মনে হয়, এ ভূমিতে এদের মত আপন কেউ নাই ! এলাকার মুরুব্বীরা এদের ভয়ে কুঞ্চিত । নেশাগ্রস্থ অবস্থায় কখন কার সাথে কি ব্যবহার করে এই ভয়ে প্রকাশ্যে কেউ এদের বিরুদ্ধে কোন শব্দই উচ্চারণ করে না ।

আমার গ্রামে আজ যারা গাঁজার নেশায় বুঁদ এদের সাথেই কেটেছে শৈশবের প্রতিটি স্মৃতিময় দিন । কতই না সুন্দর ছিল সেদিনগুলো ! সকালে বই হাতে দল বেঁধে স্কুলে যেতাম । দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে নদী-খাল কিংবা পুকুরে দস্যি ছেলেদের মত সাতার কাটতাম । বিকালে ক্রিকেট ব্যাট-বল, ফুটবল কিংবা অন্যকোন খেলার আয়োজনে মাঠে গিয়ে মাগরিবের আযান পর‌্যন্ত দৌঁড়-ঝাঁপ চলত । সেই গ্রামটির আজ এই হাল ! সমবয়সীদের কিছু সংখ্যক শহরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ণরত । অন্যদের কেউ কেউ জীবিকার তাগিদে বিভিন্ন পেশায় কর্মরত । তবে যারা গ্রাম থেকে বের হতে পারেনি তাদের বেশিরভাগ নেশার রাজ্যের রাজা । শৈশবের প্রেরণ-সাহস নিয়ে, এমন কিছু তরুণের মুখোমূখি হয়েছিলাম যাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে নিত্যদিন নেশার বীষ প্রবেশ করছে । এদের মধ্যে দু-চারজন বয়সে জেষ্ঠ্য হলেও বাকীরা সমবয়সী কিংবা ছোট । যখন তাদের মূখোমূখি হলাম তখন তাদের ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ না করেনি পারেনি । আমাকে কোথায় বসতে দিবে, কি খাওয়াবে-এ নিয়ে সোরগোল লেগে গেল । যাদের সাথে তুই-তুকারির সম্পর্ক তারা সম্মান দেখাতে গলে যেন যাচ্ছে । তাদের লাল লাল চোখগুলো দেখে বুঝেছিলাম এরা চরম নেশার ঘোরে । এদেরকে এখন কিছু বলতে গেলে হিতে-বিপরীত হয়ে যাবে । তাই তারা যা বলছিল তার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে মানে মানে কেটে পড়েছি । তাদের প্রতিটি কথায় চরম অসংলগ্নতা ছিল । কথার পূর্বাপর রেশে কোন সম্পর্ক ছিল না । এদের থেকে কৃত্রিম সম্মান পাওয়ার আকাঙ্খা কখনোই পোষন করিনি বরং সব সময় মনে প্রাণে চাইতাম এই যুবকগুলো গ্রামের উন্নয়ণে হাত হাত রেখে কাজ করবে অথচ তারাই আজ গ্রাম ধ্বংসের দামামা বাজাচ্ছে ।

