দুর্নীতির থাবায় অগ্রগতির চাকা

রাজু আহমেদ
Published : 11 Dec 2015, 07:23 PM
Updated : 11 Dec 2015, 07:23 PM

মাত্র ১ মাস যদি দেশের সর্বস্তরের দুর্নীতি বন্ধ থাকে তবে নিশ্চিত করে বলতে পারি, এ দেশের শ্রী বদলে যাবে । সৌভাগ্যক্রমে এদেশের মানুষ ঘুম থেকে জেগেই বহু স্বপ্নের কথা শুনতে শুনতে দিনের পথ চলা আরম্ভ করে ! দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ঘুমাতে যাওয়ার বেলায় সারা দিনের হিসেব-নিকেষ মিলিয়ে কোথাও স্বপ্নের বাস্তবিক রূপ ধরা পড়ে না । প্রাপ্তির হিস্যা শুধু বচনের বেড়ীতেই সীমাবদ্ধ । দুর্নীতিবিরোধী স্লোগানে স্লোগানে দেশের আকাশ বাতাস মূখরিত হয়, শ্রবনেন্দ্রিয় প্রশান্তি অনুভব করে কিন্তু দুর্নীতি বন্ধ হয়না কোথাও । দেশের অন্যান্য সময়ের চেয়ে ডিসেম্বরের ৯ তারিখে যেন আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটু বেশিই সোচ্চার হই ! দীর্ঘ শপথবাক্য পাঠ করে বিশ্বকে জ্ঞাত করিয়ে দেই, আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে ! শপথবাক্যের উচ্চারণ ধ্বণির কম্পন কিছুটা স্থায়ী হলেও মাত্র একদিনের সূর্য্যের পালাবদল পর্যন্তও স্থায়ী হয়না দুর্নীতি বিরোধী শপথের শিক্ষা । দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবসেও যে কত ধরণের দুর্নীতির মহড়া চলে তার হিসাব ক'জনে রাখে ? জাতিসংঘের উদ্যোগে ২০০৩ সালে মেক্সিকোর মেরিদা শহরে দুর্নীতি বিরোধী কনভেনশনেই দুর্নীতি বিরোধী দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয় । দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলে বিশ্ব অর্থনীতিকে দুর্নীতিমুক্ত রাখাই ছিল এ দিবস পালনের উদ্দেশ্য । বাংলাদেশ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের উদ্যোগ ও কল্যানে আমরাও পালন করছি এ দিবসটি । বোধহয় শুধু পালন করছি কিন্তু ধারণ করছি না ! ব্যক্তি থেকে দল, ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ-সর্বএই কেবল দুর্নীতির ঘনঘটা । যারাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিশ্চল থাকার অঙ্গীকার করে জনতার রায়ে ক্ষমতার মসনদে আরোহন করেছে তারাই মুড়েছে দুর্নীতির খোলসে । অবৈধ অর্থের লোভ তাদের সকল নীতি-নৈতিকতা, অঙ্গীকারকে মূহুর্তেই বিস্মৃত করে দিয়েছে । দুর্নীতি শুধু অর্থের সাথেই জড়িত নয় বরং সুপারিষ-তদবির, স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ আরও বহুভাবে দুর্নীতি হয় ।

