সমস্যাকে মূলে চিহ্নিত করুন

রাজু আহমেদ
Published : 13 Nov 2015, 12:53 PM
Updated : 13 Nov 2015, 12:53 PM

বাবা-মাকে হত্যার দায়ে 'ডাবল' ফাঁসির দণ্ড দেয়া হয়েছে ২০১৩ সালের ১৭ই আগষ্টের আলোচিত খুনের খুনী ঐশী রহমানকে । সদ্য যৌবনে পা দেয়া মেয়েটির খুন পরবর্তী গল্প তৎকালীন সময়ে দেশের অন্যতম আলোচিত ইস্যুতে পরিণত হয়েছিল । দেশের সকল বাবা-মা তাদের সন্তানদের নিয়ে আরেকবার নতুন করে ভেবেছিল । সন্তানেরাও অবাক হয়ে বলেছিল, কোন সন্তান তার জন্মদাতা-জন্মদাত্রীকে খুন করতে পারে । অথচ ঐশী পেরেছিল । পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক (এসবি) মাহফুজুর রহমান ও সপ্না রহমানকে খুন করে এ দম্পতির বড় মেয়ে ঐশী কয়েক ঘন্টার মধ্যে ভিলেন হয়েছিল । পরবর্তীতে এ খুনের ঘটনা এবং এর পূর্বাপর নিয়ে গণমাধ্যমে যে সংবাদ ছড়িয়েছিল তা পৌরাণিক কাহিনীকেও হার মানায় । মাতাল ঐশী ও তার বন্ধুরা ঐশীর বাবা-মাকে খুন করলেও ফুলের টোকাটি লাগতে দেয়নি ঐশীর একমাত্র ছোট ভাইয়ের ওপর । বরং খুন পরবর্তী দিনের অর্ধবেলা আদরের ভাইকে নিয়ে সিএনজিতে করে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে উদভ্রান্তের মত ঘন্টার পর ঘন্ট ঘুরেছিল ঐশী । বেলা এগারোটার দিকে ঐশী নিজেকে খুনী পরিচয় দিয়ে আবার নিজেই গিয়ে আত্মসমর্পণ করেছিল থানায় ।

ঐশীর বাবা-মা ঐশীকে টাকা দিয়ে লালন-পালন করলেও আদর দিয়ে লালন পালন করতে পেরেছে কতটুকু? ঐশীর যে সুইসাইডাল ডায়েরী প্রকাশিত হয়েছিল তাতে ঐশীর সাথে তার বাবা-মায়ের অভিভাবক সন্তানের সম্পর্ক সূলভ কোন সম্পর্কই গড়ে ওঠেনি বলে মনে হয়েছে । নেশার রাজ্যে হারিয়ে গেছিল একটি সদ্য তারুণ্যে পদার্পণ করা তরুণী । বাবা সারা দেশের মস্ত বড় বড় অপরাধীদের পাকড়াও করলেও নিজ মেয়েকে বিরত রাখতে পারেনি নেশার দুনিয়া থেকে; কিংবা চেষ্টাও করেনি । যে বাবার টাকা আছে সে বাবা যদি মেয়ের সব কিছুতে প্রশ্রয় না দেয় তবে সেটা বেমানান লাগে ! হাত খরচ তথা বাজে খরচের জন্য যে মেয়ে বাবা-মায়ের কাছ থেকে বয়স বিশোত্তীর্ণ হতে না হতেই প্রতি মাসে যদি লক্ষাধিক টাকা পায় তবে সে মেয়ে আর মানুষ থাকে কি করে ? দেশবাসী আজ ঐশীকে ঘৃণা করে; একজন খুনী হিসেবে তাকে জানে । যে মেয়ে বাবা-মাকে খুন করতে পারে সে মেয়ের বেঁচে থাকার অধিকার নাই । যত দ্রুত সম্ভব ঐশীর ফাঁসি হোক । দেশের সব মেয়ে তথা সন্তান জানুক বাবা-মাকে খুন করলে তার পরিণতি কি হয় ।

