স্লোভেনিয়ায় থাকা বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের দিকে নজর দিন

রাকিব হাসান রাফি
Published : 28 March 2020, 06:20 PM
Updated : 28 March 2020, 06:20 PM

মধ্য ইউরোপে ছোটো একটি রাষ্ট্র স্লোভেনিয়া। দেশটির জনসংখ্যাও খুব বেশি নয়। স্লোভেনিয়ার শিক্ষাখাতে অগগ্রতি চোখে পড়ার মতো। এখানে মানুষের প্রধান ভাষা স্লোভিন হলেও প্রায় সবাই ইংরেজি বলতে পারেন। আমাদের দেশ থেকে যখন কেউ বিদেশে যাওয়ার চিন্তা করে তখন প্রথম যে সমস্যাটি দেখা দেয় তা হচ্ছে ভাষা। এক্ষেত্রে স্লোভেনিয়া অনেকটাই নমনীয়। দেশটির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ব্যাচেলর, মাস্টার্স কিংবা পিএইচডিতে অনেক কোর্স বা প্রোগ্রাম পাওয়া যায়  ইংরেজিতে।

এখনও ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় স্লোভেনিয়াতে অনেক কম খরচে পড়াশুনা করা যায়। স্লোভেনিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কোনো লেভেলে পড়াশুনা করতে হলে এক বছরে টিউশন ফি ২ হাজার ৮০০ ইউরো থেকে ৪ হাজার ইউরোর মতো প্রয়োজন। দেশটির জীবন যাত্রার ব্যয়ও ইউরোপের অন্যান্য দেশ থেকে অনেক কম।

বাংলাদেশ থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে গিয়ে অনেকেই পার্ট টাইম চাকরির চিন্তা করেন। এক্ষেত্রেও স্লোভেনিয়া অনেকটা নমনীয়।  এখানে কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যারা শিক্ষার্থীদের পার্ট টাইম চাকরির ব্যাপারে সহযোগিতা করে থাকে। আর এসব প্রতিষ্ঠান স্লোভেনিয়ার প্রায় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দ্বারা স্বীকৃত।

এছাড়াও শিক্ষার্থীদের জন্য আরও রয়েছে  'বনি বা সাবসিডাইজস মিল' এবং  'সাবসিডাইজস বাস সার্ভিস' নামে দুইটি বিশেষ পরিষেবা। একজন স্টুডেন্ট সাশ্রয়ী মূল্যে খাবার ও গণপরিবহন ব্যবহারের সুবিধা উপভোগ করতে পারেন এতে।

অনেকে ইউরোপে আসার পর বছর শেষে টেম্পোরারি রেসিডেন্ট পারমিট নবায়ন করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যায় পড়েন। এদিক থেকেও স্লোভেনিয়া এখন পর্যন্ত তেমন জটিল নয়।  যদি আপনি শিক্ষার্থী হন তাহলে ইউনিভার্সিটি থেকে একটি লেটারের ব্যবস্থা করতে হবে যা  স্টুডেন্ট স্ট্যাটাস সম্পর্কে বিস্তারিত প্রমাণ দেবে। ওই কাগজ  স্থানীয় ইমিগ্রেশন অফিসে জমা দিলেই   টেম্পোরারি রেসিডেন্ট পারমিট রিনিউ করার জন্য আবেদন করা যাবে।

স্লোভেনিয়াতে একজন শিক্ষার্থীদের জন্য অনেক সুযোগ-সুবিধা থাকলেও এর অনেক কিছু থেকে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে। স্লোভেনিয়াতে স্টুডেন্ট জবের ক্ষেত্রে কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। গ্রেট ব্রিটেন, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রেলিয়া, নিউ জিল্যান্ড, ডেনমার্ক একজন শিক্ষার্থী সপ্তাহে বিশ ঘণ্টার অধিক কাজ করতে পারবে না কিন্তু স্লোভেনিয়াতে সে রকম আইন নেই। তাই এখানে চাইলে যে কেউ যে কোনো সময় ফুলটাইম কাজও করতে পারেন।

যা আয় হবে তা থেকে অবশ্যই একটি অংশ সরকারকে দিতে হবে ট্যাক্স বাবদ। কিন্তু বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, সার্বিয়া, মেসিডোনিয়া, আলবেনিয়া এমনকি ভারত ও শ্রীলঙ্কা থেকে  কেউ যদি স্লোভেনিয়াতে উচ্চশিক্ষার জন্য আসেন তাহলে তাকে ট্যাক্স দিতে হয় না। অথবা নামমাত্র একটি অংশ প্রদান করতে হয়। এর কারণ হচ্ছে এই সব দেশের সরকারের সাথে স্লোভেনিয়ার সরকারের দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা চুক্তি রয়েছে।

বাংলাদেশ থেকে যদি কেউ স্লোভেনিয়াতে আসেন তাহলে শিক্ষার্থী হলেও তাকে ট্যাক্স দিতে হয়। ফ্ল্যাট ট্যাক্স এবং সোশাল প্রভিডেন্ট ফান্ড মিলিয়ে যার পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৪ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশ; যা একজন শিক্ষার্থীর কাছে অনেক বড় একটি বোঝা মনে হতে পারে।

আমাদের দেশ থেকে স্লোভেনিয়াতে আসা একজন স্টুডেন্ট যদি একশো ইউরো আয় করে তাহলে ৩৪ থেকে ৪০ ইউরোর মতো তার অ্যাকাউন্ট থেকে কেটে নেওয়া হবে যা তার জন্য সত্যি বলতে গেলে অনেক বড় একটি ধাক্কা।