ব্যক্তিজীবনে যত বক্তৃতা শুনেছি তাতে কোথাও কারও মুখ থেকে শুনিনি সে দুর্নীতির পক্ষে, যত লেখা পড়েছি তাতেও কেউ দুর্নীতির পক্ষে সাফাই গায় নি অথচ দুর্নীতিমুক্ত একটি সমাজ, রাষ্ট্রের কল্পনাই করা যাচ্ছে না । এদেশে আন্না হাজারের মত কাউকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অনশন করতে, কেজরিওয়ালের মত শক্ত অবস্থান নিতে দেখিনি তবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিযোগ্য আইন, কিছু মানুষের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রয়াসেও কেন দুর্নীতির লাঘাম টানা সম্ভব হয়নি সে এক রহস্যই বটে । বিশ্লেষকরা মনে করেন, দূর্বল গণতন্ত্র এবং সুশাসনের অভাবে দুর্নীতি ব্যাপৃত হওয়ার সুযোগ ঘটে । প্রশ্ন জাগে, তবে কি স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের দীর্ঘ ৪৫ বছরের সবটুকু জুড়ে গণতন্ত্র অর্ধমৃত এবং সুশাসনের সংকট ছিল ? স্বাধীনতা অর্জনের পরে বহু সম্বলহীন মানুষের রাতারাতি অঢেল সম্পত্তির মালিক হওয়ার গল্প পড়েছি, টানা কয়েক বছর দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ণ বাংলাদেশের স্বাক্ষী হয়েছি, ক্ষমতার পালাবদলে সৃষ্ট সাবেকদের দুর্নীতির ঝাঁপি উম্মোচিত হতে দেখিছি । এদেশের হাজার হাজার কোটি টাকা অবৈধভাবে বিদেশে পাচারের গল্প গণমাধ্যমে পাতায় পাতায় প্রতিনিয়ত ভেসে বেড়ায়, শেয়ার বাজার থেকে অর্থ লোপাট, ব্যাংক থেকে জালিয়াতির মাধ্য হাজার কোটি টাকা উধাও, উন্নয়নমূলক কাজ শুরুর আগেই শত কোটি টাকা লাপাত্তা, দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিদেশী সাহায্য সংস্থার পূর্ব ঘোষিত অর্থ সাহায্য প্রকল্প স্থগিত রাখা, কাজের জন্য বরাদ্ধকৃত অর্থের ৩০ শতাংশেরও কাজ না হওয়া, যে কাজ হয় তা ভেজাল ও নকল উপাদান দিয়ে করার কারণে নির্ধারিত মেয়াদের অনেক পূর্বেই নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঘটনাগুলো আমাদের নৈতিকতা-দুর্নীতিমুক্ত অবস্থানের স্বাক্ষী দেয়না । সরকারী অফিসের পিয়ন-চাপরাশির বিলাসবহুল গাড়ী-বাড়ীর মালিক হওয়ার গল্পগুলো নিছক রূপকথা নয় । বনখোকে, পলিথিন খেকো উপাধিগুলোর সাথে আমরা অপরিচিত নই । দেশে উন্নয়ণের জোয়ার বইছে, কাজ হচ্ছে, সে কাজের সংস্কার হচ্ছে, পুণঃসংস্কার হচ্ছে….এভাবে পুণঃ…পুণঃ….হয়েই চলছে । দেশী টাকায় যে কাজ হচ্ছে তার চেয়ে বিভিন্ন দেশ ও দাতা সংস্থা থেকে গ্রহীত ঋণের টাকায় বেশি কাজ হচ্ছে । দিনে দিনে এদেশের মানুষের মাথাপিছু ঋণের পরিমান ৩১ হাজার টাকা অতিক্রম করেছে । দেশের ১৬ কোটির অধিক মানুষের প্রত্যেকে যদি ৩১ হাজারের অধিক টাকা ঋণী হয় তবে ঋণের মোট সংখ্যাটা কততে দাঁড়াবে তা আমার গণনা যন্ত্র ধারণে অক্ষম ! কাগজ কলমে আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে বটে তবে সেখানে সমতার চেয়ে বৈষম্য বহুগুনে প্রকট । আমাদের লক্ষ্য ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১'এ উন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠা করা কিন্তু উন্নতির সাথে পাল্লা দিয়ে লাঘামছাড়াভাবে যে হারে দুর্নীতির ব্যাপ্ততা ও দুর্নীতিবাজদের দৌরাত্ম্য বাড়ছে তাতে আমাদের আকাঙ্খিত গন্তব্যে পৌঁছতে পারবো কতটুকু তা যেমন প্রশ্নবিদ্ধ তেমনি এর বাস্তবিক রূপ উম্মোচিত হওয়াও সময়সাপেক্ষ । স্বপ্ন দেখা কিংবা বড় আশা করতে মোটেও দোষ কিংবা নিষেধ নাই তবে যে পথে এগুচ্ছি তাতে ইস্পিত লক্ষ্যে পৌঁছা বোধহয় সহজসাধ্য হবে না ।

যে দেশে মুক্তিযোদ্ধার সনদ জালিয়াতি হয়, মুক্তিযুদ্ধে যে সকল বিদেশীরা সহায়তা করেছিল তাদের আমন্ত্রন করে যে সম্মাননা পদক প্রদান করা হয় তা তৈরিতে ভেজাল দেয়া হয়, ত্রানের উপকরণ চুরি করা হয়, সরকারী ঔষুধ ফার্মেসিতে বিক্রি হয়, প্রভাবশালীদের গুদাম থেকে টিআর-কাবিখার বরাদ্ধ উদ্ধার করা হয়, ঘুষ, সুপারিষ ও তদবির ছাড়া চাকরি প্রাপ্তির নিশ্চয়তা কল্প রাজ্যে বাস করে সে সমাজ, রাষ্ট্র দুর্নীতিমুক্ত একথা বলার সৎসাহস আমাদের অনেকেরই নেই ! শিক্ষা সনদ টাকায় মেলার পরে কোনভাবেই বলতে পারি না আমরা দুর্নীতিকে ঘৃণা করি ! মেডিকেলসহ বিভিন্ন স্তরের ভর্তি ও সাধারণ পরীক্ষার পূর্বেই প্রশ্নপত্র ফাঁস, পরীক্ষা কেন্দ্রে নকলের সয়লাব দেখার পরেও এ সমাজ শুধু সাধুদের আবাসভূমি হিসেবে চিহ্নিত করার যৌক্তিকতা থাকে না । রাষ্ট্রের নগণ্য সংখ্যক ব্যতীত বৃহদাংশ যখন নীতিবিরুদ্ধ পথে চলছে তখন সে কাজকে অনৈতিক বলাও কিছুটা মুশকিল কিন্তু সুস্থ বিবেকবোধ সত্যের স্বাক্ষী দেবেই । উন্নত দেশগুলোর চাইতে উন্নয়শীল দেশগুলোতে ঘটমান দুর্নীতি তাদের উন্নতির প্রধাণ প্রতিবন্ধক । রাষ্ট্রযন্ত্রের হর্তা-কর্তারা যদি দুর্নীতিমুক্ত না হয় তবে সাধারণ নাগরিককে দুর্নীতিমুক্ত রাখা সম্ভব নয় । রাষ্ট্রের জন্য দুর্নীতি ক্ষতিকর ভাইরাসতুল্য । ভাইরাস সেখানেই আক্রমনে সাফল্য অর্জন করে যেখানে দুর্বলতা খুঁজে পায় । বিবেক নামক বোধকে যদি এন্টি-ভাইরাসের ভূমিকায় প্রস্তুত করার না যায় তবে দেশকে নিয়ে আমাদের লালিত স্বপ্নগুলো ভেস্তে যাবে । তখন উন্নতির আশা ছেড়ে তার বিপরীতে আমাদেরকে পতন ঠেকাতে মরিয়া হতে হবে ।

