একদিকে উগ্রতা অন্যদিকে কথিত মুক্তমত

রাজু আহমেদ
Published : 4 Nov 2015, 08:24 PM
Updated : 4 Nov 2015, 08:24 PM

ইতিহাসে প্রমাণিত যে, জাহেলী যুগে নারীর পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক মর্যাদা ছিল না বললেই চলে । কেবল ভোগ্য পণ্য হিসেবেই নারীকে বিবেচনা করা হত । পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা নারীকে এমনভাবে পিষ্ট করেছে যা মানবিক বিবেচনায় ভুলের শীর্ষে ছিল । জাহেলী যুগে নারীর সেই ভুলের শোধ আজ আবার ভুল দিয়েই নেওয়া হচ্ছে । নারীর স্বাধীনতার নামে কিছু সংখ্যক নারী স্বার্থালোভী পুরুষের খপ্পরে পড়ে আবারও ভোগ্য পণ্যেই পরিণত হয়েছে । কাজেই বলা চলে, ভুল শোধরাতে গিয়ে ভুল পথেই আমরা চলছি । বিষয়টি উল্লেখের উদ্দেশ্য হচ্ছে বর্তমান মুক্তমনাদের মুক্তমত ও উগ্রতার বিষয়টিকে স্পষ্ট করার জন্য । বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন জীব হিসেবে মানুষ মুক্তমতের চর্চা করবে এটাই স্বাভাবিক । কিন্তু মুক্তমত বলতে যখন ধর্ম স্বীকৃত কোন বিষয়ে এমন জঘণ্য মিথ্যা অপবাদ উত্থাপিত করা হয় তখন তা মুক্তমতের পর্যায়ভূক্ত থাকে কিনা সে বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসা দরকার । মুক্তমত বলতে যদি কেবল ইসলামকে গালি দেয়া উদ্দেশ্য হয় কিংবা ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেয়ার মনোবাসনা পূর্ণ করা হয় তবে সেটাকে মুক্তমত বলা চলে না । কাজেই অবৈধ যুক্তি মুক্তমত হতে পারে না বিশেষত ধর্মের ব্যাপারে গভীর কোন জ্ঞান ছাড়া ধর্ম বিষয়ে আলোচনা করাও অনুচিত যদি তা কপটার উদ্দেশ্য হয় । শুধু ইসলাম নয় বরং অন্য সকল ধর্মের বিরুদ্ধে মুক্তমনাদের এক ধরণের ক্ষোভ পরিলক্ষিত হচ্ছে । ভোগবাদি মানসিকতা হয়ত তাদেরকে ধর্মের বিরুদ্ধে মত প্রকাশে উৎসাহিত করে । কিন্তু পৃথিবীতে যতগুলো প্রতিষ্ঠিত ধর্ম ব্যবস্থা আছে সেগুলোকে ঐশ্বরিক বিবেচনায় নিতে যারা নারাজ তারাও যদি স্থুল বুদ্ধির অধিকারী না হন তবে ধর্মের সমালোচনা করতে পারে না । কেননা ধর্ম সমাজ তথা মানুষকে সুশৃঙ্খল জীবন যাপনে উৎসাহিত করে । কাজেই সুন্দর জীবন গঠনের পথ ও পদ্ধতি হিসেবে কোন ধর্মের ঢালাও সমালোচনা করা পুরোপুরি অজ্ঞতা-অজ্ঞানতার শামিল । সুতরাং ‍মুক্তমত প্রকাশের নামে সরলপ্রাণ ধর্মবিশ্বাসী মানুষের সহস্র বছরের বিশ্বাস-মূল্যবোধে আঘাত করা মারাত্মক ভুল ।
মুক্তমনাদের সেই ভুলকে শোধরাতে আরেকশ্রেণীর মানুষ সম্পূর্ণ ভুল পথেই এগুচ্ছে এবং সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট করছে । অন্যায়ভাবে বা বিনা বিচারে মানুষ হত্যার বৈধতা ইসলামসহ কোন প্রতিষ্ঠিত ধর্ম দেয়না । ধর্মের ব্যানারে একদল ধর্মান্ধ মানুষ আজ মরণ খেলায় মেতেছে । কিন্তু সেই মানুষগুলো কারা তা আজও আমরা নিশ্চিত করে জানতে পারিনি । সর্বশেষ ৩১ আক্টোবর জাগৃতি ও শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর মালিক ফয়সাল আরেফিন দীপন ও আহমেদুর রশীদ টুটুলসহ আরও দু'জন লেখক-ব্লগারের ওপর দুর্বৃত্তরা হামলা করেছে । এতে দীপন ঘটনাস্থলে মারা গেছে এবং বাকী তিনজন আশঙ্কাজনকভাবে উদ্ধার হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছে । এ হামলার পূর্বে মাত্র আড়াই বছরের মধ্যে দেশে লেখক-ব্লগারদের ওপর আরও বেশ কয়েকটি হামলা হয়েছে যাতে ৫ জন মারা গেছে । গত ফেব্রুয়ারীতে বই মেলা প্রাঙ্গনে আমেরিকায় প্রবাসী অভিজিৎ রায় খুন হওয়ার পর গোটা বিশ্ব নড়েচড়ে বসেছিল । সে খুনের ঘটনা তদন্তের জন্য বিশ্বের অন্যতম চৌকষ আমেরিকার গোয়েন্দা দল এফবিআইয়ের কয়েকজন সদস্য আমাদের দেশে এসেছিল এবং এখানে কয়েকদিন থেকে গভীরভাবে তদন্ত ও কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে গেছেন । তারা আদৌ খুনিদের শনাক্ত করতে পেরেছেন কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি তবে দেশের আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা থেকে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, এ হত্যাকান্ডের সাথে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম সম্পৃক্ত । অন্যদিকে আবার এ সকল হত্যাকান্ডের কোনটির দায় স্বীকার করেছে আল কায়েদা, কোনটির আইএস আবার কোনটির তালেবান । এ যাবৎ যে সকল ব্লগার খুন হয়েছে অর্থ্যাৎ অনন্ত, বাবু, রাজীব, নিলয় ও অভিজিত-তাদের খুন হওয়ার পর আমরা এগুলোকে রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হতে দেখেছি । অতীতে দলের মধ্যম পর্যায়ের নেতারা পরস্পর বিরোধী পক্ষকে দোষারোপ করলেও বর্তমানে দলের শীর্ষ নেতারা একে অন্যকে দোষারোপ করছে । এতে দলীয় স্বার্থ হয়ত কিছুটা রক্ষা পাচ্ছে কিন্তু নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি অবরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে । পারস্পরিক দোষারোপের রাজনৈতিক সংস্কৃতির গতানুগতিক ধারা অনুসরণ করে এ সকল হত্যাকান্ডের পর এক দল আরেকদলকে দোষারোপ করে বক্তৃতা বিবৃতি প্রদানে নিরপেক্ষ তদন্ত কতটা বাধাগ্রস্থ হয়েছে তা নিশ্চিত করে বলতে পারবো না তবে দেশবাসী যে হতাশ ও বিভ্রান্ত হয়েছে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই ।