যেদিন গ্রামের বাড়ীতে গেলাম সেদিন সন্ধ্যায় ইউনিয়ন পরিষদের কেন্দ্রীয় বাজারে প্রকাশ্য দিবালোকে অনেক মানুষের সামনে উপজেলা সরকারী কলেজের সাবেক ভিপিকে কুপিয়ে হত্যা করেছে স্থানীয় চারজন তরুণ । পত্রিকায় দেখলাম, চায়নিজ কুড়ালের উপর‌্যপুরি ২২ টি আঘাত এবং মৃত্যু নিশ্চিত কিনা সে সংশয়ে চোখ উৎপাটন করে খুনীরা বীরের মতো ডজন ডজন লোকের সামনে দিয়ে হেটে গেছে । খুন বাংলাদেশে প্রায় স্বাভাবিক রীতিতে পরিণত হয়েছে । এ নিয়ে এখন আর তেমন উৎকন্ঠা পরিলক্ষিত নয় । তবে আমার ইউনিয়নে স্বাধীনতার পূর্বে এমন খুনের ঘটনা ঘটলেও স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে এটাই প্রথম । সিনেমার দৃশ্যের মত অনেক মানুষের উপস্থিতিতে মাত্র জন চারেক লোক একটি মানুষকে দীর্ঘ সময় নিয়ে কুপিয়ে হত্যা করল অথচ ৩০ এর অধিক মানুষ মাত্র কয়েকগজ দূরে প্রতিবাদহীন দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য অবলোকন করল-এটা ভাবতেই কষ্ট লাগে । এলাকায় যে পরিস্থিতি দেখে এসেছি তাতে মনে হয়েছে এটাই শুরু কিন্তু শেষটা অনেক দূর । পুলিশ প্রশাসনেরও বা কি করার আছে ? থানা থেকে গ্রামের ভাঙা রাস্তা পারি দিয়ে অপরাধীকে পাকড়াও করতে পৌঁছানোর পূর্বে অপরাধীরা ঠান্ডা মাথায় তাদের উদ্দেশ্যের সফলতা প্রতিষ্ঠা করে দূরান্তে ছিটকে পড়তে সক্ষম । কিভাবে উত্তরণ সম্ভব এমন অমানবিক অনিশ্চয়তা থেকে ? আমাদের ছোটবেলায় গাঁজা শব্দটি দূর দেশে অবস্থান করত । অথচ সেটি নাগালে আসার সাথে সাথেই সমাজ বিশৃঙ্খলায় পূর্ণ । গাঁজার এমন সয়লাব কি রোধ করার সাধ্য কারো নাই ? প্রশাসনের দৌরাত্মের চেয়ে গাঁজা কিংবা অন্যসত মাদক দ্রব্যের দৌরাত্ম্য কি বেশি ? গাঁজার ভয়াবহতায় শুধু আমার গ্রাম নয় বরং বাংলাদেশের সকল গ্রাম আক্রান্ত । এ আগ্রাসন রোধে স্থানীয়দের খুব বেশি কিছু করার নাই বলেই মনে হচ্ছে । কাজেই প্রশাসন কি বাংলার মাটি থেকে গাঁজার পুটলি চিরতরে উৎখাত করার সামর্থ রাখে না ? গাঁজা এবং অন্যান্য মাদক দ্রব্যের সহজলভ্যতা দূর হলে গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি এদেশে থেকে অনেক ধরনের মারাত্মক অন্যায়-অপরাধ চিরতরে বিদায় হবে ।

মানব পাচারের ভয়াবহ সংকটে ধুঁকছে দেশ । জীবিকার তাগিদে সংকটাকূল জেনেও মানুষ ট্রলার যোগে দীর্ঘ সাগরপথ পাড়ি দিয়ে বিভিন্ন দেশে ঠাঁই পাওয়ার চেষ্টা করছে । জীবনে উন্নতি তো দূরে থাক এখন জীবন রক্ষাই এদের দাঁয় । ইতোমধ্যে শত শত বাংলাদেশীর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হয়েছে । থাইল্যান্ডের গহীন অরণ্যে শত শত গণকবরের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে । যাতে আশ্রয় হয়েছে হয় বাংলাদেশীদের নয় মায়ানমারের রোহিঙ্গাদের । কোথাও আশ্রয় না পেয়ে যারা দীর্ঘদিন ট্রলারের ওপর নদীতে ভাসছে তাদের আয়ুষ্কালও ক্রমাগত খাটো হয়ে আসছে । খাদ্যাভাবে তারা এখন জীবন্ত কঙ্কালে পরিণত । অনেকেই হাঙরের খাদ্য হয়েছে । যারা এখনো প্রাণে বেঁচে আছে তারা ক্ষুধার যন্ত্রনায় নিজ প্রসাব পান করে বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টা চালিযে যাচ্ছে । বাংলাদেশীদের মানবতা আজ সাগরের পানিতে ভাসছে ! দেশে কর্মসংস্থানের অভাবে মানুষগুলো পালিয়ে বাঁচতে চাইলেও তাদের শেষ রক্ষা হচ্ছে না । অথচ মানবপাচারের সাথে জড়িত থাকার গুঞ্জন ওঠছে অনেক রথী-মহারথীর বিরুদ্ধে । আমাদেরে অনেকেই আছেন যারা প্রতিপক্ষের কারণে কয়েকজন মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত হওয়ায় তাদের শোকে কেঁদে বুক ভাসিয়ে ফেলি অথচ হাজার হাজার মানুষ জীবনের চরম অনিশ্চয়তা নিয়ে সাগরে ভাসছে কিন্তু তাদের ব্যাপারে চোখ শুধু শুকনা নয় বরং তাদের বিরুদ্ধে রাগে চোখ পাকাচ্ছি ।