দেশের প্রভাবশালী মন্ত্রীদের বহুজনের মুখ থেকে তার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রনালয়ের দুর্নীতি বিষয়ক হালচালের কথা বহুবার শুনেছি । আমরা শুধু শুনে ক্ষান্ত হতে চাইনা । সর্বত্র উন্নয়ণের পরশে সাজানো একটি স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশের বাস্তবিক রূপ চাই । যেখানে থাকবে না দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, সুপারিষ-তদবির বাণিজ্য, অবৈধ ক্ষমতার লিপ্সা, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিসহ কোন ধরনের অন্যায়, শোষণ ও অবিচার । বৈষম্যহীন একটি সাম্যের বাংলাদেশ গড়ার মানসে দুর্নীতিকে ঘৃণা করে এমন আত্মপ্রত্যয়ী কিছু স্বপ্নদ্রষ্টার জাগরণ অত্যাবশ্যক । গণতন্ত্রের শক্ত ভিত্তিমূল রচিত হওয়া ব্যতিরেকে এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা ছাড়া দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব নয় । গণতন্ত্রের যেহেতু স্বকীয় কর্মক্ষমতা নাই কাজেই গণতন্ত্রের পূর্ণ বিকাশের জন্য আমাদেরকেই উদ্যোগী হতে হবে । দায়িত্বশীলরা যেন কথার জালেই শুধু দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানে না থাকেন বরং দুর্নীতির বিরুদ্ধের কার্যকরী পদপেক্ষ গ্রহনকারীর ভূমিকায় তাদেরকে দেখতে চাই । যে মন্ত্রী মহোদয় স্বীকার করেন তার মন্ত্রনালয় দুর্নীতিতে টইটম্বুর তার দ্বারাই তার মন্ত্রনালয়কে ‍দর্নীতিমুক্ত করা সম্ভব বলে বিশ্বাস করি । যদি 'শর্ষের মধ্যে ভূত' না থাকে তবে দেশের সর্বস্থান থেকে দুর্নীতি উৎখাত ও দুর্নীতিবাজকে ঝেটিয়ে বিদায় করে ভালোবাসার বাংলাদেশ নির্মান করা সম্ভব । স্বাধীনতা পরবর্তী দীর্ঘ সময়ে দেশকে যে অবস্থানে উন্নীত করা সম্ভব হয়নি তা আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে করা সম্ভব; যদি দুর্নীতিমুক্ত থাকা যায় । এ জন্য চাই দক্ষ ও যোগ্য দায়িত্বশীল এবং দুর্নীতিবিরোধী দেশপ্রেমের মানসিকতা । দুর্নীতিরোধ করার জন্য কেবল সচেতনতা সৃষ্টিই শেষ দায়িত্ব নয় বরং এ বিষয়ক আইনের কঠোর প্রয়োগ, নৈতিকতার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান, সর্বোপরি উদার দেশপ্রেমের মানসিকতা নিয়ে দেশ পরিচালনার উদ্যোগ গ্রহন করতে হবে । একটি দেশের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় মননশীল সৎ শ্রেণীর নেতা যদি ইচ্ছা করে তবে দেশকে দুর্নীতি ও ‍দুর্নীতিবাজদের কবল থেকে উদ্ধার করা সম্ভব । নিজে ঘুষ খাব, অপরকে খেতে দিব না-এ মানসিকতায় নয় বরং নিজে ন্যায়ের পথে থাকব এবং অধীনস্থদের ন্যায়ের পথে থাকতে বাধ্য করব-এ মানসিকতা প্রত্যয় তৈরি করা গেলেই কেবল দেশকে দুর্নীতিমুক্ত রাখা সহজসাধ্যভাবে সম্ভব । আমাদের দেশকে দুর্নীতিমুক্ত রাখতে পারলেই উন্নত বিশ্বের সহযোগী হিসেবে আমাদেরও নতুন ইতিহাস লেখা হবে; নচেৎ নয় ।