শুধু দেশবাসী নয়; এ হতাশার প্রকাশ আমরা শুনেছি সর্বশেষ খুন হওয়া দীপনের বাবা ঢাবি অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হকের মুখে । তার একমাত্র পুত্রসন্তান খুন হওয়ার পর তিনি বিচার চাননি বরং চেয়েছেন মানুষের শুভ বুদ্ধির উদয় । শুভ বুদ্ধির উদয় যেমন প্রয়োজন ধর্মান্ধ উগ্রজনগোষ্ঠীর তেমনি প্রয়োজন রাষ্ট্রের পরিচালকদের । দীপনের বাবার কথার অনুরূপ প্রতিধ্বনি শুনেছি আট মাস আগে খুন হওয়া মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিত রায়ের স্ত্রীর কথায়ও । তিনিও আর বিচার চান না ! রাফিদা আহমেদ বন্যাও ক্ষোভ মিশ্রিত কন্ঠেই বলেছেন, যেখানে ভোট ব্যাঙ্কের হিসাব-নিকাষ মেটানো জরুরী সেখানে বিচার চেয়ে কি লাভ ? কেউ খুন কিংবা আক্রান্ত হওয়ার পর তার আত্মীয়-স্বজনের কাকুতি-মিনতি করে বিচার চাওয়াটা খুব বেশি জরুরী নয় কেননা রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থেই সংশ্লিষ্ট মহল স্বপ্রণোদিত হয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহনের অধিকার রাখে । তবুও মনের জ্বালা নিবারণের জন্য বিচার কামনা না করে থাকা যায়না কিন্তু যখন একের পর এক ঘটনার ধারাবাহিকতা কেবল বিচারহীনতার সংস্কৃতি জন্মদিতেই থাকে তখন বিচার চাওয়া আর না চাওয়ার মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য থাকে না । বিগত আড়াই বছরে যে পাঁচজন লেখক-ব্লগারকে খুনের ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর যদি সুষ্ঠু বিচার হত এবং অপরাধীরা চিহ্নিত হয়ে দ্রুত শাস্তি পেত তবে নতুন করে এমন ঘটনা ঘটার যেমন সুযোগ থাকত না তেমনি আক্রান্তের পরিবার ন্যায় ও নিরপেক্ষ বিচার পাওয়ার আশা বুকে বেঁধে বিচারালয়ের দ্বারস্থ হত ।