কিন্তু ঐশীকে খুনী বানালো কে ? ঐশী তথা ঐশীদের আজকের পরিণতির জন্য দায়ী কারা ? যে রাষ্ট্রে সর্বত্র জীবনবিনাশী নেশাজাত দ্রব্য সহজলভ্য হয়ে যায় যে রাজ্যের বিশৃঙ্খলা রুধবে কে ? ইয়াবা কন্যা হিসেবেই ঐশীকে পরিচিত করা হয়েছে । এ দেশে ইয়াবার এজেন্ট কারা ? রাষ্ট্র সে সব লাঘব বোয়ালদের বিরুদ্ধে কতটুকু কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহন করেছে । দু'জন-চারজন ইয়াবাসেবীকে শাস্তির প্রদানের কথা আমরা মাঝে মাঝেই শুনি । কিন্তু সেবীদের শাস্তি দিয়ে লাভ কি ? আজ দু'জনকে শাস্তি দেয়া হলেও ইয়াবা আসক্তিতে জড়াচ্ছে আরও দু'শ জন । কাজেই উৎপাদন-আমদানি বন্ধে ব্যবস্থা নেয়া জরুরি অথচ সে দিকে খুব বেশি নজর আছে বলে প্রত্যক্ষিত নয় । এ দেশে অনেকে ইয়াবা সম্রাট উপাধি পেলেও বারবার তাদের নির্দোষ প্রমাণ হওয়ার সংবাদ শুনতে শুনতে দেশবাসী আশাহত । নেশার রাজ্য এমনভাবে বিস্তৃত হয়েছে যাতে নেশাহীন জাতির স্বপ্ন দেখা প্রায় অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে । আর নেশার কবলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে যুব সমাজ । সমাজের তথা রাষ্ট্রের প্রধান ভিত যদি নড়বড়ে হয়ে যায় তবে এ জাতির কপালে দুঃখ আছে । এমন পরিবারের সংখ্যা নেহায়েত হাতে গোনা যে পরিবারে একাধিক তরুণ রয়েছে অথচ তাদের কেউ না কেউ কোনভাবে নেশাজাত দ্রব্য সেবনে জড়িত নয় । নেশার রাজ্যের বিস্তৃতি সম্পূর্ণ নির্মূল করতে না পারলে ঐশীদের সংখ্যা গণনা করে শেষ করা যাবে না । চলমান অবস্থা চলতে থাকলে, মহল্লায় মহল্লায় ঐশীদের উত্থানে খুব বেশি দেরী নাই ।

গণমাধ্যমের তথ্যানুযায়ী, ঐশীর প্রতিমাসে লক্ষাধিক টাকার হাত খরচের জোগান তার বাবা করে দিত । কিভাবে করত তা রাষ্ট্রের জানা উচিত, জাতির জানা উচিত । অতিরিক্ত টাকা যে মানুষকে নষ্ট করে দিতে পারে তার অনন্য দৃষ্টান্ত ঐশী । বাবা-মায়ের কাছ থেকে অঢেল থাকা পেয়ে যৌবনের সুড়সুড়িকে ঐশী ছড়িয়েছিল তার সোসাইটিতে । জোগাড় করেছিল অনেক বন্ধু । যারাও ঐশীর মানের । কেননা এ দেশে কোন জিনিস দূর্লভ নয়; নৈতিকতা ছাড়া। ঐশীর গল্প শুনে মনে হয়েছে, ঐশীর মা তথা সপ্না রহমান জীবনের শেষ প্রান্তে ঐশীকে আয়ত্বে আনার চেষ্টা করেছিল কিন্তু সেটা বৃথা হয়েছে এবং এ কারণেই হয়ত তাদের স্বামী-স্ত্রীকে জীবন দিতে হয়েছে । সময়ের কাজ সময়ে না করলে অসময়ে তা করা যায়না । অধঃপতিত কাউকে একটানেই ঠিক পথে যে আনা যায়না সেটা ঐশীর ঘটনাতেই প্রমাণিত হয় । কাজেই বখে যাওয়া অন্যান্য সন্তানদের পিতামাতাকে কৌশলি হতে হবে । আজ ঐশীদের জন্যই ঐশীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রয়োজন কিন্তু এটা সমাধান নয় । স্থায়ী সমাধানের জন্য সমস্যার মূল চিহ্নিত করতে হবে । সন্তানের জন্য আদর্শিক বাবা-মা হওয়ার জন্য সর্বদা চেষ্টা করতে হবে । সন্তানকে সুসন্তান হিসেবে গঠনে বাবা-মায়ের চেয়ে উৎকৃষ্ট কোন শিক্ষক হয়না; হতে পারে না । দেশকে নেশাজাত দ্রব্যমুক্ত রাখতে রাষ্ট্রের সর্বশক্তি বিনিয়োগ করতে হবে । বাবা-মা হত্যার জন্য এককভাবে শুধু ঐশীকে দায়ী করা চলে না । ঐশী যেমন দায়ী তার চেয়ে কম দায়ী নয় ঐশীর পরিবার, পরিবেশ । একজন ঐশীকে দিয়ে এদেশের হাজার ঐশীর শিক্ষা হোক । সকল পিতামাতাকে আরও সচেতন হতে হবে । তা নাহলে তাদের পরিণতিও মাহফুজুর রহমান ও সপ্না রহমানের মত হতে পারে । রাষ্ট্রকে হতে হবে আরও জনবান্ধব অন্তত মাদকের বিস্তার রোধে ।