ফটোশপের মত যদি মাইন্ডশপও থাকত!

রাজু আহমেদ
Published : 3 Sept 2015, 06:52 PM
Updated : 3 Sept 2015, 06:52 PM

কৃষ্ণাঙ্গের সাম্রাজ্যে যেমন কুচকুচে কালোকে সেখানে সর্বোচ্চ আকর্ষণীয় মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা তেমনি শেতাঙ্গের সাম্রাজ্যে ধবধবে সাদাকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে মূল্যায়ণ করা হয় । আমাদের এই বঙ্গের মানুষগুলো যেমন খাঁটি কৃষকায় নয় তেমন পুরো শ্বেতবর্ণেরও নয় । কৃষ্ণাঙ্গ আর শেতাঙ্গের মিশ্রনে একটি সংকর জাতির তৈরি হয়েছে গোটা ভারত উপমহাদেশ জুড়ে । গাত্রবর্ণের ওপর যেমন ভৌগলিক প্রভাব রয়েছে তেমনি বংশগতির ধারা ব্যাপক প্রভাব রাখে । আমরা যারা পূর্ণ সাদাও নই আবার প্রকৃত কালোও নই তারা নিয়ত সংগ্রাম করছি শেতাঙ্গদের সাথে মিশতে । আমাদের সকল প্রতিযোগিতা যেহেতু পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুসরণ কেন্দ্রিক সেজন্য আমাদের মনে সাদার শ্রেষ্ঠত্বই নির্বিচারে স্থান পেয়েছে । প্রত্যহ অবিরাম চর্চা করে যাচ্ছি কিভাবে কালোকে সাদা এবং সাদাকে আরও সাদা করতে পারি । শেতাঙ্গদের চামড়ার মত আমাদের চামড়া যতদিন শুভ্র সফেদ রং ধারণ না করবে ততদিন হয়ত আমাদের এ প্রতিযোগীতা চলতেই থাকবে । হয়ত আমরা সবাই এ সত্য স্বীকার করবো না তবুও বাস্তবতার সাথে সত্যকে যেন প্রতিদ্বন্দ্বী না করি । অহর্ণিশি রূপ চর্চা, মেকাপের পর মেকাপ, রং চংয়ের চর্চা, এত সব প্রসাধণী, সূর্যস্নান ও বায়ুস্নান আরও কত কত আয়োজন । এ আয়োজন ত্বকের সফেদ রূপদানের প্রচেষ্টা সর্বস্ব ।

সৃষ্টির মধ্যে সাদা-কালো, বেঁটে-লম্বা, মোটা-পাতলা থাকবেই । কেননা পার্থক্য না থাকলে সব মিলে মিশে একাকার হয়ে যেত । তবে সৃষ্টিগত পার্থক্য নিয়ে বাহাদুরী-হীনতা দেখানো কিছু নাই । সাদা-কালোর স্রষ্টা কোনভাবেই মানুষ নয় । তবুও আমরা সাদা কিংবা আকর্ষণীয় হওয়ার জন্য যত ধরণের প্রচেষ্টা করি তার প্রায় সম্পূর্ণটাই মুখাবয়বকে ঘিরে । মানুষের সৌন্দর্য তার মুখশ্রীতেই প্রকাশ পায় বলে সমাজে প্রচলিত । তাই মুখাবয়বকে শ্রী দিতে প্রসাধনীর চর্চা যতটা চলে তার চয়ে কম চলেনা প্রযুক্তি কেন্দ্রিক শ্রী বৃদ্ধির চেষ্টা । আধুনিক প্রযুক্তির অন্যতম সংযোজন ফটোশপ নামক সফটওয়্যারটি দিয়ে আমরা আমাদের চেহারা-সুরতকে ইচ্ছা মাফিক সাজাতে পারি । কখনো কখানো আমাদের চেহারা নায়ক-মহায়নায়কদের চেহারাকেও হার মানায় ।

অথচ ফটোশপের চেয়ে আমাদের বেশি প্রয়োজন মাইন্ডশপ । মনকে সুন্দর করতে না পারলে চেহারাকে সুন্দর করা অর্থহীন । চেহার সৌন্দর্য ক্ষণিকের কিন্তু মনের সৌন্দর্য সৃ্ষ্টি করা গেলে সে সৌন্দর্যের স্থায়িত্ব কালোত্তীর্ণ । সৃষ্টির সময় মানুষের অবয়বের ভিন্নতা এসেছে কিন্তু মনের পবিত্রতার কোন ভিন্নতা আসেনি । সকলের মন জন্মের সময় পূতঃপবিত্র ছিল । অথচ আমরা আমাদের স্বার্থের কারণেই মনকে বিভিন্ন প্রবাহে বিস্তৃত করেছি । সামান্য সংখ্যক মানুষের মন আজও পবিত্র থাকলেও বহু সংখ্যকের মন হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য কপটচারী হয়েছে । দ্বিমূখী, ত্রীমূখী কিংবা বহুমূখী বলতে যা বুঝায় তার সবটাই আমরা মনের মধ্যে পুষি । অথচ হওয়া উচিত ছিল এর বীপরিত । মানবজীবনের সর্বত্র শান্তি-শৃঙ্খলা বজায়ের জন্য মনের গুরুত্ব অপরীসিম । অথচ মনটাই আজ যেন মনে নাই । খুব করে শূণ্যতা অনুভব করি পবিত্র মানসিকতার । শৈশবের সেই পবিত্র মনের অস্তিত্ব হাতড়ে বেড়াই অথচ কোথাও তাকে খুঁজে পাইনা । সেই সরলতা, সত্যতা কিংবা বিশ্বস্থতা আজ যেন সোনার হরিণ । তাই মাঝে মাঝে খুব আফসোস করে বলি, অবয়ব সুন্দর করার জন্য যেমন ফটোশপ নামের একটি ব্যবস্থা আছে তেমনি মনকে সুন্দর রাখার জন্যও যদি একটি মনশপের ব্যবস্থা থাকতো তবে কতই না ভালো হত । মনকে পবিত্র রাখার জন্য আত্মজিজ্ঞাসা, বিবেকবোধ ও নৈতিকতার চর্চা আজ খুব প্রয়োজন । মানুষের কাছে গ্রহনযোগ্য ও আকর্ষণীয় হওয়ার জন্য চেহারার গুরুত্বকে অস্বীকার করি না তবে সে গুরুত্ব খুব জরুরী নয় । মানুষ হিসেবে মনের পবিত্রতা সৃষ্টিই মূখ্য হওয়া দরকার সাথে গৌণ হিসেবে চেহারার সৌন্দর্যবৃদ্ধির চেষ্টা করা যেতে পারে । তবে মূখ্যকে বাদ দিয়ে গৌণকে গ্রহণ করা বোধহয় নিছক বোকামী ছাড়া অন্য কিছু নয় ।

রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট ।

facebook.com/rajucolumnist/