আমি যে ইউনিভার্সিটিতে পড়ছি সেখানে ভারত, তিউনিশিয়া, মিশরসহ বাইরের বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেক শিক্ষার্থী পিএইচডি. কিংবা পোস্ট ডক্টরাল করার সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশ থেকে যদি কেউ শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে স্লোভেনিয়াতে মাস্টার্স, পিএইচডি. কিংবা পোস্ট ডক্টরাল সম্পন্ন করতে চায় সেটিও হবে তার জন্য চ্যালেঞ্জিং।  এমনকি বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, সার্বিয়া, মেসিডোনিয়াসহ বেশ কিছু দেশের শিক্ষার্থীরাও স্লোভেনিয়াতে অবৈতনিক পড়াশুনা করতে পারেন।

স্লোভেনিয়াতে বাংলাদেশের কোনো অ্যাম্বাসি না থাকায় যে কোনো রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে ভিয়েনাতে অবস্থিত বাংলাদেশ অ্যাম্বাসি আমাদের যাবতীয় কাজ করে দিয়ে থাকেন। টেম্পোরারি রেসিডেন্ট পারমিট রিনিউ কিংবা অনেক সময় ইউনিভার্সিটি অ্যাডমিশনের কাজেও ডকুমেন্ট স্লোভেনিয়ার সংশ্লিষ্ট মিনিস্ট্রি থেকে লিগালাইজেশন করতে হয়। বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য এক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে ভিয়েনাতে অবস্থিত বাংলাদেশ অ্যাম্বাসি থেকে প্রথমে ডকুমেন্ট সত্যায়ন করা। ভিয়েনার বাংলাদেশ অ্যাম্বাসি এ সকল ডকুমেন্ট সত্যায়ন করলেই স্লোভেনিয়ার মিনিস্ট্রি সে সকল ডকুমেন্ট লিগালাইজেশনের জন্য গ্রহণ করবে।

লুবলিয়ানা থেকে স্লোভেনিয়ার দূরত্ব প্রায় চারশত কিলোমিটারের ওপরে এবং বাসে লুবলিয়ানা থেকে ভিয়েনা যেতে সময় লাগে সাড়ে চার থেকে প্রায় পাঁচ ঘণ্টার মতো। অনেক সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনে একদিকে যেমন ভিয়েনাতে যাওয়া-আসা অনেক কঠিন এবং বেশ খরচের একটি বিষয় হয়ে পড়ে ঠিক তেমনি অনেক সময়ও এতে নষ্ট হয়। কাঙ্খিত সময়ে কাজ হবে কি না সেটা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়।

কারও যদি টেম্পোরারি রেসিডেন্ট পারমিট কিংবা পাসপোর্টের মেয়াদ প্রায় শেষের দিকে থাকে অথবা কোনো ডকুমেন্টে কোনও সমস্যা যদি থাকে তাহলে তার পক্ষে অস্ট্রিয়া পৌঁছানো একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এতে অনেকটা প্যারাডক্সের মতো একটি অবস্থার সৃষ্টি হয়। একদিকে তিনি ভিয়েনাতে যেতে পারছেন না, অন্যদিকে ভিয়েনাতে না গেলে তিনি তার সমস্যার সমাধানও করতে পারছেন না।

স্লোভেনিয়াতে বাংলাদেশের একটি অনারারি কনস্যুলেট থাকলেও নানা কারণে সেটি দীর্ঘদিন্ ধরে অনেকটা নিষ্ক্রিয়।

এসব সঙ্কটের সমাধানে বাংলাদেশ সরকারের সাথে স্লোভেনিয়ার সরকারের একটি চুক্তি এখন সময়ের দাবি। বাংলাদেশ সরকার স্লোভেনিয়ার সরকারের সাথে চুক্তি করলে আমাদের দেশের অনেক শিক্ষার্থীরাও ৩৪  থেকে ৪০ শতাংশ  ট্যাক্সের একটি বিশাল বোঝা থেকে অনেকটা নিষ্কৃতি পাবে। অনেক দেশের মতো আমাদের দেশের অনেক শিক্ষার্থীও শিক্ষাবৃত্তি কিংবা ফান্ডিংসহ এখানে ব্যাচেলর, মাস্টার্স, পিএইচডি করারও সুযোগ পাবে।

সেই সাথে স্লোভেনিয়াতে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি স্থায়ী এবং কার্যকরী কনস্যুলেট অফিস প্রয়োজন যাতে ডকুমেন্ট লিগালাইজেশন কিংবা অন্য কোনো প্রয়োজনে কাঙ্খিত সেবা আমরা এ কনস্যুলেট অফিস থেকে পেতে পারি।

এসব সমস্যা সমাধান করতে পারলে পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশের মতো স্লোভেনিয়াতেও আমাদের বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চশিক্ষার একটি বড় ক্ষেত্র তৈরি হবে এবং আমাদের শিক্ষার্থীরাও গবেষণা ও পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে স্লোভেনিয়ার বুকেও বাংলাদেশের বড় সুনাম প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। আশা করি আমাদের বাংলাদেশ সরকার খুব শিগগিরই এ দিকে দৃষ্টি দেবে এবং এসব সমস্যা সমাধানে একটি কার্যকরী উদ্যোগ নেওয়া হবে।