আমরা আসলেই খুব আশ্চর্য জাতি ! সন্তান হত্যার পর বাবা কেন বিচার চাইলেন না তার পোষ্টমর্টেম করতে গিয়ে আসল দাবী থেকেই আমরা প্রায় সরে এসেছি । কেউ কেউ এও বলে ফেলেছে, দীপনের বাবা খুনীদের আদর্শে বিশ্বাসী বলেই তিনি বিচার চাননি ! কোন বিবেচনায় এটা বলা যায় তা আমরা জানি না তবে একজন মানুষের সমালোচিত হতে এর চেয়ে বড় ধরণের উক্তির কোন দরকার নাই । পৃথিবীতে এমন কোন বাবা নাই যিনি তার সন্তানে স্বাভাবিক কিংবা অস্বাভাবিক বিয়োগে ভেঙ্গে না পড়েন । আবুল কাশেম ফজলুল হক বাবা হিসেবে কিংবা মানুষ হিসেবে যেহেতু পাথরের তৈরি নন কাজেই তিনিও অসীম কষ্ট বুকে চাপা দিয়ে রেখেছেন । বাচ্চাদের মত হাউমাউ করে কাঁদা কিংবা ন্যায় বিচারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের চলমান বাস্তবতাকে অস্বীকার করে অনর্থক বিচার বিচার করে তিনি গলাফাটিয়ে কি ফল পাবেন ? অভিজিতের বাবা, অনন্তের বোন বিচারের দাবী করে কি বিচার পেয়েছে ? যে সকল ব্লগার হত্যার হুমকি পেয়ে আইনের কাছে নিরাপত্তা চেয়েছিল তাদেরকে আইন কতটুকু সহায়তা দিয়েছে ? রাষ্ট্রকে দু'টো বিপরীত বিষয়ের যে কোন একটিকে গ্রহন করতে হবে; হয় মুক্তমতের পক্ষে দাঁড়িয়ে তাদেরকে সার্বিক নিরাপত্তা দিতে হবে নয়ত মুক্তমতের নামে শুধু ধর্মকে গালি ও অশালীন অবৈধ যুক্তি বন্ধের সাথে উগ্রবাদের সাথে সম্পৃক্ত ধর্মান্ধ জনগোষ্ঠীকে শাস্তির মাধ্যমে দমন করতে হবে । ইসলাম কিংবা প্রকৃত মুসলিমদের কেউ বিনা বিচারে মানুষ হত্যার বিষয়টি পছন্দ তো করেই না বরং ঘৃণার সবটুকু সামর্থ উজাড় করে প্রতিবাদ জানায় কিন্তু মুক্তমনার নামে ধর্মের কুৎসা রটনা ধর্মপ্রাণ মানুষকে ব্যথিত করে । সরকারকে যেমন মানুষের আবেগ বুঝতে হবে, স্বীয় শক্তিতে অব্যক্ত কথা পাঠ করে নিতে হবে তেমনি বৃহৎ ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠীর স্বার্থও সংরক্ষন করতে হবে ।

রাষ্ট্রের একজন মন্ত্রী কিংবা সমমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি জনগণের নিরাপত্তা বিধানের পত্যক্ষ-পরোক্ষ প্রহরী । তাদের মুখ থেকে যখন প্রকাশ পায়, চোরাগুপ্ত হামলা থেকে কেউ নিরাপদ নয়; এমনকি তিনিও । তখন আমাদের দেশটা তথা আমরা নিরাপদে আছি এ কথা বলা অর্থহীন । বিশ্বের তাবৎ রাষ্ট্র আমাদর দেশের ভবিষ্যত দেখার জন্য তাকিয়ে আছে । ক্ষমতাশীলদের কাছে সবিনয় নিবেদন, ব্যর্থ পাকিস্তানের মত আমাদের দেশের পরিণতি যেন না হয় । মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে দেশটির সূচনা হয়েছিল সে দেশটিতে যা হচ্ছে তা কোন বিবেকবার মানুষ মেনে নিতে পারে না । প্রায় শতভাগ আস্তিক মানুষের এ বাসভূমে যেমন কোন ধর্মকে কটূক্তি করার সুযোগ দেয়া যাবে না তেমনি যেভাবে মুক্তমনা মানুষের খুন করা হচ্ছে এটা বন্ধ করতে হবে । মুক্তমনা বলতে যেন ধর্ম অবমননা করা না হয়-এটা যেভাবে লেখকদেরকে বুঝতে ও বোঝাতে হবে তেমনি ধর্মান্ধ ও উগ্রবাদের সমর্থকদের বোঝাতে হবে ধর্মের সঠিক রূপরেখা । পরমত সহিষ্ণুতার ক্ষমতা আরও বেশি অর্জন হওয়া আবশ্যক । চলমান সমস্যা ও সংকট সমাধানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বৃহৎ ঐক্যেরও কোন বিকল্প নাই ।