নারীর নিরাপত্তাহীনতায় ঢাকা আর দিল্লীর মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য করতে পারছি না । দিল্লীর মত ঢাকাও নির্ভয়া কান্ড প্রসব করছে । মাইক্রোবাসে তুলে আদিবাসী তরুণীকে ধর্ষণের মত ঘটনা প্রিয় বাংলাদেশে ঘটতে পারে এ বিষয় কয়েকদিন পূর্বেও কল্পনাতীত ছিল । নির্ভয়া ইস্যুতে ঢাকা হয়ত দিল্লী হবে না কিন্তু আমাদের লজ্জা হওয়া উচিত । দুষ্টামী আর ধর্ষণের মধ্যে পার্থক্য করার মত তুচ্ছা জ্ঞানটুকুও যদি হারিয়ে ফেলি তবে মানুষের কাতারে দাঁড়িয়ে কিভাবে ? নারীর বস্ত্র হরণ, সম্ভ্রম হরণ কিসের প্রতিধ্বনি ? মূল্যবোধ কি ধ্বংসের কিনারায় ঠেকেছে ? আমরাও দিনে দিনে অথর্ব জাতিতে পরিণত হচ্ছি । প্রতিবাদের ভাষা যেন আটকে গেছে । কোন সাহসে প্রতিবাদ করব ? প্রতিবাদীর জীবনের নিশ্চয়তা কোথায় । যারা নেশার ঘোরে আমার সাথে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলেছিল তারা যে কোন মূহুর্তে আমাকে পঙ্গু করে দিতে পারে । ভয় তো আমারও আছে । এক্ষেত্রে এদের দমন করা যাদের দায়িত্ব তারাই যদি এদের নেতৃত্ব দেয় তবে সাধারণ মানুষ যাবে কোথায় ? সমাজ আর কতদিন বাস যোগ্য থাকবে ? অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে ঢাকা বিশ্বের বাস অযোগ্য দ্বিতীয় শহরের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়েছে । কিন্তু নেশাজাত দ্রব্য ও নেশাখোরদের এমন বীভৎস উৎপাত চলতে থাকলে গোটা বাংলাদেশটাই বাস অযোগ্য হয়ে পড়বে । কচ্ছপের মত দীর্ঘদিন বাঁচার লোভে বিবেককে বলেছি ঘুমাও, চোখকে বলেছি অন্ধ হও, কানকে বলেছি বধির হও, ত্বককে বলেছি স্পর্শহীন থেক, মুখকে বলেছি বাক্যহীন হও, রক্তকে বলেছি সাপের রক্তের মত শীতল হও ! যাতে কোন অবস্থাতেই কাপুরুষ থেকে সুপুরুষের মত প্রতিবাদ করতে গিয়ে জীবনটা খুঁইয়ে না ফেলি ! এভাবে আর কতদিন ? ঘুমন্ত বিবেক জাগিয়ে দেওয়ার দায়িত্বটুকু দায়িত্বশীলরা পালন করবে তো ?

রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ।

facebook.com/raju69mathbaria/